Site icon BnBoi.Com

রোদনভরা এ বসন্ত – হুমায়ূন আহমেদ

রোদনভরা এ বসন্ত - হুমায়ূন আহমেদ

রাত বারোটা দশ মিনিটে

উৎসর্গ

হিমু নামের কেউ যদি থাকতো তাহলে কোন এক জোছনার রাতে তাকে বলতাম— এই বইটি কেন আপনাকে উৎসর্গ করা হল বলুনতো? দেখি আপনার কেমন বুদ্ধি!

———

০১.

মীরু রাত বারোটা দশ মিনিটে সেভেন পয়েন্ট ফাইভ মিলিগ্রামের একটা ডরমিকাম খেয়েছে। এখন বাজছে একটা পঁচিশ, ঘুমের ওষুধ খাবার পরেও এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট পার হয়েছে। ঘুমের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং ঘুম কেটে যাচ্ছে। দেয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার শব্দ কানে আসছে! ঘুমের ওষুধ খাবার পর দেয়াল ঘড়ির শব্দ কানে আসা খারাপ লক্ষণ। তখন ধরে নিতে হবে–ঘুম কেটে যাচ্ছে।

মীরুর বিরক্তি লাগছে। আজ রাতে তার ঘুম হওয়াটা খুব দরকার। আগামীকাল তার বিয়ে। রাতে এক ফোঁটা ঘুম না হলে বিয়ের দিনে তাকে দেখা যাবে উলুম্বুষের মতো। চোখের নিচে লেপ্টে থাকবে কালি। কপালে এবং গালে তেল জমতে থাকবে। চোখ ইঞ্চিখানিক ডেবে যাবে। মীরুর এই এক সমস্যা, একরাত না ঘুমুলেই চোখ ডেবে যায়, চোখের নিচে ঘন হয়ে কালি পড়ে। কপালে এবং গালে তেলতেলে ভাব চলে আসে। সাবান দিয়ে ঘষলে তেলতেলে ভাব চলে যায় ঠিকই, কিন্তু বিশ-পঁচিশ মিনিট আবার আগের অবস্থা।

যে কোন মূল্যে মীরুকে ঘুমুতে হবে। সে গায়ের চাদর মাথা পর্যন্ত তুলে দিল। মনে মনে বলল, আমি এখন আর কোনো দুঃশ্চিন্তা করছি না। সে দুঃশ্চিন্তাহীন জীবনযাপন করছে এ রকম ভাব করে পাশ ফিরল। ঠিক করল আরো আধঘণ্টা দেখবে তারপর আরেকটা ডরমিকাম খাবে। তাতেও যদি না হয় আরেকটা। দানে দানে তিন দান।

মরিয়ম। মরিয়ম।

মীরু চাদরের ভেতর থেকে মাথা বের করল। তার নাম মরিয়ম না। তার নাম ঐন্দ্রিলা। মরিয়ম নাম অনেক আগেই বাতিল হয়েছে। কিন্তু বাবা এখনো মরিয়ম ডাকেন। অন্যরা মরিয়ম ভেঙে মীরু ডাকে। মীরু পর্যন্ত সহ্য করা যায় কিন্তু দুই হাজার তিন সনে মরিয়ম নাম সহ্য করা যায় না। পুরনো ফ্যাশন ঘুরে ঘুরে আসে। গয়নার জাবদা ডিজাইনগুলি আবার ফিরে এসেছে। একসময় হয়তো মরিয়ম টাইপ নাম রাখা ফ্যাশন হবে। তখন ঐন্দ্রিলা বদলে মরিয়ম রাখা যেতে পারে। এখন মীরুর যীশু খ্রিস্টের মা হবার কোনো শখ নেই।

সে খাট থেকে নামল। ঘুমঘুম ভাব চোখে যা ছিল, খাট থেকে নামতে গিয়ে সবটাই চলে গেল। সে বাবার শোবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

বাবা ডাকছিলে?

আফজল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, ড্রয়িং রুমের দরজাটা বন্ধ কি দেখে তারপর ঘুমুতে যা। আমার ধারণা দরজা খোলা।

মীরু বলল, বাবা ড্রয়িং রুমের দরজা বন্ধ। আমি নিজে বন্ধ করেছি।

আফজল সাহেব বললেন, তোকে দেখতে বলেছি তুই দেখে আয়। এত কথার দরকার কী? কথা বলে যে সময় নষ্ট করলি তারচেয়ে কম সময়ে দেখে আসা যেত দরজা বন্ধ কি বন্ধ না।

মীরু বলল, আমি যাচ্ছি।

আফজল সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, সেই পানি খাবি তবে ঘোলা করে খাবি। দরজা বন্ধ না-কি খোলা আমাকে জানিয়ে তারপর ঘুমুতে যাবি।

তোমাকে জানানোর দরকার কী?

এত ব্যাখ্যা তোকে দিতে পারব না। আমাকে জানাতে বলেছি আমাকে জানাবি।

ড্রয়িং রুমের দরজা খোলা। মীরুর কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগছে। তার স্পষ্ট মনে আছে সে নিজে দরজা বন্ধ করেছে। নিশ্চয়ই কাজের ছেলে জিতু মিয়া এর মধ্যে আছে। তার বয়স নয়-দশের বেশি হবে না। এর মধ্যেই সে সিগারেটে টান দেয়া শুরু করেছে। কাছে গেলেই সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যায়। জিতু নিশ্চয়ই দরজা খুলে বাইরে সিগারেট কিনতে গিয়েছিল। ফিরে এসে দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছে।

মীরু দরজা বন্ধ করে বাবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। শীতল গলায় বলল, বাবা দরজা বন্ধই ছিল। তুমি শুধু শুধু আমাকে পাঠিয়েছ।

তুই দরজা খোলা পেয়েছিস না বন্ধ পেয়েছিস?

আমি বন্ধ পেয়েছি। বাবা তোমাকে তো আমি বলেছিলাম দরজা বন্ধ। আমি নিজে বন্ধ করেছিলাম। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করনি। অন্যকে এত অবিশ্বাস করতে নেই।

আফজল সাহেব চুপ করে রইলেন। জবাব দিলেন না। মীরু ইচ্ছা করে মিথ্যা কথাটা বলল যাতে তার বাবা কিছুটা হলেও অনুশোচনা ভোগ করেন। অন্তত একবার হলেও মনে হয়, আহারে দরজা তো বন্ধই ছিল! শুধু শুধু মেয়েটাকে ঘুম থেকে তুলেছি।

মিথ্যা বলার জন্যে মীরুর তেমন খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। সে গত এক বছর ধরে ক্রমাগত মিথ্যা বলছে। এখন মনে হচ্ছে। মিথ্যা বলাটা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। যেখানে মিথ্যা বলার কোনোই

প্রয়োজন নেই সেখানেও সে মিথ্যা বলছে।

গত সোমবার সে যাচ্ছিল ইউনিভার্সিটিতে। তার মা জাহেদা বললেন, কোথায় যাচ্ছিস?

মীরু বলল, এক বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছি।

মা বললেন, তোর আজ ক্লাস নাই?

মীরু ফুরফুরে গলায় বলল, আছে। ক্লাসে যাব না। বান্ধবীর জন্মদিন। জন্মদিনের পার্টিতে যাব।

দিনের বেলা কীসের পার্টি?

মীরু রাগী রাগী গলায় বলল, সে যদি দিনে পার্টি দেয় আমি কী করব? তাকে বলব যে আমি দিনে আসতে পারব না। আমি আসব রাত দশটার দিকে। তুই রাতে পার্টি দে।

জাহেদা অবাক হয়ে বললেন, ঝগড়া করছিস কেন?

মীরু বলল, ঝগড়া করছি না মা। তোমাকে বিষয়টা বোঝাবার চেষ্টা করছি।

তোর বান্ধবীর বাসা কোথায়?

বাসা কোথায় জানতে চাচ্ছ কেন?

এম্নি জানতে যাচ্ছি।

তুমি এম্নি জানতে চাচ্ছ না। তুমি সন্দেহ করছ বলে জানতে চাচ্ছ।

আমি শুধু শুধু সন্দেহ করব কেন?

তুমি সন্দেহ করবে কারণ সন্দেহ করা হল তোমার অভ্যাস। আমি যে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ফেলি তুমি সেই নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসকেও সন্দেহ কর। মা এক কাজ কর তো, চট করে শাড়িটা বদলে একটা ভালো শাড়ি পর।

কেন?

মীরু শান্ত গলায় বলল, তুমিও যাবে আমার সঙ্গে। নিজের চোখে জন্মদিনের উৎসব দেখবে। এক পিস কেক খাবে। বারান্দায় গিয়ে এক বোতল কোক খাবে।

জাহেদা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তুই আমার সঙ্গে এরকম করছিস কেন?

কথা বাড়িও না তো মা। চট করে শাড়িটা বদলাও। গত ঈদে হালকা সবুজ রঙের যে শাড়িটা কিনেছিলে সেটা পর। ঐ শাড়িটাতে তোমাকে। মানায়। আমি তোমাকে না নিয়ে জন্মদিনের পার্টিতে যাব না। সত্যি যাব না।

জাহেদা কাঁদতে বসলেন। মীরু চলে গেল ইউনিভার্সিটিতে। এই কাজগুলি সে কেন করে নিজেও জানে না। তারচেয়ে বড় কথা তার একটুও খারাপ লাগে না। গত একবছর ধরে বাসার প্রতিটি মানুষকে তার অসহ্য লাগছে। বাজারে ডিনামাইট কিনতে পাওয়া গেলে ডিনামাইট দিয়ে সে তাদের কলাবাগানের এই বাড়ি উড়িয়ে দিত। ডিনামাইট কোথায় পাওয়া। যায় মীরু জানে না। আলফ্রেড নোবেল সাহেব বেঁচে থাকলে সে তাকে একটা চিঠি লিখত, স্যার আমাকে কিছু ডিনামাইট পাঠাবেন? আমি খুব কষ্টে আছি। ইতি আপনার বাধ্যগত ঐন্দ্রিলা।

আবার বিছানায় ওঠার আগে মীরু বাথরুমে ঢুকে মাথায় পানি ঢালল। মাথার দুপাশের শিরা দপদপ করছে। পানি ঢালার কারণে মাথার দপদপানি না কমে আরো যেন বেড়ে গেল। দেয়াল ঘড়িতে এখন মনে হয় মাইক ফিট করা হয়েছে। হাতুড়ি পেটার মত শব্দ আসছে। টক টক। টক টক।

বিয়ের আগের রাতে সব মেয়েরই কি এরকম হয়? আচ্ছা বাংলাদেশে এমন মেয়ে কি আছে যে বিয়ের আগের রাতে ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুমুতে পেরেছে? কেউ না পারলেও তার পারা উচিত ছিল। সব মেয়ে আর সে এক না। সব মেয়ের যা হবে তার তা হবে না। তাছাড়া যাকে সে বিয়ে করছে। তার সঙ্গে সে তিন বছর ধরে ঘটর ঘটর করেছে। সে অপরিচিত কেউ না। তার প্রতিটি খারাপ অভ্যাস মীরু জানে। তার সবচেয়ে খারাপ অভ্যাস হল নাক ঝেড়ে সেই হাত শার্টের কোণায় মুছে ফেলা। প্রথম বার দেখে মীরু হতভম্ব। সে চোখ কপালে তুলে বলল, এটা তুমি কী করলে?

বারসাত তার মতোই অবাক হয়ে বলল, কী করলাম?

নাক ঝেড়ে হাত শার্টে মুছে ফেললে। কী কুৎসিত!

কুৎসিতের কী আছে। সঙ্গে রুমাল নেই।

রুমাল নেই কেন?

এখন কেউ রুমাল নিয়ে ঘোরে না। তুমি পাঁচশ মানুষকে জিজ্ঞেস করে। দেখ তাদের কাছে রুমাল আছে কি না। সবাই বলবে নেই। পকেটে রুমাল রাখার ফ্যাশন চলে গেছে।

তুমি বলতে চাচ্ছ এখন সবাই নাক ঝেড়ে শার্টে হাত মোছে?

আমি বলতে চাচ্ছি যে আমার সঙ্গে রুমাল নেই।

মীরু বলল, তুমি কি জানো তোমার দিকে তাকাতেও আমার ঘেন্না লাগছে?

বারসাত হতাশ গলায় বলল, না জানি না। তোমার দৃষ্টি এত পবিত্র ধারণা ছিল না। এখন আমাকে কি করতে হবে সেটা বল। আমি কি লাইফবয় সাবান দিয়ে গোসল করে আসব? না কি তারকাদের সৌন্দর্য। সাবান লাক্স দিয়ে গোসল করব?

তোমার সঙ্গে এখানেই আমার সম্পর্ক শেষ। তুমি তোমার বাড়ি যাও। আমি আমার বাড়ি যাচ্ছি।

ভেরি গুড।

ভুলেও টেলিফোন করবে না।

  1. K. পবিত্র মহিলা টেলিফোন করব না। নাকের সর্দি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি আর টেলিফোন না।

বারসাত প্রতিজ্ঞা রাখতে পারল না। রাখতে পারবে না মীরু জানে। বারসাত হচ্ছে এমন একজন যুবক যে কোনো প্রতিজ্ঞা রাখতে পারে না। চব্বিশ ঘণ্টা পার হবার আগেই টেলিফোন।

হ্যালো, ঐন্দ্রিলা একটা বিশেষ খবর দেবার জন্য টেলিফোন করেছি।

মীরু গম্ভীর গলায় বলল, বিশেষ খবরটা কী?

বারসাত মীরুর চেয়েও গম্ভীর গলায় বলল, যে হাত দিয়ে আমি নাক ঝেড়েছি ঐ হাত কজি পর্যন্ত কেটে বাদ দিয়েছি। হাত তার শাস্তি পেয়েছে। আশা করি এখন তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে।

হাত কজি পর্যন্ত কেটে বাদ দিয়েছ?

হুঁ, ভ্যানগগ টাইপ। উনি কেটেছিলেন কান আমি কেটেছি হাত। এখন কি আমার সঙ্গে কথা বলা যায়?

হ্যাঁ যায়।

তাহলে চলে এসো–তোমাকে এই সৌরলোকের শ্রেষ্ঠতম ফুচকার দোকানে নিয়ে যাব। রিকশা নিয়ে আমার মেসে চলে এসো। আজ আমাদের ফুচকা ডে। আধা কেজি করে ফুচকা খেয়ে আজ পেটে অসুখ বাধাবই।

তোমার কাটা হাতটা কোথায়?

কাটা হাত এখনো হাতের সঙ্গে লাগানো আছে। তুমি যেদিন বলবে সেদিন কেটে তোমাকে দিয়ে দেব। জার ভর্তি ফরমালিনে কাটা হাতটা প্রিজার্ভ করতে পারবে। তোমার ছেলেমেয়েদের দেখাবে, তারা খুব মজা পাবে।

এরকম মানুষের সঙ্গে রাগ করে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। বিয়ের পরেও মানুষটার স্বভাব-চরিত্র এরকম থাকবে কি না কে জানে। মনে হয় থাকবে না। থাকার কথা না। পুরুষ বদলে যায় স্ত্রীর গায়ের গন্ধে।

মীরু চেয়ারে উঠে দাঁড়াল। দেয়াল ঘড়িটা নামিয়ে পেনসিল ব্যাটারি খুলে ফেলল। সেকেন্ডের কাটার কট কট শব্দের হাত থেকে মুক্তি। মাথার দপদপানি সামান্য কমেছে। এখন অন্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে। টেনশান বেশি হলে মীরুর শ্বাসকষ্ট হয় তখন ইনহেলার নিতে হয়। ভেন্টোলিন ইনহেলার। ডাক্তার বলে দিয়েছেন চেষ্টা করতে হবে ইনহেলার ব্যবহার না করার। একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে মিনিটে মিনিটে ইনহেলার নিতে হবে। মীরু অভ্যস্ত হতে চায় না। অভ্যস্ত হওয়া খুব খারাপ ব্যাপার। কোনো কিছুতেই অভ্যস্ত হওয়া ঠিক না। সে বারসাতের অদ্ভুত ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বিয়ের পর বারসাত যখন স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ করবে তখন নিশ্চয়ই তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে।

নিঃশ্বাসের কষ্টটা দূর করার জন্যে টেনশান কমানো দরকার। আনন্দময় কিছু চিন্তা করলে টেনশান কমবে। সে রকম কোনো চিন্তাই মাথায় আসছে না। নিজের বিয়ে নিয়ে কি সে ভাববে? বিয়ে কোনো আনন্দময় ব্যাপার না। মোটামুটিভাবে ভয়ংকর একটা ব্যাপার। নিজের চেনা বিছানা ফেলে একজন পুরুষ মানুষের গায়ের ঘামের গন্ধের মাঝখানে শুয়ে থাকা-– ভাবতেই গা গুলায়।

বিয়ের খবরটা বাসায় কীভাবে দেবে মীরু এখনো তা নিয়ে ভাবেনি। বারসাত বলেছে–প্রথমে একজনকে দিয়ে বাসায় টেলিফোন করাও। সে টেলিফোনে বলবে— এইমাত্র খবর এসেছে মীরু রোড একসিডেন্টে মারা গেছে। তার গায়ের উপর দিয়ে সাতটনি একটা ট্রাক চলে গেছে। তার ডেডবডি কোথায় আছে এক্ষুণি আপনাকে জানাচ্ছি–টেলিফোন লাইনটা দয়া করে খোলা রাখবেন। এই বলেই খট করে টেলিফোন রেখে দিতে হবে। বাসায় শুরু হবে কান্নাকাটি। আধঘণ্টা পর টেলিফোন করে জানাতে হবে সংবাদটা ভুল। আসলে মীরু মারা যায়নি। সে কাজীর অফিসে গিয়ে থার্ড ক্লাস টাইপ এক ছেলেকে বিয়ে করেছে। মৃত্যু সংবাদের পরে এই ধরনের সংবাদে সবাই আনন্দে অভিভূত হবে। বাবা-মা দুজনই গদগদ গলায় বলবেন–যাকে বিয়ে করেছিস তাকে নিয়ে এক্ষুণি বাসায় আয়। তুই যে বেঁচে আছিস এতেই আমরা খুশি।

বারসাত বলছে, আমার প্রেসক্রিপশান মত যদি কাজ করতে পারতাহলে তুমি কিন্তু তোমার বাবা মার কাছে আমাকে হজম করিয়ে ফেলতে পারবে। হজমি বড়ি লাগবে না।

মীরুর ধারণা তা না। সে খুব ভাল করেই জানে বারসাতের তাদের বাড়িতে এন্ট্রি হবে না। কোনো ভাবেই না।

মীরুদের পরিবারে প্রেম নোংরা ব্যাপার। টেলিভিশনে এইসব নোংরা ব্যাপার দেখানো হয় বলে আফজল সাহেব টেলিভিশন দেখেন না। মাঝেমধ্যে টিভির খবর দেখেন এবং কিছুক্ষণ পর পর ভুরু কুঁচকে বলেন— সব মিথ্যা কথা।

মীরুর মা জাহেদা আদর্শ মধ্যবিত্ত মা। স্বামী যা করে তাকেও তাই করতে হবে। তিনিও শুধু খবর দেখেন এবং স্বামীর মতো ভুরু কুঁচকে বলেন—এত মিথ্যা কথা কীভাবে বলে? মুখে আটকায় না। আশ্চর্য!

মীরুর বড় বোন রুনি পছন্দ করে একটি ছেলেকে বিয়ে করেছিল বলে তার এই বাড়িতে ঢোকার অনুমতি নেই। তার বিয়েটা ভাল হয়নি। ছ মাসের মধ্যে ঝামেলা লেগে গেল। নয় মাসের মধ্যে ডিভোর্স। রুনি। কাঁদতে কাঁদতে স্যুটকেস হাতে বাড়িতে উঠে এসেছিল। আফজল সাহেব স্যুটকেস হাতেই তাকে বিয়ে করে দেন। সে এখন আছে তার বড় খালার সঙ্গে।

মীরুর দুই ফুপু হজ করে এসেছেন। তাঁরা বোরকা পরেন। সেই বোরকাও কঠিন বোরকা। দুই ফুপুর একজন (ছোট ফুপু সুলতানা বেগম) তাবিজ বিশেষজ্ঞ। তিনি মাঝে মধ্যে তাবিজ নিয়ে আসেন। সুতা পড়া আনেন। তাঁর কাছ থেকে তাবিজ পড়া সুতা পড়া অত্যন্ত ভক্তিসহকারে গ্রহণ করতে হয়। ফুপুর দেয়া একটা তাবিজ এখনো মীরুর গলায় ঝুলছে। এই তাবিজের বিশেষত্ব হচ্ছে, এই তাবিজ পরা থাকলে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে না।

মীরুর দুঃস্বপ্ন দেখার রোগ আছে। এর মধ্যে একটা দুঃস্বপ্ন ভয়াবহ। এই দুঃস্বপ্নে মীরু ইউনিভার্সিটির ক্লাসে বসে থাকে। হঠাৎ সে লক্ষ্য করে তার গায়ে কোনো কাপড় নেই। সে সম্পূর্ণ নগ্ন। তখন টিচার তার দিকে তাকিয়ে বলেন, ঐন্দ্রিলা এসো বোর্ডে এসো। জিনিসটা বুঝিয়ে দাও। মীরু বোর্ডে যায়। ছাত্রছাত্রীরা সবাই তার দিকে তাকিয়ে ফিকফিক করে হাসতে থাকে। স্যারও হাসতে থাকেন।

ছোট ফুপুর তাবিজ গলায় পরার পর এই ভয়ংকর স্বপ্নটা মীরু দেখছে। এটা তাবিজের গুণ, না কি দুঃস্বপ্ন দেখা রোগ মীরুর সেরে গেছে কে জানে। মীরু ঠিক করে রেখেছে বিয়ের পর যেদিন থেকে সে বারসাতের সঙ্গে ঘুমুতে যাবে সেদিনই সে তাবিজ ছিঁড়ে কুয়ায় ফেলে দেবে। (তাবিজ যেখানে-সেখানে ফেলা যায় না। স্রোতহীন পানিতে ফেলতে হয়)

 

মীরু খুব ভালো করে জানে তাদের কঠিন পরিবারের কাছে বারাসাতকে হজম করানো কোনোক্রমেই সম্ভব না। কাজীর অফিসে গিয়ে বিয়ের কারণ এই একটাই। বাংলাদেশের কোনো মেয়ে কাজীর অফিসে বিয়ে করতে চায় না। সব মেয়ে বিয়ের দিনে বউ সাজতে চায়। বিয়ের আগের দিন গায়ে হলুদ মাখতে চায়। কাজী সাহেবের সামনে বউ সেজে কে উপস্থিত হবে? তবে আগামীকাল মীরু সুন্দর করেই সাজবে। একটা জর্জেট শাড়ি ঠিক করা আছে। সাদা জমিনে হালকা সবুজ কাজ। সবুজের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ লাল ছোপ। লাল হল সবুজের কনটেম্পরারি কালার। একটা রঙ আরেকটাকে উজ্জ্বল করবে। মীরুর ধারণা শাড়িটাতে তাকে খুব মানাবে।

সাজগোছ নিয়ে বারসাতের অবশ্যি কোনো মাথাব্যথা নেই। আজ পর্যন্ত সে মীরুকে বলেনি— বাহ্ এই শাড়িটাতে তো তোমাকে সুন্দর মানিয়েছে! কিংবা বাহ্ আজ তো তোমাকে অদ্ভুত লাগছে! কপালের টিপটা নিজে হাতে একে দিয়েছ? সুন্দর তো! মাঝে মাঝে মীরুর মনে হয়। সুন্দর-অসুন্দরের কোনো বোধই বারাসাতের নেই। অথচ বারসাত নিজে সুন্দর সুন্দর শার্ট-প্যান্ট পরে। সব সময় তার চুল আঁচড়ানো থাকে। পকেটে চিরুনি থাকে। মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি— এরকম তাকে মীরু কখনো দেখেনি। সব সময় ক্লিন শেভ।

বারাসাতের সঙ্গে বাবা-মা এবং ফুপুদের একটা ইন্টারভুর ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? চাকরির ইন্টারভুর মতো ইন্টারভু। বাবা ইন্টারভ্যু বোর্ডের চেয়ারম্যান। দুই ফুপু মেম্বার। মা সেক্রেটারি। মার হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। তিনি শুধু কথাবার্তা নোট করবেন। প্রশ্ন করবেন বাবা এবং ফুপুরা। মার কাজ হবে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকা। বাবা হাসলে তিনি হাসবেন। বাবার মুখ গম্ভীর হলে তিনি মুখ গম্ভীর করবেন। বাবা রাগ করলে তিনি রাগ করবেন। হিজ মাস্টারস ভয়েস।

মীরু কল্পনায় ইন্টারভু বোর্ডটা দেখতে পাচ্ছে এবং মনে মনে আশা করছে এই ইন্টারভু বোর্ড দেখতে দেখতে তার ঘুম পেয়ে যাবে এবং খুব ভালো ঘুম হবে। ঘুম ভাঙবে সকাল দশটার দিকে। তখন তাড়াহুড়া করে সে তৈরি হবে। কাজী অফিসে উপস্থিত হতে হবে সকাল এগারোটায়। হাতে একেবারেই সময় থাকবে না। তাকে গোসল করতে হবে। তাদের বাসায় হিটার নেই। গোসলের জন্য পানি গরম করতে হবে। আচ্ছা কাল কি হবে তা কাল দেখা যাবে। এখন বরং ইন্টারভু বোর্ডে কী হচ্ছে তা দেখা যাক।

তোমার নাম?

