এম্নি জানতে যাচ্ছি।
তুমি এম্নি জানতে চাচ্ছ না। তুমি সন্দেহ করছ বলে জানতে চাচ্ছ।
আমি শুধু শুধু সন্দেহ করব কেন?
তুমি সন্দেহ করবে কারণ সন্দেহ করা হল তোমার অভ্যাস। আমি যে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ফেলি তুমি সেই নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসকেও সন্দেহ কর। মা এক কাজ কর তো, চট করে শাড়িটা বদলে একটা ভালো শাড়ি পর।
কেন?
মীরু শান্ত গলায় বলল, তুমিও যাবে আমার সঙ্গে। নিজের চোখে জন্মদিনের উৎসব দেখবে। এক পিস কেক খাবে। বারান্দায় গিয়ে এক বোতল কোক খাবে।
জাহেদা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তুই আমার সঙ্গে এরকম করছিস কেন?
কথা বাড়িও না তো মা। চট করে শাড়িটা বদলাও। গত ঈদে হালকা সবুজ রঙের যে শাড়িটা কিনেছিলে সেটা পর। ঐ শাড়িটাতে তোমাকে। মানায়। আমি তোমাকে না নিয়ে জন্মদিনের পার্টিতে যাব না। সত্যি যাব না।
জাহেদা কাঁদতে বসলেন। মীরু চলে গেল ইউনিভার্সিটিতে। এই কাজগুলি সে কেন করে নিজেও জানে না। তারচেয়ে বড় কথা তার একটুও খারাপ লাগে না। গত একবছর ধরে বাসার প্রতিটি মানুষকে তার অসহ্য লাগছে। বাজারে ডিনামাইট কিনতে পাওয়া গেলে ডিনামাইট দিয়ে সে তাদের কলাবাগানের এই বাড়ি উড়িয়ে দিত। ডিনামাইট কোথায় পাওয়া। যায় মীরু জানে না। আলফ্রেড নোবেল সাহেব বেঁচে থাকলে সে তাকে একটা চিঠি লিখত, স্যার আমাকে কিছু ডিনামাইট পাঠাবেন? আমি খুব কষ্টে আছি। ইতি আপনার বাধ্যগত ঐন্দ্রিলা।
আবার বিছানায় ওঠার আগে মীরু বাথরুমে ঢুকে মাথায় পানি ঢালল। মাথার দুপাশের শিরা দপদপ করছে। পানি ঢালার কারণে মাথার দপদপানি না কমে আরো যেন বেড়ে গেল। দেয়াল ঘড়িতে এখন মনে হয় মাইক ফিট করা হয়েছে। হাতুড়ি পেটার মত শব্দ আসছে। টক টক। টক টক।
বিয়ের আগের রাতে সব মেয়েরই কি এরকম হয়? আচ্ছা বাংলাদেশে এমন মেয়ে কি আছে যে বিয়ের আগের রাতে ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুমুতে পেরেছে? কেউ না পারলেও তার পারা উচিত ছিল। সব মেয়ে আর সে এক না। সব মেয়ের যা হবে তার তা হবে না। তাছাড়া যাকে সে বিয়ে করছে। তার সঙ্গে সে তিন বছর ধরে ঘটর ঘটর করেছে। সে অপরিচিত কেউ না। তার প্রতিটি খারাপ অভ্যাস মীরু জানে। তার সবচেয়ে খারাপ অভ্যাস হল নাক ঝেড়ে সেই হাত শার্টের কোণায় মুছে ফেলা। প্রথম বার দেখে মীরু হতভম্ব। সে চোখ কপালে তুলে বলল, এটা তুমি কী করলে?
বারসাত তার মতোই অবাক হয়ে বলল, কী করলাম?
নাক ঝেড়ে হাত শার্টে মুছে ফেললে। কী কুৎসিত!
কুৎসিতের কী আছে। সঙ্গে রুমাল নেই।
রুমাল নেই কেন?
এখন কেউ রুমাল নিয়ে ঘোরে না। তুমি পাঁচশ মানুষকে জিজ্ঞেস করে। দেখ তাদের কাছে রুমাল আছে কি না। সবাই বলবে নেই। পকেটে রুমাল রাখার ফ্যাশন চলে গেছে।
তুমি বলতে চাচ্ছ এখন সবাই নাক ঝেড়ে শার্টে হাত মোছে?
