ফল খাওয়ার এইসব নিয়ম আপনি বের করেছেন?
জি! ফল নিয়া বইসা থাকি। কাজ নাই কর্ম নাই। বইসা বইসা চিন্তার মাধ্যমে নানান জিনিস পাই।
কী পান?
আল্লাহপাকের কুদরতের দেখা পাই। ভালো কইরা চিন্তা করেন ছোট ভাই, গাছের বিষয়ে চিন্তা করেন। কোনো গাছ দেয় মধুর মতো মিষ্ট ফল, কোনো গাছ। দেয় বোম্বাইয়া মরিচের মতো ঝাল মরিচ। কোনো গাছ ফল দেয় মানুষের জন্যে, আবার কোনো গাছ ফল দেয় পাখিদের জন্যে। সেই ফল মানুষ খাইতে পারে না, তার তিতা লাগে। পাখিরা আনন্দ কইরা খায়।
কোন ফল পাখিরা আনন্দ করে খায়?
মাকাল ফল। বড়ই সৌন্দর্য ফল, কিন্তু মানুষের জন্য বিষ। ছোটভাই, শুকনা আলাপ শুইন্যা লাভ নাই। লটকন খান। আপনার উছিলায় আমিও দুইটা খাব। আমার সাথে লবণ আছে। তিনটা লটকনের দানা মুখে দিবেন আর এক চিমটি লবণ। দেখেন স্বাদ কারে বলে।
আমরা লটকন খাওয়া শুরু করলাম। আমাদের খাওয়া দেখে মুগ্ধ হয়েই হয়তো অতি দ্রুত ডালার সব লটকন বিক্রি হয়ে গেল। রমজান মিয়া ডালা গোছাতে গোছাতে বলল, ছোটভাই, দুপুরে তো আপনে খানা খান নাই। চলেন আমার সাথে, খানা খাব।
আমি বললাম, খানা যে খাই নি বুঝলেন কীভাবে? ইশারায়?
জি ইশারায়। ইশারা একটা মারাত্মক জিনিস, বুঝলেন ছোটভাই! ইশারা বুঝতে পারলে কথা বলার প্রয়োজন হয় না। আফসোস, আমরা বেতালা কথাই বলি— ইশারা বুঝি না। বুঝার চেষ্টাও নেই না।
রমজান মিয়া থাকে আগারগাঁওয়ের এক বস্তিতে। এক কামরার টিনের ঘর। বারান্দা আছে। বারান্দায় রান্নার ব্যবস্থা। সেখানে দড়ির একটা চারপাই পাতা আছে। চারপাইয়ের একটা পা সাইকেলের চেইন দিয়ে ঘরের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা। চারপাই যাতে চুরি না হয় সেই ব্যবস্থা।
আমি বললাম, আপনি একা থাকেন?
ঢাকায় একলাই থাকি। পরিবার দেশে থাকে।
রমজান মিয়া অতি দ্রুত রান্না করে ফেলল। ভাত, শুকনামরিচের সঙ্গে রসুন পুড়িয়ে একটা ভর্তা আর ডাল।
আমি আগ্রহ করে খাচ্ছি। রমজান মিয়াও আগ্রহ করে খাচ্ছে।
ছোটভাই, খাইয়া মজা পাইতেছেন?
হুঁ। অতি সুখাদ্য।
ইশারায় বুঝেছি। আপনে মজা পাইছেন? পেটে ক্ষুধা ছিল এইজন্য মজা পাইতেছেন। পেটের ক্ষুধা আল্লাহপাকের আরেক কুদরত। পেটে ক্ষুধা না থাকলে বেহেশতি খানাতেও কোনো মজা নাই ছোটভাই, আপনে অনেক লোক দেখবেন— খাবার ঘরে খানাখাদ্য বেশুমার, কিন্তু তারার পেটে ক্ষুধা নাই বইল্যা খাইতে পারে না। আহা কী কষ্ট!
