আমার ক্ষীণ সন্দেহ হলো এরকম একটা সিডি ফুপুকে নিয়েও বের হয়েছে। তাঁর নিঘুম রাত কাটানো, ঘুমের ওষুধ কিনতে চাওয়ার পেছনে আর কোনো কারণ থাকার কথা না। আমি সাহস করে বলে ফেললাম, ফুপু, তোমারও কি সিডি বের হয়েছে?
ফুপু কঠিন চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাঙা গলায় বললেন, তোকে কে বলেছে? জহির?
আমি বললাম, আমাকে কেউ বলে নি। আমি অনুমান করেছি। লিলুয়া বাতাস-৬
থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব, আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা? অবশ্যই তোকে জহির বলেছে। সে না বললে তুই জানবি কীভাবে? জহির ভিডিওর দোকানের মালিক হয়ে বসেছে। আজেবাজে ভিডিও বিক্রি করে পয়সা কামাচ্ছে। ছোটলোক কোথাকার!
ফুপু হাউমাউ কান্না শুরু করলেন। তার কান্নাও হাসির মতো বিখ্যাত। একবার শুরু হলে থামে না। চলতেই থাকে। তাকে এই অবস্থায় রেখে ঘর থেকে বের হলাম। কিছুক্ষণ ছাদে হাঁটলাম। এই বাড়ির ছাদ বিপজ্জনক ছাদ। রেলিং দেয়া হয় নি। বর্ষায় শ্যাওলা পড়ে ছাদ পিচ্ছিল হয়ে থাকে। এমন একটা পিচ্ছিল ছাদের ধার ঘেঁসে একজনই হাঁটতে পারে, তার নাম জহির। জহির ভাই প্রতি বর্ষায় দুতিনবার এই কাজটা করেন। তাঁর নাকি মজা লাগে।
ছাদের ঠিক মাঝখানে এগারোটা ফুলের টব আছে। টবগুলির মালিক ফুপু। তার জন্ম এগারো অক্টোবর বলে এগারো তার লাকি সংখ্যা। এইজন্যে ফুলের। টবের সংখ্যা এগারো। ফুপু তাঁর টবগুলির কোনো যত্ন নেন না। সব গাছই কিছুদিনের মধ্যে মরে যায়। তখন আবার কেনা হয়। ফুপু ঠিক করে রেখেছেন তার গায়েহলুদ হবে ছাদে। তাঁর চারদিকে তখন থাকবে এগারোটা ফুলের টব। এগারো সংখ্যাও নাকি অতি রহস্যময়। নিউমারোলজি মতে এগারো হচ্ছে দুই। এক এবং এক যোগ করে দুই। নিউমারোলজি মতে ফুপুর জুডায়িক সাইন লিব্রা। এদিকে জন্মতারিখ হিসেবেও তাঁর জুডায়িক সাইন লিব্রা। এটাও নাকি বিরাট ব্যাপার। ব্রিার পাওয়ার বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেল। এইসব হিসাব নিকাশ মুকুল ভাই করে দিয়েছেন। তিনি শুধু যে বিখ্যাত পরিচালক তা-না, তিনি আবার পামিস্ট্রি নিউমারোজি, এসট্রলজি এইসবও জানেন।
ফুপু মুকুল ভাইয়ের আদিভৌতিক ক্ষমতায়ও মুগ্ধ। তার প্রসঙ্গ উঠলে ফুপু চোখ বড় বড় করে বলেন— টেলেন্টেড লোক, বুঝলি! হাত দেখে এমন হড়হড় করে তোর অতীত বলবে যে তুই টাসকি খেয়ে যাবি। হিপনোসিসও উনি জানেন। তবে করতে চান না। ব্রেইনে চাপ পড়ে তো এইজন্যে। হিপনোসিস করে উনি যে-কোনো মানুষকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে দেবেন। অভিনেতা মাহফুজ ভাই অনেক বড় বড় কথা বলেছিলেন, মুকুল ভাই একদিন তার সামনে বসিয়ে কয়েকটা পাস দিলেন। মাহফুজ ভাই মুখ হা করে ঘুমাতে লাগল। অন রেকর্ড আছে। স্টিল ফটোগ্রাফারকে দিয়ে ছবি তোলানো হয়েছে। যাতে মাহফুজ ভাই পরে অস্বীকার করতে না পারেন। অবশ্যি মাহফুজ ভাই ঠিকই অস্বীকার করেছেন। তিনি সবাইকে বলেছেন, আমি আসলে ঘুমাই নি, ঘুমের ভাণ করেছি।
