আমরা মহানন্দে আম খেয়ে যাচ্ছি। আগুনঝরা রোদ উঠেছে। কাক রোদবৃষ্টি নিয়ে মাথা ঘামায় না, আজ তারাও ছায়া খুঁজছে। কয়েকটা কাক কাঁঠাল গাছের ছায়ায় বসে ঝিমাচ্ছে। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে। আকাশ নীল কাচের মতো ঝকঝকে। আকাশের দিকে তাকালে দৃষ্টি ঠিকরে আসে।
খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, লু হাওয়ার মতো গরম হাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ কোত্থেকে যেন শীতল হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। যতবারই এই হাওয়া লাগছে ততবারই আমি চমকে উঠছি। রমজান মিয়া গামছা দিয়ে মুখে লেগে থাকা আমের রস মুছতে মুছতে বলল, এই যে ঠাণ্ডা হাওয়া হঠাৎ কইরা আহে, এই হাওয়ার নাম লিলুয়া বাতাস। আল্লাহপাক তাঁর রহমতের জানালা মাঝেমধ্যে খোলেন, তখন এই হাওয়া আহে। আইজ আমাদের উপরে আল্লাহর রহমত নাজেল হইছে। সোবাহানাল্লাহ।
আমার মার নাম আফিয়া বেগম
আমার মার নাম আফিয়া বেগম। এমন কোনো বড় নাম না, তারপরেও এই নামটা ছোট করে বাবা ডাকতেন আফি। ই-কারের টান যখন দীর্ঘ হতো তখন বোঝা যেত বাবার মেজাজ শরিফ। এখানেই শেষ না, নাম নিয়ে বাবার দুটা ছড়াও ছিল। যেমন—
১
আফি আফি
করতে হবে মাফি
২
আফি আফি
You are কাফি
প্রথম ছড়াটা বাবা বেশি বলতেন। মার চোখে মুখে তখন আনন্দ ঝরে পড়ত। মা হচ্ছেন স্বামীর প্রতিভায় মুগ্ধ হওয়া গোত্রের মহিলা। এই জাতীয় মহিলাদের চোখে একধরনের অদৃশ্য চশমা থাকে। যে চশমা স্বামীদের যাবতীয় ত্রুটি ফিল্টার করে রেখে দেয়। তাদের চোখে স্বামীদের গুণাবলিই শুধু ধরা পড়ে।
আমরা যখন ভাড়াবাড়িতে থাকতাম তখন বাবা প্রথম মিল্লাত কোম্পানির একটা সিলিং ফ্যান কিনলেন। সেই ফ্যান বসার ঘরে লাগানো হলো। সুইচ টেপার পর ফ্যান থেকে বৃদ্ধ মানুষদের ধারাবাহিক কাশির মতো ঘড়ঘড় আওয়াজ হতে লাগল। আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। ভাইয়া বলে ফেলল, এত শব্দ! মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ফ্যানে একটু আধটু শব্দ তো হবেই। হাওয়া কত এটা দেখবি না? ঝড়-তুফানের মতো হাওয়া।
বাবা বললেন, ফ্যানটা বদলায়ে নিয়ে আসি?
মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তুমি আবার কষ্ট করে গরমের মধ্যে ফ্যান নিয়ে যাবে! কোনো দরকার নেই। ফ্যানে শব্দ হওয়া ভালো, বোঝা যায় একটা জিনিস চলছে।
মার প্রতি বাবার প্রেমও চোখে পড়ার মতোই। যে দোতলা বাড়িতে আমরা বাস করছি (তিনতলার ফাউন্ডেশন, দোতলা) তার নাম আফিয়া মহল। বাড়ির গেটে শ্বেতপাথরে বাড়ির নাম লেখা আছে। বাবার ঝোক হচ্ছে সস্তায় কাজ করানো। শ্বেতপাথরের নামফলকটাও তিনি অতি সস্তায় করিয়েছেন বলে এক বছরের মাথায় আফিয়ার অ এবং মহলের ম উঠে গেল।
এখন আমাদের বাড়ির নাম—
আফিয়া হল
যেদিন বাড়িতে শ্বেতপাথরের নাম লাগানো হলো সেদিন বাবা কাঁপা কাঁপা গলায় ঘোষণা করলেন, সম্রাট শাহজাহান তাজমহল বানিয়ে ছিলেন, আমি বানালাম আফিয়া মহল। ইনশাল্লাহ আমি আগামী দুই এক বছরের মধ্যে তিন তলাটা কমপ্লিট করে দেব। তিনতলার আলাদা নাম হবে—
আফিয়া আলয়
পুরা তিনতলা হবে আফিয়ার একার সংসার। তার শোবার ঘর, তার বসার ঘর, সাজের ঘর এবং নামাজ ঘর। আফিয়ার অনুমতি ছাড়া তিনতলায় কেউ যেতে পারবে না। এমনকি আমি যদি যাই আমারও অনুমতি লাগবে।
বাবার কথাবার্তায় আমাদের হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু মা কেঁদে কেটে অস্থির।
বাড়ি দোতলা পর্যন্ত হবার পর বাবা মানত রক্ষার জন্যে মাকে নিয়ে আজমির শরিফ গেলেন। পথে দিল্লিতে তারা তাজমহল দেখলেন। তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে ফটোগ্রাফারদের দিয়ে ছবি তুললেন। সেই ছবিও অনেক কায়দার ছবি। দুজন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়েছেন। দুজনের হাতের ফাঁক দিয়ে তাজমহল দেখা যাচ্ছে। এই ছবি বাঁধাই করে আমাদের বসার ঘরে f
সেই ছবিটা গতকাল সকালে সরানো হয়েছে। শুধু এই ছবি না, বাবার সব ছবিই নামানো হয়েছে। মার ঘরে বাবার তিনটা ছবি ছিল। তিনি ব্যবসার জন্যে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন, তখন তোলা ছবি। প্রতিটি ছবিতে তাঁর চোখে কালো চশমা ঠোঁটে পাইপ।
মার ঘরে বিশেষ ভঙ্গিমায় তোলা এই ছবিগুলি শুধু যে নামানো হলো তা, কাজের মেয়েকে বলা হয়েছে শিল-পাটার শিল দিয়ে ছবির কাচগুলি ভাঙতে। সে কাচ ভাঙতে গিয়ে নিজের হাতও কেটেছে। এমনই কেটেছে যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে স্টিচও করাতে হয়েছে।
বাবার বিষয়ে ভাইয়া এবং মা মিলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা হলো
১. এই বদলোক কখনো বাড়িতে ঢুকতে পারবে না।
২. এই বদের নাম বাড়িতে কেউ উচ্চারণ করতে পারবে না।
৩. বদটার নামে স্ত্রীর অনুমতি ছাড়াই দ্বিতীয় বিবাহ এবং নারী নির্যাতন আইনে মামলা করা হবে। [মামলা করা হয়ে গেছে।]
৪. বদটাকে জেলের ভাত খেতে হবে।
মার পক্ষে যে উকিল মামলা পরিচালনা করছেন তার নাম মোহম্মদ কায়েস উদ্দিন তালুকদার। এই কায়েস উদ্দিন সাহেবের হাবভাব চোরের মতো। তিনি স্থির হয়ে কারো দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারেন না। সারাক্ষণ এদিক-ওদিক করেন। তাঁর মুদ্রাদোষ হচ্ছে প্রতিটি কথার আগে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলবেন— এখন তাহলে একটা কথা বলি?
তালুকদার সাহেব মাকে বললেন— এখন তাহলে একটা কথা বলি? ভাবি সাহেব শুনেন, আমি যদি আপনার স্বামীকে সাত বছর জেলখানার লাবড়া না খাওয়াতে পারি তাহলে আমি বাকি জীবন ভাত খাব না। পাঞ্জাবিদের মতো রুটি খাব। বড়বোন হিসেবে আপনার কাছে এই আমার ওয়াদা।
মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আপনার স্বামী আপনার স্বামী করছেন কেন? সে কি আমার স্বামী?