আমি বললাম, জি-না।
তোমাদের রেজাল্ট কবে হবে?
এখনো জানি না।
আমি শুনলাম তুমিও তোমার বড়ভাইয়ের মতো ভালো ছাত্র, সত্যি না-কি? তুমিও তো ফার্স্ট সেকেন্ড হবে?
এখন তো কেউ আর ফাস্ট সেকেন্ড হয় না। এখন গ্রেডিং হয়।
তা ঠিক, খুবই বাজে সিস্টেম। ফার্স্ট সেকেন্ড হলে ছবি ছাপা হয় পত্রিকায়। ছবি দেখে অন্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কম্পিটিশনের ভাব আসে। ঠিক না?
জি।
ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়া ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাবা-মার ছবিও ছাপা হয়। এতে বাবা-মাদের মনে আনন্দ হয়। তাদের আনন্দেরও তো প্রয়োজন আছে। আছে না?
জি।
তোমার বাবার বিষয়ে উড়াউড়া কিছু খবর শুনি। সেটা সত্যি?
জি সত্যি।
ভেরি স্যাড। পিতামাতা হলো সন্তানের আদর্শ। সেই পিতামাতা যদি এরকম করে তাহলে সন্তান আর কী করবে? যাই হোক, মন খারাপ করবে না। পিতামাতা যা ইচ্ছা করুক, তুমি তোমার কাজ করে যাবে। তোমার কাজ পিতামাতাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করা। ঠিক বলেছি না?
জি।
আইসক্রিম খাবে? একটা আইসক্রিম আনিয়ে দেই?
জি-না।
আচ্ছা যাও। ফি আমানিল্লাহ। তোমার জহির ভাইয়ের সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজন থাকলে পরে আরেকবার এসো।
জি আচ্ছা।
আমার নামে কখনো কোনো চিঠি আসে না
আমার নামে কখনো কোনো চিঠি আসে না। কে আমাকে চিঠি লিখবে? যারা লেখার তারা তো আশেপাশেই আছে। তারপরেও আশ্চর্য, পোস্টাপিসের পিওন এসেছে আমার খোঁজে। সে একটা রেজিস্ট্রি চিঠি নিয়ে এসেছে। রেজিস্ট্রি উইথ অ্যাকনলেজমেন্ট। দস্তখত করে চিঠি নিতে হবে। রেজিস্ট্রি করা চিঠি আমাকে কে লিখবে? খামের লেখাও অপরিচিত। খাম খুলে দেখি বাবার দীর্ঘ চিঠি।
My dear Sun,
তোমাকে Son না বলিয়া Sun বলিলাম। এই Sunএর অর্থ সূর্য, দিবাকর। তুমি আমার নিকট দিবাকর।
বাবা, তুমি কেমন আছ? দীর্ঘদিন তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইতেছে না। বিগত পাঁচ তারিখে তোমাদের বাসার সম্মুখ দিয়া বেশ কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করিয়াছি। পরিকল্পনা ছিল তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে তোমাকে নিয়া একসঙ্গে কিছুক্ষণ বসিতাম। দুর্ভাগ্য তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নাই। পরে ঠিক করিলাম নীলার মোবাইল নাম্বারে টেলিফোন করিয়া সংবাদ নেই। তাহার টেলিফোন নাম্বার হারাইয়া ফেলিয়াছি বলিয়া ইহাও সম্ভব হয় নাই।
বাসার সংবাদ কী? তোমার মাতা আমার বিরুদ্ধে মামলা করিয়াছে। এই সংবাদ নিশ্চয়ই পাইয়াছ। মামলার ফলাফল তোমার মাতার জন্য শুভ হইবে না। কিন্তু ইহা তাহাকে কে বুঝাইবে? মিলমিশ করিয়া থাকাতে যে আনন্দ সেই আনন্দ অন্য কোথাও নাই। তোমার মাতার সহিত একান্তে বসিয়া কিছু কথা বলিতে পারিলে সমস্যার সুরাহা হইবার সম্ভাবনা আছে। কীভাবে একান্তে বসা যায় তা নিয়া আমি ভাবিতেছি। মাথায় তেমন কোনো পরিকল্পনা আসিতেছে না।
