একসময় দরজা খুলে গেল। দরজার ওপাশে যূথী। সে আমাকে দেখে গায়ের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। তার ধাক্কায় আরেকটু হলে আমি পড়েই যেতাম। সে কাঁদতে কাঁদতে যা বলল, তার অর্থ হচ্ছে সকালবেলা তার মা তাকে বলেছে দুই ঘণ্টার জন্য সে বাইরে যাচ্ছে। খুবই জরুরি কাজ। তারপর সারাদিন কেটে গেছে সে আসে নি। যূথী কিছু খায় নি। তার খুব ক্ষিধা লেগেছে।
আমি বললাম, বার্গার খাবে?
যূথী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, হুঁ। আর কোক খাব।
বিশাল একটা বিফ বার্গার যূথী দুই হাতে ধরে খাচ্ছে। পরপর কয়েকটা কামড় দিয়ে সে বার্গারটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, খাও।
আমি বললাম, তুমি খাও।
না, তুমি খাও। ক্ষুধার্ত এই মেয়েটি আমার প্রতি তার মমতা দেখাতে চাচ্ছে। আহা বেচারি। আমি বার্গারে কামড় দিলাম।
সে কয়েক কামড় খায়, তারপর বার্গার আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। আমি এক কামড় খাই। সে অতি দ্রুত কয়েকটা কামড় দেয়, আবার বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে।
যূথীর মা বাসায় ফিরলেন সন্ধ্যার পর। কাঁদতে কাঁদতে ফিরলেন। তাঁর কাছে জানলাম তিনি গিয়েছিলেন বাবার সঙ্গে দেখা করতে। একজন দালাল ধরেছিলেন। দালাল পাঁচশ টাকার বিনিময়ে কাজটা করে দেবে বলেছিল। দালালের কারণে সারাদিন তিনি জেলখানার সামনে বসা। বাবার সঙ্গে তাঁর দেখা হয় নি।
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা, চা খাবে?
আমি বললাম, না।
তিনি শান্ত গলায় বললেন, বাবা, আমি কী করব বলো তো? কোথায় যাব? কার কাছে যাব? আমি কি তোমার মার কাছে যাব?
আমি বললাম, তাকে কী বলবেন?
তিনি হতাশ গলায় বললেন, তাও তো জানি না। আসলেই তো, আমি কী বলব!
এক বর্ষায় গল্প শুরু করেছিলাম
এক বর্ষায় গল্প শুরু করেছিলাম। এখন আরেক বর্ষা। সেই মেঘকালো আকাশ, সেই বৃষ্টি। ঢাকার গাছগুলিতে নতুন পাতা। টোকাই ছেলেমেয়েগুলির হাতে কদম ফুলের গুচ্ছ। ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামছে, এরা ছুটে ছুটে যাচ্ছে ফুল নিবেন? ফুল? চাইরটা এক টাকা। চাইরটা এক টাকা।
এই এক বছরে কী কী পরিবর্তন হলো বলি—— নীলা ফুপুর বিয়ে হয়ে গেল। তিনি বরের সঙ্গে দেশের বাইরে (ইটালি, মিলান শহর) চলে গেছেন। ঢাকা এয়ারপোর্টে তিনি উঁচু হিল পরে বেকায়দায় পা ফেলেছিলেন। পা মচকে ফেললেন। হিল খুলে ফেলতে হলো। তিনি এক হাতে নতুন কেনা হিল জুতাজোড়া নিয়ে খালি পায়ে প্লেনে উঠলেন।
নীলা ফুপুর বরের নাম শামস-উল আলম। তিনি মিলানে এক চকলেট কারখানায় কাজ করেন। তার চেহারা হাবভাব চালচলন সবই বান্দরের মতো। তাঁকে প্রথম দেখে আমার মনে হয়েছিল— স্যুট পরা বান্দর। সাইজে ফুপুর চেয়েও ছোট। এক জায়গায় বসে থাকতে পারেন না। একদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেন না। বেচারা বউ খুঁজতে দেশে এসেছিলেন। এক বন্ধুর সঙ্গে নাটকের শুটিং কীভাবে হয় দেখতে গেলেন। তখন ফুপুর শট হচ্ছিল। গ্রামের মেয়ে কলসি কাঁখে জল আনতে যাচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখে ভদ্রলোক প্রেমে পড়ে গেলেন। অতি দ্রুত বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল। মা শুধু একবার বলেছিলেন, ছেলে তো সুন্দর না। চেহারায় হনুমান ভাব আছে। এতেই ফুপু কেঁদেকেটে অস্থির হয়েছেন। বিয়ে হলো খুব ধুমধাম করে। বরপক্ষ নীলা ফুপুকে দুই সেট গয়না দিল। একটা হীরার আংটি দিল। ফুপু আমাকে আংটি দেখিয়ে বললেন, অরিজিন্যাল হীরা, আমেরিকান ডায়মন্ড না। দাম কত বল তো?
