যূথীর মা প্রায় আধঘণ্টা পরে দরজা খুললেন। তাঁর চোখ-মুখ ফোলা। নাক দিয়ে পানি ঝরছে। তিনি সহজ গলায় বললেন, বাবা, চা খাবে? চা করি?
না।
যূথীর বাবাকে যখন জেলে নিয়ে যাচ্ছিল তখন কি সে কিছু বলেছে?
না। আপনার কাছে কি টাকা আছে?
সতেরশ টাকা আছে।… ঠিক আছে বাবা, তুমি যাও। তুমি বসে থেকে কী করবে?
সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলাম। বাড়িতে হালকা উৎসবের আমেজ। মা মিলাদের ব্যবস্থা করেছেন। বাদ মাগরেব মিলাদ হবে। মিলাদের শেষে হাজির তেহারি। মা নিজে নতুন (কিংবা ইস্ত্রি করা) শাড়ি পরেছেন। সাজগোজও মনে হয় করেছেন। তাকে সুন্দর লাগছে।
নীলা ফুপুকেও সুন্দর লাগছে। তার কারণ অবশ্যি ভিন্ন। তিনি হেভি সাজ দিয়েছেন। নতুন এক অল্পবয়েসী পরিচালক মিউজিক ভিডিও করছে। তিনিও একজন মডেল। আমাকে দেখে নীলা ফুপু বললেন, ভাইজানকে নাকি জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে?
আমি বললাম, হুঁ।
নীলা ফুপু বললেন, ভাইজানের একটা শিক্ষা হওয়া দরকার ছিল। তবে এতদিনের জেল না হয়ে তিন-চার বছরের হলে ঠিক হতো।
আমি বললাম, তোমাকে সুন্দর লাগছে ফুপু।
ফুপু আনন্দিত গলায় বললেন, ফুল মেকাপ এখনো নেওয়া হয় নি। চোখ আঁকা বাকি। কপালের টিপ মাঝখানে হয়েছে নাকি দেখ তো।
হয়েছে।
আমার সমস্ত টেনশন টিপ নিয়ে। তাড়াহুড়া করে যখন টিপ দেই তখন মাঝখানে পড়ে। সময় নিয়ে যখন দেই তখন হয় ডানে বেশি যাবে কিংবা বামে বেশি যাবে।
আনন্দিত মানুষজন দেখতে ভালো লাগে। ফুপুকে দেখতে ভালো লাগছে। তাঁর ভাইজানের দুঃখও তাকে স্পর্শ করছে না। তিনি এখন মিউজিক ভিডিওর জন্য তৈরি।
আমি বললাম, গান কোনটা হবে ফুপু?
ফুপু বললেন, কূলহারা কলংকিনীটা হবে। ফোক গান, কিন্তু করা হবে মডার্ন ফরম্যাটে। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, তুই আমাকে একটা ক্যাব ডেকে দে। বলবি উত্তরা যাব।
ফুপুর জন্যে ক্যাব ডাকতে হলো না। মিউজিক ভিডিওওয়ালারা একটা মাইক্রোবাস পাঠিয়েছে। ফুপুর আনন্দের সীমা রইল না। যেন তিনি তাঁর নিজের কেনা গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন এমন অবস্থা।
মাগরেবের নামাজের পর মিলাদ হলো। যে মাওলানা মিলাদ পড়াতে এসেছেন তিনি খুবই হতাশ। কারণ মিলাদে আর কেউ আসে নি। আমি একা। মাওলানা সাহেব বললেন, লোকজন কই?
আমি বললাম, লোকজন নেই, আমি একা। আমার বড়ভাই থাকতেন কিন্তু উনার মাথা ধরেছে, উনি দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছেন। আপনি শুরু করে দিন।
তুমি আর আমি? আর কেউ আসবে না?
না।
এমন মিলাদ আমি আগে পড়াই নাই। কি বললা শুরু করব?
জি, শুরু করে দিন।
কিসের উদ্দেশ্যে মিলাদ এটা বলো। সেইভাবে দোয়া করতে হবে।
একজনকে জেলে ঢুকানো গেছে, সেই আনন্দে মিলাদ।
কাকে জেলে ঢুকানো হয়েছে?
