জিতুর মা বলল, আমি কানে ধইরা উঠবোস করব কী জন্যে? আমি করছি কী?
তুমি একজন সম্মানিত মহিলার সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলেছ, এইজন্যেই তুমি কানে ধরে দশবার উঠবোস করবে। যদি না কর তোমার চাকরি নট।
জিতুর মা তেজি গলায় বলল, চাকরি নট হইলে নট। আমি ফুলপুরের মাইয়া। ফুলপুরের মাইয়া কানে ধইরা উঠবোস করে না।
বাবা বললেন, তাহলে বিদায়। এক্ষুনি বিদায়। তোমরা এই মেয়ের ট্রাংক কাঁথা বালিশ, ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখ। আমার ধারণা সে ইতিমধ্যেই কিছু জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলেছে। ফুলপুর ময়মনসিংহ ডিসট্রিক্টে। ময়মনসিংহের কাজের মেয়ে চোরের হাড়ি।
জিতুর মাকে সকাল নটায় বিদায় করে দেওয়া হলো। সেদিন সন্ধ্যাতেই বাবা তাকে বস্তি থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। পঞ্চাশ টাকা বাড়তি বেতন দিয়ে আনতে হলো। ঢাকা শহরে কাজের মেয়ের খুব অভাব। গ্রাম থেকে শত শত মেয়ে শহরে আসে ঠিকই, কিন্তু তারা বাসা বাড়িতে ঢোকে না। সরাসরি গার্মেন্টসে চলে যায়।
জিতুর মা অনেকদিন আমাদের মাঝে ছিল। শেষের দিকে বড়খালার সঙ্গে তার খুবই খাতির হয়। তারা দুজন একসঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হিন্দি সিরিয়াল দেখত। জিতুর মা হিন্দি বুঝত না। বড়খালা বুঝিয়ে দিতেন।
শালগিরা হলো জন্মদিন। ঐ যে হ্যাপি বার্থ ডে। বুঝেছ?
জি বুঝেছি।
ঐ লম্বা মেয়েটার আজ শালগিরা। সে দুনিয়ার বন্ধু-বান্ধবকে দাওয়াত দিয়েছে, তার বয়ফ্রেন্ডকে দাওয়াত দেয় নাই। বুঝেছ?
কাজটা অন্যায্য হইছে।
মোটেই অন্যায্য হয় নাই। ঠিকই হয়েছে। আমি হলেও তাই করতাম। তুমি কী করতে?
খালাজি, আমি দাওয়াত দিতাম। দশজনরে দিতে পারছি, আরেকজন অ্যাসট্রা দিলে ক্ষতি কী?
জিতুর মা কথাবার্তায় দুএকটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে। যেমন— অ্যাক্সট্রা, মিসটেক, রিস্কি। সে আমাদের সঙ্গে তিন বছর ছিল। তারপর হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে যায়। যাবার সময় রান্নাঘর থেকে একটি গরুর গোশতের শুঁটকি নিয়ে যায়। বিষয়টা বেশ রহস্যজনক— এত জিনিস থাকতে সে একটি গরুর গোশতের শুঁটকি নিয়ে কেন পালাল? গোশতের শুঁটকি বাবার খুব পছন্দের। কোরবানির গোশতের অনেকটাই বাবার জন্যে শুঁটকি বানিয়ে রাখা হতো।
বাবা শুঁটকির শোকেই বেশ কাতর হলেন। সেদিন তিনি কাজে গেলেন না। হামকি ধামকি করতে লাগলেন— এই পিশাচী ডাইনিকে আমি যদি জেলের ভাত না খাওয়াই তাহলে আমার নাম তোফাজ্জল হোসেন না। আমার নাম কুত্তা হোসেন। ঢাকা সাউথের এসপি জয়নাল আমার বাল্যবন্ধু। একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। সে অঙ্ক একেবারেই পারত না। তার হোমওয়ার্ক আমি করে দিতাম। মেট্রিক পরীক্ষার সময় তার সিট পড়ল আমার পিছনে। সে যেন অংকে পাশ করতে পারে এই জন্যে আমি একটা করে অঙ্ক করতাম, খাতাটা খুলে রাখতাম। জয়নাল অঙ্কটা টুকত, তারপর আমি অন্য অংকে হাত দিতাম। তাকে পাশ করাতে গিয়ে আমি অঙ্ক খারাপ করলাম। যেখানে লেটার মার্ক থাকার কথা সেখানে পেলাম বাহান্ন। অংকের কারণে আমার ফার্স্ট ডিভিশন মিস হয়ে গেল। যাই হোক, এটা কোনো ব্যাপার না, জিতুর মাকে টাইট দেয়াটা হলো ব্যাপার। সে ঘুঘু দেখেছে। ফাদ দেখে নি। You have seen the bird, not the cage.
