বারসাত বলল, কোন মানে নেই। এই লাইনটা ফুর্তির। বারসাত হাত পা নেড়ে খুবই মজা করে কবিতা আবৃত্তি করছে। মীরু হাসছে। হাসির বেগ ক্রমেই বাড়ছে। সে কিছুক্ষণ হাসি আটকানোর চেষ্টা করল। শেষে চেষ্টা বাদ দিল।
মেসের দুএকজন বোর্ডার উঁকি দিয়ে দেখছে। দেখুক। মীরু যদি এখন হাসতে হাসতে বারসাতের গায়ের ওপর পড়ে যায় তাহলেও কিছু যায়। আসে না। কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা বিয়ে করবে। একজন স্ত্রী স্বামীর কথা শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে (স্বামীর ওপরই পড়বে। এতে লজ্জার কিছু নেই।)
মীরু বলল, দেরি করছ কেন। চল যাই।
বারসাত বলল, দুদিন পরে যাওয়া যাক। আজ বাদ থাক।
মীরু বলল, আজ বাদ থাকবে কেন?
বারসাত বলল, তুমি যেমন আগে ঠিক করে রাখা বিয়ের শাড়ি পরে বিয়ে করবে আমিও তাই করব। আমার ঠিক করে রাখা পাঞ্জাবিটা পরব।
মীরু বলল, পাঞ্জাবিটাই কি একমাত্র কারণ? আমার ধারণা পাঞ্জাবি ছাড়াও অন্য কারণ আছে।
বারসাত বলল, তোমার ধারণা ঠিক পাঞ্জাবি ছাড়াও আরেকটা কারণ আছে। সেই কারণটা তোমাকে বলব না।
বলবে না কেন?
যদি বলি তাহলে দেখা যাবে তুমি মত পাল্টে ফেলেছ। আমাকে বিয়ে করার ব্যাপারে তোমার আগ্রহ কমে গেছে।
কারণটা বল আমি শুনব।
বলব না।
মীরু কঠিন গলায় বলল, অবশ্যই বলবে। তুমি প্রতিজ্ঞা করেছিলে আমার কাছে কিছু গোপন করব না।
বারসাত বলল, আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বিয়ের পর কেউ কারোর কাছে কিছু গোপন করব না। আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি। আচ্ছা আচ্ছা। এত মন খারাপ করতে হবে না বলছি–বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের টাকাটা আমার সঙ্গে নেই। টাকাটা খরচ করে ফেলেছি। ডাক্তার-ফাক্তার ওষুধপত্র। এই টেস্ট, সেই টেস্ট।
এই সামান্য কথাটা বলতে অস্বস্তি বোধ করছিলে কেন?
বারসাত বলল, একটা ছেলে বিয়ে করতে যাচ্ছে তার হাতে কোন টাকা-পয়সা নেই এটা কোন সামান্য ব্যাপার না। যাই হোক পরশু আঠারো তারিখ সকাল এগারোটায় কাজি অফিসে চলে আসবে।
পরশু?
হ্যাঁ পরশু। সকাল এগারোটায়। বিয়ের পর পর তবারুক হিসেবে মিনি সিঙাড়া খাওয়ানো হবে। তারপর আমরা চলে যাব বাগানবাড়ি পদ্মতে। আগে থেকে বেহালাবাদক ঠিক করা থাকবে। আমরা হাত ধরাধরি করে বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তারা বাজাবে—
লীলাবালি লীলাবালি
বড় যুবতী কন্যা কি দিয়া সাজাইবাম তোরে।
মীরু তাকিয়ে আছে। উৎসাহ এবং আনন্দে বারসাত ঝলমল করছে। তার চেহারায় যে অসুস্থ ভাব ছিল সেটা এখন আর নেই। বারসাতের ঝলমলে মুখ দেখতে ভাল লাগছে।
বারসাত বলল, পদ্ম নামের ঐ বাড়িতে যে ছবির একটা এক্সিবিশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এটা কি তুমি জানো?
আমার কি জানার কথা?
