তালুকদার সাহেব বললেন, এখন তাহলে একটা কথা বলি? উনি এখনো আপনার স্বামী। আপনি ডিভোর্স করলে স্বামী থাকবে না। তবে এখন ডিভোর্স করা ঠিক হবে না। মামলা দুর্বল হয়ে যাবে।
মা বললেন, মামলা দুর্বল হয় এমন কিছুই আমি করব না। ঐ বদটা সারাজীবনের জন্যে জেলে থাকতে পারে কি-না সেটা দেখেন।
আপা, সেটা সম্ভব হবে না। সাত বছরের বেশি আমি পারব না। ঐ গ্যারান্টি আপনাকে আমি দিচ্ছি। আমি গ্যারান্টি দিয়ে মামলা চালাই। বিনা গ্যারান্টিতে মোহম্মদ কায়েস উদ্দিন তালুকদার মামলা নেয় না।
বাবার মতো ঘড়েল লোক তালুকদারের প্যাচে পড়ে সাত বছরের জন্যে জেলে যাবেন লাবড়া খেতে, এটা আমার কখনোই মনে হয় নি। মামলার প্রথম তারিখেই আমার সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হলো। মা যে বাবাকে অনেক আগেই দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি দিয়েছেন সেই কাগজ (নোটারি পাবলিক দিয়ে নোটিফাই করানো। সঙ্গে ওয়ার্ড কমিশনারের কাগজ, যে দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতির বিষয়টি তার জানা আছে) জমা দিলেন।
আমাদের উকিল সাহেব মাকে বললেন, তাহলে একটা কথা বলি? আপনার দুষ্ট হ্যাসবেন্ড যে এরকম একটা স্টেপ নিবে তা আমার হিসাবের মধ্যে আছে। সব রোগের যেমন চিকিৎসা আছে, এই রোগেরও চিকিৎসা আছে। দেখেন কী করি?
মা বললেন, কী করবেন?
মামলার কাগজপত্রের নকল নিয়ে এসেছি। আপনার সই জাল করা হয়েছে এটা প্রমাণ করব, ওয়ার্ড কমিশনারের চিঠিও যে জাল তাও প্রমাণ করব। এতে আমাদের মামলা আরো শক্ত হবে–সাত বছরের জায়গায় আট-ন বছরের বাসস্থান উনার জোগাড় হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।
মা কোর্টের কাগজপত্র দেখে শুকনা মুখে বললেন, সই তো জাল না। সই আমার।
কখন সই করলেন?
কখন সই করেছি মনে নাই। তবে সাদা কাগজে সই করেছি। ঐ বদ নানান সময়ে কাগজপত্রে আমার সই নিয়েছে। এই বাড়ি তো আমার নামে, বাড়ির ট্যাক্স দিতে হবে, হেনতেন বলে সই করিয়েছে।
আপা, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। এই হিসাবও আমার আছে। আমি বিনা হিসাবে কাজ করি না। একজন সাধারণ মানুষ ঘুঘু দেখলে ফাঁদ দেখে না। ফঁদ দেখলে ঘুঘু দেখে না। আমি আপনাদের দশজনের দোয়ায় দুটাই একসঙ্গে দেখি। ব্যবস্থা নিচ্ছি।
কী ব্যবস্থা?
যথাসময়ে জানবেন। প্রথমে যেটা দেখতে হবে— বাড়িঘর এখনো আপনার নামে আছে, না-কি এখানেও কিছু দুই নম্বরি করা হয়েছে। এক সপ্তাহের ভেতর আপনি বাড়িঘরের টু পিকচার পাবেন। এখন আপনাকে একটা কথা বলি, ধৈর্য ধরুন।
বদটা জেলে যাবে তো?
অবশ্যই।
সাত বছর?
