একটা বাকি।
যে নামটা বাকি সেটা ইসমে আজম। এই পাক নাম আল্লাহ গোপন রেখেছেন। কেউ কেউ সেই নামের সন্ধান পায়। যারা পায় তারা…
পীর সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ইসমে আযমের সন্ধান তিনি পেয়েছেন এরকম মনে হলো।
পীর সাহেব একসময় চোখ মেলে ইশারায় বাবাকে কাছে আসতে বললেন। বাবা তার কাছে গেলেন। পীর সাহেব তার পাখির ঠোঁটের মতো নখ দিয়ে বা হাতে বাবার কপালে কী যেন কাটাকাটি করে হৃষ্ট গলায় বললেন, যা তোর কপালে আসল জিনিস লিখে দিয়েছি। এর নাম ইসমে আযম। হাকিম একবার যদি তোর দিকে তাকায়, তোর কপালের দিকে তাকায়, তাহলে ইসমে আযম তার দিলে ধাক্কা দিবে। তোরে খালাস করা ছাড়া তার কোনো পথ নাই।
ভুড়িওয়ালা বেঁটে এক লোক বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, হুজুরের আজকে দিলখোশ বলে এত বড় জিনিস পেয়ে গেলেন। আপনি বিরাট ভাগ্যবান। বসে আছেন কেন? হুজুরকে কদমবুসি করেন।
বাবা কদমবুসি করলেন। আমিও করলাম। ইসমে আযম যিনি জানেন তাঁকে কদমবুসি না করে উপায় আছে?
আজ সতেরো তারিখ
আজ সতেরো তারিখ।
বাবা কপালে অদৃশ্য ইসমে আযম নিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। বারবার কারণে অকারণে জাজ সাহেবের দিকে হাসিমুখে তাকাচ্ছেন। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটায় তিনি বেশ মজা পাচ্ছেন। একবার আমাদের দিকেও তাকালেন।
আমরা তিনজন এসেছি। মা, ভাইয়া এবং আমি। মা বসেছেন মাঝখানে, আমরা দুই ভাই মায়ের দুই দিকে।
ভাইয়ার চোখ-মুখ শক্ত। তার দুটা হাতই কাঁপছে। এই তুলনায় মা স্বাভাবিক। তিনি ভাইয়াকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে বললেন, মাগিটা তার মেয়ে নিয়ে আসে নাই? মাগিটা কই?
ভাইয়া কঠিন গলায় বললেন, মা, চুপ করে থাকতো।
আমাদের পক্ষের উকিল তার মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করার মতো ডানহাত মাথার ওপর দিয়ে বুলাচ্ছেন। তার মুখ এবং চোখ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি আজ একটা ম্যাজিক দেখাবেন। আদালতে বেশ হৈচৈ হচ্ছে। জাজ সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, অর্ডার! অর্ডার! এতে আদালতের হৈচৈ কমল না। হৈচৈ হতেই থাকল। আমাদের উকিল বললেন, ইয়োর অনার, আপনার অনুমতি সাপেক্ষে আমি একটা ক্যাসেট আপনাকে শোনাতে চাই।
জাজ সাহেব অনুমতি দিলেন কি দিলেন না তা বোঝা গেল না। তবে আমাদের উকিল ক্যাসেট চালু করলেন। চাইনিজ রেস্টুরেন্টে রেকর্ড করা বাবামায়ের কথাবার্তার ক্যাসেট। বাবার হাসি হাসি মুখ হঠাৎ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। তিনি এদিক-ওদিক তাকালেন। চোখ থেকে চশমা খুলে পাঞ্জাবির খুঁটে কাচ পরিষ্কার করতে লাগলেন।
আমাদের উকিল ক্যাসেট বন্ধ করে বাবার কাছে এগিয়ে গেলেন। ধমকের গলায় বললেন, ক্যাসেটে এতক্ষণ যে পুরুষকণ্ঠ শুনলাম সেটা কি আপনার?
বাবা জবাব দিলেন না। চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকালেন। এক পলক তাকালেন মার দিকে। তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন।
উকিল সাহেব আবারো বললেন, কথার জবাব দিন। পুরুষকণ্ঠটি কি আপনার?
দ্রুত বিচার আইনের মামলা। একদিনেই রায় হয়ে গেল। ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। আমাদের উকিল কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মার কাছে এসে বললেন, বুবু, আপনাকে কথা দিয়েছিলাম সাত বছর। সাত বছর পারলাম না। সরি। এবারের জন্যে ক্ষমা করে দিন।
মা বললেন, মাগিটা আসে নাই? মাগিটার মুখের ভাব দেখার ইচ্ছা ছিল।
উকিল সাহেব বললেন, উনি আসেন নাই।
মাগিটার নাম যেন কী?
মালতী।
হিন্দু না-কি?
জি হিন্দু।
মা এমনভাবে চমকে উঠলেন যেন তাকে সাপে কামড়েছে। এতটা চমকানোর কারণ ছিল না। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী হিন্দু এবং তার নাম মালতী— এই তথ্য মা জানেন। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে আলাপ হয়েছে।
মালতী যদি মুকুল ভাইয়ের কোনো নাটকে অভিনয় করতেন তাহলে খুব বকা খেতেন। বিস্মিত হবার অভিব্যক্তি তার আসছে না। তিনি বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
মুকুল ভাই ডিরেক্টর থাকলে চিৎকার করে বলতেন, অ্যাক্সপ্রেশন দাও। অ্যাক্সপ্রেশন। এত বড় খবর প্রথম শুনলে! তোমার স্বামীর ছয় বছরের জেল। অ্যাক্সপ্রেশন কোথায়? চোখ বড় বড় করে তাকাও। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেল।
মালতী (বাবা যাকে বিয়ে করেছেন তাঁকে নাম ধরে ডাকতে খারাপ লাগছে, কিন্তু কী করব, আর কিছু মুখে আসছে না) প্রায় ফিসফিস করে বললেন, উনার
ছয় বছরের সাজা হয়েছে?
আমি বললাম, জি।
জেলখানায় নিয়ে গেছে?
জি।
আপিল হবে না? আপিল?
আমি তো জানি না।
আজ যে তার মামলা এটাও আমাকে বলে নাই। ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ল। কোনোদিন নামাজ পড়ে না, আজ পড়েছে। তারপর বলল, জরুরি কাজ আছে। ফিরতে দেরি হবে। তুমি যদি এসে আমাকে না বলতে তাহলে তো আমি জানতামই না যে, তাকে জেলখানায় নিয়ে গেছে।
আমি চুপ করে আছি। বলার তো নেইও কিছু।
বাবলু, এখন আমি কী করব বলো? কার কাছে যাব?
ঢাকায় আপনার কোনো আত্মীয় নেই?
না। খুলনায় আমার বড়বোন থাকেন। তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। বাবা, তুমি একটু বসো।
উনি হঠাৎ করেই ছুটে শোবার ঘরে ঢুকে গেলেন। আমি চাপা গলার কান্না শুনতে পাচ্ছি। যূথী আগের মতোই খেলনা নিয়ে খেলছে। আমি তার সামনে বসলাম।
যূথী কী করো?
খেলছি।
আজ কি তোমার জ্বর আছে?
না।
তুমি কি ছবি আঁকতে পার?
পারি।
আমাকে একটা ছবি এঁকে দাও।
রঙপেন্সিল নাই তো। বাবাকে বলেছি। বাবা কিনে দেবে, তখন আঁকব।
আমার নাম কি তোমার মনে আছে?
আছে। বাবলু ভাইয়া।