না।
তোদের মধ্যে মিটিং-টিটিং হয় না?
আমার সঙ্গে হয় না। ভাইয়ার সঙ্গে হয়তো হয়। আমি জানি না।
কোনো আলাপই না?
না।
মনে হয় শেষ মুহূর্তে তোর মা মামলা তুলে নেবে। পৃথিবীর কোনো মা তার সন্তানদের বাবাকে জেলে পাঠায় না। মার কাছে সন্তানের চেয়ে বড় কিছু নাই। সন্তানের বাবাও এই কারণে তুচ্ছ না। বুঝলি?
হুঁ।
মামলা তোর মা শেষ মুহূর্তে উঠিয়ে নেবে, এই বিষয়ে আমি একশ পারসেন্ট নিশ্চিত। স্বপ্নে পেয়েছি।
স্বপ্নে কী পেয়েছ?
স্বপ্নে তোর মাকে দেখলাম। সে ছড়তা দিয়ে সুপারি কাটছে। মুখের দৃষ্টি কঠিন। আমি বললাম, তুমি তো পান খাও না। সুপারি কাটছ কী জন্যে?
সে কিছুই বলল না। তারপর দেখি পান বানাচ্ছে। আমি আশ্চর্য হলাম, কার জন্যে পান বানাচ্ছে? তারপর সে পানটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।
আমি বললাম, এর থেকে তোমার ধারণা হলো যে মা মামলা তুলে নেবে?
অবশ্যই।
বাবা কিছুক্ষণের জন্যে চুপ করলেন। অনেকখানি হাঁটা হয়েছে। পীর সাহেবকে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবাকে খুবই ক্লান্ত লাগছে। যখনই কোনো খালি রিকশা দেখছেন আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছেন। উনার কাছে টাকা থাকলে রিকশায় উঠে পড়তেন। বুঝতে পারছি, টাকা নেই। আমার কাছে আছে। আমি রিকশা ভাড়া করলে বাবা লজ্জা পাবেন। এই লজ্জাটা তাকে দেবার প্রয়োজন নেই।
বাবলু!
জি।
হাঁটার বিরাট উপকারিতা আছে, এটা মাথায় রাখবি।
জি আচ্ছা।
অতিরিক্ত হাঁটাও আবার ঠিক না। কোনো জিনিসই অতিরিক্ত ভালো না। ইংরেজিতে বলে— Too much of everything is bad. বাগধারা। ইংরেজি বাগধারা।
বাবা, তুমি মনে হয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। চল কোথাও বসি, বিশ্রাম করি।
আইডিয়া খারাপ না। পাঁচ-দশ মিনিট বসে এক কাপ চা আর একটা সিগারেট খেয়ে রওনা দিতে পারলে ভালো হতো। নবউদ্যমে যাত্রা। নজরুলের গানের মতো। গান আছে না–চল চল চল… ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল…। গানটার মধ্যে যে ভুল আছে, খেয়াল করেছিস?
কী ভুল?
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল– এই কথাটাই তো ভুল। গগন হলো আকাশ। আকাশে মাদল বাজবে কীভাবে? ভুল বলেছি?
রাস্তার মোড়ে ফ্লাক্সে করে চা-কফি দুটাই বিক্রি হচ্ছে। বাবা মা lে ভালো মতো দেখলেন। আমিও আড়চোখে দেখলাম। মানিব্যাগে দশ।
একটা নোট। এই তাঁর সম্বল।
দুটাকা করে কাপ। দুকাপ চা এবং বাবার একটা সিগারেটে চলে গেল। ছয় টাকা। বাবার তৃষ্ণা মিটে নি। তিনি উসখুস করছেন। আমি বললাম, চা অরে কাপ খাও।
বাবা বললেন, খাওয়া যেতে পারে। এরা চা-টা ভালো বানিয়েছে। তুই খাবি? আমার কাছে চার টাকা আছে। দুই কাপ চা হবে।
আমি বললাম, তুমি এক কাপ চা এবং একটা সিগারেট খাও। আমি খাব না।
বাবা বললেন, ঠিক আছে খাই। খেয়ে পুরোপুরি নিঃস্ব। তবে নিঃস্ব হবার মধ্যেও আনন্দ আছে। পৃথিবীর সমস্ত সাধু-সন্ন্যাসীও নিঃস্ব। নিঃস্ব অবস্থায় পথ চলা আনন্দের, আবার মানিব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে পথ চলাও আনন্দের।
বাবা, তোমার টাকা-পয়সার অবস্থা কি খারাপ?