আমি বলতে চাচ্ছি যে আমার সঙ্গে রুমাল নেই।
মীরু বলল, তুমি কি জানো তোমার দিকে তাকাতেও আমার ঘেন্না লাগছে?
বারসাত হতাশ গলায় বলল, না জানি না। তোমার দৃষ্টি এত পবিত্র ধারণা ছিল না। এখন আমাকে কি করতে হবে সেটা বল। আমি কি লাইফবয় সাবান দিয়ে গোসল করে আসব? না কি তারকাদের সৌন্দর্য। সাবান লাক্স দিয়ে গোসল করব?
তোমার সঙ্গে এখানেই আমার সম্পর্ক শেষ। তুমি তোমার বাড়ি যাও। আমি আমার বাড়ি যাচ্ছি।
ভেরি গুড।
ভুলেও টেলিফোন করবে না।
- K. পবিত্র মহিলা টেলিফোন করব না। নাকের সর্দি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি আর টেলিফোন না।
বারসাত প্রতিজ্ঞা রাখতে পারল না। রাখতে পারবে না মীরু জানে। বারসাত হচ্ছে এমন একজন যুবক যে কোনো প্রতিজ্ঞা রাখতে পারে না। চব্বিশ ঘণ্টা পার হবার আগেই টেলিফোন।
হ্যালো, ঐন্দ্রিলা একটা বিশেষ খবর দেবার জন্য টেলিফোন করেছি।
মীরু গম্ভীর গলায় বলল, বিশেষ খবরটা কী?
বারসাত মীরুর চেয়েও গম্ভীর গলায় বলল, যে হাত দিয়ে আমি নাক ঝেড়েছি ঐ হাত কজি পর্যন্ত কেটে বাদ দিয়েছি। হাত তার শাস্তি পেয়েছে। আশা করি এখন তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে।
হাত কজি পর্যন্ত কেটে বাদ দিয়েছ?
হুঁ, ভ্যানগগ টাইপ। উনি কেটেছিলেন কান আমি কেটেছি হাত। এখন কি আমার সঙ্গে কথা বলা যায়?
হ্যাঁ যায়।
তাহলে চলে এসো–তোমাকে এই সৌরলোকের শ্রেষ্ঠতম ফুচকার দোকানে নিয়ে যাব। রিকশা নিয়ে আমার মেসে চলে এসো। আজ আমাদের ফুচকা ডে। আধা কেজি করে ফুচকা খেয়ে আজ পেটে অসুখ বাধাবই।
তোমার কাটা হাতটা কোথায়?
কাটা হাত এখনো হাতের সঙ্গে লাগানো আছে। তুমি যেদিন বলবে সেদিন কেটে তোমাকে দিয়ে দেব। জার ভর্তি ফরমালিনে কাটা হাতটা প্রিজার্ভ করতে পারবে। তোমার ছেলেমেয়েদের দেখাবে, তারা খুব মজা পাবে।
এরকম মানুষের সঙ্গে রাগ করে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। বিয়ের পরেও মানুষটার স্বভাব-চরিত্র এরকম থাকবে কি না কে জানে। মনে হয় থাকবে না। থাকার কথা না। পুরুষ বদলে যায় স্ত্রীর গায়ের গন্ধে।
মীরু চেয়ারে উঠে দাঁড়াল। দেয়াল ঘড়িটা নামিয়ে পেনসিল ব্যাটারি খুলে ফেলল। সেকেন্ডের কাটার কট কট শব্দের হাত থেকে মুক্তি। মাথার দপদপানি সামান্য কমেছে। এখন অন্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে। টেনশান বেশি হলে মীরুর শ্বাসকষ্ট হয় তখন ইনহেলার নিতে হয়। ভেন্টোলিন ইনহেলার। ডাক্তার বলে দিয়েছেন চেষ্টা করতে হবে ইনহেলার ব্যবহার না করার। একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে মিনিটে মিনিটে ইনহেলার নিতে হবে। মীরু অভ্যস্ত হতে চায় না। অভ্যস্ত হওয়া খুব খারাপ ব্যাপার। কোনো কিছুতেই অভ্যস্ত হওয়া ঠিক না। সে বারসাতের অদ্ভুত ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বিয়ের পর বারসাত যখন স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ করবে তখন নিশ্চয়ই তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে।