কে, মারুফ ভাই? শট দিচ্ছেন? তাহলে পরে টেলিফোন করব। কার নাটক? ও বিশু ভাইয়ের? মেগা সিরিয়েল না-কি সিঙ্গেল? মেগা? বিশু ভাইকে বলেন না, আমাকে কোথাও ঢুকিয়ে দিতে। আমি ফ্রি আছি।
লুনা আপু! খবর পেয়েছি ঐদিন আপনি খুব মজা করে জন্মদিন করেছেন। আমার কথা তো মনে পড়ল না। আপনার জন্যে একটা গিফট রেখে দিয়েছি ফেস ওয়াশ। বেলজিয়ামের তৈরি। কৌটাটা খুব কিউট। আমি এসে বাসায় দিয়ে যাব। কবে আসব বলুন।
হ্যালো, কে, ফরিদ ভাই? ভালো আছেন ফরিদ ভাই? ভাবি ভালো আছেন? আপনার মেয়েটার যে হাম হয়েছিল, হাম কমেছে? ছোটবেলায় আমার একবার হয়েছিল, যা কষ্ট দেয়। একটু কাজের কথা বলি ফরিদ ভাই? আপনারা আমাকে যে রোলটা দিয়েছেন সেটা না-কি আমার আগে আরো দুজনকে আপনারা অফার দিয়েছেন। তারা রিজেক্ট করেছে। সেই রোল আমাকে দিয়েছেন। যাদের অফার করেছেন তারাই আমাকে বলেছে। আচ্ছা ফরিদ ভাই, আমি কি এতই ফেলনা? হ্যাঁ, আমি করব। করব না কেন? আপনাদের পার্টির সঙ্গে আমার সম্পর্ক আলাদা। আমরা জয়েন্ট ফ্যামিলির মতো, তাই না? ফরিদ ভাই, আমি একদিন আপনাদের বাসায় যাব। ভাবির সঙ্গে গল্প করব আর আপনার মেয়েটাকে দেখে আসব। আপনার মেয়েটা কী যে সুইট হয়েছে ফরিদ ভাই। আপনার মেয়ের জন্যে আমি এক প্যাকেট চকলেট আলাদা করে রেখেছি।
নীলা ফুপুর সঙ্গে গত বুধবারে আমি শুটিং দেখতে গিয়েছিলাম। ফুপু আমাকে জোর করে নিয়ে গেল। নায়কের সঙ্গে তাঁর না-কি সিরিয়াস অ্যাকটিং আছে। দেখার মতো জিনিস হবে।
আমি বললাম, তুমি নায়িকা না-কি?
না, আমি নায়িকা না। নতুন একটা মেয়ে নায়িকা। অভিনয়ের অ জানে। চেহারাও বান্দরীর মতো। প্রডিউসারের সাথে ইটিস-পিটিশ আছে, এইজন্যে তাকে নিয়েছে।
তুমি তাহলে নায়কের সঙ্গে কী করবে?
সিকোয়েন্সটা তোকে বলি। পার্কের সিকোয়েন্স। আমি একটা গাছে হেলান দিয়ে বাদাম খাচ্ছি, এমন সময় নায়ক রিয়াজ ভাই আসবে। আমাকে দূর থেকে দেখে মনে করবে, আমিই তার নায়িকা। রিয়াজ ভাই পা টিপে টিপে এসে আমার পাশে বসবে, মাথায় টোকা দেবে। আমি চমকে রিয়াজ ভাইয়ের দিকে তাকাব। রিয়াজ ভাই বলবেন, Sorry, I made a mistake. তারপর উঠে চলে যাবেন।
তোমার কী ডায়ালগ?
আমার কোনো ডায়ালগ নেই। ক্লোজ ট্রিটমেন্টের সিকোয়েন্স তো। এইসব সিকোয়েন্সে ডায়ালগ দিলে সিকোয়েন্স পড়ে যায়। এইসব সিকোয়েন্স হলো এক্সপ্রেশনের খেলা।
তুমি কী এক্সপ্রেশন দেবে?
আমার সঙ্গে চল। নিজের চোখে দেখবি। এই ধরনের সিকোয়েন্স দেখার মধ্যেও মজা আছে। নানান দিক থেকে লাইট করবে। ব্যাক লাইট দিবে। ব্যাক লাইট কি জানিস?
