স্যার, এ আমার ভাইয়ের ছেলে। এর নাম বাবলু।
ডিরেক্টর সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বিনীতভাবে বললাম, স্যার, স্লামালিকুম। ডিরেক্টর সাহেব সালামের জবাব না দিয়ে নীলা ফুপুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কাজ শেষ না?
নীলা ফুপু বললেন, জি স্যার। তা
হলে এখনো ঘুরঘুর করছ কেন? বাড়ি যাচ্ছ না কেন?
আমরা ট্যাক্সি ক্যাবে ফিরছি। ট্যাক্সিতে উঠে নীলা ফুপু সামান্য কান্নাকাটি করলেও এখন স্বাভাবিক। শাহবাগের কাছে এসে আমাকে বললেন, তুই এখানে নেমে যা। আমি একটু মুকুল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি। দশটা টাকা রাখ, রিকশা ভাড়া।
দশ টাকা বলে যে নোটটা তিনি আমার হাতে গুঁজে দিয়েছেন সেটা একটা একশ টাকার নোট। আমি বললাম, ফুপু, তুমি ভুলে একশ টাকার নোট দিয়েছ।
ফুপু বললেন, দিয়েছি যখন রেখে দে।
ফেরত দিতে হবে না?
তুই কি গাধা নাকি?
ট্যাক্সি থেকে নেমে হঠাৎ করে মনে হলো, আমি আমার এই ফুপুকে খুবই পছন্দ করি। কেন করি? উনি বোকা বলে কি পছন্দ করি? বুদ্ধিমান মানুষদের কেউ পছন্দ করে না। মানুষ পছন্দ করে বোকাদের। তবে বড়খালাকে আমি কেন পছন্দ করি না? উনি তো যথেষ্টই বোকা। এদিকে জহির ভাইকে আমার বেশ পছন্দ। জহির ভাই অসম্ভব বুদ্ধিমান। তাহলে কি এই দাঁড়াচ্ছে না যে, মানুষ বোকাদের পছন্দ করে, এই থিওরি ভুল?
নীলা ফুপু মাঝে মধ্যেই পাঁচটা টাকা রাখ বলে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দেন কিংবা দশটা টাকা রাখ বলে একটা একশ টাকার নোট দেন। এই কারণেই কি উনাকে পছন্দ করি? পছন্দটা কি অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত? তাও তো ঠিক না। জহির ভাই কখনো আমাকে টাকা-পয়সা দেন না। তারপরেও তো তাকে আমার খুবই পছন্দ।
জহির ভাই টাকা-পয়সা দেন না, তার মূল কারণ অবশ্যি উনার কাছে টাকা-পয়সা নেই। উনি নিজেই চলেন এর তার কাছে হাত পেতে। এখন অবশ্যি তাঁর অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। হাসপাতাল থেকে ফিরে তিনি দি ইমেজএ স্থায়ী হয়েছেন। ভালোভাবেই স্থায়ী হয়েছেন। ফারুক ভাইয়ের স্ত্রী (নাসরিন, দেখতে শাকচুন্নির মতো। দাঁত ভাসা, চুলের রঙ প্রায় লাল) না-কি জহির ভাইকে অনুরোধ করেছেন মৃত বন্ধুর ব্যবসা দেখাশোনা করতে। তাঁর বিশ্বাসী কেউ নেই। জহির ভাই ভরসা। জহির ভাই রাজি হয়েছেন। এখন তিনিই ভিডিও ব্যবসা দেখেন। শাকচুন্নি মহিলাকে আগে কখনো দি ইমেজে দেখা যায় নি। এখন তিনি প্রায়ই আসেন। বিহারি মেয়েদের মতো ঝলমলা শাড়ি পরেন। গালে কী যেন মাখেন— এতে গাল আপেলের মতো লাল টুকটুক হয়ে যায়। তারপরেও এই মহিলার দিকে তাকানো যায় না। ভিডিও দোকানের স্টাফরা আড়ালে তাকে দুটা নামে ডাকে। এক, ঘোড়ামুখী। এই নামকরণ ঠিক আছে। সাইড থেকে দেখলে তাঁর মুখের সঙ্গে ঘোড়ার মুখের মিল আছে। তবে তাঁর আরেকটা নাম হলো শিয়ালমুত্রা। এই নামের পেছনের কারণ কী জানি না। কোনো একদিন জিজ্ঞেস করে জেনে নিব।
শিয়ালমুত্রার সঙ্গে একদিনই আমার কথা হয়েছে। উনি আমাকে দেখে বললেন, তুমি জহির সাহেবের ভাই না? সারাদিন তোমাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখি, স্কুলে যাও না?