রমজান মিয়া চারপাইয়ে পাটি পেতে দিয়েছে। তার ঘরের সঙ্গে য়ে। রেন্টিগাছের ছায়া এসে পড়েছে চারপাইয়ে। আমি মাথার নিচে বালিশ দিয়ে শুয়ে আছি। আমার চোখ ভারী হয়ে আসছে। রমজান মিয়ার মতো আমিও ইশারা? বুঝতে পারছি, আজ আমার ফাটাফাটি ঘুম হবে। ঘুম ভাঙবে যখন গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়বে তখন। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নাই। তারপরেও বৃষ্টির কথাটা কেন মনে হলো কে জানে!
ঘুমের মধ্যে নীলা ফুপুকে স্বপ্নে দেখলাম। ফুপু শুটিং করছেন। মুকুল ভাই ডিরেক্টর। নায়ক ফুপুকে বলবে, আমি এখন আর তোমাকে ভালোবাসি না। তুমি বনের পংখি, তুমি বনে ফিরে যাও। নায়কের কথা শুনেই ফুপু কাঁদতে শুরু করবেন। ফুপু এই অংশটা করতে পারছেন না। নায়কের কথা শেষ হওয়া মাত্র ফুপু হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছেন। তিনবার এরকম হবার পর পরিচালক মুকুল ভাই রাগে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এলেন। ফুপু বললেন, মুকুল ভাই, আমার কোনো দোষ নেই। হিরোর ডায়ালগ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে পেছন থেকে কাতুকুতু দিচ্ছে, এই জন্যে আমি হেসে ফেলছি। সরি।
মুকুল ভাই বললেন, কোন বদমাশটা তোমাকে কাতুকুতু দিচ্ছে?
বাবলু কাতুকুতু দিচ্ছে। ওকে কিছু বলবেন না প্লিজ। ও আমার ছোটভাই। বাচ্চা মানুষ। (স্বপ্নে সম্পর্ক খানিক উলটপালট হয়েছে। আমি রমজান মিয়ার ছোটভাই। ফুপুর না।)।
মুকুল ভাই বললেন, ঐ ছোকরাকে আমার কাছে ধরে নিয়ে এসো। টিপে আমি তার রস বের করে দেব।
ফুপু বললেন, ওকে শাস্তি দিলে আমি কিন্তু শট দেব না। আমার এক কথা।
মুকুল ভাই ফুপুর কথা শুনলেন না। তিনি আমার হাত ধরে বললেন, একে তো আমি চিনি। এই বদছেলে আমার কাছ থেকে পাঁচশ টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তোমরা এই বদটার মাথায় পানি ঢালতে থাক। আমি না বলা পর্যন্ত থামবে না।
কয়েকজন মিলে আমার মাথায় পানি ঢালছে। বরফশীতল পানি। আমি ঠাণ্ডায় কাঁপছি।
এই পর্যায়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল। জেগে দেখি প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। আমার সমস্ত শরীর ভেজা। ঘরের ভেতর থেকে হাসি হাসি মুখে রমজান মিয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে মনে হয় খুব মজা পাচ্ছে।
নীলা ফুপুর চোখ লাল
নীলা ফুপুর চোখ লাল। মুখ ফোলা। তিনি গত দুদিন ধরে ঘরে আছেন। ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। রাতে মনে হয় ঘুমাচ্ছেনও না। কাল রাত তিনটার সময়ও দেখেছি তার ঘরে বাতি জ্বলছে। অসুখ-বিসুখ নিশ্চয়ই না। অসুখ হলে চাদর গায়ে বিছানায় শুয়ে থাকতেন। মাথা টিপে দেবার জন্যে কিংবা মাথায় পানি ঢালার জন্যে আমার ডাক পড়ত। এখনো ডাক পড়ছে না। বড় কোনো ঘটনা হয়তো ঘটেছে। নাটক থেকে বাদ পড়েছেন। কিংবা মুকুল ভাই আরো কোনো কাণ্ড ঘটিয়েছেন। সন্ধ্যাবেলায় আমি তাঁর ঘরে উঁকি দিলাম। তিনি চাদর গায়ে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন। আমাকে দেখে ধড়মড় করে উঠে বসলেন। ভাঙা গলায় বললেন, কী চাস?
আমি বললাম, কিছু চাই না। তোমার গলা ভাঙল কীভাবে?