যূথী বলল, ভালো না। আমার জ্বর। কপালে হাত দিয়ে দেখ।
সে মাথা আমার দিকে এগিয়ে দিল। নিতান্ত অপরিচিত একজনের সঙ্গে কী সহজ স্বাভাবিক আচরণ! আমি কপালে হাত দিলাম। যূথী ভুল বলে নি। তার সত্যিই জ্বর। একশর ওপর তো হবেই। এই জ্বর নিয়ে মেয়েটা নিজের মনে খেলছে। নিশ্চয়ই খুব লক্ষ্মী মেয়ে।
যূথী, তোমার কি অনেক খেলনা?
হুঁ। আমার একশ কোটি খেলনা।
কোন খেলনাটা তোমার সবচে প্রিয়?
আমার একটা তুলার হাতি আছে— সবচে প্রিয়।
দেখি হাতিটা।
কীভাবে দেখবে! হারিয়ে গেছে তো।
তুমি খেলনা দিয়ে খেলা ছাড়া আর কী কর?
আর কিছু করি না।
কেন, টিভি দেখ না?
আমাদের টিভি নেই। বাবা গরিব তো, এই জন্যে টিভি নেই। গরিবদের টিভি থাকে না।
গরিবদের আর কী থাকে না?
ফ্রিজ থাকে না। কিন্তু আমাদের ফ্রিজ আছে। তুমি ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি খাবে?
খাব।
আচ্ছা আমি এনে দেব। আমার ঠাণ্ডা পানি খাওয়া নিষেধ। ঠাণ্ডা পানি খেলে আমার গলা ব্যথা হয়, এই জন্যে নিষেধ।
যূথী উঠে চলে গেল এবং গ্লাস ভর্তি করে ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এলো। যূথীর মা তখন ঢুকছেন চা নিয়ে। চায়ের কাপ আমার সামনে রাখতে রাখতে চাপা গলায় বললেন, বাবা, চা খাও।
তার মুখে বাবা ডাক শুনতে অস্বস্তি লাগছে। তারও মনে হয় অস্বস্তি লাগছে। তিনি একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছেন না। আমি বললাম, ঘরে কি থার্মোমিটার আছে? যূথীর জ্বর কত দেখতাম।
ভদ্রমহিলা উঠে গেলেন এবং আমাকে থার্মোমিটার এনে দিলেন। তার চোখে কৌতূহল। তিনি থেমে থেমে বললেন (এখনো আমার দিকে তাকাচ্ছেন না), মেয়েটার প্রায়ই জ্বর হয়। তোমার বাবাকে প্রায়ই বলি, ভালো একজন ডাক্তার দেখাতে। সে সময় পায় না।
আমি যূথীর জ্বর দেখলাম, একশ এক। যূথীর মা যূথীকে শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। বসার ঘরে আমি একা বসে আছি। বাবা দশ মিনিটের কথা বলে গেছেন। আধাঘণ্টা পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে যূথীর মা এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন। তাঁর দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতে অস্বস্তি, লজ্জা এবং কিছুটা ভয়। আমি বললাম, কিছু বলবেন?
উনি বললেন, তোমাদের বাসায় কি সব জানাজানি হয়ে গেছে?
আমি বললাম, জি।
আল্লাগো, এখন কী জানি হয়!
এই ফ্ল্যাট বাড়িটা কি আপনাদের?
না। এক অ্যাডভোকেট সাহেবের বাড়ি। তোমার বাবা ভাড়া নিয়েছেন।
ভাড়া কত?
সবকিছু নিয়ে চার হাজার টাকা। তুমি কি আরেক কাপ চা খাবে? বানিয়ে দিব?
না। আমি ঘনঘন চা খাই না।
এই ফ্ল্যাটের বারান্দা আছে। বারান্দাটা সুন্দর। বারান্দায় বসবে?
