নাসেরের গাড়ি আছে, তুই রিকশা নিয়ে যাবি কেন? তুই আয় তো আমার সঙ্গে, তোকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি।
মীরু অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল। সুলতানা বললেন, হাসছিস কেন? মীরু বলল, জানি না কেন হাসছি। মনে হয় আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
সুলতানা বললেন, তুই এক কাজ কর যেখানে যাবি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যা। তোর ভাবভঙ্গি এলোমেলো, তোকে একা ছাড়া যাবে না।
মীরু বলল, তুমি তোমার অসুস্থ ভাইকে ফেলে আমার সঙ্গে বেড়াতে বের হবে? নিজের ভাই মরে যাচ্ছে।
সুলতানা বিরক্ত গলায় বললেন, মরে যাচ্ছে কী? কথা বলার স্টাইলটা তোর এরকম হয়ে যাচ্ছে কেন? তুই আমার চেয়ে ভালো জানিস যে ভাইজানের অবস্থা এখন ভালো। সব বিপদ কেটে গেছে।
মীরু হাই তুলতে তুলতে বলল, ফুপু বেশি করে চিনি দিয়ে আমাকে এক কাপ চা খাওয়াও। তারপর ডলে ডলে আমার মাথায় তেল দিয়ে দাও।
সুলতানা অবাক হয়ে মীরুর দিকে তাকালেন। মীরু ফিক করে হেসে ফেলে বলল, তুমি কি ভাবছ আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তোমাকে হকচকিয়ে দেবার জন্যে হঠাৎ চায়ের কথা বলেছি। আমার অবশ্যি চা খেতে ইচ্ছা করছে। মাথায় তেল দিতেও ইচ্ছে করছে। ফুপু তুমি কি জানো এই পৃথিবীতে তোমার চেয়ে ভালো করে কেউ মাথায় তেল দিতে পারে না। তেল দেবার পর চুলের গোছা ধরে তুমি যে টুকুস করে টান দাও–এক্কেবারে স্বর্গীয় টান।
নাসেরকে বলে দিচ্ছি ও তোকে ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে চা খাইয়ে দেবে।
মাথায় তেল দিয়ে দেবে না?
সুলতানা হেসে ফেললেন। মীরু এমন মজা করে কথা বলে না হেসে থাকা সম্ভব না।
মীরু গম্ভীর গলা করে বলল, আমি নাসের-ফাসের কাউকে সঙ্গে নেব। তোমার বোরকাটা খুলে তুমি কি আমাকে দিতে পারবে?
সুলতানা ধমক দেবার ভঙ্গিতে তাকালেন। মীরু বলল, আমার এখন এমনভাবে যাওয়া উচিত যাতে কেউ আমাকে চিনতে না পারে। বোরকার অনেক উপকারিতা আছে।
মীরু বোরকা নিয়ে কোনো রসিকতা করবি না। এই রসিকতা আমার পছন্দ না।
মীরু বলল, আচ্ছা যাও তোমার এই মহান পোশাক নিয়ে আমি কোনো রসিকতা করব না। আমি এখন বিদায় হচ্ছি।
তোর বাবার সঙ্গে দেখা করে যা।
মীরু অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-এর ভেতর ঢুকল। তার বাবার বিছানার সামনে দাঁড়াল। আফজল সাহেব ঘুমের ওষুধের কারণে সারাক্ষণই ঘুমুচ্ছেন। তারপরেও মীরু যখন বলল, বাবা আমি এখন যাচ্ছি— আফজল সাহেব চোখ মেললেন এবং একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন। হাত বাড়ানোর অর্থ হাত ধরা। মীরু হাত ধরল না। সহজ-স্বাভাবিক গলায় বলল, বাবা আমি যাচ্ছি। তুমি রেস্ট নাও।
আফজল সাহেব বললেন, আচ্ছাগো মা।
মীরু বলল, তোমার দুঃশ্চিন্তার এখন আর কিছু নেই। ঢাকা শহরে আমাদের যত আত্মীয়-স্বজন আছেন সবাই চলে এসেছেন। আজ বিকেল থেকে ঢাকার বাইরের আত্মীয়-স্বজনরা আসতে শুরু করবেন। তারা কেউই সহজে যাবে না। চিড়িয়াখানা, শিশু পার্ক, লালবাগের কেল্লা এইসব দেখে বেড়াবে।
আফজল সাহেব মেয়ের কথায় হেসে ফেললেন। কারোর রসিকতায় তিনি কখনো হেসেছেন এমন উদাহরণ নেই। হার্ট এটাকের পর সম্ভবত তার মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়েছে। মীরুর কথা শুনে তিনি যে শুধু হাসলেন তা-না। অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন।
মীরু বলল, বাবা তুমি ঘুমাও। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হার্ট ঠিক কর। হার্টকে রেস্ট দাও।
আজফল সাহেব বললেন, তুই নিজেও রেস্ট নে। তোর ওপর দিয়ে বিরাট ধকল গিয়েছে।
বুকে ব্যথাট্যথা এসব তো এখন আর নেই?
