অবশ্যই উচিত।
একটা জায়গায় শুধু আটকা পড়েছি। ক্যাপিটেলের সমস্যা। পাঁচ লাখ টাকা ক্যাপিটেল লাগে। তিনমাসের মধ্যে অবশ্য ক্যাপিটেল উঠে আসবে। ক্যাপিটেলের বিষয়ে আপনি কি আমাকে কোনো বুদ্ধি দিতে পারেন?
আমি তোমাকে কী বুদ্ধি দিব? আমি মেয়েমানুষ, ব্যবসার আমি বুঝি কী?
একটা বুদ্ধি অবশ্যি আমার মাথায় এসেছে। ক্যাপিটেলটা আমি আপনার কাছ থেকে ধার নিলাম। তিনমাস পর আপনার টাকা আপনাকে ফেরত দিলাম, প্লস লাভের একটা পারসেনটেজ। আপা, আপনি কী বলেন? আপনি হলেন ব্যবসার স্লিপিং পার্টনার! কিছুই করতে হচ্ছে না, ঘরে বসে টাকা।
আমি টাকা পাব কই? কেন, আপনার টাকা তো আছে!
আমার টাকা কোথায়? তোমার দুলাভাইয়ের টাকা। উনি কঠিন হুকুম দিয়ে গেছেন, আমি যেন টাকায় হাত না দেই। তার হুকুমের বাইরে যাব কীভাবে?
মাত্র তিন মাসের ব্যাপার।
তিনদিনের ব্যাপার হলেও তো পারব না। উনার হুকুম।
বাবা রবার্ট ব্রুসের মতো। মচকাবার লোক না। তিনি পেছনে লেগেই থাকেন। নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে বড়খালার কাছে যান। একবার গেলেন বড়খালার মগবাজারের বাড়ির বিষয়ে কথা বলতে। নানান ভণিতার পর বললেন, আপা, আপনার মগবাজারের বাড়িটা এমন এক সুবিধাজনক অবস্থায় আছে যে এটাকে বাড়ি বলা ঠিক না।
বাড়ি না বলে কী বলবে?
গোল্ড মাইন। সোনার খনি। এখানে একটা রেস্টুরেন্ট দিলে ছয় মাসের মধ্যে …
ছয় মাসের মধ্যে কী?
ছয় মাসের মধ্যে আপনি কোটিপতি। টাকা গুনতে গুনতে আপনার হাতে ঘা হয়ে যাবে।
হোটেল চালাবে কে?
আমি চালাব। শেফ আসবে ইন্ডিয়া থেকে। দেখেন না কী করি। রেস্টুরেন্টের একটা নামও ঠিক করেছি। আপনার পছন্দ হয় কি-না দেখেন— রসনা বিলাস।
নাম তো সুন্দর।
তিন ধরনের রান্না হবে, দেশী, মোঘলাই, চাইনিজ। অনেকটা ফুড কোর্টের মতো। আপনি অনুমতি দিলে কাজ শুরু করে দেই। অনেক পেপার ওয়ার্ক আছে।
তোমার দুলাইকে জিজ্ঞেস না করে অনুমতি দেই কীভাবে?
উনি মৃত মানুষ! উনাকে কীভাবে জিজ্ঞেস করবেন?
মৃত মানুষকে জিজ্ঞেস করার উপায় আছে। একে বলে ইস্তেখারা। দোয়া দরুদ পড়ে ঘুমাতে হয়। উত্তর-দক্ষিণে পাক পবিত্র হয়ে শুতে হয়। মুখ থাকে কাবার দিকে ফিরানো। দেখি আগামী বৃহস্পতিবার ইস্তেখারা করে দেখি…
বাবা বললেন, উনাকে এইসব জাগতিক বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করা ঠিক না। মগবাজারের বাড়িটাকে রেস্টুরেন্ট বানালে উনি খুশিই হবেন। ভাড়াটের কাছ থেকে আর কয় পয়সা আদায় হয় বলেন? আপনি অনুমতি দেন, ভাড়াটেদের উৎখাত নোটিশ দিয়ে দেই।
তোফাজ্জল শোন, তোমার দুলাভাইয়ের অনুমতি ছাড়া আমি কিছুই করব। কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর, আমি উনার কাছ থেকে জেনে নেই।
বড়খালার কাছ থেকে ধাক্কা খেয়ে বাবা আমার ঘরে এসে বসেন। তিনি ছোটখাটো মানুষ, ঐ ঘর থেকে বের হবার পর তাকে আরো ছোটখাটো দেখায়। ঠাণ্ডা ঘর থেকে হঠাৎ গরম ঘরে ঢোকার কারণে তিনি খুব ঘামতে থাকেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, পানি খাওয়া তো বাবা।
তিনি পানি শেষ করেন এক চুমুকে, তারপর বিড়বিড় করে বলেন, কঠিন মহিলা। অতি কঠিন। মচকাবার জিনিস না।
বড়খালার কথা বলছ?
