নিঃশ্বাসের কষ্টটা দূর করার জন্যে টেনশান কমানো দরকার। আনন্দময় কিছু চিন্তা করলে টেনশান কমবে। সে রকম কোনো চিন্তাই মাথায় আসছে না। নিজের বিয়ে নিয়ে কি সে ভাববে? বিয়ে কোনো আনন্দময় ব্যাপার না। মোটামুটিভাবে ভয়ংকর একটা ব্যাপার। নিজের চেনা বিছানা ফেলে একজন পুরুষ মানুষের গায়ের ঘামের গন্ধের মাঝখানে শুয়ে থাকা-– ভাবতেই গা গুলায়।
বিয়ের খবরটা বাসায় কীভাবে দেবে মীরু এখনো তা নিয়ে ভাবেনি। বারসাত বলেছে–প্রথমে একজনকে দিয়ে বাসায় টেলিফোন করাও। সে টেলিফোনে বলবে— এইমাত্র খবর এসেছে মীরু রোড একসিডেন্টে মারা গেছে। তার গায়ের উপর দিয়ে সাতটনি একটা ট্রাক চলে গেছে। তার ডেডবডি কোথায় আছে এক্ষুণি আপনাকে জানাচ্ছি–টেলিফোন লাইনটা দয়া করে খোলা রাখবেন। এই বলেই খট করে টেলিফোন রেখে দিতে হবে। বাসায় শুরু হবে কান্নাকাটি। আধঘণ্টা পর টেলিফোন করে জানাতে হবে সংবাদটা ভুল। আসলে মীরু মারা যায়নি। সে কাজীর অফিসে গিয়ে থার্ড ক্লাস টাইপ এক ছেলেকে বিয়ে করেছে। মৃত্যু সংবাদের পরে এই ধরনের সংবাদে সবাই আনন্দে অভিভূত হবে। বাবা-মা দুজনই গদগদ গলায় বলবেন–যাকে বিয়ে করেছিস তাকে নিয়ে এক্ষুণি বাসায় আয়। তুই যে বেঁচে আছিস এতেই আমরা খুশি।
বারসাত বলছে, আমার প্রেসক্রিপশান মত যদি কাজ করতে পারতাহলে তুমি কিন্তু তোমার বাবা মার কাছে আমাকে হজম করিয়ে ফেলতে পারবে। হজমি বড়ি লাগবে না।
মীরুর ধারণা তা না। সে খুব ভাল করেই জানে বারসাতের তাদের বাড়িতে এন্ট্রি হবে না। কোনো ভাবেই না।
মীরুদের পরিবারে প্রেম নোংরা ব্যাপার। টেলিভিশনে এইসব নোংরা ব্যাপার দেখানো হয় বলে আফজল সাহেব টেলিভিশন দেখেন না। মাঝেমধ্যে টিভির খবর দেখেন এবং কিছুক্ষণ পর পর ভুরু কুঁচকে বলেন— সব মিথ্যা কথা।
মীরুর মা জাহেদা আদর্শ মধ্যবিত্ত মা। স্বামী যা করে তাকেও তাই করতে হবে। তিনিও শুধু খবর দেখেন এবং স্বামীর মতো ভুরু কুঁচকে বলেন—এত মিথ্যা কথা কীভাবে বলে? মুখে আটকায় না। আশ্চর্য!
