খাব।
জন্মদিনের কোনো আয়োজন করতে পারি নাই। উনি অসুস্থ, বাজার কে করবে! শুধু পুডিং করেছি। কেক আনা হয়েছে। তোমার বাবা ঘুম থেকে উঠলে কেক কাটা হবে।
জি ঠিক আছে।
তিনি রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। আমি বসলাম যূথীর পাশে। জন্মদিন উপলক্ষে যুথীকে নতুন ফ্রক পরানো হয়েছে। বেণি করে চুল বাঁধা হয়েছে। আগের দিনের মতোই যূথী দুনিয়ার খেলনা নিয়ে বসেছে। আমি বললাম, যূথী, তুমি কি আমাকে চিনেছ?
যূথী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
বলো তো আমি কে?
বাবলু।
হয়েছে। তোমার অনেক বুদ্ধি।
আজ আমার জন্মদিন। তুমি জানো?
জানি। তোমার জন্য গিফট নিয়ে এসেছি।
কী গিফট?
কেক কাটা হোক। তারপর তোমাকে দেব।
আচ্ছা। জিতুর মা চলে গেছে, তুমি জানো?
না। চলে গেছে না-কি?
হুঁ। মার গয়না আর বাবার মানিব্যাগ নিয়ে চলে গেছে। পরশু সকালবেলা গেছে।
বলো কী?
হুঁ সত্যি কথা। বাবার মানিব্যাগে কত টাকা ছিল তুমি জানো?
না।
এক হাজার তিনশ ছাব্বিশ টাকা।
অনেক টাকা ছিল তো?
হুঁ। মার কী কী গয়না নিয়েছে তুমি জানো?
না।
তোমাকে বলব? বলো।
দুটা কানের দুল, একটা চেইন, চারটা চুড়ি। মা সারাদিন কেঁদেছে। মার মনে কষ্ট হয়েছে এইজন্য কেঁদেছে। কষ্ট হলে কাঁদতে হয়।
তুমি কাঁদ?
হুঁ। পেটে ব্যথা হলে কাঁদি। আর যদি খেলনা হারিয়ে যায় তাহলে কাঁদি।
চারটা মোমবাতি জ্বালিয়ে কেক কাটা হলো। সেই কেকের এক টুকরা মুখে দিয়ে বাবা বললেন, অসাধারণ কেক। দি বেস্ট। বলেই বমি করে ঘর ভাসিয়ে ফেললেন।
আমি বললাম, বাবা, তোমার অবস্থা তো খুবই খারাপ।
বাবা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, হুঁ খারাপ।
চোখ টকটকে লাল, ডেঙ্গু হয় নাই তো?
হতে পারে।
হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছ না কেন? এখন যাবে? নিয়ে যাব তোমাকে?
রুগি নিয়ে গেলেই তো ভর্তি করায় না। ধরাধরি আছে, টাকা-পয়সা খাওয়া খাওয়ি আছে। হাতে টাকা-পয়সা নাই। জিতুর মা মানিব্যাগ নিয়ে পালিয়েছে। মালতীর গয়না নিয়েছে। ক্রিমিন্যাল মেয়ে।
বাবা চল যাই হাসপাতালে ভর্তি করানো যায় কি-না দেখি।
ঠিক আছি। আমি ঠিক আছি। বমি করার পর শরীরটা ফর্মে চলে এসেছে। তুই বাসায় চলে যা। বাসায় গিয়ে সাবান ডলে গরম পানি দিয়ে একটা গোসল দিবি। নয়তো দেখা যাবে তোকেও ধরেছে। ভাইরাস মারাত্মক জিনিস, একবার ধরলে জান বিলা করে দেয়।
যূথীর মনে হয় আমার আনা হাতিটা খুব মনে ধরেছে। হাতিটা সে জড়িয়ে বুকের কাছে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে হাত টান করে সে হাতিটা তার চোখের সামনে আনে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, আবার বুকে চেপে ধরে। আমি বললাম, যূথী, তোমার কি হাতি পছন্দ হয়েছে? সে প্রশ্নের জবাব দিল না। আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। তার ভুবনে আকাশী রঙের হাতিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি বললাম, যূথী, যাই? সে শুধু ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। কিছুই বলল না।
আমার কাছে পনেরশ টাকা ছিল। হাতির পেছনে নয়শ টাকা খরচ হয়েছে। এতগুলি টাকা সামান্য একটা তুলা ভরা খেলনার পেছনে খরচ করতে মায়া লাগছিল— এখন ভালো লাগছে। এই বাচ্চামেয়েটি বড় হবে। সে তার সমগ্র জীবনে অসংখ্য উপহার নিশ্চয়ই পাবে, কিন্তু কোনো উপহারই হাতিটার স্থান নিতে পারবে না। এই মেয়েরও একদিন মেয়ে হবে। তার জন্মদিন হবে। জন্মদিনের মেয়েকে তার মা বলবে, আমি যখন তোর মতো ছোট ছিলাম তখন আমি জন্মদিনে একটা হাতি পেয়েছিলাম। পৃথিবীর সবচে সুন্দর হাতি।
বাচ্চামেয়েটি আগ্রহ করে জানতে চাইবে, কে দিয়েছিল?