হুঁ। তাকে এই বাড়িতে এনে বিরাট ভুল করেছি। সিন্দাবাদ যে ভুল করেছিল সেই ভুল। সিন্দাবাদ কী করেছিল জানিস তো? এক ভূত ঘাড়ে নিয়েছিল, আর নামাতে পারে না।
বাবা পানি শেষ করে সিগারেট ধরান। সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে উদাস হয়ে যান। তার জন্যে তখন আমার বেশ মায়া লাগে।
আমি ছাড়া বাবার প্রতি আর কেউ মায়া বোধ করে বলে আমি মনে করি। মায়া বোধ করার কোনো কারণও নেই। বাবা কারো কাছ থেকে তার টাউট প্রকৃতি লুকাতে পারেন না। নিজের ছেলেমেয়ে স্ত্রীর কাছেও না। টাউটদের কেউ পছন্দ করে না।
আজ বৃহস্পতিবার। সকাল নয়টা মাত্র। আমার হাতে বাবার কালো চামড়ার জুতা। পালিশ প্রায় শেষ পর্যায়ে। একটু আগে আমি বড়খালার ঘর থেকে এসেছি। ভূতের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তিনি আবার টিভি দেখা শুরু করেছেন। তার চায়ের ফরমাস এখনো পালন করা হয় নি। তাতে কোনো সমস্যাও নেই। বড়খালার মধ্যে কোনো তাড়াহুড়া নেই। চা যদি তাঁর কাছে দুঘণ্টা পরেও যায় তিনি অভিযোগ করবেন না।
দরজা ঠেলে বাবা ঢুকলেন। গরমের মধ্যেও তার পরনে স্যুট। গলায় টাই। কিছুক্ষণ আগে শেভ করেছেন। গাল চকচক করছে।
বাবলু, জুতার খবর কী রে? দেখি। তিনি সময় নিয়ে জুতা দেখলেন। জুতায় মুখ দেখা যায় কি-না সেই চেষ্টা। ভালো হয়েছে। ভদ্রলোক চেনা যায় জুতা দিয়ে, এটা জানিস?
না।
মানুষের জুতা দেখে তার স্বভাব, চরিত্র, হাবভাব সব বলে দেয়া যায়। নে এই পাঁচটা টাকা রাখ। দে জুতা পরায়ে দে। অন্যকে জুতা পরায়ে দেয়া খুবই অসম্মানের কাজ। শুধু বাবার পায়ে জুতা পরানো সম্মানের কাজ।
আমি জুতা পরালাম। জুতার ফিতা লাগালাম। বাবা সিগারেট ধরালেন। সিগারেট শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমার সঙ্গে গল্প করবেন। এটা তাঁর নিত্য দিনের রুটিন।
তোর বড়খালা নাকি ভূত দেখা শুরু করেছে?
হুঁ।
দিনেদুপুরেও নাকি দেখে?
হুঁ।
মাথা তো মনে হয় পুরাপুরিই গেছে। তোর কী ধারণা?
কথাবার্তা শুনে সে-রকম মনে হয় না।
কথাবার্তায় কিছুই বোঝা যায় না। বোঝা যায় কর্মে। দিনেদুপুরে যে তৃ৩ দেখে, ভূতের সঙ্গে গল্প করে, সে মানসিকভাবে সুস্থ হয় কীভাবে?
তিনি হয়তো সত্যিই ভূত দেখেন।