বাবা বললেন, কেমন আছ?
মা জবাব দিলেন না। তিনি বসলেন বাবার মুখোমুখি। আমি বললাম, আ১ কি অন্য টেবিলে যাব?
মা বললেন, যেখানে বসে আছিস সেখানে বসে থাক।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যুপের অর্ডার দেই? চাইনিজের আসল খাবার স্যুপ। এই একটা জিনিসই এরা বানাতে শিখেছে। বাকি সব অখাদ্য।
আমি বললাম, স্যুপ খাব না বাবা।
বাবা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, থাক তাহলে স্যুপ বাদ। পানি খেয়ে পেট ভরানোর মানে হয় না। আফিয়া, তুমি কী খাবে বলো? তুমি তো আবার সেভেন আপ ছাড়া কিছু খাও না। আমি এসেই খোঁজ নিয়েছি। এদের কাছে সেভেন আপ নেই। মিরিন্ডা আছে। জিনিস একই। দিতে বলি একটা মিরিন্ডা?
মা বললেন, বকবকানিটা বন্ধ করবে? সারাজীবনই তো বকবক করলে। এখন একটু কম কর।
বাবা চুপ করে গেলেন। মা বললেন, কবে আমি তোমাকে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দিয়েছিলাম? তোমার আদরের ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি, তার মাথায় হাত রেখে বলো তো কবে দিয়েছি।
বাবা বিড়বিড় করে বললেন, আফিয়া, কাজটা করেছি জানে বাঁচার জন্য। এই বয়সে জেলে ঢুকতে হলে সমস্যা না? সাদা কাগজে তোমার সিগনেচার করা কয়েকটা পাতা ছিল। ঐটা ব্যবহার করেছি।
আমার দস্তখত করা এমন কাগজ তো তোমার কাছে আরো আছে। আছে না?
আরো দুটা আছে।
সেই দুই কাগজ দিয়ে নতুন কোনো প্যাঁচ খেলবে না?
না। My word of honour.
মা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা যাই। বাবলু উঠ।
বাবা বললেন, সে-কী! কোনো কথাই তো হয় নি।
মা বললেন, যা হয়েছে যথেষ্ট। বাবলু, এখনো বসে আছিস কী জন্যে? আয়।
বাবা হড়বড় করে বললেন, এফডিআর একটা ম্যাচিউর হয়েছে। ঐ টাকাটা নিয়ে একটু কথা বলতাম। খুবই খারাপ অবস্থায় আছি। বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে দুই মাসের… আফিয়া শোন…
বাবাকে হতাশ অবস্থায় রেখে আমরা মাতা-পুত্র বের হয়ে এলাম। রিকশা করে ফিরছি, মা চাপা গলায় বললেন, ঐ বদ এখন বুঝবে কত ধানে কত পোলাউয়ের চাল। তার প্রতিটি কথা ডিজিটাল রেকর্ডারে রেকর্ড করা হয়েছে। উকিল সাহেব আমাকে রেকর্ডার দিয়ে দিয়েছিলেন। তোর বাপ পরিষ্কার বলেছে সাদা কাগজে করা আমার সিগনেচার সে ব্যবহার করেছে। বলেছে না?
বলেছে।
বলেছে— সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড হয়ে গেছে। অতি চালাকের গলায় দড়ি পড়ে, জানিস তো? তোর বাপের গলায় দড়ি পড়েছে।
কাজটা কি ঠিক হয়েছে মা?
তোর বাবা যে কাজটা করেছে সেটা ঠিক, আর আমারটা ভুল? রিকশা থামতে বল তো।
কেন?
গলা শুকিয়ে গেছে, একটা সেভেন আপ খাব। ঠাণ্ডা দেখে আনবি। আমার কাছে ভাঙুতি টাকা নেই। তোর কাছে ভাঙতি আছে?