না।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগবে। বারান্দায় বসো, আমি আরেক কাপ চা বানিয়ে দেই, চা খাও। তোমার বাবার আসতে অনেক দেরি হবে। বাজার করতে উনার খুব দেরি হয়।
ভদ্রমহিলার আগ্রহের কারণেই বারান্দায় বসলাম। ছোট্ট বারান্দা। পাশাপাশি দুটা মোড়া পাতা। বেশ কিছু টব। একটা টবে নীল অপরাজিতার লতানো গাছ। গাছ অনেক বড় হয়েছে। আরেকটা টবে সাদা সাদা ছোট ফুল। নাম জানি না কিন্তু সুন্দর গন্ধ।
বারান্দা সুন্দর না?
হুঁ।
যূথীকে এই বারান্দায় আসতে দেই না।
কেন?
আমাদের ঠিক উপরের তলার বারান্দা থেকে একটা ছেলে নিচে পড়ে গেছে। চারতলা থেকে পড়েছে, কিন্তু কিছুই হয় নি। নিচে কনস্ট্রাকশানের জন্যে বালি রাখা হয়েছিল। ছেলেটা পড়েছে বালিতে, এই জন্যে কিছু হয় নি।
আমি বারান্দার মোড়ায় বসে আছি—ভদ্রমহিলা ঠিক আমার পেছনে দরজা ধরে দাঁড়ানো। তাঁর দ্বিধা এবং সংকোচ মনে হয় সামান্য কমেছে।
ঐ ছেলেটার নাম টগর। খুব দুরন্ত ছেলে। আমাদের বাসায় প্রায়ই আসে। যূথীর সঙ্গে খেলে।
আমি ও আচ্ছা বলে চুপ করে গেলাম। ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। বারান্দা থেকে বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগছে।
তোমার বাবাকে অনেকদিন বলেছি তোমার মার কাছে সব স্বীকার করতে। সে রাজি না। তাঁর এক পীর সাহেব আছে, সেই পীর সাহেব বলেছে সব আপনা আপনি মিটমাট হবে।
ও আচ্ছা।
উনার মন দুর্বল তো, এই জন্যে শুধু পীর-ফকির করে। প্রায়ই শুনি অমুক পীরের কাছে গেছে, তমুক পীরের কাছে গেছে। আপনি পীর-ফকির বিশ্বাস করেন না?
না। এখন উনার এক পীর জুটেছে, সেই পীরের কাজ না-কি শুধু হাঁটা। পীর সাহেব হাঁটেন, পীর সাহেবের সঙ্গে তাঁর লোকজন হাঁটে। তোমার বাবা। উনার কাছে যখন যান তখন বিরাট ঝামেলা হয়।
কী ঝামেলা?
ছয়-সাত মাইল হেঁটে আসেন তো। পা ফুলে যায়। পায়ে সঁক দিতে হয়। পা টিপে দিতে হয়। তোমার মার রান্না না-কি খুব ভালো?
জি ভালো।
তোমার বাবা আমাকে বলেছেন। আমি রাধতে পারি না। কখনোই আমার লবণের আন্দাজ হয় না। হয় বেশি হবে নয় কম হবে।
ও আচ্ছা।
বাসায় ফিরলাম রাত বারোটার দিকে
বাসায় ফিরলাম রাত বারোটার দিকে। বাবা নিউ বিরানি হাউজ পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। গলা নিচু করে বললেন, My son, বাকি রাস্তা একা একা যেতে পারবি না? আমি বললাম, পারব।
বাবা বললেন, Thats good. এই মুহূর্তে ওদের সামনে পড়তে চাই না। বিসমিল্লাহ বলে চলে যা। আল্লাহু শাফি। আল্লাহু কাফি।
বাসায় এসে দেখি হুলস্থুল কাণ্ড। দি ইমেজ-এর সামনে অনেক লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে। পুলিশও আছে। আমাদের বাসার সব লাইটও জ্বলছে। বারান্দায় ভাইয়া এবং মা হাঁটাহাঁটি করছেন। আমি গেটে হাত রাখতেই ভাইয়া ছুটে এসে আমার হাত ধরল।
কই ছিলি এত রাত পর্যন্ত? বাসা খুঁজে পেয়েছিলি?