জহির ভাই আওয়ামী লীগের লোক না-কি বিএনপির লোক আমি জানি না। একটা জিনিস জানি, তাঁকে দেখতে যাওয়া দরকার। ভাইয়ার নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করেই যেতে হবে। কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে উপস্থিত হতে হবে। তিনি কোথায় আছেন এই তথ্য এখন জানি। পত্রিকায় লিখেছে।
জহির ভাই খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আমাকে দেখে একপলক তাকিয়ে আবার কাগজ পড়ায় মন দিলেন। তার ডান হাতে ব্যান্ডেজ। একহাতে পত্রিকা ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। ফ্যানের বাতাসে পত্রিকা এলোমেলো হচ্ছে। সামলানো যাচ্ছে না। জহির ভাইকে রাখা হয়েছে কেবিনে। কেবিনের দরজার সামনে একজন বন্দুকধারী পুলিশ। সে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করছে না। যার ইচ্ছা জহির ভাইয়ের কেবিনে ঢুকছে, বের হচ্ছে।
আমি খাটের পাশে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, কেমন আছ?
জহির ভাই বললেন, কাগজ পড়ছি দেখছিস না! পড়া শেষ করি, তারপর আলাপ।
আমি কি কাগজটা ধরব? তুমি তো একহাতে কাগজ ধরতে পারছ না?
জহির ভাই জবাব দিলেন না। আমি কেবিনের সাজসজ্জা দেখায় মন দিলাম। ঘরটা বেশ বড়। সঙ্গে এটাচড টয়লেট। টয়লেট থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে। হাসপাতালের কেবিনের টয়লেটে পানির কল নষ্ট থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আমি যে কয়বার হাসপাতালের কেবিনে গিয়েছি, প্রতিবারই এই জিনিস দেখেছি।
খাটের মাথার দিকে সাদা রঙ করা লোহার টেবিল। যেখানে যেখানে রঙ উঠে গেছে সেখানে লোহায় মরিচা পড়ে গেছে। টেবিলে কমলা এবং আঙুর রাখা আছে। বাংলাদেশে ফলের ব্যাপারে বিপ্লব হয়ে গেছে। সারা বছরই কমলা, আঙুর, আপেল পাওয়া যায়। রোগী দেখতে লোকজন কমলাই বেশি নিয়ে যায়। আমি এখন পর্যন্ত কাউকে আম নিয়ে রোগী দেখতে যেতে দেখি নি। রোগীদের জন্যে আম কি নিষিদ্ধ? আমের কথায় মনে পড়ল, বড়খালার জন্যে খিরসাপাতি আম কিনতে হবে। তিনি টাকা দিয়ে দিয়েছেন। খিরসাপাতি আমের কেজি কত টাকা করে কে জানে?
জহির ভাই পত্রিকা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে বালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন।
আমি বললাম, হাসপাতালে সিগারেট খেতে দেয়?
জহির ভাই বললেন, দিবে না কেন? হাসপাতাল তো আর মসজিদ না, যে, কোনো নেশা করা যাবে না।
তুমি আছ কেমন?
ভালো। ইচ্ছা করলে আজই রিলিজ নিয়ে চলে যেতে পারি। যাচ্ছি না, ঠিক করেছি কিছু দিন রেস্ট নেব। রেস্ট নেবার জন্যে হাসপাতাল খারাপ না।
খাওয়া কি হাসপাতাল থেকে দেয়?
দেয়। খাওয়া সুবিধার না, আমি হোটেল থেকে খাওয়া আনাই। এখানে ডাক্তারদের একটা ক্যান্টিন আছে, তারা দুপুরে ভালো বিরানি বানায়। দুপুর পর্যন্ত থাক, বিরানি খেয়ে যা।
আচ্ছা। জহির ভাই, তোমাকে কিন্তু সুন্দর লাগছে। কয়েকদিন শেভ না করায় খোঁচা খোঁচা দাড়ি বের হওয়ায় চেহারা বদলে গেছে।
সাধু সাধু চেহারা হয়েছে না?
