না।
তুই এত সহজভাবে না বলতে পারলি? তোর একটুও খারাপ লাগল।?
খুট করে শব্দ হল। মীরুর বাবা দরজা খুলেছেন।
মীরু চট করে টেলিফোন রেখে দিল। বাবা যদি দেখেন সে টেলিফোনে কথা বলছে তাহলে গজব হয়ে যাবে। মীরু তাকাল ঘড়ির দিকে। চারটা একুশ বাজে। ফজরের নামাজের সময় হয়ে গেছে। আফজল। সাহেব বাথরুমে যাবেন। অজু করবেন। ফজরের নামাজ শেষ করে সূরা। আর রাহমান পড়বেন। তারপর আবার ঘুমুতে চলে যাবেন। ঘুমুতে যাবার। আগে এক কাপ আদা চা খাবেন। একটা টোস্ট বিসকিট খাবেন। এই চা তাকে বানিয়ে দেবেন মীরুর মা জাহেদা বানু।
আজ আফজল সাহেবের চা হবে না। কারণ জাহেদা বানু বাসায় নেই। তিনি ফুলবাড়িয়াতে গিয়েছেন। তাঁর এক চাচাতো বোনের বিয়ে। বিয়ে সেরে ফিরতে ফিরতে আরো দুই-এক দিন লাগবে।
মীরু ঠিক করল সে যখন জেগেই আছে তখন আর বাবার রুটিনের ব্যতিক্রম করাবে না। এক কাপ চা নিজেই বানিয়ে দেবে। বাবা নিশ্চয়ই অবাক হবেন। খানিকটা খুশিও হয়তো হবেন। তবে তিনি তা প্রকাশ করবেন না। এমন একটা ভাব ধরবেন যেন এরকমই হবার কথা। মেয়ে তাকে চা বানিয়ে দিচ্ছে এতে খুশি হবার কিছু নেই। এটা মেয়ের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ছে।
তিনি একবার জিজ্ঞেসও করবেন না এত ভোরে তার মেয়ে জেগে আছে কেন? তার কি কোনো সমস্যা?
মীরু চায়ের পানি গরম করেছে। একটা জিনিস সে বুঝতে পারছে না। তার বাবা চা-টা কখন খান, সূরা আর রাহমান পাঠ করার আগে না পড়ে?
রান্না ঘরে শব্দ করে কে?
বাবার গলা। গলাটা যেন কেমন অন্যরকম। অসুস্থ মানুষের চিকন গলা। দীর্ঘ বাক্য শেষ করার মতো দমও যেন নেই।
মীরু বলল, বাবা আমি। চা খাবে? চা বানিয়ে আনি?
আজফল সাহেব হাঁপানি রোগীর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, মা। একটু এদিকে আয়।
মীরু বাবার শোবার ঘরে ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেল। বাবা জায়নামাজে আড়াআড়িভাবে শুয়ে আছেন। তাঁর মুখ দিয়ে ফেনার মতো কি যেন বের হচ্ছে। ডান হাত একটু পরে পরে কেঁপে কেঁপে উঠছে। মীরু হতভম্ব হয়ে। বলল, কী হয়েছে বাবা?
আফজল সাহেব থেমে থেমে বললেন, মারা যাচ্ছিগো মা। মারা যাচ্ছি। বুকে ব্যথা। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা। তিনি কথা শেষ করতে পারলেন না। গোঙাতে লাগলেন।
মীরু এখন কী করবে? জিতু মিয়া ছাড়া বাসায় পুরুষ মানুষ কেউ নেই। একতলায় বাড়িওয়ালা থাকেন। তারা দলবেঁধে আজমির শরিফ গিয়েছেন। বাড়িওয়ালার এক ভাগ্নেকে রেখে গেছেন বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে। সেই ভাগ্নে আধপাগল। সারাদিন বারান্দায় মাথা নিচু করে বসে থাকে। মেঝের দিকে তাকিয়ে ফিক ফিক করে হাসে। মীরু দৌড়ে টেলিফোন রিসিভার কানে নিল। ডায়াল টোন নেই। একটু আগেই সে কথা বলেছে আর এখন ডায়াল টোন নেই— এর মানে কি?