জানি না। অনেক দাম।
বাংলাদেশী টাকায় ছাপ্পান্ন হাজার টাকা। এত দাম দিয়ে আংটি কেনার কোনো মানে হয়! টাকা থাকলেই খরচ করতে হবে? আমি ওর সঙ্গে রাগ করেছি। দেখি আংটিটা তোর আঙুলে পর। কেমন লাগে দেখি। আহা, পর না!
আমি কড়ে আঙুলে আংটি পরে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। ইটালি রওনা হবার দিন হঠাৎ ফুপুর তার ভাইজানের কথা মনে পড়ল। তাঁর প্লেন বিকাল তিনটায়, তিনি সকাল এগারোটায় আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, ভাইজানের জন্যে মন খারাপ লাগছে। উনার সঙ্গে দেখা করব। ব্যবস্থা করতে পারবি?
না। একদিনে ব্যবস্থা করা যাবে না।
গতরাতে ভাইজানকে স্বপ্নে দেখে মন এত খারাপ হয়েছে! কী স্বপ্নে দেখি জানিস? দেখি ভাইজান সুই-সুতা দিয়ে একটা কাঁথা সেলাই করছেন। আমি তাকে বললাম, এইসব মেয়েদের কাজ, তুমি করছ কেন? আমাকে দাও। ভাইজান আমার হাতে সুই-সুতা দিতে দিতে বললেন, তুই বিয়ে করলি, আমাকে দাওয়াত দিলি না কেন? আমি বললাম, দাওয়াত দিব কীভাবে? তুমি তো জেলে। তখন ভাইজান বললেন, দাওয়াত দিলে একদিনের ছুটি নিয়ে আসতাম। আমাদের জেলখানাটা ভালো। এখানে এরকম সিস্টেম আছে।
ফুপু কাঁদতে লাগলেন। তাকে আমি নাটকের অনেক দৃশ্যে কাঁদতে দেখেছি। বাস্তবের কোনো দৃশ্যে তিনি অনেকদিন পর কাঁদলেন। দৃশ্যটা এত সুন্দরভাবে করলেন যে, আমার চোখে পানি এসে গেল। তিনি ফোপাতে ফোপাতে বললেন–বুঝলি বাবলু, অল্প বয়সে আমাদের বাবা মারা গেল। বিরাট সংসার এসে পড়ল ভাইজানের ঘাড়ে। বেচারাকে কত ধান্ধাবাজি করে সংসার টানতে হলো!
ফুপু, কান্না বন্ধ করে গোছগাছ কর। একটার সময় তোমাদের রিপোর্টিং।
ফুপু কান্না বন্ধ করতে পারলেন না।
এয়ারপোর্টে একটা মজার ঘটনার উল্লেখ করতেই হয়। নতুন ফুপা কমপ্লিট স্যুট পরে তিড়িং-বিড়িং করছেন। হাতে সময় নেই, ইমিগ্রেশনে ঢুকে যাবেন! নীলা ফুপু বললেন, ও বাবলু, তোর ফুপাকে সালাম করলি না? পা ছুঁয়ে সালাম কর। দোয়া নে। আদব-কায়দা শিখিয়ে দিতে হবে— গাধা ছেলে!