হুঁ।
চা খাবি?
খাব।
না-কি কফি খাবি? ক্যান্টিনে কফিও পাওয়া যায়। দশ টাকা কাপ।
কফিও খেতে পারি।
জহির ভাই শোয়া থেকে আধশোয়া হলেন। তাঁর হাতে সিগারেট। তিনি খুবই আরাম করে সিগারেট টানছেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সব মানুষের আলাদা কিছু বিশেষত্ব থাকে। তোর বিশেষত্ব কী জানিস?
না।
তোর বিশেষত্ব হচ্ছে, তুই কোনো কিছুতেই না বলতে পারিস না। বিরানি খেতে বললাম, তুই রাজি। চা খেতে বললাম রাজি। কফি খেতে বললাম তাতেও রাজি। তুই কি না বলতে পারিস না?
না।
তুই অনেকক্ষণ হয়েছে আমার কাছে এসেছিস। এখনো একবারও জিজ্ঞেস করিস নি, ঐ রাতে কী ঘটেছিল। এটাও তোর একটা বিশেষত্ব।
তোমার বিশেষত্ব কী?
আমারটা আমি বলব কেন, তুই বলবি। এক্ষুনি বলতে হবে না। চিন্তা ভাবনা করে বের কর, তারপর তোর কাছ থেকে জেনে নেব। টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে মানিব্যাগ বের কর। পঞ্চাশ টাকার একটা নোট পুলিশ ভাইজানকে দে, তিন কাপ কফি নিয়ে আসবে। সে নিজে এককাপ খাবে। আর পনেরশ টাকা তোর। ধার নিয়েছিলাম, ধার শোধ করলাম। ঐ রাতে মরে গেলে তো ধার শোধ হতো না।
জহির ভাই হাসছেন। একটা মানুষের হাসি এত সুন্দর! এখন কেবিনে শুধু আমরা দুজন। পুলিশ ভাইজান কফি আনতে আগ্রহের সঙ্গেই গিয়েছেন। জহির ভাইয়ের কাছে শুনেছি, সে কোনো বাজার সদাইয়ের কাজ খুব আগ্রহের সঙ্গে করে, শুধু টাকা ফেরত দেয় না। একশ টাকার নোট দিয়ে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট আনতে তাকে পাঠালে সে সিগারেট আনবে। সঙ্গে দুটা দেয়াশলাই আনবে, শুধু বাকি টাকাটা ফেরত দেবে না। এমন ভাব করবে যেন এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট এবং দুটা দেয়াশলাইয়ের দাম কাঁটায় কাঁটায় একশ টাকা।
বাবলু!
জি জহির ভাই।
আজকের কাগজে বিনোদন পাতা ছাপা হয়েছে। সেটা পড়েছিস?
না।
নীলার ছবি ছাপা হয়েছে বিনোদন পাতায়।
তাই নাকি?
পরিচালক মুকুল সাহেব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন, এরকম একটা ছবি। নীলা আছে পরিচালকের পাশে, সে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। পরিচালক সাহেবের কথা গিলছে এমন ভাব। পেপারটা হাতে নিয়ে ছবিটা দেখ।
আমি ছবি দেখলাম। জহির ভাই ভুল বলেন নি। নীলা ফুপু সত্যি সত্যি বিকট হাঁ করে আছে। নীলা ফুপু জহির ভাইয়ের চেয়ে এক দুবছরের ছোট। জহির ভাই তাকে সে জন্যেই নাম ধরে ডাকে। সম্পর্ক হিসেবে জহির ভাইয়েরও উচিত তাকে ফুপু ডাকা। তা সে ডাকবে না। আমার ক্ষীণ সন্দেহ, জহির ভাই নীলা ফুপুকে খুবই পছন্দ করে। যদিও এই পছন্দের ব্যাপারটা সে কখনো বলে নি। একবার ফুপুর অ্যাপেন্ডিস অপারেশন হয়। তাঁকে সারারাত হাসপাতালে থাকতে হলো। জহির ভাইও সারারাত কাটালেন হাসপাতালের বারান্দায়।