তোমার জানার কথা না। কারণ এটা রাখা হয়েছিল তোমাকে চমকে দেবার জন্যে। সারপ্রাইজ আইটেম। আমি বিভিন্ন সময়ে তোমার যে কয়টা স্কেচ করেছি সবগুলির একটা প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর নাম এ এবং ঐ। দর্শক মাত্র দুজন। তুমি আর আমি। আমি এ তুমি ঐ। ছবির সংখ্যা কত শুনলে তুমি আঁৎকে উঠবে। ছবির সংখ্যা একশ সাত। ওয়ান জিরো সেভেন।
মীরু বিস্মত হয়ে বলল, বল কি? এত ছবি কখন এঁকেছ?
যখনই তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে— মেসে ফিরে সঙ্গে সঙ্গে একটা ছবি এঁকে ফেলেছি।
সত্যি?
তোমার কি মনে হয় মিথ্যা?
না মিথ্যা মনে হয় না।
মীরু আবারও বারসাতের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখে তাকিয়ে থাকার পুরানো খেলা। এই খেলায় সে আজ হেরে যাবে কারণ তার চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা যায় না।
বারসাত বিস্মিত হয়ে বলল, কাঁদছ কেন ঐ?
মীরু বলল, তোমার সঙ্গে আমার আরো একটা চুক্তি হয়েছিল, সেই চুক্তির শর্ত ছিল আমি যদি কখনো কাঁদি তুমি জিজ্ঞেস করতে পারবে না কেন কাদছি। কান্নাটাই একটা লজ্জার ব্যাপার। কেন কাঁদছি তা ব্যাখ্যা করা আরো লজ্জার। এ রকম হা করে তাকিয়ে আছ কেন?
বারসাত বলল, আমি তোমার অনেক ছবি এঁকেছি, এখন লক্ষ্য করলাম সবচে সুন্দর ছবিই আঁকিনি। চোখে চকচক করছে অশ্রু এই ছবি। তুমি চুপ করে পাঁচটা মিনিট বস তো। জানালার দিকে তাকিয়ে বস। টেবিলের ড্রয়ারে দেখ কাগজ আছে পেনসিল আছে। দাও আমাকে। অবতীর ছবি একে দিচ্ছি।
মীরু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। বারসাতের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি পরশু এগারোটায় উপস্থিত থাকব। সঙ্গে করে একজন সাক্ষী নিয়ে আসব। একজনের খুব শখ আমার বিয়েতে সাক্ষী হিসেবে থাকা।
বারসাত বলল, মীরু তুমি চাইলেও এখন যেতে পারবে না। কারণ বৃষ্টি নেমেছে। ঝুমঝুমান্তি বৃষ্টি।
কি বৃষ্টি।
ঝুমঝুমান্তি বৃষ্টি। যে বৃষ্টিতে ঝুমঝুম করে নুপূরের শব্দ হয় সেই বৃষ্টির নাম ঝুমঝুমান্তি বৃষ্টি।
তুমি যে খুব সুন্দর করে কথা বল এটা কি তুমি জানো?
জানি।
বিয়ের পরেও কি তুমি এত সুন্দর করে কথা বলবে?
বুঝতে পারছি না।
মীরু বলল, তোমার শরীর যদি খুব বেশি খারাপ না লাগে তাহলে উঠ!
কোথায় যাব?
আমার ক্ষিধে লেগেছে। মিনি সিঙাড়া খাব।
এই বৃষ্টিতে?
গরম গরম সিঙাড়া তো বৃষ্টিতেই খেতে ভাল লাগবে।
সত্যি সত্যি ঝুমঝুমান্তি বৃষ্টি। আজ মনে হচ্ছে ঢাকা শহর বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাবে। বারসাত ফুর্তিমাখা গলায় বলল, সিঙাড়া খাবার পর আমরা ঢাকা শহরে রিকশায় করে ঘুরে বেড়াব। বর্ষা যাপন করব।
মীরু বলল, আমার সঙ্গে টাকা আছে। সিঙাড়া খেয়ে আমরা কাজি অফিসে যাব। তুমি কি দুজন সাক্ষী জোগাড় করতে পারবে না? সিঙাড়ার কারিগরকে যদি বলি সে কি আমাদের বিয়েতে সাক্ষী হবে?