স্যার আমার নাম বারসাত আলি।

বারসাত আবার কেমন নাম?

আমার নানাজান রেখেছিলেন। নামের অর্থ বৃষ্টি। আমি হচ্ছি বৃষ্টি আলি।

পড়াশোনা কী?

এম. এ. পাস করেছি। সেকেন্ড ক্লাস ফোর্থ হয়েছিলাম।

বিষয়?

ফিলসফি।

এখন করছ কী?

চাকরিবাকরি তেমন কিছু জোগাড় করতে পারিনি। অল্প কিছুদিন একটা ইস্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করেছি। আমার এক বন্ধুর মামার ট্রাভেল এজেন্সি আছে। সেখানে কিছুদিন বসেছিলাম। এখন কিছু করছি না। রেস্টে আছি।

দিন চলছে কীভাবে?

তিনটা টিউশনি করছি। একটা কোচিং সেন্টারের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে।

বাবা-মা জীবিত আছেন?

বাবা মারা গেছেন, মা জীবিত আছেন।

মা কোথায় থাকেন?

আমার তিন বোন। তিনজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। মা ভাগাভাগি করে তিনজনের সঙ্গে থাকেন। একেক বোনের সঙ্গে চার মাস করে ব্যবস্থা।

আমি থাকি মেসে।

বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় উঠবে?

এই মুহুর্তে স্ত্রীকে নিয়ে ওঠার কোনো জায়গা নেই।

ঠিক আছে তুমি এখন যেতে পার।

চট করে আমাকে বাতিল করে দেবেন না স্যার। আমাকে আরো প্রশ্ন করুন। জেনারেল নলেজ থেকে যা ইচ্ছা জিজ্ঞেস করতে পারেন। জেনারেল নলেজে আমার দখল ভালো।

তুমি বিদেয় হও।

এক্সট্রা কারিকুলাম একটিভিটিজ সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমি ভালো ব্যাডমিন্টন খেলতে পারি। রাজশাহী ডিভিশনে পরপর দুবছর আমি রানার্স আপ ছিলাম। দাবাও ভাল খেলতে পারি। গ্রান্ড মাস্টার নিয়াজ মোরশেদের সঙ্গে তিনবার দাবা খেলেছি। দুবার ড্র হয়েছে। একবার অবশ্যি উনি জিতেছেন।

ভালো যন্ত্রণা তো। তোমাকে যেতে বলছি তুমি যাচ্ছ না কেন?

ব্যাডমিন্টন খেলা ছাড়াও আমি খুব ভালো পোট্রেট আঁকতে পারি। আমাকে দয়া করে এক শিট ফুল স্কেপ কাগজ আর একটা পেনসিল দিন। দশ মিনিটের মধ্যে আমি আপনার ছবি এঁকে দেব। আমার পোট্রেট করার ক্ষমতা দেখেই আপনার মেয়ে আমার প্রেমে পড়েছিল।

কী বললে, প্রেমে পড়েছে? এমন একটা অশ্লীল কথা তুমি আমার মেয়ের সম্পর্কে বললে কোন সাহসে? জানো তোমাকে আমি পুলিশে দিতে পারি?

প্রেমের কারণে আপনি আমাকে পুলিশে দেবেন? প্রেমের কারণে যদি আমাকে পুলিশে দেন তাহলে ভেলেনটাইনস দিবসে আপনার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হবে।

চুপ, অশ্লীল কথা মুখে আনবে না।

অশ্লীল কথা কোনটা?

আবার কথা বলে। বের হও বললাম।

আমাকে ছোট্ট একটা সুযোগ দিন স্যার। একটা টু বি পেনসিল আর এক শিট কাগজ। আমার আঁকা পোট্রেট দেখার পর আপনার মন অবশ্যই দ্রবীভূত হবে। পেনসিল না থাকলে বলপয়েন্টই দিন। সবচেয়ে ভালো হত চারকোল হলে। স্যার এক টুকরা কয়লা কি জোগাড় করা যায়?

মীরু উঠে বসল। ইন্টারভু বোর্ডের কথা ভাবতে গিয়ে তার ঘুম পুরোপুরি চলে গেছে। আজ রাতে ঘুম আসবে এরকম মনে হচ্ছে না। ঘুমের চেষ্টা করার কোনো মানে হয় না। বরং এখন গরম এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়া যায়। HBO মুভি চ্যানেলে মুভি দেখা যেতে পারে। অদ্রিা রোগীদের জন্যে মুভি চ্যানেলগুলি খুব ভালো। ইনসমনিয়া চ্যানেল চালু করলে চমৎকার হত। পৃথিবীর সব অন্দ্রিা রোগী আগ্রহ করে এই চ্যানেল দেখত।

মীরু চা বানিয়ে নিজের শোবার ঘরে চলে এল। টিভির সামনে বসল। আফজল সাহেবের ঘুম খুব পাতলা। টিভি ছাড়লেই তিনি জেগে উঠবেন এবং বিরক্ত গলায় বলবেন, কে? টিভি ছেড়েছে কে? তার চেয়ে বরং চা খেতে খেতে অন্য কিছু ভেবে সময় কাটানো যাক। সুলতানা ফুপুর সঙ্গে কাল্পনিক কথােপকথন। কঠিন ইসলামিক মহিলা হলেও সুলতানা ফুপুকে মীরুর ভালো লাগে, কারণ এই ফুপু বিস্মিত হতে ভালবাসেন। অতি তুচ্ছ জিনিসেও তিনি বিস্মিত হন। বোরকা পরে বের হবার আগে ঠোটে গাঢ় করে লিপস্টিক দেন। চোখে মাসকারা। রোজ দিয়ে গালে লালচে আভা আনেন।

ফুপুর সঙ্গে কাল্পনিক কথাবার্তা শুরু করা যাক। ফুপু এসেছেন। মীরুর হাত ধরে তাকে নিয়ে গেছেন বারান্দায়। গলা নিচু করে তিনি বললেন–

এইসব কী শুনছি মীরু? কী সর্বনাশ!

কী শুনছ ফুপু?

কোন এক বদ ছেলের সঙ্গে তোর নাকি খাতির হয়েছে?

বদ ছেলে তোমাকে কে বলল?

যেসব ছেলে-মেয়ের সঙ্গে খাতির করে তারা অবশ্যই বদ।

ছেলের সঙ্গে মেয়ের ভাব হবে না?

ভাব হবে। বিয়ের পর হবে। বিয়ের আগে কীসের ভাব? যা শুনছি তা কি সত্যি?

হুঁ।

কী সর্বনাশ! তুই তওবা কর।

তওবা করার মতো কোনো পাপ করিনি ফুপু।

বেগানা পুরুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিস এটা পাপ না? আমার তো এখন সন্দেহ হচ্ছে তোরা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রিকশায় বসেছিস।

তোমার সন্দেহ ভুল না ফুপু। আমরা প্রায়ই রিকশায় চড়ি।

গায়ের সঙ্গে গা লাগে?

যা অজু করে আয়— এক্ষুণি তোকে তওবা করাব।

ছেলেটাকে তোমার পছন্দ হবে। খুব ভালো ছেলে।

অচেনা মেয়ের সঙ্গে এক রিকশায় ঘুরে বেড়ায় সেই ছেলে ভালো? তুই কি পাগল হয়ে গেলি?

বারসাতের সঙ্গে দশ মিনিট কথা বললে তুমি পটে যাবে।

পটে যাবে কী রকম কথা। এই ধরনের নোংরা কথা আমার সঙ্গে বলবি না মীরু। তোর মুখে নোংরা কথা মানায় না। নোংরা কথা বললে যে অজু ভেঙে যায় এটা জানিস?

বারসাতকে তুমি পনেরো মিনিট সময় যদি দাও তাহলে সে তোমার পোট্রেট করে ফেলবে। সেই পোট্রেট দেখলে তোমার চোখ কপালে উঠে যাবে।

পোট্রেট করে ফেলবে মানে কী? পোট্রেট কী?

তোমার ছবি এঁকে ফেলবে। এমন সুন্দর যে মনে হবে ক্যামেরায় তোলা।

ছবি আঁকা তো খুবই গুনার কাজ।

গুনার কাজ না সোয়াবের কাজ আমি জানি না তবে তার আঁকা ছবি। দেখলে তোমার আক্কেলগুড়ুম হয়ে যাবে। ছবি আঁকা কীভাবে শিখেছে শুনবে?

না।

আহা শোনো না। বারসাত একদিন গিয়েছে নিউ মার্কেটে। ফার্মেসি থেকে এসিডিটির ওষুধ কিনবে। ওর মারাত্মক এসিডিটি। যাই হোক ওষুধ কিনতে গিয়ে দেখে ফার্মেসির সামনে এক লোক মেঝেতে বসে ফটোগ্রাফ দেখে দেখে পেনসিলে ছবি আঁকছে। ওয়ান ফুট বাই ওয়ান ফুট ছবি একে। দেয়, একশ করে টাকা নেয়। বারসাত লোকটার পাশে বসে পড়ল। দুঘণ্টা ছবি আঁকা দেখল। তারপর কাগজের দোকান থেকে কাগজ কিনল, পেনসিল কিনল। মেসে ফিরে নিজের পাসপোর্টের ছবি দেখে একটা ছবি আঁকল। খুবই সুন্দর হল ছবিটা— এই তার শুরু।

ছেলের ধৈর্য আছে।

এটা ধৈর্য না। এর নাম ক্ষমতা। কোনো কিছু করতে হলে শুধু ধৈর্যে হয় না। ক্ষমতা লাগে। বারসাত ছবি আঁকার ক্ষমতা নিয়ে এসেছে। নিজে বুঝতে পারেনি। তবে সে পোট্রেট ছাড়া আর কিছু করে না। যে পোট্রেট এত ভালো পারে সে সব কিছুই পারবে অথচ সে করবে না। তার না কি মানুষের মুখ ছাড়া অন্য কিছু আঁকতে ভালো লাগে না। ফুপু তাকে দিয়ে তোমার একটি ছবি আঁকাবে? বোরকা ছাড়া ছবি।

ফাজলামি করিস না তো।

আচ্ছা ঠিক আছে ছবি না আঁকালে। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বল। কথা বলাতে তো দোষ নেই।

কথা বললে কী হবে?

কিছুক্ষণ কথা বললেই তাকে আপন মনে হবে। মনে হবে সে বাইরের কেউ না, ঘরের মানুষ। সে তিনটা প্রাইভেট টিউশনি করে। যে সব বাচ্চাদের সে পড়ায় তাদের মায়েদের সঙ্গে ওর খুবই খাতির। মায়েরা। তাকে প্রায়ই খবর দিয়ে নিয়ে যায়। তাকে নিয়ে শপিং-এ যায়। এটা-ওটা কাজ করায়। যে কোনো কাজ তাকে দাও সে নিখুঁতভাবে করবে। তার এক ছাত্রীর নানির চোখ অপারেশন হবে মাদ্রাজে। বারসাত একা তাঁকে নিয়ে মাদ্রাজ থেকে চোখ অপারেশন করে চলে এসেছে। মানুষটাকে তোমার এখন কেমন লাগছে ফুপু?

নাই কাজ খই ভাজ টাইপ লাগছে। এক ধরনের মানুষই আছে যাদের নিজের কোনো কাজ থাকে না তারা কাজের জন্যে অন্যের ওপর লেপ্টে থাকে।

ঠিক বলেছ ফুপু। বিয়ের পর আমি ওর এই অভ্যাস ঠিক করাব।

বিয়ে মানে? বিয়ের কথা আসছে কেন? তুই কি ঐ গাধাটাকে বিয়ের কথা ভাবছিস?

হুঁ।

হুঁ মানে?

হুঁ মানে Yes. আমি ঐ লোকটাকে কাজির অফিসে বিয়ে করব।

আমি তোর বিয়ে ঠিক করে রেখেছি। ছেলের নাম–জাহাঙ্গীর। হীরের টুকরো ছেলে। তুই কাজি অফিসে কেন বিয়ে করবি।

কাজি অফিসে বিয়ে করব কারণ আমি জাহাঙ্গীর সাহেবকে বিয়ে করছি। অন্য একজনকে বিয়ে করছি। হীরা আমার পছন্দের পাথর না। আমার পহন্দের পাথর হল রেললাইনের পাথর।

মীরু তুই বুঝতে পারছিস না, এরকম কিছু করলে কিন্তু বাসায় গজব হয়ে যাবে।

গজব যাতে না হয় তুমি সেই চেষ্টা চালাবে। তুমি কাজ করবে আমার হয়ে। তুমি হবে আমার স্পাই। ঘরের শত্রু বিভীষণ।

আমি কেন তোর হয়ে কাজ করতে যাব?

কারণ তুমি আমার অতি আদরের ফুপু। আমি তোমাকে পছন্দ করি। তুমিও আমাকে পছন্দ কর। ফুপু দেখ তো বিয়ের দিন আমি এই শাড়িটা পরব। ঠিক আছে না?

মোটেই ঠিক নেই। বিয়ের দিন সাদা শাড়ি কেউ পরে? সাদা হল বিধবাদের রঙ।

পশ্চিম দেশের সব মেয়েরা বিয়েতে সাদা পোশাক পরে। তাছাড়া শাড়িটা পুরোপুরি সাদাও না। মাঝে মধ্যে লাল-সবুজের খেলা আছে।

তুই তো পশ্চিমা মেয়ে না। তুই বাঙালি মেয়ে। বিয়ের দিন তুই পরবি টকটকে লাল রঙের শাড়ি।

তুমি পাগল হয়েছ? লাল শাড়ি পরে আমি কাজির অফিসে যাব না-কি?

এক কাজ কর, শাড়ির উপর বোরকা পরে ফেল। তাহলে কেউ বুঝবে।

এই বুদ্ধি খারাপ না। ঘোমটার নিচে খেমটা নাচ।

কাল্পনিক কথােপকথন আর ভাল লাগছে না। এখন সত্যি সত্যি কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। রুনির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা যায়। সে মনে হয় রাতে ঘুমায় না। মীরু যত রাতেই টেলিফোন করুক দুটা রিং বাজার আগেই রুনি টেলিফোন ধরে সহজ গলায় বলবে–হ্যালো। টেলিফোনটা থাকে বড় খালার ড্রয়িং রুমে। দুটা রিং হবার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন ধরতে হলে ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে হয়। মীরার ধারণা তার বড় বোন রাত এগারোটার পর ড্রয়িং রুমেই চুপচাপ বসে থাকে। যার সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে তার টেলিফোন কলের জন্যে অপেক্ষা। সেই কল আর আসে না।

মীরা টেলিফোন করল। একবার রিং হবার পরই রুনি মিষ্টি গলায় বলল, হ্যালো।

আমি মীরা। আপা তুমি জেগে আছ?

হুঁ।

ঐ লোকের কি টেলিফোন করার কথা?

কারোরই টেলিফোন করার কথা না। ঘুম আসছে না বলে জেগে আছি। তুই জেগে আছিস কেন?

আমি কেন জেগে আছি তা তোমাকে বলতে পারি কিন্তু তুমি সঙ্গে সঙ্গে সেটা চারদিকে রাষ্ট্র করে দেবে, আমার হবে অসুবিধা।

মীরা বাসার খবর কি?

বাসার খবর ভাল।

বাবা আমাকে ত্যাজ্য কন্যা করেছেন এটা কি সত্যি?

হুঁ, সত্যি।

তার মানে আমি বাবার বিষয়-সম্পত্তি কিছুই পাব না?

না।

তুই এত সহজভাবে না বলতে পারলি? তোর একটুও খারাপ লাগল।?

খুট করে শব্দ হল। মীরুর বাবা দরজা খুলেছেন।

মীরু চট করে টেলিফোন রেখে দিল। বাবা যদি দেখেন সে টেলিফোনে কথা বলছে তাহলে গজব হয়ে যাবে। মীরু তাকাল ঘড়ির দিকে। চারটা একুশ বাজে। ফজরের নামাজের সময় হয়ে গেছে। আফজল। সাহেব বাথরুমে যাবেন। অজু করবেন। ফজরের নামাজ শেষ করে সূরা। আর রাহমান পড়বেন। তারপর আবার ঘুমুতে চলে যাবেন। ঘুমুতে যাবার। আগে এক কাপ আদা চা খাবেন। একটা টোস্ট বিসকিট খাবেন। এই চা তাকে বানিয়ে দেবেন মীরুর মা জাহেদা বানু।

আজ আফজল সাহেবের চা হবে না। কারণ জাহেদা বানু বাসায় নেই। তিনি ফুলবাড়িয়াতে গিয়েছেন। তাঁর এক চাচাতো বোনের বিয়ে। বিয়ে সেরে ফিরতে ফিরতে আরো দুই-এক দিন লাগবে।

মীরু ঠিক করল সে যখন জেগেই আছে তখন আর বাবার রুটিনের ব্যতিক্রম করাবে না। এক কাপ চা নিজেই বানিয়ে দেবে। বাবা নিশ্চয়ই অবাক হবেন। খানিকটা খুশিও হয়তো হবেন। তবে তিনি তা প্রকাশ করবেন না। এমন একটা ভাব ধরবেন যেন এরকমই হবার কথা। মেয়ে তাকে চা বানিয়ে দিচ্ছে এতে খুশি হবার কিছু নেই। এটা মেয়ের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ছে।

তিনি একবার জিজ্ঞেসও করবেন না এত ভোরে তার মেয়ে জেগে আছে কেন? তার কি কোনো সমস্যা?

মীরু চায়ের পানি গরম করেছে। একটা জিনিস সে বুঝতে পারছে না। তার বাবা চা-টা কখন খান, সূরা আর রাহমান পাঠ করার আগে না পড়ে?

রান্না ঘরে শব্দ করে কে?

বাবার গলা। গলাটা যেন কেমন অন্যরকম। অসুস্থ মানুষের চিকন গলা। দীর্ঘ বাক্য শেষ করার মতো দমও যেন নেই।

মীরু বলল, বাবা আমি। চা খাবে? চা বানিয়ে আনি?

আজফল সাহেব হাঁপানি রোগীর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, মা। একটু এদিকে আয়।

মীরু বাবার শোবার ঘরে ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেল। বাবা জায়নামাজে আড়াআড়িভাবে শুয়ে আছেন। তাঁর মুখ দিয়ে ফেনার মতো কি যেন বের হচ্ছে। ডান হাত একটু পরে পরে কেঁপে কেঁপে উঠছে। মীরু হতভম্ব হয়ে। বলল, কী হয়েছে বাবা?

আফজল সাহেব থেমে থেমে বললেন, মারা যাচ্ছিগো মা। মারা যাচ্ছি। বুকে ব্যথা। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা। তিনি কথা শেষ করতে পারলেন না। গোঙাতে লাগলেন।

মীরু এখন কী করবে? জিতু মিয়া ছাড়া বাসায় পুরুষ মানুষ কেউ নেই। একতলায় বাড়িওয়ালা থাকেন। তারা দলবেঁধে আজমির শরিফ গিয়েছেন। বাড়িওয়ালার এক ভাগ্নেকে রেখে গেছেন বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে। সেই ভাগ্নে আধপাগল। সারাদিন বারান্দায় মাথা নিচু করে বসে থাকে। মেঝের দিকে তাকিয়ে ফিক ফিক করে হাসে। মীরু দৌড়ে টেলিফোন রিসিভার কানে নিল। ডায়াল টোন নেই। একটু আগেই সে কথা বলেছে আর এখন ডায়াল টোন নেই— এর মানে কি?

মীরু টেলিফোন রেখে বাবার কাছে গেল। আফজাল সাহেব বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মীরু বলল, বাবা খুব খারাপ লাগছে?

তিনি জবাব দিলেন না। মীরু বাবাকে ফেলে রেখে আবার টেলিফোনের কাছে গেল।

এমন তো হতে পারে হঠাৎ টেলিফোন ঠিক হয়ে গেছে। যে টেলিফোন কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ নষ্ট হয় সেই টেলিফোন কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ কি ঠিকও হতে পারে না? মীরু ছুটে গিয়ে টেলিফোন রিসিভার কানে দিল। পোঁ পোঁ শব্দ হবার বদলে কেমন যেন ঝড়-তুফানের শব্দ হচ্ছে। শোঁ শো আওয়াজ। বৃষ্টির শব্দ। মীরু অনেকক্ষণ বুঝতেই পারল না যে বৃষ্টি-বাদলার শব্দ টেলিফোন রিসিভার থেকে আসছে না। বাইরে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। সেই শব্দ। শ্রাবণ মাস বৃষ্টি-বাদলারই সময়।

বারসাত আনন্দমাখা গলায় বলল

বারসাত আনন্দমাখা গলায় বলল, বৃষ্টি দেখেছেন? কেমন ঝুম ঝুমান্তি নেমেছে। শ্রাবণ মাসে টিপটিপ বৃষ্টি হয়। ঝুম বৃষ্টি হয় না। আবহাওয়া আসলেই বদলে যাচ্ছে। ওজোন স্কেয়ার ফুটো হয়ে গেছে। বারসাত জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। ফুটো হওয়া ওজোন ফেয়ার দেখার জন্যে কি না কে জানে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সে ফুটো দেখতে পাচ্ছে।

নীলুফার কৌতূহলী হয়ে বারসাতকে দেখছে। মানুষটার আনন্দ আনন্দ ভাব তার কাছে অদ্ভুত লাগছে। আজ বারসাতের বিয়ের দিন। আনন্দ ভাব থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু বিয়ের কনের দেখা নেই। এগারোটার মধ্যে মেয়ের আসার কথা। এখন বাজছে একটা। নীলুফারের মনে হচ্ছে কনের দেখা শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে না। অথচ বারসাতের মধ্যে এ নিয়ে কোনোরকম টেনশান দেখা যাচ্ছে না। বরং তাকে আনন্দিত মনে হচ্ছে। এই আনন্দ নিশ্চিয়ই লোক দেখানো আনন্দ—Fake happyness.

বারসাত বলল, বৃষ্টির ফোঁটার সাইজ ম্যাক্সিমাম কত বড় হতে পারে জানেন ভাবি?

নীলুফার না-সূচক মাথা নাড়ল।

বারসাত বলল, বৃষ্টির ফোঁটার রেকর্ডেড বড় সাইজ হল— পিং পং বলের সাইজ। ভেনিজুয়েলায় ১৮৭০ সনে এই সাইজের বৃষ্টি হয়েছিল। সেখানকার চার্চের রেকর্ড বইয়ে রেকর্ড করা আছে।

নীলুফার কিছু বলল না। সে এসেছে বারসাতের বিয়েতে একজন সাক্ষী হিসেবে। সে ভেবেছিল দুপুর বারোটার মধ্যে সব শেষ হয়ে যাবে। সে চলে যেতে পারবে। তার ছেলে টুকটুকির স্কুল ছুটি হয় দুপুর দুটায়। তার আগেই তাকে যেতে হবে। ছেলেকে স্কুল থেকে আনার আর কেউ নেই। বারসাতকে চলে যাবার কথা বলতে মায়া লাগছে। নীলুফারের ধারণা বারসাত এখনো আশা করে আছে মীরু নামের মেয়েটা চলে আসবে।

বারসাতের চেহারায় আনন্দ এখনো ঝলমল করছে। তাকে দেখতে সুন্দর লাগছে। হালকা হলুদ রঙের হাফ শার্ট পরেছে। শার্ট থেকে হলুদের আভা চলে গেছে মুখে।

ভাবী চা খাবেন?

না। আমি ঘন ঘন চা খাই না।

বৃষ্টি দেখতে দেখতে চা খেতে ভালো লাগে।

তুমি খাও। বারসাত আমার যে এখন উঠতে হয়। ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে হবে।

বারসাত বলল, ভাবী আমার মনে আছে। ওর স্কুল ছুটি হবে দুটায়। আপনাকে দেড়টার সময় উঠলেই চলবে। এখনো আপনার হাতে পঁচিশ মিনিট সময় আছে।

নীলুফার বলল, মেয়েটার বাসায় টেলিফোন নেই? তুমি টেলিফোনে খোঁজ নাও না কেন?

এক ফাঁকে চেষ্টা করে এসেছি। ওদের টেলিফোন নষ্ট।

রিং হয়?