যূথী বলবে, বাবলু দিয়েছিল।
বাবলু কে?
আমার ভাই। উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন।
আচ্ছা আমি কি মেয়েটিকে স্নেহ করি? হয়তো করি। স্নেহ না করলে এত টাকা দিয়ে হাতি কিনব কেন। আবার এও হতে পারে যে স্নেহ-ট্রেহ কিছু না, আমি ঘটনা দেখতে আসি। বড়খালা ভিডিওতে ঘটনা দেখে মজা পান। আমি বাস্তবের ঘটনায় মজা পাই।
মায়ের উকিল তালুকদার সাহেব
মায়ের উকিল তালুকদার সাহেবের পরামর্শে মা বাবার সঙ্গে একান্তে দেখা করতে রাজি হলেন। তবে মা একা কিছুতেই যাবেন না। সঙ্গে কাউকে না কাউকে যেতে হবে। ঠিক হলো আমি মাকে নিয়ে যাব। কোথায় যাব সেই জায়গাও ঠিক হলো। ধানমণ্ডিতে জিংলিং নামের একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। দুপুরবেলা যাওয়া হবে, তখন লোকজন কম থাকে। উকিল সাহেব মাকে কী বলতে হবে না বলতে হবে সব শিখিয়ে দিলেন। আমার প্রতি নির্দেশ হলোতারা যখন কথা বলা শুরু করবেন, তখন আমি অন্য টেবিলে চলে যাব। একা একা কোক বা সেভেন আপ খাব।
উকিল সাহেব বললেন, কোন কোন পয়েন্টে কথা বলবেন এইগুলা আমি আলাদা কাগজে লিখে দেই।
মা বললেন, দরকার নেই, আমার মনে থাকবে।
দেখা হওয়ার মানসিক উত্তেজনায় পয়েন্ট বাই পয়েন্ট কথা মনে নাও আসতে পারে।
ঐ লোককে দেখে আমার মানসিক উত্তেজনা হবার কিছু নেই। যা হবে তার নাম রাগ।
রাগের সময় মানুষ বেশি ভুল করে।
আমি ভুল করব না।
চাইনিজ রেস্টুরেন্টের এক কোনায় বাবা বসেছিলেন। অসুখ থেকে উঠায় তাঁকে খুবই কাহিল লাগছে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেছেন। পাঞ্জাবিটা কুঁচকানো। বাইরে বের হবার সময় বাবা কাপড়-চোপড়ে খুব সাবধান থাকেন। ইস্ত্রি ছাড়া কাপড় পরেন না। আজ মনে হয় ইচ্ছা করেই কুঁচকানো কাপড় পরেছেন। নিজের হতাশ চেহারাটা দেখাতে চাচ্ছেন।
বাবা সিগারেট টানছিলেন। মাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। আধখাওয়া সিগারেট অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিলেন। আমার ধারণা, বাবা এই প্রথম তার স্ত্রীকে দেখে সম্মান করে উঠে দাঁড়ালেন।