ফুপু বললেন, হুট হাট করে ঘরে ঢুকবি না।
চলে যাব?
চেয়ারে বোস।
আমি চেয়ারে বসলাম। ঘরে বাতি জ্বালানো হয় নি। জানালা বন্ধ। ঘর অন্ধকার। ভ্যাপসা গরমে ফুপু গায়ে চাদর জড়িয়ে রেখেছেন। আমি বললাম, তোমার জ্বর না-কি?
জানি না। তুই একটা কাজ করে দে, আমাকে ঘুমের ওষুধ কিনে এনে দে। পঞ্চাশটা কিনবি, ইউনিকট্রিন। নাম মনে থাকবে?
না।
আমি লিখে দিচ্ছি। একটা ফার্মেসি থেকে এতগুলি দিবে না। বিভিন্ন ফার্মেসিতে যাবি, ঘুরে ঘুরে কিনবি। পারবি না?
পারব।
এতগুলো ঘুমের ওষুধ দিয়ে কী করব জিজ্ঞেস করলি না?
খাবে। ঘুমের ওষুধ দিয়ে মানুষ আর কী করে?
এতগুলা ওষুধ একসঙ্গে খেলে আমার অবস্থা কী হবে বুঝতে পারছিস?
একসঙ্গে খাবে?
অবশ্যই একসঙ্গে খাব। এ ছাড়া আমার কোনো গতি নেই।
ফুপু, বাতি জ্বালাব?
না।
মুখ দেখতে পাচ্ছি না তো! এইজন্যে কথা বলে আরাম পাচ্ছি না।
গাধার মতো কথা বলিস না। আর পা দোলাচ্ছিস কেন? পা দোলাবি না। গাধা!
আমি পা দোলানো বন্ধ করলাম। অন্ধকার চোখে সয়ে গেছে। ফুপুর চেহারা দেখা যাচ্ছে। তাঁকে খুবই সুন্দর লাগছে। মানুষের চেহারার এই এক অদ্ভুত ব্যাপার। সব আলোয় সব মানুষকে একরকম দেখা যায় না। কাউকে দুপুরের খটখটা আলোয় ভালো লাগে। কাউকে ভালো লাগে সকালে, আবার কাউকে আধো আলো আধো অন্ধকারে।
বাবলু!
বল শুনছি।
তোকে পা দোলাতে নিষেধ করেছি, তুই তো দুলিয়েই যাচ্ছিস।
ফুপু আমি পা দোলাচ্ছি না।
ড্রয়ার খুলে দেখ টাকা আছে, একশ টাকার একটা নোট নিয়ে যা। আমার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট আনবি।
তুমি সিগারেট খাও?
হঠাৎ হঠাৎ খাই। আমাদের অভিনয়ের লাইনে অনেকেই খায়। চন্দনা বলে যে মেয়েটা আছে, মডেলিং করে, সে তো চেইন স্মোকার। চন্দনাকে চিনেছিস?
না।
চকলেটের অ্যাড করেছে। সুন্দর অ্যাড। বয়স কত শুনলে চমকে উঠবি–ত্রিশ। সে অবশ্যি মুখে বলে আঠারো। মেকাপ ছাড়া চন্দনাকে দেখলে তোর ইচ্ছা করবে গালে থাপ্পড় মারতে। গিরগিটির শরীরের মতো উচা-নিচা চামড়া। বিরাট বিরাট গর্ত। পেনকেক দিয়ে গর্ত ভরাট করতে হয়।
পেনকেকটা কী?
পেনকেক কী তোকে বলতে পারব না। সিগারেট আনতে বলছি আন। মালবরো লাইট আনবি।
এইটা কি তোমার ব্র্যান্ড?
আমার কোনো ব্র্যান্ড-ফ্রেন্ড নেই। আমি তো চন্দনার মতো চেইন স্মোকার না যে আমার ব্র্যান্ড লাগবে। যখন যেটা পাই খাই। মালবরোটা ভালো। আমেরিকান সিগারেট। রোস্টেড টোবাকো।
রোস্টেড টোবাকো কী জিনিস?