একটু ইয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবনে উন্থানপতন আছে না? এই বিষয়েও একটা ইংরেজি বাগধারা আছে। এখন ভুলে গেছি।
এখন কি তোমার পতন?
হুঁ। ভাটা চলছে। সমুদ্রের জীবনে যেমন জোয়ার-ভাটা আছে, মানুষের জীবনেও আছে। মানুষের সঙ্গে এই জায়গাতেই সমুদ্রের মিল।
পীর সাহেবকে শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল। উনি আজ বের হন নি। আস্তানায় ছিলেন। আমরা শুধু শুধুই উনার খোজে পথে পথে ঘুরেছি।
পীর সাহেবের চেহারায় বালক-ভাব আছে। ফর্সা মুখ, বড় বড় চোখ। চোখ জ্বলজ্বল করছে। মুখভর্তি দাড়ি থাকবে ভেবেছিলাম, দাড়ি নেই। তার পরনে অতি নোংরা এক কথা। কাধের ওপর আরেক কথা। সেটাও নোংরা। হাতপায়ের নখ মনে হয় তিনি কাটেন না। নখ বড় হয়ে পাখির ঠোঁটের মতো বেঁকে গেছে। পায়ের তলার চামড়া ফেটে ফেটে গেছে। ভেতরের লাল মাংস দেখা যাচ্ছে। পীর সাহেবের কোলে অ্যালুমিনিয়ামের লোটা। মাঝে মাঝে লোটা মুখে নিয়ে চুমুক দিচ্ছেন। লোটায় কী আছে কে জানে। ভালো কিছু নিশ্চয়ই না। লোটার জিনিস মুখে দেয়ার পর পর তার চোখ-মুখ কিছুক্ষণের জন্যে কুঁচকে যাচ্ছে। তাঁর বাঁ হাতে সিগারেট। হঠাৎ হঠাৎ তিনি সিগারেটে টান দিচ্ছেন। মনে হয় সিগারেটের প্রতি তার তেমন আগ্রহ নেই। পীর সাহেবকে ঘিরে চৌদ্দপনেরোজন মানুষের একটা জটলা। এর মধ্যে বোরকা পরা দুজন মহিলাও আছেন।
বাবা পীর সাহেবকে কদমবুসি করলেন। আমাকেও ইশারা করলেন কদমবুসি করতে। আমি তাঁর নির্দেশ পালন করলাম। বাবা হাত জোড় করে বললেন, আমার ছেলে, নাম বাবলু, আপনি একটু দোয়া করে দেন।
পীর সাহেব কিছুক্ষণ মাথা নাড়লেন। এটাই মনে হয় তাঁর দোয়া।
বাবা বললেন, আমার জন্যেও হুজুর একটু দোয়া করতে হবে। মামলা মোকদ্দমায় পড়ে গেছি।
পীর সাহেব আগ্রহী গলায় বললেন, কী মামলা? ফৌজদারি না দেওয়ানি?
ফৌজদারি। জেল হয়ে যেতে পারে। জেলে যাওয়াটা আটকান।
পীর সাহেব বললেন, দুনিয়াটাই তো জেল। এক জেল থেকে আরেক জেলে যাবি, অসুবিধা কী?
পীর সাহেবের অতি জ্ঞানগর্ভ কথায় অনেকেই অভিভূত হলো। বুঝদারের মতো মাথা নাড়তে লাগল। বাবা করুণ গলায় বললেন, আপনার দরবারে এসেছি, আমার জেলে যাওয়াটা আটকান।
পীর সাহেব বললেন, আল্লাহপাকের নাম কয়টা জানিস?
নিরানব্বইটা।
কোরআন শরীফে নাম আছে নিরানব্বইটা। কিন্তু উনার নাম সর্বমোট তিন হাজার। এক হাজার নাম জানে ফেরিশতারা। এক হাজার জানেন পয়গম্বররা। নয়শ নিরানব্বইটা আছে চাইর কিতাবে। বাকি থাকল কত?