আমার বাবা তোফাজ্জল হোসেন খোন্দকার বোকা মানুষ না বুদ্ধিমান মানুষ, তা এখনো আমি ধরতে পারি না। তাঁর কথাবার্তা আচার-আচরণ বোকার মতো। এদিক দিয়ে তিনি বোকা। কিন্তু বোকাদের কর্মকাণ্ডের পেছনে কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। বাবার সমস্ত কর্মকাণ্ডের পেছনেই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য থাকে। বাইরের মানুষ বাবাকে তোফাজ্জল হোসেন বলে না। বলে টাউট হোসেন।
খালু সাহেবের মৃত্যুর পর বাবা যে বড়খালাকে এ বাড়িতে এনে তুললেন তার পেছনেও উদ্দেশ্য কাজ করেছে। খালু সাহেব ধনবান মানুষ ছিলেন। তিনি অনেক টাকা-পয়সা রেখে গিয়েছিলেন। বাবার উদ্দেশ্য ছিল, বড়খালাকে আমাদের বাড়িতে তুলে তার টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়া। বাবার এই উদ্দেশ্য সফল হয় নি। বড়খালা বাবার ফাঁদে কখনো পা দেন নি।
বাবা কিছুদিন পর পরই নতুন নতুন ব্যবসার পরামর্শ করতেন বড়খালার সঙ্গে। উৎসাহ এবং উত্তেজনায় তিনি তখন ঝলমল করতেন। বড়খালাও বাবার কথা খুব আগ্রহের সঙ্গে শুনতেন।
আপা! আপনি যে শুধু সম্পর্কে আমার আপা, তা না। আপনি আমার মুরুব্বি। আজকে আমি এসেছি আপনার দোয়া নিতে। পা-টা একটু আগায়ে দেন। সালাম করি।
বড়খালা পা এগিয়ে দিলেন। বাবা সালাম করলেন। আয়োজন করে সালাম।
নতুন একটা ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছি আপা, আপনার দোয়া চাই। এতদিন যা করলাম, সবই তো টুকটাক। ঢাকের বাদ্য। এইবার গুড়ুম গাড়ম বজ্রপাত।
কিসের ব্যবসা করবে?
রঙের ব্যবসা। ডাই। সুতায় যে রঙ দেয়া হয় সেই রঙ। বাংলাদেশে এই ব্যবসা একচেটিয়া যে করত তার নাম নাজিম। চাঁদপুরে বাড়ি। বিয়ে করেছে জামালপুরের মুনশি বাড়ির মেয়ে। সেই সূত্রে আমার সাথে পরিচয়। আমাকে সে খুবই ভালো পায়। দুলাভাই ডাকে।
তোমাকে খামাখা দুলাভাই ডাকে কেন? তুমি তো আর তার বোনকে বিয়ে কর নাই।
এইখানে একটা মজা আছে। তার যে আসল দুলাভাই, সে লঞ্চড়ুবিতে মারা গেছে। তার চেহারা ছিল অবিকল আমার মতো। এই জন্যেই সে আমাকে ডাকে দুলাভাই। শুধু যে দুলাভাই ডাকে তা-না, সম্মানও সে-রকমই করে।
ও আচ্ছা।
নাজিম সামনের মাসে আমেরিকা চলে যাচ্ছে। গ্রীন কার্ড না-কি ইয়েলো কার্ড কী যেন পেয়েছে। আমাকে সে ডেকে নিয়ে বলেছে, দুলাভাই, আমার রঙের ব্যবসাটা আপনার হাতে দিয়ে যাই। আপনাকে কিছুই করতে হবে না। জাপানে এবং কোরিয়ায় এলসি খুলবেন। রঙ আনবেন। ক্যাশ পয়সায় বেচবেন। পার্টি আপনার বাড়িতে এসে টাকা দিয়ে যাবে, আপনাকে যেতেও হবে না। আপা, এখন আপনি বলেন, এই ব্যবসাটা করা উচিত না?