ঘড়ি লাগবে না।
অবশ্যই লাগবে। লাগবে না মানে!
দুপুর বারটায় জহির ভাই আমাকে কাকরাইলের এক অফিসে নিয়ে গেলেন। চারতলায় সুন্দর অফিস। অফিসের নাম মনিটর। ফিল্মপাড়ায় অফিস। নায়কনায়িকার ছবি দিয়ে অফিস সাজানো। লোকজন আসছে যাচ্ছে। জমজমাট ভাব। জহির ভাই দরজা ঠেলে ঢুকলেন। আমিও ঢুকলাম এবং হকচকিয়ে গেলাম। সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে মুকুল ভাই বসে আছেন। তিনি পুরোপুরি বুড়ো হয়ে গেছেন। তাঁর গলার চামড়া ঝুলে গেছে। চোখ ঝুলে গেছে। মানুষ হাঁটার সময় কুঁজো হয়ে হাঁটে, তিনি বসে আছেন কুঁজো হয়ে। জহির ভাই বললেন, ভালো আছেন?
মুকুল ভাই মাথা তুলে তাকালেন। মনে হলো তিনি আমাদের চিনতে পারছেন না।
আপনার শরীর কেমন খোঁজ নিতে এসেছি। শরীর ভালো তো?
মুকুল ভাই এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। বুড়োদের মতোই খুকখুক করে কাশতে লাগলেন।
কোনো শারীরিক সমস্যা হচ্ছে না?
মুকুল ভাই বিড়বিড় করে কী যেন বললেন কিছু বোঝা গেল না। কাচের পার্টিশান দেয়া অফিস। পার্টিশানের ওপাশে দুজন কাজ করছে। তিনি হতাশ চোখে তাদের দিকে তাকালেন। তাদের একজন এই ঘরে ঢুকল। জহির ভাই তার দিকে তাকিয়ে মধুর ভঙ্গিতে বললেন, ভাই, আমাকে একটু চা খাওয়াতে পারেন?
সেই লোক বলল, অবশ্যই চা হবে। লেবু চা চলবে?
লেবু চা খুব ভালো চলবে।
জহির ভাই আরাম করে চেয়ারে বসেছেন। আমাকে ইশারা করলেন দূরের চেয়ারটায় বসতে। আমি তাই করলাম।
মুকুল ভাই বললেন, আমার কাছে কী চান?
জহির ভাই বললেন, কিছু ক্যাশ টাকার দরকার ছিল। ব্যবস্থা করে দিন।
মুকুল ভাইয়ের মুখ ঝুলে গেল। জহির ভাই হাসিমুখে বললেন, আপনার ঐ ক্যামেরাম্যান লিয়াকত, তার খবর পত্রিকায় পড়ে মনটা খারাপ হয়েছে। সন্ত্রাসীর হাতে মৃত্যু। So sad! আপনার তো ডান হাত চলে গেলরে ভাই।
মুকুল ভাই বললেন, আপনার কত টাকা দরকার?
দুই লাখ।
অফিসে দশ হাজার টাকা আছে।
তাই তো থাকবে। অফিসে বেশি টাকা থাকা ঠিক না। আপনি চেক লিখে কাউকে ব্যাংকে পাঠিয়ে দিন। আমি অপেক্ষা করি। ভালো কথা, আপনার হাতের ঘড়িটা রোলেক্স না? যাবার সময় ঐটাও দিয়ে দিবেন। ঘড়ির অভাবে সময় বুঝতে পারি না।
আমরা লেবু-চা খাচ্ছি। মুকুল ভাই চেক লিখে কাকে যেন পাঠিয়েছেন। জহির ভাইকে খুব হাসিখুশি মনে হচ্ছে। পা দোলাচ্ছেন। দেয়ালে টাঙানো নায়ক-নায়িকার ছবি দেখছেন। যেন তিনি খুবই মজা পাচ্ছেন।
মুকুল সাহেব!
জি।
আপনি বলেছিলেন অভিনয়ের জন্যে অডিশন নেবেন। হাতে তো সময় আছে, অডিশন নিয়ে নেবেন নাকি?