মনে হচ্ছে রিং হয়। কিন্তু কেউ তো ধরছে না।

নীলুফার বলল, শেষ মুহূর্তে মেয়ে মত বদলায়নি তো?

বারসাত বলল, বদলাতে পারে। মেয়েরা কেন জানি কাজির অফিসে এসে বিয়ে করার টেনশানটা নিতে পারে না। বাড়ি থেকে বের হবার আগ মুহর্তে মত বদলায়। কাজের মেয়ের সঙ্গে লুডু খেলতে বসে।

লুডু খেলতে বসে মানে?

কথার কথা বললাম।

বারসাত হাসছে। শব্দ করেই হাসছে। নীলুফার বলল, হাসছ কেন?

বারসাত বলল, মজার একটা কথা মনে করে হাসছি। মাঝে মাঝে। এমনও হয় কাজি অফিসের টেনশানের উত্তাপে সাত বছরের প্রেমও উড়ে যায়। প্রেমিককেই চিনতে পারে না বিয়ে তো দিল্লি হনুজ দূর অস্ত।

প্রেমিককেই চিনতে পারবে না কেন?

আমার নিজের চোখে দেখা। আমার বন্ধু রকিবুল কাজি অফিসে বিয়ে করবে। আমি সাক্ষী। মেয়ের বিকেলে আসার কথা। রাত আটটা বেজে গেল মেয়ের খোঁজ নেই। রকিবুল গেল টেলিফোন করতে। মুখ শুকনা করে ফিরে এল। মেয়ে তাকে চিনতে পারছে না। টেলিফোনে রকিব যতই বলে— আমি রকিব। মেয়ে বলে, কোন রকিব? হা হা হা।

হাসছ কেন?

মজা পেয়ে হাসছি ভাবী।

নীলুফার বলল, তুমি মনে হয় সব কিছুতেই মজা পাও।

বারসাত বলল, আসলে আমি কোনো কিছুতেই মজা পাই না। কিন্তু ভঙ্গি করি সব কিছুতে মজা পাচ্ছি।

তার মানে তুমি এখন মজা পাচ্ছ না?

একটু কম পাচ্ছি।

মেয়েটার জন্যে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে?

চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করব।

চারটা কেন?

মীরুকে বলে রেখেছিলাম আমি অবশ্যই চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। ভাবী আপনার কি ক্ষিধে লেগেছে। কিছু খাবেন? এখানে একটা দোকান আছে মিনি সিঙাড়া পাওয়া যায়। প্রায় মার্বেলের মতো সাইজ। খেতে অসাধারণ। নিয়ে আসি?

নীলুফারের মনে হল বারসাতের ক্ষিধে পেয়েছে। টেনশানে সে হয়তো সকালে নাস্তাই করেনি। মিনি সিঙাড়া খাওয়ার কোনো ইচ্ছাই নীলুফারের করছে না। বারসাতের কথা ভেবে সে বলল, চট করে নিয়ে এসো।

বারসাত সিঙাড়া আনতে পারল না। আজ সিঙাড়া বানানোর কারিগর আসেনি। বারসাত ফিরল কাক ভেজা হয়ে। নীলুফার বলল, এ কী অবস্থা! এমন ভিজা কী করে ভিজলে?

ইচ্ছা করে ভিজলাম ভাবী। যখন দেখলাম সিঙাড়া বানানোর কারিগর আসেনি তখন এমন মেজাজ খারাপ হল যে রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। বৃষ্টিতে ভিজে যদি গরম মেজাজ একটু ঠাণ্ডা হয়।

ঠাণ্ডা হয়েছে?

কিছুটা হয়েছে।

নীলুফার বলল, আমাকে এখন যেতে হবে। তুমি অপেক্ষা কর। আমার মোবাইল টেলিফোন খোলা থাকবে। মেয়েটা যদি এসে পরে আমাকে টেলিফোন করবে।

আচ্ছা।

না এলেও করবে। কী হয়েছে পুরোপুরি না জানা পর্যন্ত আমার অস্থীর ভাব যাবে না।

ভাবী চারটার পর নিউজ বুলেটিন প্রচার করা হবে।

নীলুফার বলল, তোমাকে আমি এখন ছোট্ট একটা উপদেশ দিতে চাচ্ছি। দেব?

দিন।

ঠাণ্ডায় তোমার গা কাপছে। তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে তোমার জ্বর আসবে। চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার নেই তুমি চলে যাও। কাজি সাহেবকে বলে যাও–ঐন্দ্রিলা নামের মেয়েটা এলে যেন তাকে বলা হয় তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। ঠিক আছে?

বারসাত হাসল। কিছু বলল না।

নীলুফার বলল, বাসায় যেতে না চাও থাক এখানে। অপেক্ষা কর। একটা টাওয়েল জোগাড় করে মাথাটা মোছার ব্যবস্থা কর।

বারসাত আবারো হাসল।

তার মাথায় অন্য পরিকল্পনা খেলা করছে। তার ইচ্ছা করছে ঝুম বৃষ্টিতে ভালোমতো ভিজে সত্যি সত্যি একটু অসুখ বাধাতে। বেশ কিছুদিন ধরে তার শরীর অতিরিক্ত রকমের ভালো যাচ্ছে। অসুখ-বিসুখ কিছু হচ্ছে না। শেষবার হল ভাইরাল ফিভার। বিছানায় তিনদিন শুয়ে থাকা। বিছানা থেকে উঠে বসলেই মাথা চক্কর দিত। চক্করটা খারাপ লাগত না। পর্দা সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ কড়কড় করত। মাথা ধকধক করত। দুটাই কেন জানি ভালো লাগত। অসুখও উপভোগ করতে জানতে হয়।

বারসাত বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়াল। ভেজার উদ্দেশে বৃষ্টিতে নামলেই বৃষ্টি কেন জানি কমে যায়। বারসাত ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি অনেকখানি কমে গেছে—তারপরও যা আছে খারাপ না। এই বৃষ্টি ঘণ্টা দুই শরীরে মাখাতে পারলে অসুখ অবশ্যই হবে। ডবল নিউমোনিয়া বাধিয়ে ফেলা যেতে পারে। ঘোর ঘোর ভাব নিয়ে বিছানায় পরে থাকা খারাপ কী?

বৃষ্টিতে ভেজার জন্যে বারসাত মোটামুটি একটা ভালো জায়গা পেয়েছে। রাস্তা থেকে চট করে তাকে দেখা যাবে না। সে রাস্তার লোকজন ঠিকই দেখতে পাবে। রাস্তার সব লোক তার দেখার দরকার নেই। মীরুকে দেখতে পেলেই চলবে। আচ্ছা মীরু যখন দেখবে সে হাসি হাসি মুখে বৃষ্টিতে ভিজছে তখন কী করবে? রিকশা থেকে নেমেই বিরক্তিতে কপালে ভাঁজ ফেলে বলবে, তুমি বৃষ্টিতে ভিজছ কেন?

বারসাত বলবে, এই বৎসর বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি। কাজেই ভাবলাম কোটা শেষ করে রাখি। শুভদিনে বৃষ্টিতে ভেজা যাক।

আজ শুভদিন না কি?

আরে আজ আমাদের বিয়ের দিন। আজ শুভদিন না? রিকশা ভাড়া দিয়ে চলে এসো দুজনে মিলেই ভিজি।

তুমি পাগল হতে পার। আমি তো পাগল না। দুনিয়ার মানুষের সামনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভিজব। লোকজন তাকিয়ে দেখবে শাড়িটা কতটা গায়ের সঙ্গে লেগেছে।

তাহলে তুমি বৃষ্টিতে ভিজবে না?

না।

শাড়ি গায়ের সঙ্গে লেগে যাবে এই ভয়ে বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবে?

উফ চুপ কর তো!

রবীন্দ্রনাথের ঐ গানটা মনে করলে কিন্তু ভেজা শাড়ির কথা মাথায় আসবে না। দুহাত তুলে ঘুরে ঘুরে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করবে।

কোন গান?

এসো কর স্নান, নবধারা জলে
এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে।

বারসাত শোনো তুমি অনেক দিন আমার সঙ্গে আছ ঠিকই কিন্তু তুমি আমাকে সেই অর্থে চেন না। আমার মধ্যে প্রকৃতিপ্রেম নেই। বৃষ্টি দেখলেই আমার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করে না।

রেগে যাচ্ছ কেন?

রাগছি না। তোমার নায়ক টাইপ কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছি। তুমি কি জানো তুমি মানুষকে খুব বিরক্ত করতে পার।

জানি।

বৃষ্টিতে ভেজার এই ঢংটা না করে তুমি কি দয়া করে রিকশায় উঠবে?

তোমার সঙ্গে?

হ্যাঁ, আমার সঙ্গে।

তোমার নতুন শাড়ি ভিজে যাবে তো।

ভিজুক। তুমি উঠে এসো।

এখন উঠতে পারব না। ছোট্ট একটা কাজ আছে কাজটা শেষ করে উঠতে হবে।

কী কাজ?

নীলুফার নামের একটি মেয়েকে নিউজ বুলেটিন পাঠাতে হবে। তার মোবাইলে টেলিফোন করে জানাতে হবে যে তুমি এসেছ। বিয়েটা শেষপর্যন্ত হচ্ছে! হাসছ কেন?

হাসছি কারণ আমি আসিনি। আমাদের বিয়েও হচ্ছে না। আমার রিকশায় করে চলে আসার ব্যাপারটা পুরো কল্পনা। শুধু যে আমার ব্যাপারটাই কল্পনা তা না, বৃষ্টির ব্যাপারটাও কল্পনা।

তাই না কি?

হ্যাঁ, তাই। বৃষ্টি অনেকক্ষণ থেমে গেছে। আকাশে মেঘ কেটে গিয়ে রোদ পর্যন্ত উঠে গেছে। তুমি যদি একটু ডান দিকে সরে দাঁড়াও তাহলে তোমার গালে রোদ পড়বে।

মীরু তোমার হাতে কি ঘড়ি আছে?

না আমার হাতে ঘড়ি নেই। আমি কল্পনার মীরু। কল্পনার মীরু হাতে ঘড়ি পরে না। বাস্তবের মীরু পরে। ঘড়ি দিয়ে কী হবে?

চারটা বাজছে কি না জানতে চাই।

তোমার নিজের হাতে ঘড়ি আছে। ঘড়িটা দেখে সময় জেনে নাও। আমার ধারণা চারটার বেশি বাজে।

বারসাত ঘড়ি দেখল। চারটা পঁচিশ বাজে। মীরুর জন্যে আর অপেক্ষা করার দরকার নেই। এখন চলে যাওয়া যেতে পারে। একটা টেলিফোন নীলুফার ভাবীকে করতে হবে। উনি নিশ্চয়ই টেলিফোনের জন্যে অপেক্ষা করে আছেন।

হ্যালো ভাবী।

হ্যাঁ।

মীরু আসেনি।

আই এ্যাম সরি টু হিয়ার দ্যাট। তুমি কোথায়?

আমি এখনো কাজি অফিসের আশপাশে। টেলিফোন শেষ করেই রওনা দেব।

কোথায় রওনা দিবে?

আমার দূর-সম্পর্কের এক মামার বাগানবাড়িতে। বাগানবাড়িতে আটচল্লিশ ঘণ্টা কাটানোর অনুমতি নিয়েছিলাম। ঐখানে যাব।

বাগানবাড়িটা কোথায়?

কালিয়াকৈর-এর কাছে।

আমি একটা সাজেশান দেই?

দিন।

একা একা কালিয়াকৈর যাবার কোনো মানে হয় না। আজ কোথাও যাবার দরকার নেই। ঢাকাতেই থাক। মীরু মেয়েটার বাসায় যাও, খোঁজ নাও তার কী হয়েছে।

তার কিছু হয়নি, সে ভালো আছে। সে আমাকে মাথা থেকে ঝেড়ে। ফেলেছে। এখন বাসায় গেলে দেখব সে তার মার সঙ্গে সাপ লুডু খেলছে।

উল্টোটাও হতে পারে। সে হয়তো কোনো সমস্যায় পড়েছে। তুমি আজ বাগানবাড়িতে যাবার আইডিয়া বাদ দাও।

বাদ দিতে পারব না। আমাকে যেতেই হবে। সেখানে তিনজন বেহালা বাদক ঠিক করা আছে। তারা আজ দুপুর থেকে বসে আছে।

তোমার শরীর ঠিক আছে তো? তোমার কথাবার্তা কেমন যেন জড়ানো মনে হচ্ছে।

শরীর ঠিক আছে।

কালিয়াকৈর যাবার আগে কি আমার বাসা হয়ে যাবে? এক কাপ চা খেয়ে যাবে।

চেষ্টা করব।

চেষ্টাটেষ্টা না। চলে এসো। তোমাকে ইন্টারেস্টিং কিছু কথা বলব। তোমার কালিয়াকৈর যাওয়া আমি আটকাচ্ছি না। তুমি যাও তবে যাবার আগে আমার এখানে এক কাপ চা খেয়ে যাও।

ভাবী কটা বাজে বলতে পারবেন? আমার হাত ঘড়িটা কাজ করছে। বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।

এখন বাজছে পাঁচটা ছয়। তুমি আসছ তো?

বারসাত জবাব না দিয়ে টেলিফোন রেখে দিল। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে তার জ্বর এসেছে। এই জ্বর চট করে যাবার জ্বর না। জ্বর তাকে ভোগাবে। চিৎ করে বিছানায় ফেলে দেবে।

মীরু তার ছোট ফুপুর দিকে তাকিয়ে বলল, ফুপু কটা বাজে?

সুলতানা বললেন, পঁচটা দশ বাজে।

মীরু বলল, ফুপু আমি এখন চলে যাব।

সুলতানা অবাক হয়ে বললেন, তোর বাবার এই অবস্থা তুই কোথায় চলে যাবি! তোর কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে?

মীরু বলল, বাবার অবস্থা এখন ভালো। ডাক্তাররা বলেছেন বিপদ কেটে গেছে। তোমরা সবাই চলে এসেছ। এখন আমার দরকার কী?

তুই দেখি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছিস। তোর দরকার থাকবে না?

তোমরা যা পার কর। হাসপাতাল আমার পছন্দের জায়গা না। হাসপাতালে ঢুকলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। দমবন্ধ অবস্থায় অনেকক্ষণ আছি। এখন আমাকে যেতেই হবে।

কোথায় যেতে হবে?

মীরু স্বাভাবিক গলায় বলল, কাজি অফিসে যাব ফুপু। আজ আমার বিয়ে।

সুলতানা বিরক্ত গলায় বললেন, সব সময় ঠাট্টা-ফাজলামি করিস এসব ভালো না। তোর ওপর দিয়ে খুব ধকল গেছে। বুঝতে পারছি মাথা আউলিয়ে গেছে। যা কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে আয়। নাসেরকে বলে দিচ্ছি ও তোকে নামিয়ে দেবে।

নাসেরটা আবার কে?

নাসেরের সঙ্গে তো আজ ভোরেই এক গাদা কথা বললি। এর মধ্যে ভুলে গেছিস? তোর হয়েছে কী বল তো?

মীরু ক্লান্ত গলায় বলল, ফুপু আমার কিছু হয়নি। আমি ভালো আছি। আর শোনো আমাকে পৌঁছে দিতে হবে না। আমি রিকশা নিয়ে যাব।

নাসেরের গাড়ি আছে, তুই রিকশা নিয়ে যাবি কেন? তুই আয় তো আমার সঙ্গে, তোকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি।

মীরু অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল। সুলতানা বললেন, হাসছিস কেন? মীরু বলল, জানি না কেন হাসছি। মনে হয় আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

সুলতানা বললেন, তুই এক কাজ কর যেখানে যাবি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যা। তোর ভাবভঙ্গি এলোমেলো, তোকে একা ছাড়া যাবে না।

মীরু বলল, তুমি তোমার অসুস্থ ভাইকে ফেলে আমার সঙ্গে বেড়াতে বের হবে? নিজের ভাই মরে যাচ্ছে।

সুলতানা বিরক্ত গলায় বললেন, মরে যাচ্ছে কী? কথা বলার স্টাইলটা তোর এরকম হয়ে যাচ্ছে কেন? তুই আমার চেয়ে ভালো জানিস যে ভাইজানের অবস্থা এখন ভালো। সব বিপদ কেটে গেছে।

মীরু হাই তুলতে তুলতে বলল, ফুপু বেশি করে চিনি দিয়ে আমাকে এক কাপ চা খাওয়াও। তারপর ডলে ডলে আমার মাথায় তেল দিয়ে দাও।

সুলতানা অবাক হয়ে মীরুর দিকে তাকালেন। মীরু ফিক করে হেসে ফেলে বলল, তুমি কি ভাবছ আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তোমাকে হকচকিয়ে দেবার জন্যে হঠাৎ চায়ের কথা বলেছি। আমার অবশ্যি চা খেতে ইচ্ছা করছে। মাথায় তেল দিতেও ইচ্ছে করছে। ফুপু তুমি কি জানো এই পৃথিবীতে তোমার চেয়ে ভালো করে কেউ মাথায় তেল দিতে পারে না। তেল দেবার পর চুলের গোছা ধরে তুমি যে টুকুস করে টান দাও–এক্কেবারে স্বর্গীয় টান।

নাসেরকে বলে দিচ্ছি ও তোকে ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে চা খাইয়ে দেবে।

মাথায় তেল দিয়ে দেবে না?

সুলতানা হেসে ফেললেন। মীরু এমন মজা করে কথা বলে না হেসে থাকা সম্ভব না।

মীরু গম্ভীর গলা করে বলল, আমি নাসের-ফাসের কাউকে সঙ্গে নেব। তোমার বোরকাটা খুলে তুমি কি আমাকে দিতে পারবে?

সুলতানা ধমক দেবার ভঙ্গিতে তাকালেন। মীরু বলল, আমার এখন এমনভাবে যাওয়া উচিত যাতে কেউ আমাকে চিনতে না পারে। বোরকার অনেক উপকারিতা আছে।

মীরু বোরকা নিয়ে কোনো রসিকতা করবি না। এই রসিকতা আমার পছন্দ না।

মীরু বলল, আচ্ছা যাও তোমার এই মহান পোশাক নিয়ে আমি কোনো রসিকতা করব না। আমি এখন বিদায় হচ্ছি।

তোর বাবার সঙ্গে দেখা করে যা।

মীরু অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-এর ভেতর ঢুকল। তার বাবার বিছানার সামনে দাঁড়াল। আফজল সাহেব ঘুমের ওষুধের কারণে সারাক্ষণই ঘুমুচ্ছেন। তারপরেও মীরু যখন বলল, বাবা আমি এখন যাচ্ছি— আফজল সাহেব চোখ মেললেন এবং একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন। হাত বাড়ানোর অর্থ হাত ধরা। মীরু হাত ধরল না। সহজ-স্বাভাবিক গলায় বলল, বাবা আমি যাচ্ছি। তুমি রেস্ট নাও।

আফজল সাহেব বললেন, আচ্ছাগো মা।

মীরু বলল, তোমার দুঃশ্চিন্তার এখন আর কিছু নেই। ঢাকা শহরে আমাদের যত আত্মীয়-স্বজন আছেন সবাই চলে এসেছেন। আজ বিকেল থেকে ঢাকার বাইরের আত্মীয়-স্বজনরা আসতে শুরু করবেন। তারা কেউই সহজে যাবে না। চিড়িয়াখানা, শিশু পার্ক, লালবাগের কেল্লা এইসব দেখে বেড়াবে।

আফজল সাহেব মেয়ের কথায় হেসে ফেললেন। কারোর রসিকতায় তিনি কখনো হেসেছেন এমন উদাহরণ নেই। হার্ট এটাকের পর সম্ভবত তার মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়েছে। মীরুর কথা শুনে তিনি যে শুধু হাসলেন তা-না। অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন।

মীরু বলল, বাবা তুমি ঘুমাও। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হার্ট ঠিক কর। হার্টকে রেস্ট দাও।

আজফল সাহেব বললেন, তুই নিজেও রেস্ট নে। তোর ওপর দিয়ে বিরাট ধকল গিয়েছে।

বুকে ব্যথাট্যথা এসব তো এখন আর নেই?

না। মীরু শোন, তুই না থাকলে তো আজ আমি মরেই যেতাম রে মা! আফজল সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। তার ইচ্ছা করল কিছুক্ষণ মেয়ের হাত ধরে থাকতে। তিনি আবারো তার ডান হাতটা মেয়ের দিকে বাড়ালেন। মীরু এমন ভাব করল যেন সে দেখতে পায়নি। হাত ধরাধরি নাটক করতে তার ইচ্ছা করছে না।

 

নাসের নামের ভদ্রলোকের গাড়িতে করেই মীরু রওনা হয়েছে। ভদ্রলোক নিজে গাড়ি চালাচ্ছেন। কাজেই মীরুকে বসতে হয়েছে ড্রাইভারের পাশের সিটে। এই ভদ্রলোক কে? তাদের কোন ধরনের আত্মীয় তা মীরু ধরতে পারছে না। ভোর রাত থেকে ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে ডিউটি দিচ্ছেন। কাজেই ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হবার কথা। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলে মীরুর চেনার কথা। সে চিনতে পারছে না। মীরুর মনে ক্ষীণ সন্দেহ— এই ভদ্রলোকই কি সুলতানা ফুপুর ঠিক করা পাত্র? যার সঙ্গে মীরুর বিয়ে দেবার জন্যে সুলতানা ফুপু প্রায় জীবন দিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সেই ছেলের নাম নাসের না। তার নাম অন্যকিছু মোঘল রাজা বাদশার নামে নাম। ভদ্রলোকের মাথা ভর্তি টাক। এরকম টেকো মাথার কাউকে ফুপু তার পাত্র হিসেবে ঠিক করবেন তা ভাবা যায় না। তাছাড়া পাত্ররা কখনো হাসপাতালে ডিউটি দেয় না। তারা ভাব ধরে দূরে থাকে। হাসপাতালে ডিউটি দেয় গরিব প্রেমিকরা।

মীরুর ঘন ঘন হাই উঠছে। বাবাকে নিয়ে তার খুব টেনশান গিয়েছে। এখন টেনশানমুক্ত বলে হঠাৎ শরীর ছেড়ে দিয়েছে। যেভাবে তার হাই উঠছে গাড়ির মধ্যেই ঘুমিয়ে পরা বিচিত্র না। মীরু ঘুম কাটানোর জন্যেই কথা বলা শুরু করল—আপনার নামটা ভালো না, এটা কি আপনি জানেন?

মানুষটা কথা শুনে হাসল তবে মীরুর দিকে তাকাল না। সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, কেন ভালো না?

নাসের নামের সঙ্গে টাক মাথা মানায় না। নাসের নাম শুনলে মনে হয়। মানুষটার মাথা ভর্তি চুল।

ও আচ্ছা।

এই নাম ছাড়া আপনার অন্য কোনো নাম নেই?

আমার ডাক নাম জাহাঙ্গীর।

মোঘল বাদশার নামে যে নাম সেই নাম ডাক নাম হবে কেন? আপনার পোশাকি নাম হওয়া উচিত জাহাঙ্গীর। ডাক নাম নাসের। বাবা মা আদর। করে ডাকবেন নাসু।

আপনার সাজেশান আমার মনে থাকবে। ডাক নাম এবং পোশাকি নাম। ইন্টারচেঞ্জ করার সুযোগ থাকলে করে ফেলব। আপনি কোথায় যাবেন। বললে আমার গাড়ি চালাতে সুবিধা হয়।

সরি আপনাকে বলা হয়নি–আমি যাব মগবাজারে। আমরা কি ভুল পথে চলে এসেছি?

সামান্য এসেছি। এটা কোনো ব্যাপার না। আপনার ফুপু বলেছিলেন পথে কোথাও গাড়ি থামিয়ে আপনাকে বেশি চিনি দিয়ে কড়া এক কাপ চা খাওয়াতে। এখন কি খাবেন? এখানে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে আমার পরিচিত।

না।

নাসের এক ঝলক মীরুর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোনো কারণে আমার ওপর বিরক্ত। আপনার বিরক্তি উৎপাদনের মতো কিছু কি আমি করেছি? আমার মাথায় কোনো চুল নেই এই কারণেই কি আপনি বিরক্ত? বারবার মাথার চুলের দিকে তাকাচ্ছেন তাই বললাম।

মীরু চুল প্রসঙ্গে না গিয়ে হঠাৎ বলল, আচ্ছা শুনুন। আপনি কি সেই ব্যক্তি যার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবার জন্য সুলতানা ফুপু প্রায় জীবন বাজি রেখে ফেলেছেন?

জি।

আপনিও মনে হয় আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন।

অপেক্ষা করছি কারণ আপনার ফুপু বলেছেন— এই সৌরজগতে আপনার মতো ভালো মেয়ে নেই। আপনার ফুপুর কথা আমি খুব বিশ্বাস করি।

আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে যে আমার মতো ভালো মেয়ে সৌরজগতে নেই?

