বারসাত হাসল।
মীরু বলল, তোমার হাসিও বদলে গেছে। হাসির মধ্যেও অসুস্থ ভাৰ চলে এসেছে। হাসিতে কোন প্রাণ নেই।
বারসাত বলল, চা খাবে?
মীরু বলল, হ্যাঁ খাব।
বারসাত বলল, আমার চৌকির নিচে কেরোসিনের চুলা আছে। চিনি, চা পাতা সবই আছে। শুধু দুধ নেই। দুকাপ লিকার চা বানাও। লিকার চায়ে না কি এন্টি-অক্সিডেন্ট থাকে। শরীরে এন্টি-অক্সিডেন্ট ঢুকিয়ে দেখি কিছু করা যায় কি-না।
মীরু চা বানাতে বসল। বারসাত দেয়ালে হেলান দিয়ে চৌকিতে পা ছড়িয়ে বসেছে। সে কৌতূহলী চোখে মীরুর চা বানানো দেখছে।
মীরু বলল, ঐ দিন আমি কেন যথাসময়ে উপস্থিত হইনি তা কি তুমি জানতে চাও না?
না।
জানতে চাও না কেন?
বারসাত শান্ত গলায় বলল, জানতে ইচ্ছা করছে না।
ইচ্ছা করছে না কেন?
ইচ্ছা করছে না কারণ আমি জানি তুমি কেন আসনি এটা শোনার পর। আমার মন খারাপ হয়ে যাবে। এম্নিতেই শরীর খারাপ তার সঙ্গে মন খারাপ যুক্ত হলে আর দেখতে হবে না।
মীরু বলল, তোমার ধারণা আমি কি জন্যে আসিনি?
তুমি আসনি কারণ শেষ মুহূর্তে তোমার মনে হয়েছে কাজটা ঠিক হচ্ছে। বিয়ে কোন ছেলেখেলা ব্যাপার না। হুট করে বারসাত আলিকে বিয়ে করা যায় না। বিয়ের পর স্ত্রীকে কোথায় নিয়ে তুলবে যে লোক এটা জানে। না তাকে বিয়ে করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মীরুর চা বানানো হয়ে গেছে। সে এক কাপ চা বারসাতকে দিয়ে। নিজে এক কাপ নিয়ে খাটের উপর আরাম করে বসতে বসতে বলল, এ রকম কিছু যদি আমার মনে আসত তাহলে তোমাকে জানাতাম। না। জানিয়ে ডুব দিতাম না। আমার স্বভাবের মধ্যে ডুব দেয়া ব্যাপারটা নেই।
বারসাত চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, এটা ঠিক। তুমি ডুবুরি কন্যা না। তুমি ভাসন্ত কন্যা।
মীরু বলল, আমি ঐ দিন সময় মত আসিনি কারণ বাবা অসুস্থ ছিলেন। তাঁর হার্ট এটাক হয়েছিল। তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলাম। তবে আমি বিকেল সাড়ে পাঁচটায় কাজি অফিসে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে। তোমার মেসে গিয়েছিলাম।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। তুমি খুব ভাল করেই জানো এটা সত্যি। আমি তোমার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কখনো তোমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলব না।
সব সময় সত্যি কথা বললে জীবন হয়ে যাবে ডিসটিলড ওয়াটারের মত। সিদ্ধ করা পানি টেস্টলেস।
হোক টেস্টলেস। প্রতিজ্ঞা যখন করেছি প্রতিজ্ঞা রাখব।
বারসাত গম্ভীর গলায় বলল, প্রতিজ্ঞাবতী নাম আজ আমি তোমাকে দিলাম।
মীরু উঠে দাঁড়াল। বারসাত বলল, তুমি চলে যাচ্ছ না কি?
মীরু বলল, হ্যাঁ যাচ্ছি। বিশেষ কিছু বলতে চাইলে পাঁচ মিনিটের জন্যে বসতে পারি। বিশেষ কিছু বলার আছে?