মুকুল ভাই একধরনের চাপা আওয়াজ করতে লাগলেন। তাঁর চোখে ঘৃণা নেই, রাগ নেই, হতাশা নেই। তার চোখে নির্লিপ্ততা। যেন জগতের কোনো কিছুর সঙ্গেই তাঁর কোনো যোগ নেই।
দুপুর একটা পঁচিশে (রোলেক্স টাইম) জহির ভাই দুই লক্ষ টাকা এবং একটা রোলেক্স ঘড়ি নিয়ে বের হয়ে এলেন। রাস্তায় নেমে হালকা গলায় বললেন, ঘড়িটা রাখ। আর শোন, আমি কিছু দিনের জন্যে ড়ুব মারছি। দেশের বাইরে চলে যাব। তুই ভালো থাকিস।
ঘড়িটা আমি নেব না জহির ভাই।
অবশ্যই নিবি। নিবি না মানে? সাধু সাজতে চাস? দুনিয়াতে সাধু বলে কিছু নাই। দুনিয়া হলো ভণ্ডের জায়গা। কেউ বেশি ভণ্ড কেউ কম ভণ্ড। নে ঘড়ি।
না।
ঘড়িটার দাম কত জানিস? খুব কম করে ধরলেও এক লাখ। তুই নিবি না?
না।
গুড!
জহির ভাই এক লাখ টাকা দামের ঘড়ি নর্দমায় ফেলে নির্বিকার ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করেছেন। একবার শুধু পেছনে ফিরে আমাকে দেখলেন। হাসিমুখে হাত নাড়লেন। উনার সঙ্গে এটাই আমার শেষ দেখা।
বাসায় ফিরলাম সন্ধ্যা সন্ধ্যায়। সেখানে হুলুস্থুল কাণ্ড। বাসার সামনে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দি ইমেজ-এর সামনে পুলিশের গাড়ি। একটা টিভি চ্যানেলের গাড়ি। প্রচুর লোকজন।
আমাদের বসার ঘরে রমনা থানার ওসি সাহেব বসে আছেন। ভাইয়া তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন। দরজার ওপাশে মা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি মাঝে মধ্যে পর্দা ফাঁক করে দেখছেন।
জানা গেল, দি ইমেজ-এর বাথটাবে (জহির ভাইয়ের কেনা গোল বাথটাব) শিয়ালমুত্রার ডেডবডি পাওয়া গেছে। কেউ তাকে গলা টিপে মেরে বাথটাবের পানিতে ড়ুবিয়ে রেখেছে।
আমি দুপুরে জহির ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম। জহির ভাই তার ঘর থেবললেন, ভেতরে ঢুকবি না, বাইরে দাঁড়িয়ে থাক। আমি ঘরে ঢুকি নি। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন কী হচ্ছিল ভেতরে?
ওসি সাহেব আমার সঙ্গে কথা বললেন। হাসি হাসি মুখ। গলার স্বর মিষ্টি। কথা মিষ্টি।
কী নাম তোমার?
বাবলু।
নাম জিজ্ঞেস করলে ভালো নাম বলতে হয়। বাবলু তো ডাক নাম। ভালো নাম কী?
মনোয়ার হোসেন।
ভেরি গুড। কী পড়?
এইবার এসএসসি দিয়েছি।
কিছুদিনের মধ্যেই তো রেজাল্ট হবে, তাই না?
জি।
রেজাল্ট কেমন হবে?
এই প্রশ্নের জবাব আমাকে দিতে হলো না। ভাইয়া দিল। আগ্রহের সঙ্গে বলল, ওর রেজাল্ট খুব ভালো হবে। সে অসম্ভব ভালো ছাত্র।
ওসি সাহেব বললেন, আমার বড় ছেলেটাও এসএসসি দিয়েছে। পড়াশোনায় কোনো মন নাই। দিনরাত ক্রিকেট নিয়ে আছে। ফেল করবে জানা কথা। যাই হোক, বাবলু তুমি কোন স্কুলে পড়?
আমি স্কুলের নাম বলতেই ওসি সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আমার গাধাটা তো ঐ স্কুল থেকেই এসএসসি দিয়েছে। শামসুলকে চিন?
জি চিনি। সে খুব হাসাতে পারে। সবাইকে হাসায়।
ওসি সাহেবের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে গেল। তিনি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, জোকার ছেলে পয়দা করেছি। সারাক্ষণ আছে জোকারির মধ্যে। একদিনের ঘটনা শোনেন, সে তার মার সঙ্গে ইশারায় কথা বলা শুরু করেছে। তার নাকি জবান বন্ধ, কথা বলতে পারছে না। তার মা অস্থির হয়ে আমাকে টেলিফোন করেছে। আমি ছিলাম একটা মামলার তদন্তে। সব ফেলে ছুটে এসে বললাম, শামসুল, কী হয়েছে রে ব্যাটা? সে মাথা নিচু করে বলল, মার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম বাবা। এখন বলেন, এই ছেলেকে নিয়ে কী করি?