মিনিমাম সাত। বেশিও হতে পারে। আপাতত জেলের চিন্তা মাথা থেকে দূর করতে হবে। প্রায়োরিটি বেসিসে কাজ করতে হবে। বাড়িঘর ঠিক আছে কি-না আগে দেখতে হবে। প্রায়োরিটি লিস্টে এটা নাম্বার ওয়ান।
এক সপ্তাহের মধ্যে জানা গেল, বাড়িঘর ঠিক ঠাক আছে। আফিয়া মহল মার নামেই আছে। তার নামেই নাম জারি করা হয়েছে। মিউনিসিপ্যালটি ট্যাক্সও তার নামেই দেয়া হচ্ছে।
বাবার সাম্প্রতিক খবরে বিন্দুমাত্র বিচলিত যিনি হলেন না, তিনি বড়খালামাজেদা বেগম। তিনি বিচলিত লোডশেডিং নিয়ে। আমার সঙ্গে এই নিয়ে তার দীর্ঘ আলাপ হয়। তিনি হতাশ গলায় বলেন, এটা কী অবস্থারে বাবলু? এক ঘণ্টা কারেন্ট না থাকা সহ্য করা যায় দেড় ঘণ্টা দুঘণ্টা এসি ছাড়া মানুষ বাঁচবে কীভাবে?
ঠিকই বলেছ, এসি ওয়ালাদের বিরাট দুর্ভোগ।
ভোল্টেজ কী রকম উঠানামা করে দেখেছিস? যে-কোনোদিন কম্প্রেসার জ্বলে যাবে। তখন উপায় কী হবে?
আরেকটা এসি কিনবে। তোমার তো টাকার অভাব নেই।
সেইটা যখন জ্বলে যাবে তখন?
তখন আরেকটা।
উন্মাদের মতো কথা বলিস না তো বাবলু। তোর কথাবার্তা বদ্ধ উন্মাদের মতো। আমি একটার পর একটা কিনতেই থাকব? তুই আছিস নিজেকে নিয়ে। অন্যের দুঃখ-কষ্ট তোর মাথায় ঢোকে না। পরশু রাতে কী হয়েছে জানিস?
না। বলো।
রাতে আরাম করে ঘুমাচ্ছি। ঘর ঠাণ্ডা। এসি চলছে। হঠাৎ স্বপ্নে দেখলাম, এসিটা বাস্ট হয়েছে। সেখানে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আমি ঘর থেকে বের হতে গেলাম, দেখি আমার প্যারালিসিসের মতো হয়েছে, বিছানা থেকে নামতে পারা দূরের কথা, শোয়া থেকে উঠে বসতেও পারছি না। এদিকে এসির আগুন বাড়ছে। গায়ে আগুনের আঁচ লাগছে। শরীর পুড়ে যাচ্ছে। তখন ঘুম ভাঙল। দেখি এসি বন্ধ। লোডশেডিং না কী যেন হয়েছে কে জানে! ঘরের ভেতরে অসহ্য গরম। আমি মাথায় পানি ঢাললাম, সারা গায়ে পানি ঢাললাম, বিছানায় পানি ঢাললাম, তাতেও গরম কমে না। কারেন্ট এলো ভোর চারটা তেইশ মিনিটে, তখন ঘুমাতে গেলাম। বুঝলি অবস্থা?
তোমার জন্যে অবস্থা যে খারাপ এটা বুঝতে পারছি।
তুই এসির লোককে খবর দে তো। সার্ভিসিং করে দিক।
গত মাসে তো একবার সার্ভিসিং করল।
আরেকবার করুক। সার্ভিসিং যত করবি তত ভালো।
আচ্ছা খবর দেব।
এখন তুই ঘর থেকে যা, আমার গরম বেশি লাগছে। গায়ের কাপড়-চোপড় খুলে গায়ে এসির ঠাণ্ডা বাতাস মাখব। বনের পশুরা কী আরামে থাকে, একবার ভেবেছিস? কাপড় পরতে হয় না…
বাবার বিষয় নিয়ে আরো একজন নির্বিকার। তিনি নীলা ফুপু। বাসায় কী হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে ফুপুর মাথাব্যথা নেই। তাঁর ধ্যান-স্বপ্ন প্যাকেজ নাটক। পরিচালক মুকুল ভাই, নাটকের লোকজন অভিনেতা, অভিনেত্রী, ক্যামেরাম্যান, মেকাপম্যান, লাইটম্যান। বাসায় তিনি যতক্ষণ থাকেন ততক্ষণ তার হাতে মোবাইল টেলিফোন থাকে। তিনি হাঁটতে হাঁটতে নাটকের সঙ্গে যুক্ত কারো না কারো সঙ্গে গল্প করেন।