আমি ছাদ থেকে নামলাম বৃষ্টি শুরু হবার চার-পাঁচ মিনিট পর। এই চারপাঁচ মিনিট আমি ফুপুর সাজানো এগারোটা টবের মাঝখানে বসে রইলাম। মাঝখানটা ফুপু সাদা রঙ দিয়ে বৃত্ত দিয়ে রেখেছেন। তিনি যখন এখানে বসেন তখন না-কি গাছগুলি থেকে একধরনের এনার্জি পান। আমি কোনো এনার্জি পাই নি। এগারো সংখ্যা আমার জন্যে না, হয়তো এ কারণেই। তাছাড়া এগারোটি টবের মধ্যে মাত্র চারটাতে গাছ আছে। বাকিগুলির গাছ মরে গেছে। এটাও একটা কারণ হতে পারে।
ফুপুর ঘরে আরেক দফা উঁকি দিলাম। আমার প্রধান উদ্দেশ্য ফুপুর কান্না থেমেছে কি-না দেখা, অপ্রধান উদ্দেশ্য টবের গাছগুলি মরে গেছে এই খবর জানানো। চারা কিনতে হলে এখনি কিনতে হবে। বৃক্ষমেলা চলছে। এবারের বৃক্ষমেলার স্লোগান গাছ জীবনের জন্যে।
বাবলু, দরজা ফাঁক করে উঁকি দিবি না। এইসব আমার পছন্দ না। ঘরে ঢোক।
আমি ঘরে ঢুকলাম।
তুই একজনকে একটা চিঠি দিয়ে আসতে পারবি?
মুকুল ভাইকে?
কাকে দেব সেটা পরে বলব। তুই পারবি কি-না সেটা বল। যাওয়া আসার রিকশাভাড়া ছাড়াও আলাদা দুশ টাকা পাবি।
এখন দিতে হবে?
হ্যাঁ, এখনই দিতে হবে। তুই চিঠি নিয়ে যাবি, যদি দেখিস উনি বাসায় নেই, তাহলে রাস্তায় অপেক্ষা করবি। যত রাতই হোক অপেক্ষা করবি। চিঠি উনার হাতে দিতে হবে। অন্যের হাতে দেয়া যাবে না।
চিঠি লিখে রেখেছ?
হ্যাঁ। তোর অন্যের চিঠি খুলে পড়ার অভ্যাস নেই তো?
আমি জানি নেই। তারপরেও জিজ্ঞেস করলাম। এই চিঠি তুই যদি পড়িস তাহলে রোজ হাশরের দিনে দায়ী থাকবি।
ফুপু আমার হাতে চিঠি দিলেন। খামের ওপর লেখা পরম শ্রদ্ধাভাজন মুকুল ভাই।
দুশ টাকা দেয়ার কথা ছিল, আরো একশ দিলাম। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
রোজ হাশরে দায়ী থাকার বিষয়টা আমার তেমন ভয়াবহ মনে হলো না। ফুপুর ঘর থেকে বের হয়েই চিঠি খুলে পড়লাম
মুকুল ভাই,
আপনি আমার কাছে দেবতা। না না, ভুল বললাম, দেবতার চেয়েও বড়। আপনি আমার সব। আপনি যা বলেছেন আমি তাই করেছি। ভবিষ্যতেও করব। যতদিন বাঁচব ততদিন করব। এখন আমার মহাবিপদ। এখন আপনি বলে দিন, আমি কী করব? আমি কি ঘুমের ওষুধ খাব? নাকি সিলিং ফ্যানে ফাস নিব? আপনি যা বলবেন তাই হবে।
আমার ওপর তুফান বয়ে যাচ্ছে, আর আপনি শুনলাম হোতাপাড়ায় প্রজাপতির মন নাটকের শুটিং শুরু করেছেন। খবরটা প্রথম বিশ্বাস করি নি। ইতি আপার কাছে টেলিফোন করে নিশ্চিত হয়েছি।