হ্যাঁ হচ্ছে। আপনি আপনার বাবার চিকিৎসার যে ব্যবস্থা করেছেন সেটা চিন্তাই করা যায় না। রাত সাড়ে তিনটার সময় একা ওষুধ কিনতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে শাহবাগে গিয়েছেন।

আপনি ভুল করেছেন। আমি একা যাইনি আমার সঙ্গে বলশালী। একজন পুরুষ মানুষ ছিল। সে আমাকে ভরসা দিয়েছিল যে কোনো ভয় নেই।

নাসের অবাক হয়ে বলল, পুরুষ মানুষের কথা জানতাম না। কে ছিল। আপনার সঙ্গে?

মীরু হাসতে হাসতে বলল, যে রিকশায় করে গিয়েছি সেই রিকশার রিকশাওয়ালা ছিল।

নাসের শব্দ করে হেসে ফেলল। হাসি থামিয়ে বলল, আপনার সেন্স। অব হিউমার অসম্ভব ভালো।

মীরু বলল, এখন আমি যাই করব তাই আপনার কাছে ভালো লাগবে। কারণটা খুব সহজ। আমাকে না দেখে শুধুমাত্র সুলতানা ফুপুর কথা শুনেই আপনার আমাকে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে যখন দেখা হল তখন সেই পছন্দ হওয়াটা কমে না গিয়ে বাড়ল। প্রায় প্রেম পর্যায়ে চলে গেল। এখন যদি আমি শব্দ করে নাক ঝাড়ি এবং নাকের সর্দি আপনার গাড়ির সিট কাভারে মুছে ফেলি সেটাও আপনার কাছে ভালো লাগবে।

কেন?

ভালো লাগার জন্যে আপনি কোনো-না-কোনো লজিক দাঁড় করিয়ে ফেলবেন। প্রেমিকরা এই কাজটা খুব ভালো করে।

নাসের বলল, সর্দি গাড়ির সিটে মুছবেন। এটা ভালো লাগবে এরকম লজিক দাঁড় করানো তো কঠিন।

কঠিন কিছুই না। তখন আপনি ভাববেন— মেয়েটা স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড। তার মধ্যে কোনো ভনিতা নেই। তার বিষয়ে কে কী ভাবল তা নিয়ে এই মেয়ের কোনো মাথাব্যথা নেই। কোনো দিকে না তাকিয়ে এই মেয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে সর্দি গাড়ির সিটে মুছে ফেলেছে। একসেলেন্ট। এ রকম একটা মেয়েই তো আমি চাচ্ছিলাম।

নাসের শব্দ করে হাসছে। মীরু বলল, আপনার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুব মজা পাচ্ছেন।

নাসের বলল, হ্যাঁ মজা পাচ্ছি।

মীরু বলল, আমি যখন মগবাজারে পৌছব তারপর থেকে আপনি আমার আর কোনো কর্মকাণ্ডে মজা পাবেন না। বরং আমার প্রতিটি কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হবেন। নাসের বিস্মিত হয়ে বলল, কেন বলুন তো?

মীরু বলল, কারণ আমি যাচ্ছি মগবাজার কাজি অফিসে। সেখানে আমার আজ গোপনে বিয়ে করার কথা। যার সঙ্গে বিয়ে হবার কথা তার নাম বারসাত। আমার যাবার কথা ছিল সকাল এগারোটায়। বাবার শরীর খারাপের কারণে যেতে পারিনি। আমার মনে হয় না বারসাত এখনো। আমার জন্যে বসে আছে, তারপরেও খোঁজ নেবার জন্যে যাচ্ছি। এখন বলুন আমাকে কি আপনার অসহ্য মনে হচ্ছে?

নাসের বলল, না মনে হচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগে আপনাকে যতটা ভালো লাগছিল— এখন তারচেয়ে বেশি ভালো লাগছে। সত্যি বলছি। বারসাত সাহেব যদি থাকেন এবং আপনাদের বিয়েটা যদি হয় তাহলে আমি বিয়ের সাক্ষী হিসেবে আমাকে অফার করব।

 

বারসাতকে কাজি অফিসে পাওয়া গেল না। মীরু নাসেরকে সঙ্গে নিয়ে বারসাতের মেস-এ গেল। সেখানেও সে নেই।

নাসের বলল, আপনাকে খুবই ক্লান্ত লাগছে। আসুন এক কাপ চা খাই।

মীরু বলল, চলুন চা খাই। এখন মনে পড়েছে আমি দুপুরেও কিছু খাইনি। ক্ষিধের জন্যেই মাথা ধরেছে।

আমি আপনার মাথা ধরা সারিয়ে দেব।

কীভাবে?

 

খুব ভালো চা খাওয়াব। তারপর আপনার মাথা ধরা না সারা পর্যন্ত আপনাকে গাড়িতে নিয়ে ঘুরব।

মীরু চোখ বন্ধ করে ফেলল।

 

মীরু কতক্ষণ পরে চোখ মেলল তা সে নিজেও জানে না। তার কাছে মনে হল সে দীর্ঘ ঘুম দিয়ে জেগে উঠেছে। ঘুমের ভেতর নানা ধরনের স্বপ্ন সে দেখে ফেলেছে। স্বপ্নের মধ্যে গা ছমছমানো বিশেষ স্বপ্নও আছে। সে ক্লাসে বসে আছে, গায়ে শুধু পাতলা একটা চাদর। আর কিচ্ছু নেই। এই চাদরটাও আবার হাঁটুর উপর রাখা। স্যার বললেন, এই যে চাদর গায়ে মেয়ে আজকের ক্লাসের পড়া বুঝেছ?

মীরু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

তাহলে এক কাজ কর। বোর্ডে চলে এসো। বোর্ডে এসে সবাইকে বুঝিয়ে দাও।

স্যার আমি বোর্ডে যেতে পারব না। আমার একটু অসুবিধা আছে।

কী অসুবিধা?

সেটা স্যার বলতে পারব না।

কোনো অজুহাত শুনতে চাচ্ছি না। এসো বোর্ডে। এসো বলছি।

মীরুর তখন ঘুম ভাঙল। সে দেখল গাড়ি রাস্তার ওপর থেমে আছে। গাড়ির ওপর মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। নাসের নামের মানুষটা ড্রাইভারের সিটে ঝিম ধরে বসে আছে। নাসের হাসিমুখে বলল, ঘুম ভেঙেছে?

মীরু বলল, আমরা কোথায়?

নাসের বলল, আমরা রাস্তায়। রাস্তা কাটা ছিল। বৃষ্টির পানিতে পুরো রাস্তা ঢাকা। বুঝতে পারিনি গাড়ি নিয়ে খাদে পড়ে গেছি। আপনি গভীর ঘুমে ছিলেন কিছু বুঝতে পারেননি।

আমাকে ডাকলেন না কেন?

এত আরাম করে ঘুমুচ্ছিলেন, ডাকতে মায়া লাগল।

আমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছি?

এক ঘণ্টা দশ মিনিট।

বলেন কি! আপনি এতক্ষণ কী করলেন?

ঝিম ধরে বসে থাকলাম। বৃষ্টি দেখলাম। চা খাবেন?

এখানে চা কোথায় পাবেন?

আমি মোবাইলে টেলিফোন করে চা আনিয়েছি। ফ্লাস্ক ভর্তি গরম চা এবং সিঙাড়া আছে। চা দেই?

মীরু বলল, দিন। আপনি দেখি খুব গোছানো মানুষ।

নাসের বলল, আমি অবশ্যই গোছানো তবে মেয়েরা গোছানো মানুষ পছন্দ করে না। মেয়েরা পছন্দ করে অগোছালো মানুষ।

আপনার এরকম ধারণা?

জি। গাড়ি যখন খাদে পড়ল তখন যদি হৈচৈ করে আপনার ঘুম ভাঙাতাম, খুব অস্থির হয়ে যেতাম সেটা আপনার অনেক বেশি পছন্দ হত।

মীরু বলল, ঝুম বৃষ্টিতে গাড়িতে বসে গরম চা খাচ্ছি, সিঙাড়া খাচ্ছি। এটা আমার বেশ পছন্দ হচ্ছে। চা খাবার পর আমরা কি গাড়িতে বসে থাকব নাকি গাড়ি খাদ থেকে উঠানোর ব্যবস্থাও আপনি করে রেখেছেন?

নাসের হাসিমুখে বলল, চা খাবার পর আপনাকে নিয়ে একটা মাইক্রোবাসে উঠব। মাইক্রোবাস আনানো হয়েছে। আমার লোকজন মাইক্রোবাসে বসে আছে। তারা এসে খাদে পড়া গাড়ি তুলবে। আমরা মাইক্রোবাস নিয়ে চলে যাব।

মীরু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। এত গোছানো মানুষ মেয়েরা পছন্দ করে না। যখন গরম চা খাচ্ছিলাম তখন। আপনাকে ভালো লাগছিল। বিপদ থেকে উদ্ধারের সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন শুনে আর ভালো লাগছে না। এখন আপনাকে রোবট রোবট লাগছে।

নাসেরের অফিসের লোকজন ছাতা হাতে চলে এসেছে। মীরু কিছুক্ষণ ভুরু কুচকে তাদের দেখল। তারপর নাসেরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কেন জানি গাড়ি থেকে নামতে ইচ্ছা করছে না। আমি কি আরেক কাপ চা খেয়ে তারপর নামতে পারি?

অবশ্যই পারেন।

নাসের কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিল। মীরু বলল, আপনাকে অন্যরকম লাগছে। কেন অন্যরকম লাগছে বুঝতে পারছি না।

নাসের বলল, আমাকে অন্যরকম লাগছে কারণ আমি আমার টাক মাথা ঢেকে ফেলেছি। ক্যাপ পরেছি।

মীরু বলল, আশ্চর্য! এই ব্যাপারটা আমি লক্ষ্য করলাম না কেন?

নাসের বলল, আপনার পর্যবেক্ষণ শক্তি খুব ভালো বলে আপনি লক্ষ্য করেননি। যাদের পর্যবেক্ষণ শক্তি খুব ভালো তারা প্রায়ই খুব কাছের জিনিস দেখতে ভুল করে।

মীরু নাসেরের দিকে তাকিয়ে আছে। নাসের কি কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কথাগুলি বলেছে? সে-রকম মনে হচ্ছে না। আবার কেন জানি মনে হচ্ছে। মীরু বলল, ভালো কথা, আপনি কি আমার নাম জানেন?

আপনার নাম মীরু।

মীরু আমার নাম ঠিকই আছে কিন্তু এই নামটা আমার অপছন্দের। আমার পছন্দের নাম ঐন্দ্রিলা। আমার চা খাওয়া শেষ হয়েছে। এখন আমি নামব।

নাসের বলল, আমরা কি আরেকবার বারসাত সাহেবের মেসে খোঁজ নিয়ে দেখব। উনি ফিরেছেন কি না।

মীরু ক্লান্ত গলায় বলল, না আমি বাসায় যাব।

আপনার মাথা ধরা কি কমেছে?

হ্যাঁ কমেছে।

যে ভাবে ভুরু কুঁচকে আছেন মনে হচ্ছে না মাথা ধরা কমেছে।

না কমলেও সমস্যা নেই।

আমি চাচ্ছি না আপনি মাথা ধরা নিয়ে বাসায় যান।

কি বলতে চাচ্ছেন পরিষ্কার করে বলুন।

নাসের শান্ত গলায় বলল, আপনার সঙ্গে হয়ত আমার আর দেখা হবে না। আমাদের শেষ দেখায় হাইফেনের মত থাকবে মাথাব্যথা। এই হাইফেনটা না থাকলে হয় না।

মীরু বলল, আমাকে বাসায় নামিয়ে দিন। আমার কথা বলতে ভাল লাগছে না।

দুটা মাছি ভন ভন করছে

বারসাতের মুখের ওপর অনেকক্ষণ ধরে দুটা মাছি ভন ভন করছে। একটা বড় একটা ছোট! বড়টার রঙ ঘন নীল। বারসাত বিস্মিত চোখে মাছি দুটার দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি-বাদলার সময় মাছি উড়ে না। বৃষ্টি শুরু হলেই মাছিরা যে যেখানে আছে সেখানে ঝিম ধরে বসে থাকে। বৃষ্টির পানি পাখায় লাগলে মাছিদের উড়তে অসুবিধা হয় বলেই তাদের এত সাবধানতা।

অথচ এই মাছি দুটা উড়েই যাচ্ছে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। সেদিকেও তাদের নজর নেই। তারা উড়ে উড়ে জানালা পর্যন্ত যাচ্ছে আবার ফিরে এসে বারসাতের নাকের কাছাকাছি ওড়াউড়ি করছে। বারসাতের কেন জানি মনে হচ্ছে এই মাছি দুটার একটা (বড়টা যেটার গায়ের রঙ ঘন নীল।) তার নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকে পড়ার চেষ্টায় আছে। যে কোনো। মুহর্তে এই কাজটা সে করবে।

খুবই অদ্ভুত চিন্তা-ভাবনা। মাছিরা এমন কাজ কখনো করবে না। তারা জাপানি কামাকাজি পাইলট না। বারাসাত তাদের শত্রুও না। তারপরেও সে এই চিন্তা মাথা থেকে দূর করতে পারছে না। জ্বর বেশি হলে মানুষের মাথায় উদ্ভট চিন্তা আসে। বারসাতের গায়ে জ্বর। বেশ ভালোই জ্বর। মাথার ভেতর এরোপ্লেন চলার মতো শব্দ হচ্ছে। জ্বর খুব বেড়ে গেলে মাথার ভেতর এরোপ্লেন চলার মতো শব্দ হয়। এরকম জ্বর-তপ্ত মাথায় উদ্ভট চিন্তা আসতেই পারে।

বারসাত শুয়ে আছে তার দূর-সম্পর্কের মামার বাগানবাড়িতে। বাড়ির নাম পদ্মাকাঠের একতলা বাড়ি। বড় বড় জানালা। জানালা খুললেই চোখে পড়ে বাড়ির পেছনের পদ্ম পুকুর। পুকুরে সত্যিকার পদ্ম ফুটে আছে। মীরু এই বাড়ি দেখলে মুগ্ধ হত। সেটা সম্ভব হল না। মীরু আসেনি, বারসাতকে একা আসতে হয়েছে। বারসাত তিন বেহালাবাদক ঠিক করে রেখেছিল। এরা পদ্ম নামের বাড়ির উঠানে বসে থাকবে। বারসাত এবং মীরুর বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতে দেখলে বেহালায় বাজাতে থাকবে—

লীলাবালী লীলাবালী
বড় যুবতী কন্যা কি দিয়া সাজাইতাম তরে?

বারসাতের আসতে দেরি দেখে তিন বেহালাবাদকের মধ্যে দুজন বারান্দার সোফায় লম্বা হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। একজন জেগে রইল। সেই একজন বারসাতকে একা ঢুকতে দেখে খানিকটা বেদিশা হয়ে গেল। তারপরেও সে বেহালা হাতে নিল। বাজাব না-কি বাজাব না ভঙ্গিতে তাকাল। বারসাত বলল, লাগবে না। বেহালা বাজানোর দরকার নেই।

বেহালাবাদক বলল, আপনার কী হয়েছে? চোখ টকটকা লাল।

বারসাত বলল, আমার কিছু হয় নাই, চোখে লাল রঙ মেখেছি। মেয়েরা ঠোটে লিপস্টিক দেয়। আমি ঠোটে দিয়েছি আই স্টিক। আপনাদের তো টাকা-পয়সা আগেই দিয়ে রেখেছি এখন বাড়ি চলে যান। বিদায়।

বাজনা বাজাব না?

বাজনা বাজাতে হবে না। বাজনার দরকার ছিল আমার স্ত্রীর জন্যে। স্ত্রী নাই, বাজনাও নাই।

উনি কোথায়?

জানি না উনি কোথায়। আপনারা বিদায় হন। টা টা বাই বাই।

ভাই সাব আপনার কি জ্বর? আপনি তো দাঁড়ায়ে থাকতে পারতেছেন না।

বারসাত বলল, দাঁড়িয়ে থাকতে না পারলেও কোনো সমস্যা নেই। আমি এক্ষুনি বিছানায় শুয়ে পড়ব। এক মাস ঘুমাব। গিনিস বুক অব রেকর্ডে নাম তুলে ফেলব। একবিংশ শতাব্দীর রিপ ভ্যান উইংকেল।

বারসাত কতক্ষণ ঘুমুচ্ছে বা কতক্ষণ ঘোরের মধ্যে আছে তা সে জানে না। তার কাছে মনে হচ্ছে সে বেশির ভাগ সময় অচেতন অবস্থাতেই থাকে। মাঝে মাঝে সামান্য চেতনার মতো আসে তখন পদ্ম নামের বাগানবাড়ির কেয়ারটেকারের সঙ্গে তার কিছু কথাবার্তা হয়। কেয়ারটেকারের নাম রফিক। রফিকের চেহারা বারসাতের কাছে একেক সময় একেক রকম মনে হয়। প্রবল জ্বরের কারণেই এরকম হচ্ছে এটা বারসাত বুঝতে পারছে। মেয়েরা সাজগোছ করে চেহারা বদলায়। ছেলেদের চেহারা বদলায় না। রফিকের চেহারা একেক সময় একেক রকম দেখানোর আর কোনো কারণই নেই। জ্বর বারসাতের মাথা এলোমেলো করে দিচ্ছে।

জ্বর খুব যখন বাড়ছে তখন আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে। মাথার ভেতর ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। এক পর্যায়ে ঝিঝি পোকার ডাকটা বেহালার শব্দের মতো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তিন বেহালাবাদক বাজাচ্ছে—

লীলাবালী লীলাবালী
বড় যুবতী কন্যা কি দিয়া সাজাইতাম তরে।

 

বারসাত ডাকল, রফিক রফিক

রফিক প্লেটে করে কাটা পেঁপে নিয়ে ঢুকল। যে কোনো খাদ্যদ্রব্য দেখলেই বারসাতের সমস্ত শরীর মোচড় দিয়ে ওঠে। ইচ্ছা করে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যে ঢুকেছে তার গায়ে বমি করে ভাসিয়ে দেয়। এবারো একই ঘটনা ঘটল। বারসাত নিজেকে সামলে নিয়ে অনেক কষ্টে প্রায় আদুরে গলায় বলল, কেমন আছ রফিক?

রফিক হড়বড় করে বলল, আমি তো ভালোই আছি। আফনের অবস্থাটা কী কন দেহি।

আমিও ভালোই আছি শুধু এই মাছি দুটা খুব বিরক্ত করছে। মাছি দুটা মারতে পারলে একশ টাকা বকশিশ পাবে। বড় মাছিটা মারতে পারলে পাবে সত্তর টাকা আর ছোটটা মারতে পারলে ত্রিশ। দেখ তো মারতে পার কি না।

একশ টাকা বকশিশ রফিককে কাবু করতে পারল না। সে পেঁপের প্লেট বিছানার পাশের টেবিলে রাখল। কঠিন কোনো কথা বলবে এর রকম ভঙ্গিতে বারসাতের খাটের পাশে এসে দাঁড়াল। থমথমে গলায় বলল, স্যার আমি আপনেরে দুইটা কথা বলব মন দিয়া শুনেন।

বারসাত বলল, তোমার কথা আমি মন দিয়েই শুনি রফিক। মীরুর কথা যতটা মন দিয়ে শুনি ততটা মন দিয়ে হয়তো শুনি না। সেটা সম্ভবও না। তারপরেও…

স্যার আপনি কথা কইয়েন না। আমি কী বলতেছি শুনেন। আপনার আল্লাহর দোহাই লাগে।

বল শুনছি।

আপনের শরীর খুবই খারাপ। আপনারে এইখানে রাখতে কোনো ভরসা পাই না। আপনের এইখানে মৃত্যু হলে আমরা বিরাট বিপদে পড়ব।

বিপদের কী আছে? মানুষের মৃত্যু হয় না? মৃত্যু হলে এখানে কবর দিয়ে দিবে। কিংবা আমাকে ইটসহ বস্তায় ভরে পদ্ম পুকুরে ফেলে দেবে। কোনো সমস্যা নাই।

স্যার শুনেন, উল্টাপাল্টা কথা বলে লাভ নাই। আজ সন্ধ্যায় আমি টেম্পো ভাড়া করে আনতেছি। আমি আপনারে নিজে ঢাকায় দিয়ে আসব।

রফিক এখন তুমি আমার কথা মন দিয়ে শোনো আমার শরীরের যে অবস্থা–পথেই মারা যাব তখন তুমি বিরাট বিপদে পড়বে। পুলিশ তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। তোমার সঙ্গে নিরীহ বেবিটেক্সিওয়ালাকে ধরে নিয়ে যাবে। হেভি প্যাদানি দেবে। পুলিশের পাদানি খেয়েছ কখনো? মারাত্মক জিনিস।

স্যার আপনি ঢাকার বাড়ির আত্মীয়-স্বজনের ঠিকানা দেন। আমি তাদের নিয়া আসি।

তোমাকে এইসব কিছু করতে হবে না। আমি শরীরে বল পাওয়া শুরু করেছি। এক-দুই দিনের ভেতর উঠে বসব। তখন তুমি একটা বেবিটেক্সি ডেকে আনবে। আমি বেবিটেক্সিতে উঠে ফুড়ুৎ করে চলে যাব। আমার সঙ্গে তোমাকে আসতে হবে না। কাজেই পথে যদি মারা যাই তোমাকে কেউ ধরবে না। বেবিটেক্সিওয়ালাকে ধরবে।

স্যার আপনি এত কথা বলতেছেন কেন?

শরীর যে ঠিক হতে শুরু করেছে এটা তোমাকে বোঝানোর জন্যে এত কথা বলছি। এখন তুমি দয়া করে পেঁপের পিরিচটা সামনে থেকে নাও। তোমাকে তো বলেছি আমার সামনে কোনো খাদ্যদ্রব্য আনবে না। আমি বাতাস খেয়ে বাঁচব। এখন থেকে আমি বায়ু-ভুক।

আজকেও কিছু খাবেন না?

না। কিছু না খাওয়াও এক ধরনের চিকিৎসা। এই চিকিৎসার নাম উপবাস চিকিৎসা।

অন্য কিছু খাইতে ইচ্ছা করে?

এই মুহূর্তে একটা জিনিস খেতে ইচ্ছা করছে। জিনিসটার নাম মার্বেল সিঙাড়া। মার্বেলের সাইজ। একসঙ্গে দুটা-তিনটা মুখে দেয়া যায়। মগবাজার কাজি অফিসের কাছে এই সিঙাড়া বানানো হয়। মীরুর খুবই পছন্দের খাদ্য। একবার সে আটত্রিশটা সিঙাড়া খেয়ে ফেলেছিল। তখন আমি তাকে টাইটেল দিলাম সিঙাড়া কন্যা। এই অপূর্ব সিঙাড়া যে কারিগর বানায় তার নাম নেক মর্দ। অদ্ভুত নাম না?

রফিক জবাব দিল না। পেপের প্লেট নিয়ে চলে গেল। বারসাত চিৎ অবস্থা থেকে পাশে ফিরল। তার মাথায় কবিতার লাইন আসছে। সবই উল্টা হয়ে আসছে। ব্যাপারটা কী? মাথা কি পুরো খারাপ হয়ে গেল–

য়াখিরা নম্পক ন্নক্ষু ব্ধক্ষু ন্তেপ্রালজ
য়াকিআঁ যাকিআঁ গুচিণরচ লজস

বারসাত বুঝতে পারছে না তার পৃথিবী উল্টো হয়ে যাচ্ছে কি না। মাথার ভেতর বড় রকমের কোনো ঝামেলা অবশ্যই হচ্ছে। হোক ঝামেলা। মাথার ভেতর উলটপালট ঝামেলা হলে খারাপ লাগে না।

Ring a ring O roses
A pocket full of poises
Atishoo! Atishoo!
We alf fall down.

এই কবিতাটা মাথায় উল্টা আসেনি। ঠিকমতোই এসেছে। ১৬৬৫ সনে লন্ডনে যখন ভয়াবহ plague দেখা দিল তখন লন্ডনের ছেলেমেয়েরা এই ছড়াটা রাস্তায় রাস্তায় বলে বেড়াত। We all fall do down. আমরা সবাই মরে পড়ে যাব। কারণ আমাদের হয়েছে ভয়াবহ ব্যাধি–প্লেগ!

রফিক রফিক।

রফিক বিরক্ত মুখে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। বারসাত বলল, তাড়াতাড়ি বালতিটা আনো। আমি বমি করব। বমির টাইম চলে এসেছে। বমি করার পর কী হবে জানো? We all fall down.