মীরুর বড় বোন রুনি পছন্দ করে একটি ছেলেকে বিয়ে করেছিল বলে তার এই বাড়িতে ঢোকার অনুমতি নেই। তার বিয়েটা ভাল হয়নি। ছ মাসের মধ্যে ঝামেলা লেগে গেল। নয় মাসের মধ্যে ডিভোর্স। রুনি। কাঁদতে কাঁদতে স্যুটকেস হাতে বাড়িতে উঠে এসেছিল। আফজল সাহেব স্যুটকেস হাতেই তাকে বিয়ে করে দেন। সে এখন আছে তার বড় খালার সঙ্গে।
মীরুর দুই ফুপু হজ করে এসেছেন। তাঁরা বোরকা পরেন। সেই বোরকাও কঠিন বোরকা। দুই ফুপুর একজন (ছোট ফুপু সুলতানা বেগম) তাবিজ বিশেষজ্ঞ। তিনি মাঝে মধ্যে তাবিজ নিয়ে আসেন। সুতা পড়া আনেন। তাঁর কাছ থেকে তাবিজ পড়া সুতা পড়া অত্যন্ত ভক্তিসহকারে গ্রহণ করতে হয়। ফুপুর দেয়া একটা তাবিজ এখনো মীরুর গলায় ঝুলছে। এই তাবিজের বিশেষত্ব হচ্ছে, এই তাবিজ পরা থাকলে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে না।
মীরুর দুঃস্বপ্ন দেখার রোগ আছে। এর মধ্যে একটা দুঃস্বপ্ন ভয়াবহ। এই দুঃস্বপ্নে মীরু ইউনিভার্সিটির ক্লাসে বসে থাকে। হঠাৎ সে লক্ষ্য করে তার গায়ে কোনো কাপড় নেই। সে সম্পূর্ণ নগ্ন। তখন টিচার তার দিকে তাকিয়ে বলেন, ঐন্দ্রিলা এসো বোর্ডে এসো। জিনিসটা বুঝিয়ে দাও। মীরু বোর্ডে যায়। ছাত্রছাত্রীরা সবাই তার দিকে তাকিয়ে ফিকফিক করে হাসতে থাকে। স্যারও হাসতে থাকেন।
ছোট ফুপুর তাবিজ গলায় পরার পর এই ভয়ংকর স্বপ্নটা মীরু দেখছে। এটা তাবিজের গুণ, না কি দুঃস্বপ্ন দেখা রোগ মীরুর সেরে গেছে কে জানে। মীরু ঠিক করে রেখেছে বিয়ের পর যেদিন থেকে সে বারসাতের সঙ্গে ঘুমুতে যাবে সেদিনই সে তাবিজ ছিঁড়ে কুয়ায় ফেলে দেবে। (তাবিজ যেখানে-সেখানে ফেলা যায় না। স্রোতহীন পানিতে ফেলতে হয়)
মীরু খুব ভালো করে জানে তাদের কঠিন পরিবারের কাছে বারাসাতকে হজম করানো কোনোক্রমেই সম্ভব না। কাজীর অফিসে গিয়ে বিয়ের কারণ এই একটাই। বাংলাদেশের কোনো মেয়ে কাজীর অফিসে বিয়ে করতে চায় না। সব মেয়ে বিয়ের দিনে বউ সাজতে চায়। বিয়ের আগের দিন গায়ে হলুদ মাখতে চায়। কাজী সাহেবের সামনে বউ সেজে কে উপস্থিত হবে? তবে আগামীকাল মীরু সুন্দর করেই সাজবে। একটা জর্জেট শাড়ি ঠিক করা আছে। সাদা জমিনে হালকা সবুজ কাজ। সবুজের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ লাল ছোপ। লাল হল সবুজের কনটেম্পরারি কালার। একটা রঙ আরেকটাকে উজ্জ্বল করবে। মীরুর ধারণা শাড়িটাতে তাকে খুব মানাবে।
সাজগোছ নিয়ে বারসাতের অবশ্যি কোনো মাথাব্যথা নেই। আজ পর্যন্ত সে মীরুকে বলেনি— বাহ্ এই শাড়িটাতে তো তোমাকে সুন্দর মানিয়েছে! কিংবা বাহ্ আজ তো তোমাকে অদ্ভুত লাগছে! কপালের টিপটা নিজে হাতে একে দিয়েছ? সুন্দর তো! মাঝে মাঝে মীরুর মনে হয়। সুন্দর-অসুন্দরের কোনো বোধই বারাসাতের নেই। অথচ বারসাত নিজে সুন্দর সুন্দর শার্ট-প্যান্ট পরে। সব সময় তার চুল আঁচড়ানো থাকে। পকেটে চিরুনি থাকে। মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি— এরকম তাকে মীরু কখনো দেখেনি। সব সময় ক্লিন শেভ।
বারাসাতের সঙ্গে বাবা-মা এবং ফুপুদের একটা ইন্টারভুর ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? চাকরির ইন্টারভুর মতো ইন্টারভু। বাবা ইন্টারভ্যু বোর্ডের চেয়ারম্যান। দুই ফুপু মেম্বার। মা সেক্রেটারি। মার হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। তিনি শুধু কথাবার্তা নোট করবেন। প্রশ্ন করবেন বাবা এবং ফুপুরা। মার কাজ হবে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকা। বাবা হাসলে তিনি হাসবেন। বাবার মুখ গম্ভীর হলে তিনি মুখ গম্ভীর করবেন। বাবা রাগ করলে তিনি রাগ করবেন। হিজ মাস্টারস ভয়েস।