না। মীরু শোন, তুই না থাকলে তো আজ আমি মরেই যেতাম রে মা! আফজল সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। তার ইচ্ছা করল কিছুক্ষণ মেয়ের হাত ধরে থাকতে। তিনি আবারো তার ডান হাতটা মেয়ের দিকে বাড়ালেন। মীরু এমন ভাব করল যেন সে দেখতে পায়নি। হাত ধরাধরি নাটক করতে তার ইচ্ছা করছে না।
নাসের নামের ভদ্রলোকের গাড়িতে করেই মীরু রওনা হয়েছে। ভদ্রলোক নিজে গাড়ি চালাচ্ছেন। কাজেই মীরুকে বসতে হয়েছে ড্রাইভারের পাশের সিটে। এই ভদ্রলোক কে? তাদের কোন ধরনের আত্মীয় তা মীরু ধরতে পারছে না। ভোর রাত থেকে ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে ডিউটি দিচ্ছেন। কাজেই ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হবার কথা। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলে মীরুর চেনার কথা। সে চিনতে পারছে না। মীরুর মনে ক্ষীণ সন্দেহ— এই ভদ্রলোকই কি সুলতানা ফুপুর ঠিক করা পাত্র? যার সঙ্গে মীরুর বিয়ে দেবার জন্যে সুলতানা ফুপু প্রায় জীবন দিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সেই ছেলের নাম নাসের না। তার নাম অন্যকিছু মোঘল রাজা বাদশার নামে নাম। ভদ্রলোকের মাথা ভর্তি টাক। এরকম টেকো মাথার কাউকে ফুপু তার পাত্র হিসেবে ঠিক করবেন তা ভাবা যায় না। তাছাড়া পাত্ররা কখনো হাসপাতালে ডিউটি দেয় না। তারা ভাব ধরে দূরে থাকে। হাসপাতালে ডিউটি দেয় গরিব প্রেমিকরা।
মীরুর ঘন ঘন হাই উঠছে। বাবাকে নিয়ে তার খুব টেনশান গিয়েছে। এখন টেনশানমুক্ত বলে হঠাৎ শরীর ছেড়ে দিয়েছে। যেভাবে তার হাই উঠছে গাড়ির মধ্যেই ঘুমিয়ে পরা বিচিত্র না। মীরু ঘুম কাটানোর জন্যেই কথা বলা শুরু করল—আপনার নামটা ভালো না, এটা কি আপনি জানেন?
মানুষটা কথা শুনে হাসল তবে মীরুর দিকে তাকাল না। সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, কেন ভালো না?
নাসের নামের সঙ্গে টাক মাথা মানায় না। নাসের নাম শুনলে মনে হয়। মানুষটার মাথা ভর্তি চুল।
ও আচ্ছা।
এই নাম ছাড়া আপনার অন্য কোনো নাম নেই?