রফিক বালতি নিয়ে এসেছে। বালতির রঙ ঘন লীল। রঙটা চোখে লাগছে। অসুস্থ অবস্থায় কটকটা হলুদ রঙ চোখে লাগে। লাল রঙ লাগে। নীল রঙ কি লাগে?

রফিক!

জি স্যার।

আমি আর বাঁচব না। আমার আত্মীয়-স্বজনকে খবর দাও।

স্যার বলেন কারে খবর দিব।

আমার মাকে খবর দিতে পার। তাকে খবর দেবার সমস্যা কী জানো? তিনি এসেই আমার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করবেন। ক্যাটক্যাট কথা বলবেন। এমন সব কথা যা শুনলে নিতান্ত ভালোমানুষের গায়েই আগুন ধরে যাবে।

স্যার কথা না বলে চুপ করে শুয়ে থাকেন। রেস্ট নেন।

কথা বলাতেই আমার রেস্ট হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের একটা বিখ্যাত গান আছে— আমার এই কথা বলাতেই আনন্দ। উঁহু ভুল করেছি, গানটা হচ্ছে— আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ। রফিক।

জি।

তুমি বিরক্ত মুখ করে হলেও আমার যথেষ্ট সেবা করেছ। আমি যদি কোটিপতি হতাম তাহলে উইল করে তোমাকে লাখ বিশেক টাকা দিয়ে। যেতাম। আমি হতদরিদ্র। বাজারে আমার দেনা হল তেইশ হাজার টাকা। বিয়ে যে আমার হয়নি সেটা একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। রফিক!

জি।

দুটা মাছি আমার নাকের কাছে ভ্যান ভ্যান করছিল। এরা কোথায় গেছে একটু দেখ তো। এদেরকে ধরার জন্যে একশ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলাম। জীবিত বা মৃত একশ টাকা দেয়া হবে।

স্যার আপনি শুয়ে থাকেন আমি মাথায় পানি ঢালি।

যা ঢালতে ইচ্ছা হয় ঢাল। একটাই শুধু কথা, আমার মা যদি আমার খোঁজে চলে আসে তাহলে বলবে আমি মারা গেছি। বলতে পারবে না?

অবশ্যই বলতে পারবে। বলতে না পারার কিছু নেই। সামান্য মিথ্যা বলা হবে। তবে ঠিক মিথ্যাও না। আমি তো মারাই যাচ্ছি। আমি যদি অতি বিখ্যাত কেউ হতাম তাহলে তুমি একটা বই লিখতে পারতে–

বারসাত আলীর সঙ্গে
শেষ কিছু সময়।

আমি বিখ্যাত কেউ না। বিখ্যাত কেউ হবার কোনো সম্ভাবনাও আমার মধ্যে নেই। আমার মত মানুষরা জীবন শুরু করে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে। জীবন শেষ করে কোচিং সেন্টারের ম্যানেজার হিসেবে।

রফিক বারসাতের মাথায় পানি ঢালতে শুরু করেছে। বারসাত কথা। বলা বন্ধ করেছে। তবে এখন তার অন্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। তার কাছে। মনে হচ্ছে বিছানার পাশে তার মা দাড়িয়ে আছেন। তাঁর মুখ থেকে জর্দার গন্ধ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। জর্দার কড়া গন্ধের কারণে বারসাত বুঝতে পারছে না— তার মা কি সত্যি সত্যি চলে এসেছেন না কি সে যা দেখছে। ঘোরের মধ্যে দেখছে।

মাকে দেখতে ইচ্ছা করছে না। বারসাত চোখ বন্ধ করল। তাতেও লাভ হল না। চোখ বন্ধ অবস্থাতেও সে তার মাকে পরিষ্কার দেখতে পেল।

লাভের মধ্যে লাভ আগের মা জর্দার গন্ধ নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ছিলেন। এই মা কথা বলা শুরু করলেন।

এই তোর কী হয়েছে?

জানি না।

শরীর থেকে চামড়া উঠছে না কি?

শরীর থেকে চামড়া উঠবে কেন? আমি কি সাপ?

শরীর থেকে চামড়া ওঠা রোগ তোর বাপেরও হয়েছিল। এই রোগেই সে মারা গেল। এটা তোদের বংশের ধারা। চামড়া ওঠা রোগে মৃত্যু।

দুষ্ট লোকে বলে বাবা মারা গেছেন তোমার ক্যাটক্যাটানি শুনে। বাবা যখন মৃত্যুশয্যায় তখনো তুমি তার কানের কাছে দিনরাত ক্যাটক্যাট করেছ।

তোর বাপের সঙ্গে কী করেছি সেটা তোর বাপের আর আমার ব্যাপার। রোজ হাশরে আমার মধ্যে আর তোর বাপের মধ্যে ফয়সালা হবে।

ফয়সালা হলে তো ভালোই।

লোকমুখে শুনলাম তুই গোপনে বিয়ে করেছিস।

বিয়ে করার চেষ্টা করেছিলাম মা। শেষ মুহূর্তে পাত্রী আসেনি বলে বিয়ে হয়নি।

তাহলে তো ভালোই হল। এখন তুই আমার বোনের মেয়েকে বিয়ে কর।

ফাতিলকে বিয়ে করতে বলছ?

ফাতিলটা আবার কে?

লতিফাকে উল্টো করে বললাম ফাতিল। এখন বেশির ভাগ শব্দ আমার। মাথায় উল্টো করে আসছে।

লতিফার মত মেয়ে পাবি না। তোকে সে মাথায় করে রাখবে। একশ বার লাথি দেবার পরেও মাথা নিচু করে রাখবে। কোনো শব্দ করবে না।

বারসাত গুনগুন করে বলল,

লাথি-কন্যা নাম
আজ আমি তোমাকে দিলাম।

কী বললি?

একটা কবিতা বলেছি মা।

কী কবিতা?

লতিফাকে নিয়ে কবিতা। তুমি কি একটা কাজ করবে? লতিফাকে পাঠিয়ে দেবে। আমি অসুস্থ মানুষ। সে আমার সেবা করুক।

তুই কি পাগলটাগল হয়ে গেলি? একটা কুমারী মেয়েকে এমন নির্জন জংলা টাইপ জায়গায় একা পাঠিয়ে দেব? তোর চিন্তা-ভাবনা তো ভালো না। তোর চিন্তা-ভাবনাও দেখি তোর বাবার মত।

বাবার চিন্তা-ভাবনা এ রকম ছিল?

হুঁ। আমি তোর বড় বোনের জন্মের সময় এক মাস ছিলাম হাসপাতালে। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে দেখি তোর বাবা অল্প বয়েসী এক কাজের বুয়া রেখেছে। সেই বুয়া ঠোটে লিপস্টিক মাখে। তোর বাবার দিকে তাকিয়ে কেমন করে জানি হাসে।

তুমি কি করলে, ঝেঁটিয়ে বিদায় করলে?

বিদায় করব কি? তোর বাবা বিদায় করতে দিলে তবে না বিদায় করব। একদিন দেখি কি সে তোর বাবার পিঠে তেল মালিশ করে দিচ্ছে।

ঐ বুয়ার নাম কি ছিল মা?

রানী।

শেষ পর্যন্ত তাকে বিদায় করলে কি ভাবে মা?

কি কষ্টে যে বিদায় করেছি তা শুধু আমি জানি আর আল্লাহপাকে জানেন। তোর বাবা তাকে ছাড়াবে না, সেও এই বাড়ি ছেড়ে যাবে না।

উনি দেখতে কেমন ছিলেন মা?

উনি উনি করছিস কেন? কাজের বুয়ার আবার উনি কি।

দুষ্টু লোকে যে বলে বাবা গোপনে ঐ বুয়াকে বিয়ে করেছিলেন সেই জন্যেই সম্মান করে উনি বলছি।

এক থাপ্পড় দিয়ে আমি তোর দাঁত ফেলে দেব।

ছড়া শুনবে মা?

কী শুনব?

ছড়া। ইংরেজি ছড়া—

Atishoo! Atishoo!
We all fall down.

এর মানে কী?

এর মানে হল আমাদের সবারই প্লেগ রোগ হয়েছে। আমরা সবাই মরে। পড়ে থাকব তুমি, আমি, রানী বুয়া, লতিফা, ঐন্দ্রিলা, নীলুফার।

ঐন্দ্রিলার সঙ্গে কথা

আমি কি ঐন্দ্রিলার সঙ্গে কথা বলতে পারি? তার আরেক নাম মীরু।

আমার নাম ঐন্দ্রিলা। আপনি কে?

ঐন্দ্রিলা তুমি আমাকে চিনবে না। আমার নাম নীলুফার… আমি…

আপনি কি অন্য কোন সময় টেলিফোন করবেন? আজ আমাদের বাসায় বিরাট ঝামেলা।

ঐন্দ্রিলা আমি তিন মিনিটের বেশি সময় নেব না। আমার নাম নীলুফার। আমার ছেলের নাম টুকটুকি। বারসাত আমার ছেলের প্রাইভেট টিউটর। তুমি নিশ্চয়ই বারসাতকে চেন? চেন না?

জি চিনি।

আমি যতদূর জানি বারসাতের সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা হয়েছিল। আমি ছিলাম একজন সাক্ষী। তুমি আসনি… আমরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম…

আপনার সঙ্গে আরেকদিন কথা বলি। আজ আমাদের বাসায় বিরাট ঝামেলা।

আমার কথা শেষ হয়ে গেছে। ঐদিন তুমি আসনি। কেন আসনি সেটা তোমার ব্যাপার। না আসার মত কারণ নিশ্চয়ই তোমার আছে। আমি তোমাকে টেলিফোন করেছি বারসাতের খবর জানার জন্যে। ও হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে। বারাসাত কোথায় আছে জানো?

না।

কালিয়াকৈরে বারসাতের দূর সম্পর্কের কোন আত্মীয়ের একটা বাগানবাড়ি আছে। বিয়ের পর তোমাকে নিয়ে বারসাতের সেই। বাগানবাড়িতে যাবার কথা ছিল। তুমি কি সেই বাগানবাড়ির ঠিকানা জাননা?

না।

বারসাতের তিন বোন ঢাকায় থাকে। তার মা-ও ঢাকায় থাকেন। তুমি কি তাদের ঠিকানা জানো?

না।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছ। তোমাকে বিরক্ত করা আমার উদ্দেশ্য না। আমি বারসাতের খোঁজ জানতে চাচ্ছি। ওর কোন বন্ধু-বান্ধবের টেলিফোন নাম্বার কি তুমি জানো?

না।

তুমি কি আমার টেলিফোন নাম্বারটা রাখবে? যদি তোমার সঙ্গে বারসাতের যোগাযোগ হয় তাহলে কষ্ট করে যদি আমাকে জানাও। I will be so happy.

দিন আপনার টেলিফোন নাম্বার।

আমি তুমি তুমি করে বলছি। দয়া করে এতে কিছু মনে করো না। আমি বয়সে তোমার অনেক বড়।

আপনি টেলিফোন নাম্বারটা দিন।

তোমার সঙ্গে কাগজ-কলম কি আছে?

কাগজ-কলম লাগবে না। টেলিফোন নাম্বারটা বলুন। একবার শুনলেই আমার মনে থাকবে। আমার স্মৃতিশক্তি ভাল।

আচ্ছা থাক তোমার টেলিফোন নাম্বার রাখতে হবে না। মনে হচ্ছে তুমি খুবই বিরক্ত। সরি।

নীলুফার খট করে টেলিফোন রেখে দিল। মীরুর মুখে কোন ভাবান্তর হল না। সে টেলিফোন রেখে ছুটে গেল রান্নাঘরে। রান্নাঘরে আজ ক্রমাগত চা বানানো হচ্ছে। ভাপা পিঠা বানানো হচ্ছে। যার ইচ্ছা চা ভাপা পিঠা নিয়ে যাচ্ছে। বাড়ি ভর্তি মানুষ। পিঠা এবং চা বানিয়ে দুজন কাজের মেয়ে এবং মীরুর মা জাহেদা বানু কূল পাচ্ছেন না।

বাড়িতে চা এবং ভাপা পিঠা এই বিপুল আয়োজনের কারণ হচ্ছে আফজল সাহেব আজ সকালে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। তিনি নাস্তা হিসেবে ভাপা পিঠা খেতে চেয়েছেন। তার বাড়ি ফেরা উপলক্ষে দুনিয়ার আত্মীয়-স্বজন এ বাড়িতে ভিড় করেছে। আফজল সাহেব ভাব করছেন যে তিনি খুব বিরক্ত হচ্ছেন, আসলে তা না। তিনি অত্যন্ত খুশি। তিনি চাচ্ছেনও না যে কেউ বাড়ি থেকে চলে যাক। তিনি মীরুকে ডেকে ষড়যন্ত্র করার ভঙ্গিতে বললেন, এরা তো কেউ নড়বে বলে মনে হচ্ছে না। দুপুরে খাবার ব্যবস্থা করা দরকার। কি করা যায় বল তো?

মীরু বলল, তোমাকে এইসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তুমি ভাপা পিঠা খাচ্ছ, ভাপা পিঠা খাও। মা আছে মা যা পারে করবে।

তোর মার মাথায় এত বুদ্ধি থাকলে তো কাজই হত। বিয়ের সময় সে তার সব বুদ্ধি বাবার বাড়ির কোন একটা ট্রাংকে তালাবদ্ধ করে চলে এসেছে। এক কাজ করা যাক ওয়ান আইটেম রান্না হোক। তেহারি।

মীরু বলল, বাবা কি আইটেম রান্না হবে, হবে না এইসব নিয়ে কথা বলতে আমার একেবারেই ইচ্ছা করছে না।

আফজল সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, তুই কি কোন কারণে আমার ওপর রেগে আছিস?

হুঁ রেগে আছি।

আফজল সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন, কেন রেগে আছিস?

মীরু বলল, আমি রেগে আছি কারণ তুমি অসুস্থ হবার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে মার বদনাম করে যাচ্ছ। যেই আসছে তাকেই বলার চেষ্টা করছ মা কত খারাপ একজন মহিলা। হার্ট এটাকের রোগী ফেলে বোনের মেয়ের বিয়ে খেতে চলে গেছে।

কথাটা তো সত্যি।

কথা সত্যি না। মা যখন বিয়ে খেতে গিয়েছে তখনো তোমার হার্ট এটাক হয়নি। হার্ট এটাক হলে মা তোমাকে ফেলে যেত না। এই সত্য তোমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না।

আফজল সাহেব বললেন, যে দুএকজনের সঙ্গে এই কথা বলেছি তারা সবাই নিজের লোক। বাইরের কেউ না। আপনা লোকের কাছে। দুএকটা ভুল ভাল কথা বললে কিছু যায় আসে না।

তুমি বাইরের মানুষের সামনেও মাকে অপমান করেছ।

সেটা আবার কখন করলাম?

ডাক্তার যখন মাকে ওষুধপত্র বুঝিয়ে দিচ্ছিল তখন তুমি বললে, এই বোকা মহিলাকে এইসব বুঝিয়ে লাভ নেই। সে সব আউলিয়ে ফেলবে। আপনি বরং আমার মেয়েকে বুঝিয়ে দিন।

তোর মা সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত থাকে— ওষুধপত্রের হিসাব মাথায় ঢুকবে না। এই ভেবে বলেছি।

এই ভেবে তুমি বলনি। তুমি মাকে বোকা ভেবেই বলেছ। আমি ঠিক। করেছি মার কাছে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত আমি তোমার ঘরে আসব না। কথা বলা তো অনেক পরের ব্যাপার।

আফজল সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ক্ষমা চাওয়ার মত অপরাধ কি করলাম?

চিন্তা করে দেখ কি করেছ।

তুই এবং তোর মার সমস্যা কি জানিস? তোরা একজন অসুস্থ মানুষকে যে চাপ দিতে পারিস পৃথিবীর আর কেউ তা পারে না। হার্ট এটাক হয়ে গেছে এমন একজন মানুষের সঙ্গে কথা কি করে বলতে হয়। এটা তোরা জানিস না। আমার আসলে বাড়িতে আসাই উচিত হয় নাই। আমার উচিত ছিল হাসপাতালে পড়ে থাকা। তুই সামনে থেকে যা।

মীরু বাবার সামনে থেকে চলে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বাবাকে আরো কিছু কঠিন কথা শুনাতে পারলে তার ভাল লাগত। অসুস্থ মানুষ হিসেবে কিছু কনসেশন তাকে করা হল। ভয়ংকর কঠিন কথাগুলি শুনানো হল না।

 

আফজল সাহেবের গ্রামের বাড়ির দূর সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনরা খুঁটি গাড়তে হবে এই চিন্তা-ভাবনা নিয়ে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। প্রত্যেকের হাতে ব্যাগ, স্যুটকেস। বেশ কিছুদিন থাকার পরিকল্পনা। আশ্চর্যজনক ভাবে এদের অনেকেই আগে ভাগে স্বপ্নের মাধ্যমে এত বড় দুর্ঘটনা যে। ঘটবে সেই বিষয়ে জেনে গেছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন। আফজল সাহেবের চাচাতো ভাই ইসমাইল হোসেন। তিনি ভাদরগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার। দেখে মনে হয় সুফি সাধক। মুখ ভর্তি চুলদাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। চোখে সুরমা। গায়ে রবীন্দ্রনাথের আলখাল্লা টাইপ পোশাক। তিনি মীরুকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে গলা নিচু করে বললেন, মাগো তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

মীরু বলল, বলুন কি কথা।

কথাগুলি তুমি দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির কাছে প্রকাশ করবে না। স্বপ্নের মাধ্যমে পাওয়া কথা। এইসব কথা বাতেনি পর্যায়ের। এইসব প্রকাশ হলে ক্ষতি হয়। আমারো ক্ষতি হবে তোমারও ক্ষতি হবে।

বলুন কি কথা। আমি শুনছি।

ভদ্রলোক গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন, তোমার বাবা সম্পর্কে কথা। যে দিন ঘটনা ঘটবে সেই রাতে এশার নামাজের পর আমি শুয়েছি। শরীরটা খারাপ। রোজা করেছি এই জন্যেই শরীর খারাপ। তুমি শুনেছ। নিশ্চয়ই আমি বছরে ছয় মাস রোজা রাখি। এই বয়সে এত কষ্ট করা উচিত না। কিন্তু কি করব বল, এমন একজনের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছি শরীরে না কুলালেও রোজা রাখতে হবে।

কার কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছেন?

মাগো সেটা বলা যাবে না। আমার গলা কেটে ফেললেও আমি বলতে পারব না। যাই হোক ঘটনা যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা শোন। বিছানায় যাওয়া মাত্র চোখ বন্ধ হয়ে গেল তখনি খোয়াবে উনাকে পেলাম। দেখামাত্রই চিনলাম। আগেও কয়েকবার দেখেছি।

কাকে দেখেছেন?

মাগো তুমি শুধু ভেতরের কথা জানতে চাও। ভেতরের কথা তো বলা। যাবে না। আচ্ছা ঠিক আছে ইনার নামটা বলি— কথা একটাই কারো কাছে প্রকাশ করবে না, খোয়াবে যাকে পেলাম তার নাম খোয়াজ খিজির রাজিআল্লাহুতালা আনহু। উনি দরিয়ার সম্রাট। দরিয়ায় দরিয়ায় থাকেন।

উনি কি বললেন?

তোমার বাবার কথা বলে আফসোস করলেন। বললেন, সামনে পরপর তিনটা বিপদ। প্রথমটা কাটান দেয়াই সমস্যা। প্রথমটা কাটান দেয়া গেলে বাকি দুটা কাটান দেয়া সহজ। আমি তখন স্বপ্নের মধ্যেই উনার পা চেপে ধরে বললাম, আপনাকে যখন পেয়েছি তখন দোয়া করে যান। উনিও দোয়া করবেন না আমিও ছাড়ব না এমন অবস্থা। রীতিমত ঝুলাঝুলি, যাই হোক। শেষে উনার মন গলল। উনি বললেন, তোর কাছে আসাই ভুল হয়েছে। হাত তোল দোয়া করি। দোয়া শেষ করলাম, আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি ঘরে খাটি মৃগনাভীর গন্ধ। এই হচ্ছে ঘটনা। তাকায়ে দেখ মা ঘটনার কথা বলতে গিয়ে হাতের লোম খাড়া হয়ে গেছে।

মীরু বলল, আমার বাবার মত ঘুষখোর একজন মানুষের জন্যে দোয়া করতে খোয়াজ খিজির এসে পড়বেন। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা?

ইসমাইল হোসেন অবাক চোখে বেশ কিছুক্ষণ মীরুর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে হতভম্ব গলায় বললেন, মাগো আমি কি মিথ্যা কথা বলছি?

মীরু বলল, অবশ্যই মিথ্যা কথা বলছেন। আমার বাবার মত বিরাট ঘুষখোরের জন্যে খোয়াজ খিজির আসবেন না। আমাদের বনানীতে একটা বাড়ি আছে। ঐ বাড়ি বানানোর প্রতিটি টাকা ঘুষের টাকা। বাড়ি বানানো শেষ করার পর বাবা যখন বাড়ির নামের জন্যে আমার কাছে এলেন আমি বাবাকে বললাম–নাম দাও ঘুষ কুটির। সেই থেকে বাবার সঙ্গে আমার গণ্ডগোল।

নিজের বাবা সম্পর্কে এইসব কি কথা বলছ মা?

সত্যি কথা সবার সম্পর্কেই বলা যায়। নিজের বাবা সম্পর্কে তো আরো বেশি বলা যায়। ভাল কথা, আপনি কি নাস্তা করেছেন?

চা-নাস্তা খেয়েছি।

তাহলে বাড়ি চলে যান। বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলবেন না। মিথ্যা কথা আমার খুব অপছন্দ। আপনি একেবারে মৃগনাভীর গন্ধ পেয়ে গেলেন। মৃগনাভির গন্ধ কখনো শুকেছেন?

না।

জিনিসটা দেখেছেন?

দেখি নাই।

আমি কি প্রমাণ করতে পেরেছি যে আপনি মিথ্যাবাদী?

ইসমাইল হোসেন পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকলেন, মীরু চলে গেল ছাদে। তার অসহ্য লাগছে। কিছুদিনের জন্যে ঢাকার বাইরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করছে।

 

এ বাড়ির ছাদটা খুবই সুন্দর। বাড়িওয়ালা শরফুদ্দিন সাহেবের গাছের শখ আছে। ছাদে তিনি অস্বাভাবিক সুন্দর একটা বাগান তৈরি করেছেন। বাগানে নানা জাতের অর্কিড আছে, গোলাপ আছে আর আছে বাগানবিলাস। ছাদের এই বাগানে ঢুকলেই মীরুর মাথা যেন কেমন কেমন করে।

শরফুদ্দিন সাহেব এই বাগানের ছাদে কাউকে আসতে দেন না। শুধু মীরুকে ছাদে আসার একটা চাবি দিয়েছেন। প্রতিদিন এক মিনিটের জন্যে হলেও মীরু একবার ছাদে আসে। ছাদটার নাম সে দিয়েছে অক্সিজেন সেন্টার। অক্সিজেন সেন্টারে তার নিজের একটা আলাদা জায়গা আছে। সেখানে রট আয়রনের একটা মাঝারি আকৃতির সোফা সে নিজে কিনে এনে বসিয়েছে। সোফাটা নীল অপরাজিতার ঝোপের আড়ালে এমন ভাবে রাখা যে সোফায় বসে থাকলে কেউ চট করে তাকে দেখবে না। অথচ সে অপরাজিতার পাতার ফাঁক দিয়ে সবাইকে দেখতে পাবে।

মীরু ছাদে এলে সোফায় মাথা রেখে শুয়ে থাকে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, এই সোফায় মাথা রাখা মাত্রই তার প্রচণ্ড ঘুম পায়। মীরুর ধারণা নীল অপরাজিতা গাছ থেকে কড়া কোন ঘুমের ওষুধ বাতাসে ভেসে আসে।

সুলতানা মীরুর খোঁজে ছাদে এসেছেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, আশ্চর্য কাণ্ড, তুই কি ঘুমাচ্ছিস না-কি?

মীরু বলল, হ্যাঁ।

বাসায় হুলস্থুল ঝামেলা বাধিয়ে তুই ছাদে ঘুমাচ্ছিস। আশ্চর্য! তোর কাণ্ডকারখানা বোঝা মুশকিল।

বাসায় হুলস্থুল ঝামেলা?

তুই ভাইজানকে কি বলেছিস কে জানে। ভাইজান কান্নাকাটি করছেন। ভাবীর সঙ্গে করেছেন ঝগড়া। ভাবী রাগ করে তার ভাই-এর বাসায় চলে গেছেন। বলে গেছেন আর কোনোদিন আসবেন না। কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার ডেকে এনে ভাইজানের প্রেসার মাপা হল।

প্রেসার নিশ্চয়ই নরম্যাল ছিল। ছিল না?