আমার বাবাকে।
মাওলানা সাহেব কথা বাড়ালেন না। মিলাদ শুরু করে দিলেন।
ইয়া নবী সালাম আলাইকা।
ইয়া রসুল সালাম আলাইকা।
হে নবী, আপনার প্রতি সালাম।
হে রসুল, আপনার প্রতি সালাম।
কয়েক দিন ধরে দি ইমেজ তালাবন্ধ
কয়েক দিন ধরে দি ইমেজ তালাবন্ধ। কলাপসেবল গেটে বিরাট তালা ঝুলছে। তালার সঙ্গে নোটিশ
অনিবার্য কারণে দোকান বন্ধ।
সম্মানিত গ্রাহকদের অসুবিধার জন্য দুঃখিত।
দি ইমেজ-এর সম্মানিত গ্রাহকদের একজন আমার বড়খালা। তার চূড়ান্ত রকমের অসুবিধা হচ্ছে। নতুন ছবি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। অন্য ভিডিওর দোকান থেকে আনা যায়। তার জন্যে মেম্বার হতে হবে। মেম্বারশিপ ফি পাঁচশ টাকা। বড়খালা এই টাকা খরচ করবেন না।
আমি বললাম, বড়খালা, পাঁচশ টাকা কি তোমার কাছে কোনো টাকা?
বড়খালা বললেন, অবশ্যই টাকা। পাঁচশ টাকা তো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আমার কোলে পড়ে না। যে মাটি কাটে তাকে পাঁচশ টাকার জন্য পুরো এক সপ্তাহ মাটি কাটতে হয়।
যতই দিন যাচ্ছে তুমি ততই কৃপণ হয়ে যাচ্ছ। এত টাকা তুমি করবে কী?
গাধা! এটা কি আমার টাকা? তোর খালুর টাকা। অন্যের টাকা খরচ করা যায় না। গায়ে লাগে।
অন্যের টাকা বড়খালা যে একেবারেই খরচ করেন না, তা-না। তিনি পুরনো এসি বিক্রি করে প্লিট এসি লাগিয়েছেন। শব্দহীন এসি। ঠাণ্ডাও হয় অতি দ্রুত। বড়খালার গরম তাতেও কমে না। তিনি গায়ে শাড়ি রাখতে পারেন না। গরমে হাঁসফাস করেন।
বাবলু! দেখ না বাপধন, একটা ছবি এনে দিতে পারিস কি-না। জহিরকে বললেই ব্যবস্থা করবে। সেই না-কি দি ইমেজ-এর মালিক।
কে বলল তোমাকে?
খবর পাই।
খবর কীভাবে পাবে, তুমি তো সারাদিন ঘরেই থাক। কেউ তোমার ঠাণ্ডাঘরে আসেও না।
তারপরেও খবর পাই। তোর বাপকে যে জেলে, ঢুকিয়ে দিয়েছে সেই খবরও পেয়েছি। কত দিনের কয়েদ হয়েছে?
ছয় বছর।
জেলে নয় মাসে বছর হয়। ছয় বছর কোনো ব্যাপারই না। একটাই সমস্যা, গরমে কষ্ট পাবে। জেলে ফ্যানের কারবার নেই। ধুন্ধুমার গরম।
জহির ভাই তালাবন্ধ দি ইমেজ-এর ভেতরেই আছেন। সুখেই আছেন। সারাদিন না-কি বাথটাবে শুয়ে থাকেন। সন্ধ্যার পর বিছানায় শুয়ে পুরনো ম্যাগাজিন ঘাঁটেন। আমাকে দেখে প্রথমেই বললেন, কয়টা বাজে?
আমি বললাম, ঘড়ি নাই। বলতে পারব না কয়টা বাজে।
তোকে ঘড়ি দেয়ার কথা ছিল, দেয়া হয় নি। কাল দুপুর বারোটার দিকে আসিস, ঘড়ির ব্যবস্থা হবে।
ঘড়ি লাগবে না। বড়খালার জন্যে কয়েকটা ছবির ব্যবস্থা কর।
দোকানে যা আছে নিয়ে যা। ভিডিওর দোকান উঠিয়ে দিয়েছি।
উঠিয়ে দিয়েছ কেন?
ভালো লাগে না। তোর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না। তুই বিদেয় হ! কাল দুপুর বারটায় চলে আসবি। ঘড়ি পাবি।