স্কুল বন্ধ।
এখন কিসের স্কুল বন্ধ? বাংলাদেশের সব স্কুল খোলা, তোমারটা বন্ধ এর মানে কী? আমার সঙ্গে বাইচলামি কর?
এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি তো, এই জন্যে স্কুল বন্ধ।
ও আচ্ছা তাই বলো। তুমি কি এখান থেকে ভিডিও নিয়ে যাও?
জি।
তুমি দেখ, না আর কেউ দেখে?
আমার বড়খালা দেখেন।
এক্স রেটেড ছবি নাও না তো? ঐ যে ছেলেমেয়ের কুকর্মের ছবি?
জি-না।
আমি কিন্তু রেজিস্টার চেক করে দেখব। যদি দেখি ট্রিপল এক্স বা ডাবল এক্স ছবি নিয়েছ— তাহলে কিন্তু তোমার খবর আছে। তোমার বাসায় কমপ্লেইন করা হবে। বুঝেছ তো?
জি।
আরেকটা কথা তোমাকে বলব। এই কথাটা উঁচাগলায় বলতে পারব না। চাপাগলায় বলব। আমি চাই না বাইরের কেউ শুনুক।
আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। শিয়ালমুত্রা ফিসফিস করে বললেন, এতক্ষণ ধরে তোমার সঙ্গে কথা বলছি, তুমি আমার চোখের দিকে তাকাও নাই। তাকিয়ে ছিলে আমার বুকের দিকে। সেই দিনের বাচ্চাছেলে, মুখের দুধের গন্ধ এখনো যায় নাই, এর মধ্যেই মেয়েছেলের বুকের দিকে তাকিয়ে থাকা শিখেছ! যাও সামনে থেকে।
আমি ভদ্রমহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম না, এটা ঠিক। তবে আমি তার বুকের দিকেও তাকিয়ে ছিলাম না। আমি তাকিয়ে ছিলাম তার দাঁতের দিকে।
জহির ভাইয়ের সঙ্গে এই মহিলার সম্পর্ক কোন পর্যায়ের আমি এখনো জানি। জহির ভাই তাকে ডাকেন রুবি। মনে হয় রুবি এই মহিলার ডাকনাম।
একদিন জহির ভাইয়ের ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি, দি ইমেজ-এর ম্যানেজার কাদের সাহের গম্ভীর গলায় বললেন, বাবলু, এখন যেও না। ম্যাডাম জহির ভাইয়ের সঙ্গে আছেন। ঘণ্টাখানিক পরে এসো।
বলতে ভুলে গেছি, কাদের সাহেবকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও পরে ছেড়ে দিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত হয়েছে। কিছু টাকা খরচ হয়েছে, তার পরিমাণও অল্প।
কাদের সাহেব লোক ভালো। গাট্টাগোট্টা চেহারা। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তাকে দেখলেই মনে হয় ফুটবল কোচ বা এই ধরনের কেউ। তিনি সব সময় ভুরু কুঁচকে রাখেন। মনে হয় গভীর কোনো চিন্তার মধ্যে থাকেন। তিনি কারো সঙ্গেই বিশেষ কথাবার্তা বলেন না— তবে আমার সঙ্গে মাঝে মধ্যে কথা বলেন।
জহির ভাইয়ের ঘরের সামনে থেকে ফিরছি, কাদের সাহেব বললেন, বাবলু, কোক ফান্টা এইসব কিছু খাবে?