হ্যাঁ প্রেসার নরম্যাল। তুই কি করে বুঝলি?

বাবার বেশির ভাগ কর্মকাণ্ডই ভান।

নিজের বাবা সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলা কি ভাল?

নিজের কথা সম্পর্কে কেউ বলার চেয়ে নিজের বাবা সম্পর্কে কথা বলাই কি ভাল না?

 

তোর সঙ্গে যুক্তি-তর্কে যাব না। যুক্তি-তর্ক আমি পারি না। আমি ভাইজানকে ঠিক করে ফেলেছি। উনি এখন নরম্যাল। তোর দায়িত্ব হচ্ছে ভাবীকে নরম্যাল করে বাসায় নিয়ে আসা।

ঠিক আছে নিয়ে আসব। তুমি বস তো আমার পাশে।

সুলতানা বসলেন। মীরু বলল, তোমাকে দিয়ে আমি একটা ছোট্ট এক্সপেরিমেন্ট করতে চাই।

কি এক্সপেরিমেন্ট?

তুমি চোখ বন্ধ করে এই সোফায় কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবে। আমি দেখতে চাই তোমার ঘুম আসে কি না। আমি এই সোফাটার নাম দিয়েছি ঘুম সোফা। এখানে মাথা রেখে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলেই ঘুম পায়।

তাহলে এক কাজ কর। সোফাটা আমাকে দিয়ে দে। আমি বাসায় নিয়ে যাই। আমার রাতে এক্কেবারেই ঘুম হয় না। এখন থেকে ঘুম সোফায় শুয়ে ঘুমুব।

মীরু বলল, ফুপু সোফা দেয়া যাবে না। সোফা এখানে থাকবে। ঘুমাতে চাইলে তোমাকে আমাদের বাড়ির ছাদে এসে ঘুমাতে হবে। এত কথা বলে লাভ নেই। শুয়ে পড়।

সুলতানা বাধ্য মেয়ের মত শুয়ে পড়লেন।

মীরু বলল, চোখ বন্ধ কর।

সুলতানা চোখ বন্ধ করলেন। মীরু বলল, আমি এখন চলে যাচ্ছি। তুমি চোখ বন্ধ করে থাক। আমি পনেরো মিনিট পরে এসে খোঁজ নেব ঘুম এসেছে কি না।

সুলতানা খপ করে মীরুর হাত ধরে বললেন, তুই পাগল হয়েছিস আমি একা একা ছাদে বসে থাকব? ভয়েই মরে যাব। তুই যা করতে বলবি আমি করব। কিন্তু তোকে আমার পাশে বসে থাকতে হবে। আমি এই লোহার সোফায় মাথা রেখে ঘুমুতে পারব না। তোর কোলে মাথা রেখে ঘুমাব। তুই আমার চুলে হাত বুলিয়ে দে।

সুলতানা মীরুর কোলে মাথা রাখলেন। মীরু ফুপুর চুলে হাত বুলাতে লাগল। সুলতানা ঘুম ঘুম গলায় বললেন, নাসের তোর খুব প্রশংসা করছিল। তার ধারণা তুই হচ্ছিস তার দেখা পাঁচজন শ্রেষ্ঠ মানুষের একজন।

বাকি চারজন কে?

বাকি চারজন কে আমি জিজ্ঞেস করিনি। বাকি চারজনকে দিয়ে আমার দরকার নেই। পাঁচজনের মধ্যে তুই আছিস এটাই বড় কথা।

মীরু বলল, নাসের সাহেব আমার বিষয়ে সব গল্প কি করেছেন? আমি যে তাকে নিয়ে বারসাত নামের এক লোককে খুঁজছিলাম সেই গল্প বলেছেন?

না তো। বারসাতটা কে? ঐ যে ছবি আঁকনেওয়ালা?

হুঁ।

প্রাইভেট টিউশনি করে জীবন চালায়?

হ্যাঁ।

এইসব পরজীবী, প্যারাসাইট টাইপ মানুষের নাম মনেও করবি না। এই শ্রেণীর মানুষ গল্প করার জন্য বা সঙ্গে নিয়ে ঘুরার জন্যে খুব ভাল। স্বামী হিসেবে এরা ভয়ংকর খারাপ।

কেন খারাপ?

এরা অপদার্থ এই জন্যে খারাপ।

তোমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ফুপু তোমার কি ঘুম পাচ্ছে?

হুঁ। শাড়িটা আমার মুখের ওপর দিয়ে দে। আমি কিছুক্ষণ ঘুমাব।

মীরু ফুপুর মাথার ওপর শাড়ি দিয়ে দিল। সুলতানা জড়ানো গলায় বললেন, তুই কি নাসেরকে বিয়ে করবি? হ্যাঁ বলার দরকার নেই। চুপ করে থাকলেই বুঝব তোর অমত নেই।

ফুপু ঘুমাও।

তাহলে তোর মত আছে? আলহামদুলিল্লাহ।

মীরু বলল, তুমি বলেছিলে চুপ করে থাকলেই বুঝবে আমার মত আছে। আমি কিন্তু চুপ করে থাকিনি। আমি কথা বলেছি। আমি বলেছি, ফুপু ঘুমাও।

সুলতানা বললেন, তোর মত থাকুক বা না থাকুক নাসেরের সঙ্গেই তোর বিয়ে হবে। আমি ইস্তেখারা করে এই জিনিস পেয়েছি।

কি করে এই জিনিস পেয়েছ?

ইস্তেখারা। দোয়া-কালাম পড়ে স্বপ্নে ভবিষ্যৎ জানার একটা পদ্ধতি।

কি দেখেছিলে স্বপ্নে?

স্বপ্নে দেখেছি তোরা দুইজন এক থালায় ভাত খাচ্ছিস। চীনা মাটির বড় একটা থালা।

এক থালায় ভাত খাওয়া স্বপ্নে দেখলে কি বিয়ে হয়?

ইস্তেখারার স্বপ্নগুলি আসে প্রতীকের মত। প্রতীক ব্যাখ্যা করতে হয়। আমার ব্যাখ্যায় এইটাই আসে। তোর ব্যাখ্যা কি?

আমার ব্যাখ্যা হল তুমি মনেপ্রাণে চাচ্ছ নাসের সাহেবের সঙ্গে আমার বিয়ে হোক। চাচ্ছ বলেই স্বপ্নে এই জিনিস দেখেছ। উইশফুল থিংকিং থেকে উইসফুল ড্রিমিং। ফুপু তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?

সুলতানা জবাব দিলেন না। তিনি আসলেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।

 

মীরু ভেবেছিল সন্ধ্যার দিকে সে নিজে বড় মামার বাসায় যাবে। মাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসবে। তিনি আসতে চাইবেন না। রাগেঅভিমান-দুঃখে কান্নাকাটি করবেন। যে কোনো একদিন আটত্রিশটা ঘুমের ওষুধ খাবেন এটা বলবেন এবং হেন্ডব্যাগ খুলে ঘুমের ওষুধ দেখাবেন। সব শেষে একটা শর্তে আসতে রাজি হলেন—স্বামীর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নাই এটা সবাইকে স্বীকার করতে হবে। তিনি অন্য ঘরে আলাদা বিছানায় ঘুমাবেন। বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীর যত যুগল ছবি আছে সব নামিয়ে ফেলতে হবে।

মীরু আগেও কয়েকবার তার মাকে এনেছে। এবারো আনা যাবে কোনো সমস্যা হবে না। বোকা মানুষদের পরিচালনা করা খুব সহজ।

মাকে আনার জন্যে মীরুকে কোথাও যেতে হল না। জাহেদা দুপুর বেলা নিজেই চলে এলেন। যথারীতি রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। এক ফাঁকে আফজল সাহেবের ঘরে গিয়ে বললেন, তোমাকে পেঁপে কেটে দেব?

আফজল সাহেব বললেন, দাও। আরেকটা কাজ কর। পায়ের তলা। চুলকাচ্ছে। সরিষার তেল গরম করে মালিশ করে দাও।

জাহেদা বললেন, রূপচান্দা মাছের শুটকি রান্না করছি। তরকারি চড়িয়ে দিয়ে আসি।

আফজল সাহেব দরাজ গলায় বললেন, এসো। কোনো অসুবিধা নাই। চেঁপা শুঁটকি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। চেঁপা ভরতা কর খেয়ে দেখি।

হার্টের অসুখে ঝাল খেলে সমস্যা নাই তো?

সমস্যা থাকলে থাকবে। তাই বলে সব খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেব না কি?

তাদের দেখে কে বলবে আজ সকালেই দুজনের ভয়াবহ ঝগড়া হয়েছে। আফজল সাহেব কঠিন গলায় স্ত্রীকে বলেছেন–তোমার সঙ্গে রাস্তার নেড়ি কুত্তির কোনো ডিফারেন্স নাই। নেড়িকুত্তি কাপড় পরে না। তুমি শাড়ি পর— ডিফারেন্স বলতে এই টুকুই।

মীরু পর্দার আড়াল থেকে দেখল তার মা প্রবল বেগে বাবার পায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছেন। মীরুর ইচ্ছা করল মাকে কঠিন কিছু কথা। শোনায়। শোনানো গেল না। কারণ সে প্রতিজ্ঞা করেছে বাবার ঘরে ঢুকবে। না। প্রতিজ্ঞা করা হয় প্রতিজ্ঞা ভাঙার জন্যে। মীরুর প্রতিজ্ঞা ভাঙতে ইচ্ছা করে না।

বাড়ি খালি। ইসমাইল হোসেন সাহেবের সঙ্গে ঝামেলা পাকিয়ে একটাই লাভ হয়েছে— আত্মীয়-স্বজনরা আপাতত এ বাড়িতে কেউ নেই। তবে পুরোপুরি চলেও নিশ্চয়ই যায়নি। দৃষ্টি সীমার বাইরে আছে। আবারো উদয় হবে। বিশেষ করে ইসমাইল সাহেব। ইনি টাকা-পয়সা না নিয়ে গ্রামে ফিরবেন তা কখনো হবে না। খোয়াজ খিজিরের এমন একটা গল্প তিনি নিশ্চয়ই অকারণে তৈরি করেননি।

 

দুপুরের পর থেকে মীরুর শ্বাসকষ্ট শুরু হল। অথচ শ্বাসকষ্ট শুরু হবার মত কোন ঘটনা ঘটেনি। ঝগড়াঝাটি যা হবার সকালবেলা হয়েছে। সকালের কথা তার মনেও নেই। তাহলে শ্বাসকষ্টটা হচ্ছে কেন? আবহাওয়ার পরিবর্তনের জন্যে?

আকাশ মেঘলা করেছে। বর্ষাকালে এ রকম মেঘলা আকাশ দিনের মধ্যে কয়েকবার হয়। তার জন্যে শ্বাসকষ্ট শুরু হবার কথা না। মীরু ইনহেলারটা হাতে নিয়ে তার নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

খাটে আধশোয়া হয়ে বসে শ্বাসকষ্ট সামাল দিতে চেষ্টা করল। আজ সে ইনহেলার নেবে না। ইনহেলার নেয়া অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। শেষে অবস্থা এ। রকম হবে যে একটু পর পর হা করে মুখে ইনহেলার পাফ করতে হবে। দৃশ্যটা কুৎসিত। মীরু কোন কুৎসিত দৃশ্যের অংশ হতে চায় না।

টেলিফোন বাজছে। টেলিফোনটা মীরুর হাতের পাশে। সে যেখানে বসে আছে সেখান থেকে না নড়েও সে টেলিফোন ধরতে পারে। টেলিফোন ধরবে কি ধরবে না তা সে বুঝতে পারছে না। মীরু লক্ষ্য করেছে। শ্বাসকষ্টের সময় টেলিফোন ধরলে মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্টটা কমে যায়। অবশ্যি টেলিফোনে যদি ইন্টারেস্টিং কোনো কথাবার্তা হয় তবেই।

মীরুর মনে হচ্ছে নীলুফার নামের মহিলা টেলিফোন করেছেন। যে মহিলার ছেলের নাম টুকটুকি। ছেলেদের নাম টুকটুকি হয় সে আগে কখনো শুনেনি। মহিলা কি তার টেলিফোন নাম্বার দেবার জন্যে টেলিফোন করেছেন? তিনি এখন কি বলবেন? সরি লাইন কেটে গিয়েছিল–টেলিফোন নাম্বারটা লিখে নাও। মীরু বলবে, লাইন কেটে গিয়েছিল না কি আপনি রাগ করে টেলিফোন রেখে দিয়েছিলেন? ভদ্রমহিলা বলবেন, ও আল্লা রাগ করব। কেন শুধু শুধু। তুমি কি রাগ করার মত কিছু করেছ?

টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। মীরু টেলিফোন রিসিভার কানে ধরল। ক্লান্ত গলায় বলল, হ্যালো।

মীরুকে অবাক করে দিয়ে ওপাশ থেকে স্পষ্ট এবং সুন্দর স্বর শোনা গেল।

আপনি আমাকে মনে রেখেছেন কি না বুঝতে পারছি না। ভয়ে ভয়ে টেলিফোন করেছি। আমার নাম নাসের।

কেমন আছেন আপনি?

আমি ভাল আছি কিন্তু আপনার তো মনে হয় শরীর খারাপ।

কেন মনে হল আমার শরীর খারাপ?

গলার স্বর শুনে মনে হল। শ্বাস টানছেন বলে মনে হচ্ছে। আপনার কি এ্যাজমা আছে?

হ্যাঁ, এ্যাজমা আছে। আপনি টেলিফোনে আমার গলা শুনেই বুঝে। ফেললেন আমার এ্যাজমা আছে? না কি ছোট ফুপু আপনাকে বলেছে?

আপনার ছোট ফুপু আমাকে কিছু বলেননি। আপনার ছোট ফুপু আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। তিনি আগবাড়িয়ে আপনার দোষ-ত্রুটি আমাকে বলবেন না।

এ্যাজমা আমার দোষের মধ্যে পড়ছে?

অবশ্যই। বিয়ের কনে এবং কোরবানির পশু এক শ্রেণীতে পড়ে। কোরবানির পশু দেখেশুনে কিনতে হয়। এ্যারেঞ্জ ম্যারেজেও মেয়ে দেখেশুনে যাচাই করে নিতে হয়।

ছেলেদের যাচাই করতে হয় না?

না। সোনার চামচ বাকা হলেও সোনার চামচ।

আপনি সোনার চামচ?

নাসের জবাব দিচ্ছে না। তাকিয়ে আছে। মীরুর কপালের চামড়া কুঁচকে এসেছে। সে এখন বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে।

নাসের শব্দ করে হেসে ফেলল। মীরু বলল, আপনি হাসছেন কেন? আমার কথার জবাব দিন? আপনার ধারণা আপনি সোনার চামচ?

আমি সোনার চামচ না কি এলুমিনিয়ামের চামচ সেই জবাব দিচ্ছি তার আগে আপনি বলুন তো আপনার শ্বাসকষ্টটা পুরোপুরি চলে গেছে না?

মীরু কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ চলে গেছে।

নাসের বলল, যখন কারো হেঁচকি উঠে তখন যদি তাকে হকচকিয়ে দেয়া যায় তাহলে হেঁচকি চলে যায়। শ্বাসকষ্টের বেলাতেও একই ব্যাপার। নিজেকে সোনার চামচ বলে আপনাকে হকচকিয়ে দিয়ে শ্বাসকষ্ট দূর করে দিয়েছি। আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে ছোট্ট করে একটা থ্যাংকস দিতে পারেন।

মীরু বলল, থ্যাংকস দেবার আগে আপনার কাছে জানতে চাচ্ছিআপনি আমাকে কেন টেলিফোন করেছেন? গল্প করার জন্যে?

হ্যাঁ।

শুধুই গল্প না কি উদ্দেশ্যমূলক গল্প?

উদ্দেশ্যমূলক গল্প।

উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করবেন?

হ্যাঁ করব। আমি চাচ্ছি আপনার কাছাকাছি যেতে। কথাবার্তা বলা ছাড়া সেটা সম্ভব না। যে কোন দুপ্রান্তের যে কোন দুজন শুধুমাত্র কথা বলেই কাছাকাছি আসে।

আমার কাছাকাছি আসতে চাচ্ছেন কেন?

আপনার সুলতানা ফুপুর স্বপ্ন পূরণের জন্যে। আমি ব্যবসায়ী মানুষ তো, আমার চট করে কাউকে পছন্দ হয় না। কারো সঙ্গে পরিচয় হলে আমি নানা ভাবে তাকে যাচাই করার চেষ্টা করি। হিসাব-নিকাশ করতে থাকি। এক সময় বলি– No. চলবে না। আপনার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। আমি আপনাকে যতই দেখছি ততই ভাল লাগছে।

আপনি কিন্তু আমাকে একবারই দেখেছেন।

ও আচ্ছা তাই তো! তাহলে আমার কেন মনে হচ্ছে রোজই আপনার সঙ্গে আমার একবার করে দেখা হয়?

মীরু শান্ত গলায় বলল, আমার ধারণা আপনি একটা ব্যাপার পুরোপুরি ভুলে গেছেন। বারসাত নামে একজন মানুষের কথা আপনাকে বলেছিলাম। আপনাকে সঙ্গে নিয়ে তার মেসেও গিয়েছিলাম।

নাসের বলল, উনার কথা ভুলিনি। উনার কথা মাথায় রেখেই আপনাকে টেলিফোন করেছি।

তাই বুঝি?

আপনার তাই বুঝি বলাটায় এক ধরনের ব্যঙ্গ আছে। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি বারসাত সাহেবের কথা মাথায় রেখেই আপনাকে টেলিফোন করেছি।

তাই?

উনি ঢাকায় ফিরেছেন এই খবরটা আপনাকে জানানোও আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল।

মীরু থমকে গেল। নাসের নামের মানুষটার কাণ্ডকারখানা এখন সে। ঠিক বুঝতে পারছে না। এখন তার মনে হচ্ছে নাসের তাকে টেলিফোন করেছে বারসাতের খবর দেবার জন্যে। এতক্ষণ যেসব কাব্যময় কথা বলল। তার সবই খেলা। ইংরেজিতে এই খেলার একটা নামও আছে— Word Gane.

বারসাত কবে ফিরেছে সেটা কি জানেন?

হ্যাঁ জানি। আজ সকালে ফিরেছেন। সাড়ে নটায়।

এতো ডিটেইলে কিভাবে জানেন? আপনি কি স্পাই লাগিয়ে রেখেছিলেন?

হ্যাঁ। অফিসের একজনকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম সে যেন মেসের ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।

কেন?

কেনর জবাব এখন দেব না। পরে দেব।

পরে কখন?

আপনার যেদিন বিয়ে হবে সেদিন দেব।

মীরু বলল, কিছু মনে করবেন না আপনার সঙ্গে কথা বলতে এখন আর আমার ভাল লাগছে না। আমি টেলিফোন রেখে দেব।

আপনার শ্বাসকষ্টটা কি ফিরে এসেছে?

হ্যাঁ ফিরে এসেছে।

বুঝতে পারছি আমি হঠাৎ আপনার মেজাজ খারাপ করে দিয়েছি। আমি চাচ্ছি না আপনি আমার ওপর বিরক্ত হন। আপনি বলুন কি করলে আপনার বিরক্তি কমবে? আমি তাই করব। স্পাই কেন লাগিয়ে রেখেছিলাম সেটা বলব?

মীরু টেলিফোন নামিয়ে রাখল।

আকাশ কালো হয়ে আছে। যে কোন মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি নামার আগেই তাকে বারসাতের মেসে উপস্থিত হতে হবে। সামান্য বৃষ্টিতেই বারসাতের মেসের সামনে পানি জমে যায়। মেসে ঢুকতে হলে নোংরা পানিতে পা ডুবিয়ে ঢুকতে হয়। ঘেন্নার ব্যাপার। সে এখন সুন্দর একটা শাড়ি পরবে। নতুন স্যান্ডেল পরবে। নোংরা পানিতে পা ডুবাতে পারবে না।

 

খুব সাবধানে কে যেন দরজা খুলছে। ভৌতিক ছবিতে দরজা যেভাবে খোলা হয় অবিকল সেইভাবে। প্রায় নিঃশব্দে। মীরু দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে তার মা। কিছু একটা ঘটেছে–মার বয়স মনে হচ্ছে দশ বছর কমে গেছে। তার চেহারায় এবং তাকানোর ভঙ্গিতে খুকি খুকি ভাব।

মীরু ঘুমোচ্ছিস?

না।

বিরাট একটা ঘটনা ঘটেছে।

কি ঘটনা?

আন্দাজ করতো কি ঘটনা?

আন্দাজ খেলা এখন খেলতে পারব না মা। কি ঘটেছে বলতে চাইলে বল। বলতে না চাইলে চলে যাও।

জাহেদা ফিসফিস করে বললেন, তোর বাবা রুনিকে ক্ষমা করে দিয়েছে। আমাকে একটু আগে বলেছে, রুনিকে বাড়ি ফিরতে বল। বিরাট ঘটনা না?

হ্যাঁ। কিন্তু তুমি ফিসফিস করছ কেন? ফিসফিস করার মতো ঘটনা তো এটা না।

জাহেদা মেয়ের পাশে বসলেন। গলার স্বর আরো নামিয়ে ফেলে বললেন, দুপুরে ভাত খাবার পর তোর বাবা বলল, আমাকে কাঁচা সুপারি। দিয়ে একটা পান দাও তো। কাঁচা সুপারি হার্টের জন্যে ভাল। ঘরে কাঁচা সুপারি ছিল। আমি দিলাম পান বানিয়ে। পান খেতে খেতে হঠাৎ বলল, আমি এতদিন হাসপাতালে ছিলাম তোমার বড় মেয়ে কি আমাকে দেখতে গেছে?

আমি বললাম, না।

তোর বাবা বলল, দেখতে আসেনি কেন?

আমি বললাম, ভয়ে আসেনি। তাকে দেখে তোমার যদি প্রেসার উঠে যায়। এই সময় প্রেসার খুবই ক্ষতিকর।

তখন তোর বাবা বলল, ওকে আসতে বল। বিছানা বালিশ নিয়ে যেন চলে আসে। অদ্ভুত না?

মীরু জবাব দিল না। হাই তুলল। জাহেদা বললেন, মীরু আমাকে একটা সাজেশান দে। আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব। না কি টেলিফোনে চলে আসতে বলব।

যেটা তুমি ভাল মনে কর সেটাই কর।

আমার কি যে ভাল লাগছে। তোর শরীর খারাপ না কি রে মীরু। চোখ-মুখ কেমন শুকনা।

শরীর খারাপ না।

জাহেদা আনন্দময় গলায় বললেন, রুনির বাড়ি ফেরার পেছনে তোর সুলতানা ফুপুর একটা ভূমিকা আছে। সুলতানার কাছে তোর বাবা শুনলেন যে তুই নাসেরকে বিয়ের ব্যাপারে মত দিয়েছিস। এটা শুনেই তোর বাবার মন ভাল হয়ে গেল। তোর বাবা ঠিক করেছে তোর বিয়ে হবে দেশের বাড়িতে। ঢাকা থেকে বরযাত্রীকে গ্রামে যেতে হবে। তোর বাবা রেল স্টেশনে হাতী রাখবে। হাতীতে চড়ে বরযাত্রী যাবে। বিয়ে উপলক্ষে মেমানি। হবে। মেমেনি বুঝিস? মেমানি হল গণ-খাওয়া। একটা গ্রামের সব মানুষকে যদি দাওয়াত করে খাওয়ানো হয় তখন তাকে বলা হবে মেমানি।

মীরু মার দিকে তাকিয়ে আছে। মা কি বলছেন তা এখন আর তার মাথায় ঢুকছে না। সে জানালা খুলল। আকাশ মেঘে মেঘে কালো হয়ে আছে। যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে।

জাহেদা বললেন, হাতী দিয়ে বরযাত্রী নেয়ার আইডিয়া তোর কাছে কেমন লাগছে?

হাস্যকর লাগছে।

হাস্যকর কেন লাগবে? আমার তো মনে হয় সবাই পছন্দ করবে।

বরযাত্রীদের কেউ কেউ হাতী থেকে পিছলে পড়ে ব্যথা পেতে পারে মা।

জাহেদা বিরক্ত গলায় বললেন, অদ্ভুত সব চিন্তা শুধু তোর মাথাতেই আসে। হাতী থেকে পিছলে পড়বে কেন?

মীরু বলল, পিছলে পড়বে কারণ হাতীতে চড়ে কারোর অভ্যাস নেই। নতুন ধরনের কিছু করতে চাইলে কর তবে এমন কিছু কর যাতে রিস্ক নেই। যেমন বরযাত্রীদের ঠেলাগাড়িতে করে নেয়ার ব্যবস্থা কর।

মীরু চুপ কর।

মীরু হাই তুলতে তুলতে বলল, মা শোন আমি যদি আমার নিজের পছন্দের কাউকে বিয়ে করি তাহলে বাবা কি করবে? হাতী দিয়ে লাথী দেয়াবে?