এতকিছু তোকে বলতে পারব না।
আমি সিগারেট কিনে এনে দেখি ঘরে বাতি জ্বলছে। ফুপুর গায়ে চাদর নেই। তিনি হাত-মুখ ধুয়েছেন। মনে হয় কাপড়ও বদলেছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি বাইরে যাবার জন্যে তৈরি। তাঁর ভাঙা গলাও ঠিক হয়ে গেছে। তিনি সিগারেটের প্যাকটটা হাতে নিতে নিতে বললেন, আমার জন্যে কড়া করে এক কাপ চা নিয়ে আয়। সিগারেট শুধু শুধু খেয়ে আরাম পাওয়া যায় না। চায়ের সঙ্গে খেতে হয় কিংবা ড্রিংকসের সঙ্গে।
তুমি ড্রিংকসের সঙ্গে কখনো খেয়েছ?
দুএকবার পাল্লায় পড়ে খেয়েছি। জিন এন্ড লাইম। এক ধরনের ককটেল। জিন সামান্যই থাকে।
খেতে কেমন?
শরবতের মতো একটু তিতা ভাব আছে। তোর কি খেতে ইচ্ছা করছে না
হুঁ।
খবরদার! এইসব জিনিসের ধারে কাছে যাবি না। তুই গাধা আছিস গাধাই থাকবি। ঘোড়া হতে যাবি না।
ফুপু, গাধা নিয়ে একটা জোক আছে। তোমাকে বলি? খুবই মজার।
ফুপু চোখ সরু করে তাকিয়ে আছেন। জোক শোনার ব্যাপারে তাঁর ভালোই আগ্রহ আছে। তবে বেশিরভাগ জোকই তিনি ধরতে পারেন না। সবাই যখন হাসে তখন তিনি করুণ মুখ করে সবার দিকে তাকান। মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে হাসেন। হাসার পর তার মুখ আরো করুণ হয়ে যায়।
আমি জোক শুরু করলাম— ফুপু শোন। একবার এক ছেলে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে মাকে বলছে, মা, আজ আমাদের স্কুল টিচার আমার খুব প্রশংসা করেছেন। ছেলের মা বললেন, উনি কী বলেছেন? ছেলে বলল, স্যার আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা সবাই গাধা। তারপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আর এই রটা সবচে বড় গাধা!
ফুপু হাসতে শুরু করেছেন। তার হাসি বিখ্যাত। বেশিরভাগ সময়ই হাসতে হাসতে তাঁর হেঁচকি উঠে যায়। তিনি বিষম খান। একবার তো খাট থেকে মাটিতে পড়ে ভালো ব্যথাও পেয়েছিলেন।
ফুপু হাসছেন। তার হাসির মিটারের কাঁটা লাফিয়ে লাফিয়ে উপরের দিকে উঠছে। আমি তাঁকে হাসন্ত অবস্থায় রেখে তার জন্যে চা আনতে গেলাম। আমি নিশ্চিত ফিরে এসে দেখব তার হাসি তখনো বন্ধ হয় নি। হাসির সঙ্গে হেঁচকি যুক্ত হয়েছে।
সে রকম দেখা গেল না। ফুপু আগের অবস্থায় ফিরে গেছেন। বসে আছেন খাটে। গায়ে চাদর। ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়েছেন। তবে বাথরুমের বাতি জ্বলছে। বাথরুমের দরজা সামান্য খোলা বলে বাথরুমের আলো এসেছে। ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় ভর্তি। চা বানিয়ে আনার অতি অল্প সময়ে তিনি কয়েকটা সিগারেট খেয়ে ফেলেছেন বলে আমার ধারণা। ফুপু চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন, চন্দনা মেয়েটা কী যে বিপদে পড়েছে! মেয়েটার ভালো বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ছেলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। ইউরোপিয়ানদের মতো চেহারা। লম্বা, ফর্সা, খাড়া নাক। একদিন চন্দনার সঙ্গে শুটিং-এ এসেছিল দেখেছি। সেই বিয়ে বাতিল।
কেন?
চন্দনার একটা বাজে ভিডিও বাজারে রিলিজ হয়েছে।
তার মানে কী?
ফুপু হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে নতুন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, চন্দনা একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা করেছিল সেই ভিডিও গোপনে করা হয়েছে। তারপর ছেড়ে দিয়েছে ইন্টারনেটে। সেখান থেকে নিয়ে ভিডিও কোম্পানি সিডি বের করে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। সিডির নাম নাইট কুইন চন্দনা। তবে কভারে তারা চন্দনার একটা নরম্যাল ছবি দিয়েছে। শাড়ি পরা ছবি। এই ছবি দেখলে বোঝাই যাবে না ভেতরে কী আছে।