আছে।
বল। আমি বসলাম।
বারসাত বলল, আগামীকাল তোমার সময় হবে? বেশিক্ষণ লাগবে না। এই ধর আধঘণ্টা। বেশি হলে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
না আগামীকাল সময় হবে না। সারাদিন আমি গাজীপুরে থাকব। শালবনে ইউনিভার্সিটি পিকনিক।
আমার ধারণা ছিল তুমি ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে বের হয়ে গেছ।
ধারণা ঠিকই আছে। পাস করে বের হবার পরেও ল্যাজ আটকে আছে। পিকনিক যাবার দাওয়াত পেয়েছি। তিনশ টাকা চাঁদা দিয়েছি। চাঁদার টাকা তোলার জন্যে হলেও পিকনিকে যেতে হবে। পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় তোমার কি জন্যে দরকার?
কাজি অফিসের ঝামেলাটা সেরে ফেলার জন্যে দরকার।
মীরু বলল, পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় এখন দিতে পারি।
এখন?
হ্যাঁ এখন। আমি যতদূর জানি কাজি অফিসে নটা-পাঁচটা অফিস টাইম বলে কিছু নেই। রাতেও সেখানে বিয়ে হয়।
বারসাত বিস্ময়মাখা গলায় বলল, এখন যাবে?
মীরু বলল, হ্যাঁ যাব। বিয়ে রেজিষ্ট্রেশনের জন্যে ফী লাগে। সেই টাকা। কি আছে?
বারসাত কিছু বলল না। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইল। যেন তার মধ্যে ঘোর লেগে গেছে। মাথায় কিছু ঢুকছে না।
মীরু বলল, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি হঠাৎ গভীর সমুদ্রে পড়েছ। কোন সমস্যা?
বারসাত বিড়বিড় করে বলল, বিয়ের দিন পরব বলে যে পাঞ্জাবি ঠিক করে রেখেছিলাম সেই পাঞ্জাবি কালিয়াকৈরে ফেলে এসেছি। এটাই হল সমস্যা। গভীর সমুদ্রে পড়ার মতই সমস্যা।
নতুন পাঞ্জাবি পরাটা কি খুব ইম্পর্টেন্ট?
হ্যাঁ ইম্পর্টেন্ট। আমি গরিব মানুষ তারপরেও আঠারশ টাকা খরচ করে পাঞ্জাবিটা কিনেছিলাম। বিয়েতে পরব বলে কিনেছিলাম। বিয়ে তো আমি তিন-চারবার করব না। একবারই করব। তুমি হাসছ কেন?
তুমি সত্যি সত্যি পাঞ্জাবির শোকে কাতর হয়ে পড়েছ এটা দেখে হাসছি। আচ্ছা দেখ তো আমার শাড়িটা কেমন? সুন্দর না? সাদার ওপর লাল সবুজের খেলা। শাড়িটা কি চিনতে পারছ?
পারছি। এটাই তো তোমার বিয়ের শাড়ি।
হ্যাঁ।
তার মানে কি দাঁড়ায়? তুমি কি ইচ্ছা করে আজ এই শাড়ি পরে এসেছ?
হুঁ। তুমি জানতে আজই কাজি অফিসে যাওয়া হবে?
হুঁ।
দুজন আবারো দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। শুরু হয়েছে তাকিয়ে থাকার খেলা। কেউ আগে চোখ নামাবে না। যে নামাবে সে হেরে যাবে। তাকিয়ে থাকা খেলায় কথাও বলা যায় না। যে আগে কথা বলবে সে হেরে যাবে।
প্রথম হার মানল বারসাত। সে চোখ নামিয়ে নিল এবং কথাও বলল, প্রায় ফিসফিস করে বলল, মীরু তোমাকে নিয়ে আমার মাথার মধ্যে একটা। কবিতা তৈরি হয়েছে।
কি কবিতা?
কবিতাও ঠিক না। ছড়া। হালকা টাইপ বিষয়। শুনলে তুমি হয়তোবা রাগ করবে।
রাগ করব না। শুনি।
ঐ
ও আমার সই
তুমি গেলা কই
ঐ ঐ ঐ
চিকা চিকা ভুম ভুম ভুম।
মীরু গম্ভীর গলায় বলল, চিকা চিকা ভুম ভুম মানে কি?