জাহেদা হেসে ফেললেন। মীরু মাঝে মাঝে এমন মজা করে কথা বলে।

দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে

দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পাতা কেউ নামিয়ে নিচ্ছে না। এটা যেন একটা খেলা, চোখের পাতা যে আগে নামিয়ে নেবে সে হেরে যাবে।

পরাজিত হল বারসাত। সে চোখ নামিয়ে নিয়ে কোমল গলায় বলল, কেমন আছ ঐ?

ঐ মানে?

ঐন্দ্রিলাকে সংক্ষেপ করে ঐ বললাম।

মীরু বলল, তোমার কি হয়েছে? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি এইডস-এর রুগী। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে মারা যাবে। এত দিন কোথায় ছিলে?

বারসাত বলল, বাহ তুমি তো অবিকল বনলতা সেনের মত প্রশ্ন করলে— এতদিন কোথায় ছিলেন? এতদিন আমি ছিলাম বিম্বিষার অশোকের ধূসর জগতে।

মীরু বিরক্ত গলায় বলল, ধোয়াটে ভাবে কথা বলা বন্ধ কর। সরাসরি কথা বল। তুমি কোথায় ছিলে?

বারসাত সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, সিকোয়েন্স বাই সিকোয়েন্স বলি। সিকোয়েন্স ওয়ান-– কাজীর অফিস থেকে আমি চলে গেলাম মামার। বাগান বাড়িতে। বাগান বাড়িটা কালিয়াকৈরে। বাগানবাড়ির নাম পদ্ম। সিকোয়েন্স টু বাগান বাড়িতে পা দিয়েই আমি জ্বরে পড়লাম। যাকে বলে উল্টা জ্বর।

উল্টা জ্বর মানে?

যে জ্বরে পৃথিবী উল্টা হয়ে যায় সেই জ্বরকে বলে উল্টা জ্বর। আমার পৃথিবী গেল উল্টা হয়ে। তোমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কবিতাগুলি পর্যন্ত আমার মাথায় উল্টা করে আসতে শুরু করেছিল। বলা যেতে পারে আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি।

মীরু বলল, মৃত্যুর মুখ থেকে পুরোপুরি ফিরে এসেছ, এমন বলা ঠিক হবে না। তেমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি এখনও মৃত্যুর মুখে বাস করছ।

আমরা সবাই তাই করছি মীরু। আমরা সবাই মৃত্যুর মুখে বাস করছি।

ফিলসফি কপচাবে না।

বারসাত হাসতে হাসতে বলল, ফিলসফি তো কপচাতেই হবে। মীরু তুমি ভুলে গেছ আমি ফিলসফির ছাত্র। খুবই খারাপ ছাত্র। তাকে কি? বিষয় তো ফিলসফি।

তোমার স্বাস্থ্য যে কতটা খারাপ হয়েছে তাকি তুমি জানো? তোমাকে টুথপিকের মত দেখাচ্ছে। শরীর কি এখন ঠিক হয়েছে?

হুঁ।

আমার তো মনে হয় না তোমার শরীর ঠিক হয়েছে। তুমি সিগারেট ধরিয়ে দুটা টান দিয়ে সিগারেট ফেলে দিলে। শরীর ঠিক থাকলে সিগারেট ফেলে দিতে না। তুমি নিঃশ্বাস নিচ্ছ হা করে। একমাত্র মাছেরাই ডাঙ্গায় এইভাবে নিঃশ্বাস নেয়। তুমি তো মাছ না।

বারসাত হাসল।

মীরু বলল, তোমার হাসিও বদলে গেছে। হাসির মধ্যেও অসুস্থ ভাৰ চলে এসেছে। হাসিতে কোন প্রাণ নেই।

বারসাত বলল, চা খাবে?

মীরু বলল, হ্যাঁ খাব।

বারসাত বলল, আমার চৌকির নিচে কেরোসিনের চুলা আছে। চিনি, চা পাতা সবই আছে। শুধু দুধ নেই। দুকাপ লিকার চা বানাও। লিকার চায়ে না কি এন্টি-অক্সিডেন্ট থাকে। শরীরে এন্টি-অক্সিডেন্ট ঢুকিয়ে দেখি কিছু করা যায় কি-না।

মীরু চা বানাতে বসল। বারসাত দেয়ালে হেলান দিয়ে চৌকিতে পা ছড়িয়ে বসেছে। সে কৌতূহলী চোখে মীরুর চা বানানো দেখছে।

মীরু বলল, ঐ দিন আমি কেন যথাসময়ে উপস্থিত হইনি তা কি তুমি জানতে চাও না?

না।

জানতে চাও না কেন?

বারসাত শান্ত গলায় বলল, জানতে ইচ্ছা করছে না।

ইচ্ছা করছে না কেন?

ইচ্ছা করছে না কারণ আমি জানি তুমি কেন আসনি এটা শোনার পর। আমার মন খারাপ হয়ে যাবে। এম্নিতেই শরীর খারাপ তার সঙ্গে মন খারাপ যুক্ত হলে আর দেখতে হবে না।

মীরু বলল, তোমার ধারণা আমি কি জন্যে আসিনি?

তুমি আসনি কারণ শেষ মুহূর্তে তোমার মনে হয়েছে কাজটা ঠিক হচ্ছে। বিয়ে কোন ছেলেখেলা ব্যাপার না। হুট করে বারসাত আলিকে বিয়ে করা যায় না। বিয়ের পর স্ত্রীকে কোথায় নিয়ে তুলবে যে লোক এটা জানে। না তাকে বিয়ে করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

মীরুর চা বানানো হয়ে গেছে। সে এক কাপ চা বারসাতকে দিয়ে। নিজে এক কাপ নিয়ে খাটের উপর আরাম করে বসতে বসতে বলল, এ রকম কিছু যদি আমার মনে আসত তাহলে তোমাকে জানাতাম। না। জানিয়ে ডুব দিতাম না। আমার স্বভাবের মধ্যে ডুব দেয়া ব্যাপারটা নেই।

বারসাত চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, এটা ঠিক। তুমি ডুবুরি কন্যা না। তুমি ভাসন্ত কন্যা।

মীরু বলল, আমি ঐ দিন সময় মত আসিনি কারণ বাবা অসুস্থ ছিলেন। তাঁর হার্ট এটাক হয়েছিল। তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলাম। তবে আমি বিকেল সাড়ে পাঁচটায় কাজি অফিসে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে। তোমার মেসে গিয়েছিলাম।

সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি। তুমি খুব ভাল করেই জানো এটা সত্যি। আমি তোমার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কখনো তোমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলব না।

সব সময় সত্যি কথা বললে জীবন হয়ে যাবে ডিসটিলড ওয়াটারের মত। সিদ্ধ করা পানি টেস্টলেস।

হোক টেস্টলেস। প্রতিজ্ঞা যখন করেছি প্রতিজ্ঞা রাখব।

বারসাত গম্ভীর গলায় বলল, প্রতিজ্ঞাবতী নাম আজ আমি তোমাকে দিলাম।

মীরু উঠে দাঁড়াল। বারসাত বলল, তুমি চলে যাচ্ছ না কি?

মীরু বলল, হ্যাঁ যাচ্ছি। বিশেষ কিছু বলতে চাইলে পাঁচ মিনিটের জন্যে বসতে পারি। বিশেষ কিছু বলার আছে?

আছে।

বল। আমি বসলাম।

বারসাত বলল, আগামীকাল তোমার সময় হবে? বেশিক্ষণ লাগবে না। এই ধর আধঘণ্টা। বেশি হলে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।

না আগামীকাল সময় হবে না। সারাদিন আমি গাজীপুরে থাকব। শালবনে ইউনিভার্সিটি পিকনিক।

আমার ধারণা ছিল তুমি ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে বের হয়ে গেছ।

ধারণা ঠিকই আছে। পাস করে বের হবার পরেও ল্যাজ আটকে আছে। পিকনিক যাবার দাওয়াত পেয়েছি। তিনশ টাকা চাঁদা দিয়েছি। চাঁদার টাকা তোলার জন্যে হলেও পিকনিকে যেতে হবে। পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় তোমার কি জন্যে দরকার?

কাজি অফিসের ঝামেলাটা সেরে ফেলার জন্যে দরকার।

মীরু বলল, পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় এখন দিতে পারি।

এখন?

হ্যাঁ এখন। আমি যতদূর জানি কাজি অফিসে নটা-পাঁচটা অফিস টাইম বলে কিছু নেই। রাতেও সেখানে বিয়ে হয়।

বারসাত বিস্ময়মাখা গলায় বলল, এখন যাবে?

মীরু বলল, হ্যাঁ যাব। বিয়ে রেজিষ্ট্রেশনের জন্যে ফী লাগে। সেই টাকা। কি আছে?

বারসাত কিছু বলল না। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইল। যেন তার মধ্যে ঘোর লেগে গেছে। মাথায় কিছু ঢুকছে না।

মীরু বলল, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি হঠাৎ গভীর সমুদ্রে পড়েছ। কোন সমস্যা?

বারসাত বিড়বিড় করে বলল, বিয়ের দিন পরব বলে যে পাঞ্জাবি ঠিক করে রেখেছিলাম সেই পাঞ্জাবি কালিয়াকৈরে ফেলে এসেছি। এটাই হল সমস্যা। গভীর সমুদ্রে পড়ার মতই সমস্যা।

নতুন পাঞ্জাবি পরাটা কি খুব ইম্পর্টেন্ট?

হ্যাঁ ইম্পর্টেন্ট। আমি গরিব মানুষ তারপরেও আঠারশ টাকা খরচ করে পাঞ্জাবিটা কিনেছিলাম। বিয়েতে পরব বলে কিনেছিলাম। বিয়ে তো আমি তিন-চারবার করব না। একবারই করব। তুমি হাসছ কেন?

তুমি সত্যি সত্যি পাঞ্জাবির শোকে কাতর হয়ে পড়েছ এটা দেখে হাসছি। আচ্ছা দেখ তো আমার শাড়িটা কেমন? সুন্দর না? সাদার ওপর লাল সবুজের খেলা। শাড়িটা কি চিনতে পারছ?

পারছি। এটাই তো তোমার বিয়ের শাড়ি।

হ্যাঁ।

তার মানে কি দাঁড়ায়? তুমি কি ইচ্ছা করে আজ এই শাড়ি পরে এসেছ?

হুঁ। তুমি জানতে আজই কাজি অফিসে যাওয়া হবে?

হুঁ।

দুজন আবারো দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। শুরু হয়েছে তাকিয়ে থাকার খেলা। কেউ আগে চোখ নামাবে না। যে নামাবে সে হেরে যাবে। তাকিয়ে থাকা খেলায় কথাও বলা যায় না। যে আগে কথা বলবে সে হেরে যাবে।

প্রথম হার মানল বারসাত। সে চোখ নামিয়ে নিল এবং কথাও বলল, প্রায় ফিসফিস করে বলল, মীরু তোমাকে নিয়ে আমার মাথার মধ্যে একটা। কবিতা তৈরি হয়েছে।

কি কবিতা?

কবিতাও ঠিক না। ছড়া। হালকা টাইপ বিষয়। শুনলে তুমি হয়তোবা রাগ করবে।

রাগ করব না। শুনি।


ও আমার সই
তুমি গেলা কই
ঐ ঐ ঐ
চিকা চিকা ভুম ভুম ভুম।

মীরু গম্ভীর গলায় বলল, চিকা চিকা ভুম ভুম মানে কি?

বারসাত বলল, কোন মানে নেই। এই লাইনটা ফুর্তির। বারসাত হাত পা নেড়ে খুবই মজা করে কবিতা আবৃত্তি করছে। মীরু হাসছে। হাসির বেগ ক্রমেই বাড়ছে। সে কিছুক্ষণ হাসি আটকানোর চেষ্টা করল। শেষে চেষ্টা বাদ দিল।

মেসের দুএকজন বোর্ডার উঁকি দিয়ে দেখছে। দেখুক। মীরু যদি এখন হাসতে হাসতে বারসাতের গায়ের ওপর পড়ে যায় তাহলেও কিছু যায়। আসে না। কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা বিয়ে করবে। একজন স্ত্রী স্বামীর কথা শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে (স্বামীর ওপরই পড়বে। এতে লজ্জার কিছু নেই।)

মীরু বলল, দেরি করছ কেন। চল যাই।

বারসাত বলল, দুদিন পরে যাওয়া যাক। আজ বাদ থাক।

মীরু বলল, আজ বাদ থাকবে কেন?

বারসাত বলল, তুমি যেমন আগে ঠিক করে রাখা বিয়ের শাড়ি পরে বিয়ে করবে আমিও তাই করব। আমার ঠিক করে রাখা পাঞ্জাবিটা পরব।

মীরু বলল, পাঞ্জাবিটাই কি একমাত্র কারণ? আমার ধারণা পাঞ্জাবি ছাড়াও অন্য কারণ আছে।

বারসাত বলল, তোমার ধারণা ঠিক পাঞ্জাবি ছাড়াও আরেকটা কারণ আছে। সেই কারণটা তোমাকে বলব না।

বলবে না কেন?

যদি বলি তাহলে দেখা যাবে তুমি মত পাল্টে ফেলেছ। আমাকে বিয়ে করার ব্যাপারে তোমার আগ্রহ কমে গেছে।

কারণটা বল আমি শুনব।

বলব না।

মীরু কঠিন গলায় বলল, অবশ্যই বলবে। তুমি প্রতিজ্ঞা করেছিলে আমার কাছে কিছু গোপন করব না।

বারসাত বলল, আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বিয়ের পর কেউ কারোর কাছে কিছু গোপন করব না। আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি। আচ্ছা আচ্ছা। এত মন খারাপ করতে হবে না বলছি–বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের টাকাটা আমার সঙ্গে নেই। টাকাটা খরচ করে ফেলেছি। ডাক্তার-ফাক্তার ওষুধপত্র। এই টেস্ট, সেই টেস্ট।

এই সামান্য কথাটা বলতে অস্বস্তি বোধ করছিলে কেন?

বারসাত বলল, একটা ছেলে বিয়ে করতে যাচ্ছে তার হাতে কোন টাকা-পয়সা নেই এটা কোন সামান্য ব্যাপার না। যাই হোক পরশু আঠারো তারিখ সকাল এগারোটায় কাজি অফিসে চলে আসবে।

পরশু?

হ্যাঁ পরশু। সকাল এগারোটায়। বিয়ের পর পর তবারুক হিসেবে মিনি সিঙাড়া খাওয়ানো হবে। তারপর আমরা চলে যাব বাগানবাড়ি পদ্মতে। আগে থেকে বেহালাবাদক ঠিক করা থাকবে। আমরা হাত ধরাধরি করে বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তারা বাজাবে—

লীলাবালি লীলাবালি
বড় যুবতী কন্যা কি দিয়া সাজাইবাম তোরে।

মীরু তাকিয়ে আছে। উৎসাহ এবং আনন্দে বারসাত ঝলমল করছে। তার চেহারায় যে অসুস্থ ভাব ছিল সেটা এখন আর নেই। বারসাতের ঝলমলে মুখ দেখতে ভাল লাগছে।

বারসাত বলল, পদ্ম নামের ঐ বাড়িতে যে ছবির একটা এক্সিবিশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এটা কি তুমি জানো?

আমার কি জানার কথা?

তোমার জানার কথা না। কারণ এটা রাখা হয়েছিল তোমাকে চমকে দেবার জন্যে। সারপ্রাইজ আইটেম। আমি বিভিন্ন সময়ে তোমার যে কয়টা স্কেচ করেছি সবগুলির একটা প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর নাম এ এবং ঐ। দর্শক মাত্র দুজন। তুমি আর আমি। আমি এ তুমি ঐ। ছবির সংখ্যা কত শুনলে তুমি আঁৎকে উঠবে। ছবির সংখ্যা একশ সাত। ওয়ান জিরো সেভেন।

মীরু বিস্মত হয়ে বলল, বল কি? এত ছবি কখন এঁকেছ?

যখনই তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে— মেসে ফিরে সঙ্গে সঙ্গে একটা ছবি এঁকে ফেলেছি।

সত্যি?

তোমার কি মনে হয় মিথ্যা?

না মিথ্যা মনে হয় না।

মীরু আবারও বারসাতের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখে তাকিয়ে থাকার পুরানো খেলা। এই খেলায় সে আজ হেরে যাবে কারণ তার চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা যায় না।

বারসাত বিস্মিত হয়ে বলল, কাঁদছ কেন ঐ?

মীরু বলল, তোমার সঙ্গে আমার আরো একটা চুক্তি হয়েছিল, সেই চুক্তির শর্ত ছিল আমি যদি কখনো কাঁদি তুমি জিজ্ঞেস করতে পারবে না কেন কাদছি। কান্নাটাই একটা লজ্জার ব্যাপার। কেন কাঁদছি তা ব্যাখ্যা করা আরো লজ্জার। এ রকম হা করে তাকিয়ে আছ কেন?

বারসাত বলল, আমি তোমার অনেক ছবি এঁকেছি, এখন লক্ষ্য করলাম সবচে সুন্দর ছবিই আঁকিনি। চোখে চকচক করছে অশ্রু এই ছবি। তুমি চুপ করে পাঁচটা মিনিট বস তো। জানালার দিকে তাকিয়ে বস। টেবিলের ড্রয়ারে দেখ কাগজ আছে পেনসিল আছে। দাও আমাকে। অবতীর ছবি একে দিচ্ছি।

মীরু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। বারসাতের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি পরশু এগারোটায় উপস্থিত থাকব। সঙ্গে করে একজন সাক্ষী নিয়ে আসব। একজনের খুব শখ আমার বিয়েতে সাক্ষী হিসেবে থাকা।

বারসাত বলল, মীরু তুমি চাইলেও এখন যেতে পারবে না। কারণ বৃষ্টি নেমেছে। ঝুমঝুমান্তি বৃষ্টি।

কি বৃষ্টি।

ঝুমঝুমান্তি বৃষ্টি। যে বৃষ্টিতে ঝুমঝুম করে নুপূরের শব্দ হয় সেই বৃষ্টির নাম ঝুমঝুমান্তি বৃষ্টি।

তুমি যে খুব সুন্দর করে কথা বল এটা কি তুমি জানো?

জানি।

বিয়ের পরেও কি তুমি এত সুন্দর করে কথা বলবে?

বুঝতে পারছি না।

মীরু বলল, তোমার শরীর যদি খুব বেশি খারাপ না লাগে তাহলে উঠ!

কোথায় যাব?

আমার ক্ষিধে লেগেছে। মিনি সিঙাড়া খাব।

এই বৃষ্টিতে?

গরম গরম সিঙাড়া তো বৃষ্টিতেই খেতে ভাল লাগবে।

 

সত্যি সত্যি ঝুমঝুমান্তি বৃষ্টি। আজ মনে হচ্ছে ঢাকা শহর বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাবে। বারসাত ফুর্তিমাখা গলায় বলল, সিঙাড়া খাবার পর আমরা ঢাকা শহরে রিকশায় করে ঘুরে বেড়াব। বর্ষা যাপন করব।

মীরু বলল, আমার সঙ্গে টাকা আছে। সিঙাড়া খেয়ে আমরা কাজি অফিসে যাব। তুমি কি দুজন সাক্ষী জোগাড় করতে পারবে না? সিঙাড়ার কারিগরকে যদি বলি সে কি আমাদের বিয়েতে সাক্ষী হবে?

বারসাত বলল, OK. আজ আমাদের বিয়ে।

রিকশাওয়ালা তাকালো পেছন দিকে। বারসাত বলল, ভাই আপনার নামটা কি শুনি।

রিকশাওয়ালা বলল, আমার নাম মজনু।

বারসাত বলল, অসম্ভব সুন্দর নাম। লাইলী নামের মেয়েটির খুব পছন্দের নাম। ভাই শুনুন, আমরা দুজন আজ বিয়ে করতে যাচ্ছি। আপনি একজন সাক্ষী। অসুবিধা আছে?

রিকশাওয়ালা জবাব দিল না। বৃষ্টির পানিতে রাস্তা ডুবে গেছে। তাকে খানাখন্দ এড়িয়ে রিকশা চালাতে হচ্ছে। প্যাসেঞ্জারের খেজুরে আলাপ শোনার সময় নাই।

বারসাত বলল, মীরু আমাকে মনে করিয়ে দিও তো আমি আবহাওয়া অফিসে খোঁজ নেব আজ কত ইঞ্চি বৃষ্টি হল।

মীরু বলল, বৃষ্টি কত ইঞ্চি হয়েছে তার খোঁজের দরকার কি?

বারসাত বলল, আজ একটা বিশেষ দিন। আজ আমাদের বিয়ে। বিয়ের দিন কত ইঞ্চি বৃষ্টি হল আমরা জানব না?

 

মীরুদের বিয়ে হল না। প্রধান কাজি গিয়েছেন ফরিদপুরে মেয়ের বাড়িতে। দ্বিতীয় কাজি কোথায় যেন বিয়ে পড়াতে গেছেন। কখন ফিরবেন কেউ বলতে পারে না।

মীরু স্বপ্নটা আবারো দেখছে

মীরু স্বপ্নটা আবারো দেখছে। তবে স্বপ্নটা আগের মত না। একটু মনে হল বদলেছে। ডায়াসে স্যারকে দেখা যাচ্ছে। স্যারের চেহারা শান্ত। তিনি। আঙুল উঁচিয়ে ডাকলেন, এই যে মেয়ে। উঠে এসো। তোমার নামই তো ঐ? অদ্ভুত এক অক্ষরের নাম–ঐ।

স্যার আমার নাম ঐন্দ্রিলা।

ঐন্দ্রিলার চেয়ে ঐ অনেক সুন্দর নাম। আজ থেকে আমরা সবাই তোমাকে ঐ নামে ডাকব। ঠিক আছে?

মীরু কিছু বলার আগেই সব ছাত্রছাত্রীরা একসঙ্গে বলে উঠল, ইয়েস ইয়েস কণ্ঠ ভোটে পাশ। কণ্ঠ ভোটে পাশ।

মীরু তাকালো নিজের দিকে। আশ্চর্য কাণ্ড, তার গায়ে কাপড় আছে। সাদা জমিনে লাল সবুজের খেলা। তার বিয়ের শাড়ি। এটা তাহলে দুঃস্বপ্ন না। এটা আনন্দের স্বপ্ন। স্যার যদি তাকে এখন বোর্ডে যেতে বলেন সে যাবে।

হ্যাঁ ঐ হ্যালো!

জি স্যার।

তুমি বিয়ের শাড়ি পরে ক্লাসে এসেছ কেন?

আজ আমার বিয়ে হয়েছে এই জন্যেই বিয়ের শাড়ি পরে ক্লাসে এসেছি।

কার সঙ্গে বিয়ে ঔ-এর সঙ্গে? ঐ-এর বিয়ে ঔ-এর সঙ্গে?

জি না স্যার।

ছাত্ররা আবারো চেঁচিয়ে উঠল, ইয়েস। ইয়েস। কণ্ঠ ভোটে পাস। কণ্ঠ ভোটে পাস।

স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ঐ তোমাদের বিয়ে কবে হবে?

পরশু সকাল এগারোটায় হবে।

ছাত্ররা চেঁচিয়ে উঠল, পাস পাস কণ্ঠ ভোটে পাস।

স্যার বললেন, আমরা সবাই তোমার বিয়েতে যাব।

আবারো ডেস্ক চাপড়িয়ে চিৎকার, পাস পাস। কণ্ঠ ভোটে পাস।

স্বপ্নে প্রচণ্ড হৈচৈ-এ মীরুর ঘুম ভাঙল। ঘর নিঃশব্দ। বইয়ের ভাষায় পিনপাতনিক নৈঃশব্দ। স্বপ্নের ভেতর হৈচৈ হলে স্বপ্ন ভঙ্গের পর দেখা যায় ঘরেও হৈচৈ হচ্ছে। অথচ ঘরে কোনো শব্দ নেই।

মীরুর ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত বাজে আটটা। মাথা ধরেছিল বলে সে দুটা প্যারাসিটামল খেয়ে শুয়েছিল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি। মাথা ধরা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে ঘুম ভাঙার পরেও মাথা ধরা থাকে। তারবেলা ব্যতিক্রম হয়েছে। মাথা ধরা নেই। শরীর ফুরফুরে লাগছে।

মীরু পাশ ফিরল। সে ঠিক করল ঘুম ভাঙলেও সে বিছানা থেকে নামবে না। আরো কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করবে। নিজের বিছানায় গড়াগড়ি খাওয়ার দিন তার শেষ হয়ে এসেছে। তাকে চলে যেতে হবে অন্য কোথাও। বারসাত কোথায় নিয়ে তাকে তুলবে কে জানে। আত্মীয়-স্বজনের বাসায় নিয়ে তুলবে না এটা বলে দেয়া যাচ্ছে। এক-দুদিনের জন্যে বন্ধুবান্ধবের বাসায় স্ত্রীকে নিয়ে ওঠা যায়–তারপর? মীরুর ব্যাংকে পনেরো হাজার চারশ টাকা আছে। এই টাকাটা নিয়ে কক্সবাজার চলে যাওয়া যায়। যুগল জীবনের প্রথম কিছুদিন সমুদ্র দেখে কাটানো।

সমুদ্র দেখার পর তারা দেখবে— পাহাড়। চলে যাবে রাঙ্গামাটি কিংবা বান্দরবান। সমুদ্র এবং পাহাড় দেখার পর যাবে অরণ্যে। সুন্দরবন। সমুদ্র পর্বত ও অরণ্য এই তিন জিনিস দেখার পর শুরু হবে যুগল জীবন…

মীরু ঘুমাচ্ছিস?