না।
পেছন থেকে যে লাইট দেয় তাকে বলে ব্যাক লাইট। ব্যাক লাইট দিলে চেহারা ফুটে উঠে। আমার পেছনে যখন ব্যাক লাইট দিবে তখন দেখবি চেহারা কেমন বদলে যায়। আমাকে রাজকন্যার মতো লাগবে।
নীলা ফুপুর অভিনয় দেখতে না যাওয়াই ভালো ছিল। পরিচালক সাহেব (মুকুল ভাই না, অন্য একজন) এমন ধমক শুরু করলেন। ধমকের ভাষাও খারাপ— এই গাধী মেয়েকে কে এনেছে? হাত-পা শক্ত করে বসে আছে। কেউ একজন এর গালে একটা থাপ্পড় দাও তো। এই মেয়ে, তুমি আগে আগে মাথা ঘোরাও কেন? আবার যদি আগে আগে মাথা ঘোরাও ঘাড় মটকে দেব। গাধীর গাধী!
পরিচালক সাহেবকে আমি দোষ দিতে পারি না। নীলা ফুপু আসলেই কিছু পারছে না। অ্যাকশান বলার আগপর্যন্ত ঠিক আছে। অ্যাকশান বলার পরপরই উনার হাত-পা-মুখ সব শক্ত। নিঃশ্বাসও বন্ধ। জীবন্ত মানুষ থেকে হঠাৎ তিনি মূর্তি হয়ে যাচ্ছেন। নায়ক তার পেছনে দাঁড়ানো মাত্রই তিনি আড়চোখে তাকাবেন। তাকিয়ে শরীরে ছোট্ট ঝাঁকি দেবেন।
শেষপর্যন্ত টেক ওকে হলো। তবে পরিচালকের মন মতো হলো না। তিনি তার অ্যাসিসটেন্টকে বললেন, এই গাধীকে আবার যদি কল দিয়ে আনো, তোমাকে আমি কানে ধরে উঠবোস করাব। ত্রিশ সেকেন্ডের সিকোয়েন্সে একঘণ্টা খেয়ে ফেলেছে।
নীলা ফুপু বেশ স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয় নি। তিনি তার নিজের জন্যে এবং আমার জন্যে দুকাপ চা নিয়ে নিলেন। চাপা গলায় বললেন, প্রডাকশনের লেবু চা, খেয়ে দেখ মজা পাবি। দুপুরে এফডিসির খানা আসবে। মিনিমাম দশ পদের ভর্তা থাকবে। সঙ্গে মাছ গোশত। মাছ গোশত দুটাই কেউ পাবে না। যারা গোশত নিবে তারা মাছ পাবে না। শুধু ডিরেক্টর সাহেব এবং নায়ক-নায়িকা মাছ-গোশত দুপদই পাবে। এটাই নিয়ম। দুপুর পর্যন্ত থাক, খেয়ে যা।
আমি বললাম, তোমার কি আরো সিকোয়েন্স আছে?
আর নেই। তবু থাকতে হয়। একটা ইউনিটের সঙ্গে আছি, কাজ নেই বলে চলে যাওয়া তো ঠিক না।
তুমি বরং চলেই যাও। ডিরেক্টর সাহেব যেমন রেগেছেন। তোমাকে মারবেন।
তুই কী যে বলিস! টেক-এর সময় উনি সবাইকে ধমকা ধমকি করেন। সিকোয়েন্স শেষ হয়ে গেলে আবার মাটির মানুষ। সবার সঙ্গে হাসি খুশি জোক বলছেন, মজা করছেন। আর তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই।
কোনো দরকার নেই।
দরকার আছে। তার ধারণা হয়েছে, উনি আমার ওপর রেগে আছেন। ধারণাটা কত ভুল এক্ষুনি প্রমাণ পাবি।
আমার প্রমাণের দরকার নেই।
আয় তো।
নীলা ফুপু আমার হাত ধরে প্রায় টেনেই ডিরেক্টর সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি মুখভর্তি করে পান খাচ্ছিলেন। এক হাতে আবার চায়ের কাপ। পান এবং চা কি একসঙ্গেই খাচ্ছেন? অসম্ভব না। এরা তো আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষ না।