মীরু টেলিফোন রেখে বাবার কাছে গেল। আফজাল সাহেব বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মীরু বলল, বাবা খুব খারাপ লাগছে?
তিনি জবাব দিলেন না। মীরু বাবাকে ফেলে রেখে আবার টেলিফোনের কাছে গেল।
এমন তো হতে পারে হঠাৎ টেলিফোন ঠিক হয়ে গেছে। যে টেলিফোন কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ নষ্ট হয় সেই টেলিফোন কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ কি ঠিকও হতে পারে না? মীরু ছুটে গিয়ে টেলিফোন রিসিভার কানে দিল। পোঁ পোঁ শব্দ হবার বদলে কেমন যেন ঝড়-তুফানের শব্দ হচ্ছে। শোঁ শো আওয়াজ। বৃষ্টির শব্দ। মীরু অনেকক্ষণ বুঝতেই পারল না যে বৃষ্টি-বাদলার শব্দ টেলিফোন রিসিভার থেকে আসছে না। বাইরে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। সেই শব্দ। শ্রাবণ মাস বৃষ্টি-বাদলারই সময়।
বারসাত আনন্দমাখা গলায় বলল
বারসাত আনন্দমাখা গলায় বলল, বৃষ্টি দেখেছেন? কেমন ঝুম ঝুমান্তি নেমেছে। শ্রাবণ মাসে টিপটিপ বৃষ্টি হয়। ঝুম বৃষ্টি হয় না। আবহাওয়া আসলেই বদলে যাচ্ছে। ওজোন স্কেয়ার ফুটো হয়ে গেছে। বারসাত জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। ফুটো হওয়া ওজোন ফেয়ার দেখার জন্যে কি না কে জানে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সে ফুটো দেখতে পাচ্ছে।
নীলুফার কৌতূহলী হয়ে বারসাতকে দেখছে। মানুষটার আনন্দ আনন্দ ভাব তার কাছে অদ্ভুত লাগছে। আজ বারসাতের বিয়ের দিন। আনন্দ ভাব থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু বিয়ের কনের দেখা নেই। এগারোটার মধ্যে মেয়ের আসার কথা। এখন বাজছে একটা। নীলুফারের মনে হচ্ছে কনের দেখা শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে না। অথচ বারসাতের মধ্যে এ নিয়ে কোনোরকম টেনশান দেখা যাচ্ছে না। বরং তাকে আনন্দিত মনে হচ্ছে। এই আনন্দ নিশ্চিয়ই লোক দেখানো আনন্দ—Fake happyness.
বারসাত বলল, বৃষ্টির ফোঁটার সাইজ ম্যাক্সিমাম কত বড় হতে পারে জানেন ভাবি?
নীলুফার না-সূচক মাথা নাড়ল।
বারসাত বলল, বৃষ্টির ফোঁটার রেকর্ডেড বড় সাইজ হল— পিং পং বলের সাইজ। ভেনিজুয়েলায় ১৮৭০ সনে এই সাইজের বৃষ্টি হয়েছিল। সেখানকার চার্চের রেকর্ড বইয়ে রেকর্ড করা আছে।
নীলুফার কিছু বলল না। সে এসেছে বারসাতের বিয়েতে একজন সাক্ষী হিসেবে। সে ভেবেছিল দুপুর বারোটার মধ্যে সব শেষ হয়ে যাবে। সে চলে যেতে পারবে। তার ছেলে টুকটুকির স্কুল ছুটি হয় দুপুর দুটায়। তার আগেই তাকে যেতে হবে। ছেলেকে স্কুল থেকে আনার আর কেউ নেই। বারসাতকে চলে যাবার কথা বলতে মায়া লাগছে। নীলুফারের ধারণা বারসাত এখনো আশা করে আছে মীরু নামের মেয়েটা চলে আসবে।
বারসাতের চেহারায় আনন্দ এখনো ঝলমল করছে। তাকে দেখতে সুন্দর লাগছে। হালকা হলুদ রঙের হাফ শার্ট পরেছে। শার্ট থেকে হলুদের আভা চলে গেছে মুখে।