মীরু চোখ মেলল। পাশ ফিরল। জাহেদা বানু ঘরে ঢুকেছেন। তিনি মনে হয় দরজা বন্ধ করে কেঁদেছেন। চোখ লাল হয়ে আছে। তিনি মেয়ের পাশে বসলেন। মীরু বলল, কোনো সমস্যা হয়েছে?

জাহেদা ক্ষীণ গলায় বললেন, রুনি ব্যাগ স্যুটকেস নিয়ে এসেছিল। তোর বাবা ধমক দিয়ে আবার তাকে ফেরত পাঠিয়েছেন। মেয়েটা হাসিমুখে এসেছিল কাঁদতে কাঁদতে গেছে।

মীরু বলল, জগতের এটাই নিয়ম। হাসতে হাসতে যে আসবে তাকে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় হতে হবে। একবারই শুধু এর ব্যতিক্রম হয়। মানুষ আসেও কাঁদতে কাঁদতে যায়ও কাঁদতে কাঁদতে।

কখন?

জন্ম-মুত্যুর সময়। জন্মের সময় কাঁদতে কাঁদতে পৃথিবীতে আসে এবং মৃত্যুর সময়ও কাঁদতে কাঁদতে যায়।

জাহেদা বললেন, কথাটা তো সুন্দর।

মীরু বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, আমার একজন ফিলসফার বন্ধু আছে। এইসব মজার মজার কথা সবই তার কাছ থেকে শেখা।

জাহেদা আতংকিত গলায় বললেন, ছেলে বন্ধু না তো?

মীরু বলল, তুমি ঠিক ধরেছ। ছেলে বন্ধু। এবং আগামী পরশু সকাল এগারোটায় তাকে বিয়ে করছি। তুমি যদি ভাব তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছি তাহলে ভুল করবে।

বিয়ে করছিস?

হ্যাঁ। বিয়ে করে আমি ফুড়ুৎ করে উড়াল দিয়ে চলে যাব। তুমি তখন তোমার অতি প্রিয় স্বামীকে নিয়ে অতি সুখে জীবন যাপন করতে পারবে–

দু’জনে মুখোমুখি
গভীর দুখে দুখী
আঁধারে ঢাকিয়া গেছে আর সব।

জাহেদা অবাক হয়ে বললেন, তুই সত্যি বিয়ে করছিস?

হুঁ।

ছেলেটা কে?

বারসাত নাম।

কাজি অফিসে বিয়ে করছিস?

কাজি অফিস ছাড়া উপায় কি? তোমরা কি কমুনিটি সেন্টারে আমার বিয়ে দেবে?

জাহেদা কাদো কাদো গলায় বললেন, আমি আমার দুই মেয়ের কোনো মেয়েকেই কি শখ করে বিয়ে দিতে পারব না?

মীরু বলল, সে রকমই তো মনে হচ্ছে।

জাহেদা কেঁদে ফেললেন। মীরু মার হাত ধরে বলল, বাবাকে রাজি করাও। বাবাকে গিয়ে বল— মীরু একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। ছেলে বেকার। হতদরিদ্র। বাবা যদি তাতেই রাজি থাকে তাহলে আমি খুবই খুশি মনে বেনারসি শাড়ি পরে বিয়ে করব। বাবাকে বলতে পারবে?

জাহেদা কিছু বললেন না। চোখ মুছতে থাকলেন। মীরু বলল, এত মন। খারাপ করো না তো মা। যা হবার হবে। কে সারা সারা। এসো আমরা হাসি। ছাদে যাবে? চল ছাদে যাই। ছাদের ঘুম সোফায় তুমি শুয়ে থাকবে। আমি তোমার চুল টেনে দেব। যাবে?

জাহেদা এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, বিয়ের পর তুই কী করবি? রুনির মতো বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি?

মীরু শান্তগলায় বলল, আমার চলে যাবার জায়গা নেই মা। ওর হাতে একেবারেই টাকা-পয়সা নেই। ঘর ভাড়া করে আমাকে নিয়ে থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমাকে তোমাদের সঙ্গেই কুমারী মেয়ে সেজে থাকতে হবে। মাঝে মধ্যে স্বামীর সঙ্গে তার মেসে দেখা করতে যায়।

এইভাবে কতদিন থাকবি?

যতদিন থাকা যায়। মা তুমি কি আমাকে এইভাবে থাকতে দেবে না। কি বাবার কাছে আমাকে ধরিয়ে দেবে?

ধরিয়ে দেব কেন?

স্বামীর কাছে ভালো সাজার জন্যে ধরিয়ে দেবে। আদর্শ স্ত্রী সাজতে যাবে। তোমার জীবনের লক্ষ্য হল আদর্শ স্ত্রী হওয়া। আদর্শ মা হওয়া না।

আমার সম্বন্ধে তোর এত খারাপ ধারণা?

হ্যাঁ মা তোমার সম্পর্কে আমার খুবই খারাপ ধারণা। রুনি আপু যে গোপনে বিয়ে করেছে সেই খবরটা বাবাকে তুমি দিয়েছ। আমি তোমার কী নাম দিয়েছি শুনতে চাও? আমি তোমার নাম দিয়েছি তালেবান মা। বাবার সব কথায় তুমি তাল দাও বলেই তুমি তালেবান।

আমি তালেবান?

হ্যাঁ তুমি তালেবান। বাবা যখন ঘুষ খায় তখন তুমি বল, অফিসের সবাই ঘুষ খায়। তোর বাবা একা যদি না খায় সে একঘরে হয়ে যাবে। তার চাকরি চলে যাবে। চাকরি বাঁচানোর জন্যেই তার ঘুষ খাওয়া দরকার। বলনি এমন কথা?

জাহেদা ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। মীরু বাথরুমে ঢুকল। চোখেমুখে পানি দিল। রান্নাঘরে ঢুকে নিজের জন্যে এক কাপ চা বানাল। চায়ের। কাপে দুই চুমুক দেয়ার পর আফজল সাহেব ডাকলেন, মরিয়ম। মরিয়ম।

মীরু চায়ের কাপ রেখে উঠে দাঁড়াল। আফজল সাহেব আবারো। ডাকলেন, মরিয়ম।

মীরু বলল, বাবা আমি আসছি। একটা টেলিফোন করে আসছি।

টেলিফোন পরে হবে আগে শুনে যা।

এত ব্যস্ত হয়ো না বাবা আমি আসছি। টেলিফোন করতে এক মিনিট লাগবে।

মীরু টেলিফোনের ডায়াল ঘুরাল। সুলতানা ফুপুকে টেলিফোন করা দরকার। নামাজে দাঁড়িয়ে পড়লে এক-দেড় ঘণ্টা তাকে আর পাওয়া যাবে না।

হ্যালো ফুপু।

হুঁ।

কী ব্যাপার এখনো তুমি এশার নামাজে দাঁড়াওনি?

তুই কী বলবি বল তো সময় নষ্ট করিস না।

আমার জন্যে একটা ঘর খালি করে রাখ আমি আসছি।

তুই এমন কী মহারানী যে তোর জন্যে ঘর খালি করে রাখতে হবে। তুই আসবি আমার সঙ্গে ঘুমাবি।

নাসের সাহেবের টেলিফোন নাম্বারটা আমাকে একটু দাও তো ফুপু।

টেলিফোন করবি?

টেলিফোন না করলে নাম্বার নিয়ে কী করব?

ঠিক করে বল তো মীরু ছেলেটাকে তোর পছন্দ হয়েছে না?

হ্যাঁ।

কিন্তু নতুন ধনী না। চারপুরুষের ধনী।

ফুপু তুমি টেলিফোন নাম্বারটা দাও। আমার হাতে বেশি সময় নেই। বাবা ডাকছেন।

তুই আমার এখানে কখন আসবি?

এই ধর ঘণ্টা খানিক।

বাড়িতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?

মীরু বলল, আমি যে পরশু সকাল এগারোটায় গোপনে একজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছি এই খবরটা মাকে বলেছিলাম। আমার ধারণা মা বাবাকে গিয়ে বলেছেন। যে কারণে বাবা ব্যস্ত হয়ে আমাকে তলব করেছেন।

তুই বারসাতকে বিয়ে করছিস?

হুঁ।

নাসেরের টেলিফোন নাম্বার দরকার কেন?

সাক্ষী লাগবে না? উনি হবেন আমার দিকের সাক্ষী।

আমি জীবনে অনেক মেয়ে দেখিছি। তোর মতো অদ্ভুত মেয়ে দেখিনি।

মীরু বলল, বারসাতের সঙ্গে যখন তোমার পরিচয় হবে তখন তুমি বলবে— আমি অনেক অদ্ভুত ছেলে দেখেছি কিন্তু বারসাতের মতো অদ্ভুত ছেলে দেখিনি। আমিও অদ্ভুত সেও অদ্ভুত! অদ্ভুত অদ্ভুতে ধূল পরিমাণ।

জাহেদা এসে ঘরে ঢুকলেন। মীরু টেলিফোন নামিয়ে রেখে বলল, মা কিছু বলবে?

জাহেদা বললেন, তোর বাবা তোকে ডাকছে তুই যাচ্ছিস না কেন?

মীরু বলল, তুমি কি বাবাকে পরশু সকালে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটা বিস্তারিতভাবে বলেছ?

জাহেদা চুপ করে রইলেন। মীরু বলল, বাবার সঙ্গে আমি দেখা করব না। তিনি হার্টের রোগী। চিৎকার চেঁচামেচি করে একটা সমস্যা তৈরি করবেন। আমি নিঃশব্দে পালিয়ে যাব। তোমার কাছে টাকা-পয়সা থাকলে আমাকে দাও।

শোবার ঘর থেকে আফজল সাহেব আবারো ডাকলেন, মরিয়ম। মরিয়ম।

আকাশ ঘন নীল

আকাশ ঘন নীল।

আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় চোখে নীল সানগ্লাস পরে আকাশ দেখা হচ্ছে। মীরু বলল, আকাশ কী রকম নীল দেখেছেন? হালকা নীলকে আমরা বলি আকাশী নীল। কিন্তু আসলে আকাশের নীল অনেক গাঢ়।

নাসের কিছু বলল না। হাসল।

মীরু বলল, নীল দিয়ে শুরু হয়েছে এমন একটা গানের কলি বলুন তো।

নাসের বলল, বলতে পারব না। আমি আসলে এত মন দিয়ে গান শুনি না।

গান না পারলে কবিতার লাইন বলুন যেটা শুরু হয়েছে নীল দিয়ে।

আমি পারছি না। বারসাত সাহেব নিশ্চয়ই পারতেন। তাই না?

হ্যাঁ ও পারত।

দুনিয়ার কবিতা ওর মুখস্ত।

নাসের বলল, আমি টেকো মাথার এক ব্যবসায়ী। পৃথিবীর সমস্ত ফাইনার ফিলিংস থেকে অনেক দূরে বাস করি। একেক জনের একেক লাইন। আমি যা বলতে পারব বারসাত সাহেব কিন্তু তা পারবেন না। হাজার চেষ্টা করলেও পারবেন না।

আপনি কী বলতে পারবেন?

কোন ব্রান্ডের সিমেন্টের কত দাম সেটা বলতে পারব। রডের দাম বলতে পারব।

মীরু বলল, বারসাত যেমন ইন্টারেস্টিং একজন মানুষ। আপনিও সে রকম ইন্টারেস্টিং একজন মানুষ।

থ্যাংক ইউ।

মীরু বলল, আপনার ঘড়িতে কটা বাজে একটু দেখবেন?

নাসের বলল, একটা দশ।

মীরু বলল, এতক্ষণে ওর চলে আসা উচিত না?

রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। এই জন্যেই আসতে দেরি হচ্ছে।

মীরু বলল, কাজি অফিসে ছেলে মেয়ে দুজনকেই আসলে একসঙ্গে আসা উচিত। একজন যদি আগে এসে অপেক্ষা করে তাহলে তার খুব। খারাপ লাগে।

নাসের বলল, বারসাত সাহেব একবার সারাদিন আপনার জন্যে অপেক্ষা করেছেন। আপনিও না হয় কিছুক্ষণ করলেন। আমি একটা কাজ করতে পারি। আমার গাড়িটা তাকে আনার জন্যে পাঠাতে পারি। পাঠাব?

না। আমার ক্ষিধে লেগেছে। আপনি বরং কিছু খাবার ব্যবস্থা করুন।

কী খাবেন?

মিনি সিঙাড়া।

সেটা কী জিনিস?

সবচে ছোট সাইজের সিঙাড়া। যে কারিগর এই সিঙাড়া বানায় তার নাম নেকমর্দ। আমি দোকানটা চিনিয়ে দিচ্ছি। আপনি নিয়ে আসুন। আমি বারসাতের জন্যে অপেক্ষা করি।

নাসের মীরুকে চমকে দিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, মনে পড়ছে।

মীরু বলল, কী মনে পড়েছে?

নীল দিয়ে শুরু কবিতার লাইন— নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাই আর নাহিরে।

মীরু বলল, এই তো পারলেন। নাসের বলল, আরেকটা মনে পড়েছে। এইটা অবশ্যি গান-– নীল কবুতর লয়ে নবীর দুলালী মেয়ে। নজরুল। গীতি। গানটা শুনেছেন?

না।

আরেকটা মনে পড়েছে। এবারে রবীন্দ্র সংগীত। বলব?

না বলতে হবে না। আপনি প্রথমে বললেন, আপনি টেকো মাথার এক ব্যবসায়ী, ফাইনার ফিলিংস থেকে অনেক দূরে বাস করেন। কিছুই বলতে পারবেন না। এখন একের পর এক বলে যাচ্ছেন। এর মানে কী?

নাসের হাসল।

মীরু রাগী গলায় বলল, হাসবেন না। শুরুতে আপনি মূখ সাজার ভান করেছিলেন। আমার সঙ্গে ভান করবেন না। আমি ভান পছন্দ করি না।

রাগ করছেন?

সামান্য করেছি।

রাগ করিয়ে দেই? হাসির কোনো একটা গল্প বলে আপনাকে হাসিয়ে দেই?

কোনো দরকার নেই।

আমি আপনাকে রাগিয়েছি। রাগ কমানোর দায়িত্বও তো আমার। গল্পটা বলি। এক ভদ্রমহিলা তার ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন। বৌ ফিজিক্সে M.Sc. ছেলের বৌকে নিয়ে শাশুড়ির অহংকারের শেষ নেই। বাড়িতে যেই আসে তার সঙ্গেই বৌ-এর জ্ঞানের গল্প করেন। একদিন হয়েছে কী বাড়িতে অনেক মেহমান এসেছে। শাশুড়ি যথারীতি বৌ-এর প্রশংসা করছেন; এমন সময় চায়ের ট্রে হাতে বউ ঢুকল। শাশুড়ি দেখলেন চায়ে পিঁপড়া ভাসছে। তিনি বললেন, একি বৌমা চায়ে তো পিঁপড়া ভাসছে।

বৌ সঙ্গে সঙ্গে বলল, এত অবাক হচ্ছেন কেন মা? পিঁপড়া চায়ে ভাসবে এটাই তো স্বাভাবিক। পিঁপড়া চায়ের চেয়ে হালকা। আর্কিমিডিসের সূত্র অনুসারে সে ভাসছে। একটা মার্বেল চায়ে ছেড়ে দিয়ে দেখা যাবে মার্বেল ডুবে গেছে। মা একটা মার্বেল ছেড়ে দেখাব?

মীরু হাসছে। হাসি থামানোর চেষ্টা করেও পারছে না। যতই সে হাসি। থামানোর চেষ্টা করছে ততই হাসি বাড়ছে। আশেপাশের লোকজন কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে। নাসের বলল, আরেকটা বলব? এরচে কড়া ডোজের?

মীরু বলল, আর লাগবে না। আপনি সিঙাড়া নিয়ে আসুন।

নাসের বলল, আরেকটা বলি। এটা বলে আমি খাবার আনতে চলে যাব। আপনি একা একা হাসতে থাকবেন। আশা করছি এর মধ্যে বারসাত সাহেব চলে আসবেন। তিনি অবাক হয়ে দেখবেন আপনি একা একা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছেন। তাঁর কাছে অদ্ভুত লাগবে। গল্পটা বলব?

বলুন।

না থাক। কেন জানি মনে হচ্ছে আপনাকে হাসাতে পারব না। আমি যাই সিঙাড়া নিয়ে আসি। আপনি কি লক্ষ্য করছেন— আকাশের নীল রঙটা কমে আসছে। মেঘ জমতে শুরু করেছে। বিকাল চারটার দিকে দেখবেন। বৃষ্টি নামবে।

মীরু কিছু বলল না। আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। এই মেঘ দেখতে ভালো লাগছে না। মোটেও ভালো লাগছে না।

 

ঘড়িতে পাঁচটা বাজে। আকাশ মেঘে মেঘে কালো হয়ে আছে। মীরু বলল, বলুন তো বৃষ্টি কখন নামবে?

নাসের বলল, বলতে পারছি না। আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে। এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে।

মীরু বলল, আমি লক্ষ্য করেছি আকাশে যেদিন খুব মেঘ হয় সেদিন বৃষ্টি হয় না। তবে আজ হবে। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ চলে এসেছে।

নাসের বলল, আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে চান?

বৃষ্টি নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। আমি আপনার সারাটা দিন নষ্ট করলাম। সরি। এক কাজ করুন, আপনি চলে যান। আমার একা অপেক্ষা করতে কোনো সমস্যা নেই।

নাসের বলল, আপনার যদি একা অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করে তাহলে অবশ্যই একা অপেক্ষা করবেন। আমি চলে যাব। সে-রকম কোনো ইচ্ছা যদি না থাকে তাহলে অপেক্ষা করব।

মীরু বলল, বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। বৃষ্টির একটা ফোঁটা গায়ে পরা মাত্রই আমি রওনা হব।

নাসের বলল, আপনি মোটেও চিন্তা করবেন না। আমি লোক লাগিয়ে দিয়েছি উনি কোথায় আছেন সেই খোঁজ আজ রাতের মধ্যে বের করে ফেলব।

মীরু জবাব দিল না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল। নাসের বলল, সময় কাটানোর জন্যে একটা মজার খেলা আছে। এই খেলাটা খেলবেন? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার সময় কাটছে না। ভিতরে ভিতরে আপনি ছটফট করছেন। খেলাটা খেলবেন?

কী খেলা?

আমি একটা শব্দ বলব। শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আপনার মনে যে শব্দটা আসবে আপনি সেটা বলবেন। আপনার কাছ থেকে শব্দটা শোনার পর আমার মনে যা আসবে তা বলব। এরকম চলতে থাকবে।

শেষ হবে কখন?

যেখান থেকে শুরু করেছি সেখানে পৌঁছার পর শেষ হবে। আসুন শুরু করি। আমি বলছি প্রথম শব্দ। বৃষ্টি। বৃষ্টি শব্দটা শুনে আপনার মনে যে শব্দটা আসবে সেটা বলুন।

মীরু : অশ্রু।

নাসের : নদী।

মীরু : নৌকার পাল।

নাসের : নীল আকাশ।

মীরু : আকাশে মেঘ।

নাসের : ঝড়।

মীরু :বৃষ্টি।

নাসের বলল, খেলা শেষ। আমরা বৃষ্টি দিয়ে শুরু করেছিলাম আবার বৃষ্টিতে ফিরে এসেছি।

মীরু বলল, বৃষ্টি নামতেও শুরু করেছে। কয়েক ফোঁটা আমার গায়ে পড়েছে। চলুন যাওয়া যাক।

মীরুর চোখ ভর্তি পানি। সে চোখের পানি আড়াল করার কোনো চেষ্টা করছে না।

নাসের দুঃখিত গলায় বলল, ঐন্দ্রিলা আপনি নিশ্চিত থাকুন আমি আজ রাতের মধ্যে বারসাত সাহেবের খবর বের করব।

———-

পরিশিষ্ট

মেয়েটির চেহারা অত্যন্ত মিষ্টি। চোখ বুদ্ধিতে ঝলমল করছে। সে এসেছে। তার বিয়েতে আমাকে দাওয়াত করতে। আমি বললাম, তোমার নাম কী?

মেয়েটি বলল, আমার চারটা নাম, মরিয়ম, মীরু, ঐন্দ্রিলা এবং ঐ।

আমি বললাম, চার নামের মেয়ে আমি এই প্রথম দেখলাম।

মেয়েটি বলল, চারটা নামের মধ্যে কোন নামটা আমার সঙ্গে সবচে ভালো যায়।

আমি বললাম, মরিয়ম নামটা সবচে ভালো যায়। মরিয়ম নামের মধ্যে কোমল একটা ব্যাপার আছে। তোমার মধ্যেও কোমলতা আছে।

আমার মধ্যে কোনোই কোমলতা নেই। আমি খুবই কঠিন একটা মেয়ে। যাই হোক আমি কঠিন না কোমল তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমার বিয়েতে কিন্তু আপনাকে আসতে হবে। শুক্রবারে বিয়ে। শুক্রবারে আপনি কোনো কাজ রাখতে পারবেন না।

তোমার বিয়েতে আমাকে আসতে হবে কেন?

কারণ আমার জীবনটা অবিকল আপনার লেখা একটা উপন্যাসের মতো। উপন্যাসের নায়িকা গোপনে একটা ছেলেকে বিয়ে করার জন্যে কাজি অফিসে যায়। ছেলেটা কিন্তু আসে না। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসে। তার বিয়ে হয় অন্য আরেকজনের সঙ্গে। তার জীবন কাটে

কাঁদতে কাঁদতে। উপন্যাসের কথা কি আপনার মনে পড়েছে?

না। ছেলেটা আসে না কেন?

ছেলেটা খুবই অসুস্থ ছিল। তার হয়েছিল হেপাটাইটিস বি। ডাক্তাররা সন্দেহ করেছিলেন তার লিভার সিরোসিস হয়েছে। এক ধরনের ক্যানসার। কাজেই তার মনে হল দুদিন পরে সে মারা যাচ্ছে। এই অবস্থায় একটা মেয়েকে বিয়ে করে তার জীবন সে নষ্ট করতে পারে না। কাজেই বিয়ের দিন সে পালিয়ে গেল গ্রামে। এখন কি আপনার মনে পড়েছে?

হ্যাঁ মনে পড়েছে।

উপন্যাসের নাম রোদনভরা এ বসন্ত।

আমি বললাম, তুমিও কি সেই উপন্যাসের নায়িকার মতো অন্য একটা ছেলেকে বিয়ে করছ?

না আমি অসুস্থ ছেলেটাকেই বিয়ে করছি। তাকে গ্রাম থেকে ধরে আনা হয়েছে। আমার এক বন্ধু নাসের নাম উনি তাকে তার বাড়িতে গৃহবন্দি করে রেখেছেন।

ইন্টারেস্টিং তো!

অবশ্যই ইন্টারেস্টিং। আমাদের বিয়েতে আপনি উপস্থিত থাকবেন। এবং উপন্যাসের শেষটা পাল্টে দেবেন। ছেলেটার অসুখ অবশ্যই সারিয়ে দেবেন। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা যেন খুব সুখে জীবন কাটায়।

তাহলে তো উপন্যাসের নামও পাল্টাতে হয়। মিলনান্তক উপন্যাসের নাম–রোদনভরা এ বসন্ত হতে পারে না।

নাম পাল্টানোর দরকার নেই। আমি সারা জীবন কাঁদতে রাজি আছি কিন্তু বারসাতকে হারাতে রাজি না।

মেয়েটি কাঁদছে। তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। সুন্দর লাগছে দেখতে।

আমি বললাম, আমার উপন্যাসের নায়ক সুন্দর ছবি আঁকত। তোমার এই ছেলে বারসাত কি ছবি আঁকতে পারে?

ঐন্দ্রিলা চোখ মুছতে মুছতে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

তার চেহারা থেকে কান্না চলে গেছে। সে এখন আনন্দে ঝলমল করছে। এই মেঘ এই রৌদ্র।

Exit mobile version