মালতীর ইচ্ছা সে একদিন তাহার শিশু সন্তানকে কোলে নিয়া তোমার মাতার কাছে যাইবে। এবং তোমার মাতার পা জড়াইয়া ধরিয়া বসিয়া থাকিবে। এই বুদ্ধিও খারাপ না। স্ত্রীলোকের মাথায় মাঝে মধ্যে ভালো বুদ্ধি খেলা করে। স্ত্রীলোকেরা পা ধরাধরির বিষয়টাও পছন্দ করে। মালতী যদি এক পা জড়াইয়া ধরে এবং যূথী যদি অন্য পা জড়াইয়া ধরে, (যূথীকে শিখাইয়া পড়াইয়া নিলে সে এই কাজ অবশ্যই করিবে) তাহা হইলে তোমার মাতার হৃদয় নরম হইবার সম্ভাবনা আছে। তোমার কী ধারণা? সাক্ষাতে আমরা এইসব নিয়া আলাপ করিব। বাবা, তুমি একবার আস।
আগামী ১৭ তারিখ সন্ধ্যায় যূথীর চতুর্থ জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হইবে। ইহা তাহার মায়ের ইচ্ছা। তোমার পক্ষে কি এই দিন আসা সম্ভব? উৎসব তেমন কিছু না। উন্নত মানের খাদ্য কেক মিষ্টি ইত্যাদি। আমার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। বড় কিছু করা সম্ভব না। সঞ্চিত টাকাপয়সা একত্র করিয়া তোমার মায়ের নামে দুইটি এফডিআর করাইয়া দিয়াছিলাম। একটি এফডিআর চলতি মাসের ১১ তারিখে ম্যাচিউরড হইয়াছে। তোমার মাতা এই এফডিআর হইতে দশ লক্ষ টাকা পাইবেন। এই অর্থের কিছু আমাকে দিলে আমার উপকার হইত। তোমার মাতাকে যে এই বিষয়ে অনুরোধ করিব সেই সুযোগও পাইতেছি না। আল্লাহ পাকের উপর ভরসা। দেখি উনি আমার জন্য কী ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছেন।
বাবা বাবলু, পত্রপাঠ সম্পন্ন হইবা মাত্র ছিড়িয়া কুটিকুটি করিয়া ফেলিবে। এই পত্র তোমার মায়ের হাতে পড়িলে বিপদের সম্ভাবনা।
দোয়াগো
তোমার হতভাগ্য পিতা
তোফাজ্জল হোসেন
সতেরো তারিখ সন্ধ্যায় আমি যূথীর জন্মদিন পালন করতে গেলাম। যূথীর জন্য এক প্যাকেট চকলেট এবং একটা হাতি কিনলাম। যূথী তার পছন্দের একটা হাতির কথা বলছিল, এইটাই সেই হাতি কি-না কে জানে।
দরজার কড়া নাড়তেই মালতী দরজা খুলে দিলেন। এই মহিনে ১৩ ডাকাটা ঠিক হচ্ছে না। ছোট মা ডাকতে পারলে ভালো হতো। তাও পারছি।
মালতী দরজা খুলে একপাশে সরে গিয়ে নিচু গলায় বললেন, কে আছ বাবা?
আমার মনে হয় তিনি যে এই বাক্যটি বলবেন তা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। বাক্যটা বললেন যন্ত্রের মতো গলায়। বলেই মাথাও নিচু করে ফেললেন। আমি বললাম, ভালো আছি।
তুমি যূথীর সঙ্গে গল্প কর। তোমার বাবা ঘুমাচ্ছেন।
অসময়ে ঘুমাচ্ছেন কেন?
উনার জ্বর।
জ্বর কি বেশি?
বেশি। পাঁচদিন ধরে জ্বর। ডাক্তারের কাছে যেতে বলি—— যায় না। আমার মনে হয় ডেঙ্গু হয়েছে। শরীর ফুলে ফুলে গেছে। তার মাথায়ও যন্ত্রণা। ডেঙ্গু হলে মাথায় যন্ত্রণা হয়। বাবা, তোমাকে একটু চা করে দেই, চা খাবে?