আছে।
ক্যানের সেভেন আপ আনবি। সঙ্গে স্ট্র আনবি।
আমি রিকশা থেকে নেমে গলির ভেতর ঢুকে হাঁটা দিলাম। মা থাকুন গরমের মধ্যে রিকশায় বসে। আমাকে ফেলে চলে যেতে পারবে না। ছেলে সেভেন আপ আনতে গিয়ে কোথায় গেল। তার কোনো বিপদ হলো কি-না। সবচে ভালো হয় যদি আজ রাত বাসায় না ফিরি। তাহলে বুঝবে টেনশন কত প্রকার ও কী কী। মার ওপর রাগ লাগছে। তাকে শাস্তি দিতে ইচ্ছা করছে। আমি ছোট্ট মানুষ, আমার শাস্তি দেয়ার ক্ষমতাও ছোট্ট।
কোনো রকম উদ্দেশ্য ছাড়া রাস্তায় হাঁটাহাটি করে সময় পার করা কঠিন ব্যাপার। তখন সময় আটকে যায়। নিজেকে ব্যস্ত রাখাও মুশকিল। দেখার অনেক কিছুই আছে, আবার কিছুই নেই। ঢাকার রাস্তার সব দৃশ্যই অনেকবার দেখা। ঝকঝকে প্রকাণ্ড সব নতুন বাস নেমেছে। এসি বাস। এই বাসের যাত্রীদের দিকে তাকালে মনে হয়, একদল সুখী মানুষ। আরাম করে কোথাও যাচ্ছে। আবার এই যাত্রীরাই যখন ভাঙাচোরা বাসে চড়ে, গরমে ঘামে, খুপড়ি জানালা দিয়ে মুখ বের করে রাখে, তাদেরকে মনে হয় ভয়ানক অসুখী। অতি ব্যস্ত রাস্তায় ঠেলাগাড়ি দেখতে ভালো লাগে। সব ঠেলার সঙ্গে ঠেলাওয়ালার অল্প বয়েসী একটা ছেলে থাকে। সে তার বাবার সাহায্যের জন্যে অতি ব্যস্ত। তার ব্যস্ততাও দেখতে ভালো লাগে। ঢাকার রাস্তায় সবসময় কিছু অতি বৃদ্ধ পাওয়া যায় যাদের একমাত্র কাজ রাস্তা পার হওয়া। রাস্তা খানিকটা পার হয়ে তারা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফিরে আসতে চায়, ফিরতে পারে না। হঠাৎ দৌড় দেয়ার মতো ভঙ্গি করে আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। এমন কোনো বৃদ্ধের দেখা পেলে অনেকটা সময় পার করা যায়।
আজ আমার দিন খারাপ। ঠেলাগাড়ি নেই, বৃদ্ধ নেই। আষাঢ় মাসেও দিন ঝকঝক করছে। বৃষ্টির দেখা নেই। আকাশ ঘন নীল। শান্তির নীল রঙ না, উত্তাপের নীল। আষাঢ় মাসে রোদে হাঁটতে ভালো লাগে না। আষাঢ় মাসে মাথার ওপর মেঘ নিয়ে হাঁটতে ভালো লাগে।
রোদ মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম রমজান মিয়ার কাছে। রমজান মিয়া রাস্তার এক কোনায় ছাতা মাথায় বসে আছে। তার ঝুড়িতে আম নেই। সে বসেছে ডালা নিয়ে, ডালা ভর্তি লটকন। ডালার দিকে তাকালে মনে হয় হলুদ ফুল ফুটে আছে।
রমজান মিয়া আমাকে দেখেই আনন্দিত গলায় বলল, আসেন ছাতির নিচে আসেন। আপনের দেখা যে আইজ পামু এইটা জানি।
কীভাবে জানেন?
মানুষের ভিতর ইশারা চলাচল করে। ইশারায় জানি।
আম পান নাই?
না। লটকন খান। বাজারের সেরা লটকন। লটকন কেমনে খাইতে হয় জানেন? রইদে বইসা খাইতে হয়। একেক ফল খাওয়ার একেক নিয়ম। কমলা খাইতে হয় ছেমায় বইসা, তেঁতুল খাইতে হয় গাছের নিচে।
তেঁতুল গাছের নিচে বসে খেতে হয়?
অবশ্যই। গাছের ছেমায় বইসা তেঁতুল খাওনের মজাই অন্যরকম।