মীরু ঘুমোচ্ছিস?
না।
বিরাট একটা ঘটনা ঘটেছে।
কি ঘটনা?
আন্দাজ করতো কি ঘটনা?
আন্দাজ খেলা এখন খেলতে পারব না মা। কি ঘটেছে বলতে চাইলে বল। বলতে না চাইলে চলে যাও।
জাহেদা ফিসফিস করে বললেন, তোর বাবা রুনিকে ক্ষমা করে দিয়েছে। আমাকে একটু আগে বলেছে, রুনিকে বাড়ি ফিরতে বল। বিরাট ঘটনা না?
হ্যাঁ। কিন্তু তুমি ফিসফিস করছ কেন? ফিসফিস করার মতো ঘটনা তো এটা না।
জাহেদা মেয়ের পাশে বসলেন। গলার স্বর আরো নামিয়ে ফেলে বললেন, দুপুরে ভাত খাবার পর তোর বাবা বলল, আমাকে কাঁচা সুপারি। দিয়ে একটা পান দাও তো। কাঁচা সুপারি হার্টের জন্যে ভাল। ঘরে কাঁচা সুপারি ছিল। আমি দিলাম পান বানিয়ে। পান খেতে খেতে হঠাৎ বলল, আমি এতদিন হাসপাতালে ছিলাম তোমার বড় মেয়ে কি আমাকে দেখতে গেছে?
আমি বললাম, না।
তোর বাবা বলল, দেখতে আসেনি কেন?
আমি বললাম, ভয়ে আসেনি। তাকে দেখে তোমার যদি প্রেসার উঠে যায়। এই সময় প্রেসার খুবই ক্ষতিকর।
তখন তোর বাবা বলল, ওকে আসতে বল। বিছানা বালিশ নিয়ে যেন চলে আসে। অদ্ভুত না?
মীরু জবাব দিল না। হাই তুলল। জাহেদা বললেন, মীরু আমাকে একটা সাজেশান দে। আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব। না কি টেলিফোনে চলে আসতে বলব।
যেটা তুমি ভাল মনে কর সেটাই কর।
আমার কি যে ভাল লাগছে। তোর শরীর খারাপ না কি রে মীরু। চোখ-মুখ কেমন শুকনা।
শরীর খারাপ না।
জাহেদা আনন্দময় গলায় বললেন, রুনির বাড়ি ফেরার পেছনে তোর সুলতানা ফুপুর একটা ভূমিকা আছে। সুলতানার কাছে তোর বাবা শুনলেন যে তুই নাসেরকে বিয়ের ব্যাপারে মত দিয়েছিস। এটা শুনেই তোর বাবার মন ভাল হয়ে গেল। তোর বাবা ঠিক করেছে তোর বিয়ে হবে দেশের বাড়িতে। ঢাকা থেকে বরযাত্রীকে গ্রামে যেতে হবে। তোর বাবা রেল স্টেশনে হাতী রাখবে। হাতীতে চড়ে বরযাত্রী যাবে। বিয়ে উপলক্ষে মেমানি। হবে। মেমেনি বুঝিস? মেমানি হল গণ-খাওয়া। একটা গ্রামের সব মানুষকে যদি দাওয়াত করে খাওয়ানো হয় তখন তাকে বলা হবে মেমানি।
মীরু মার দিকে তাকিয়ে আছে। মা কি বলছেন তা এখন আর তার মাথায় ঢুকছে না। সে জানালা খুলল। আকাশ মেঘে মেঘে কালো হয়ে আছে। যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে।
জাহেদা বললেন, হাতী দিয়ে বরযাত্রী নেয়ার আইডিয়া তোর কাছে কেমন লাগছে?
হাস্যকর লাগছে।
হাস্যকর কেন লাগবে? আমার তো মনে হয় সবাই পছন্দ করবে।
বরযাত্রীদের কেউ কেউ হাতী থেকে পিছলে পড়ে ব্যথা পেতে পারে মা।
জাহেদা বিরক্ত গলায় বললেন, অদ্ভুত সব চিন্তা শুধু তোর মাথাতেই আসে। হাতী থেকে পিছলে পড়বে কেন?
মীরু বলল, পিছলে পড়বে কারণ হাতীতে চড়ে কারোর অভ্যাস নেই। নতুন ধরনের কিছু করতে চাইলে কর তবে এমন কিছু কর যাতে রিস্ক নেই। যেমন বরযাত্রীদের ঠেলাগাড়িতে করে নেয়ার ব্যবস্থা কর।
মীরু চুপ কর।
মীরু হাই তুলতে তুলতে বলল, মা শোন আমি যদি আমার নিজের পছন্দের কাউকে বিয়ে করি তাহলে বাবা কি করবে? হাতী দিয়ে লাথী দেয়াবে?
জাহেদা হেসে ফেললেন। মীরু মাঝে মাঝে এমন মজা করে কথা বলে।
দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে
দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পাতা কেউ নামিয়ে নিচ্ছে না। এটা যেন একটা খেলা, চোখের পাতা যে আগে নামিয়ে নেবে সে হেরে যাবে।
পরাজিত হল বারসাত। সে চোখ নামিয়ে নিয়ে কোমল গলায় বলল, কেমন আছ ঐ?
ঐ মানে?
ঐন্দ্রিলাকে সংক্ষেপ করে ঐ বললাম।
মীরু বলল, তোমার কি হয়েছে? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি এইডস-এর রুগী। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে মারা যাবে। এত দিন কোথায় ছিলে?
বারসাত বলল, বাহ তুমি তো অবিকল বনলতা সেনের মত প্রশ্ন করলে— এতদিন কোথায় ছিলেন? এতদিন আমি ছিলাম বিম্বিষার অশোকের ধূসর জগতে।
মীরু বিরক্ত গলায় বলল, ধোয়াটে ভাবে কথা বলা বন্ধ কর। সরাসরি কথা বল। তুমি কোথায় ছিলে?
বারসাত সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, সিকোয়েন্স বাই সিকোয়েন্স বলি। সিকোয়েন্স ওয়ান-– কাজীর অফিস থেকে আমি চলে গেলাম মামার। বাগান বাড়িতে। বাগান বাড়িটা কালিয়াকৈরে। বাগানবাড়ির নাম পদ্ম। সিকোয়েন্স টু বাগান বাড়িতে পা দিয়েই আমি জ্বরে পড়লাম। যাকে বলে উল্টা জ্বর।
উল্টা জ্বর মানে?
যে জ্বরে পৃথিবী উল্টা হয়ে যায় সেই জ্বরকে বলে উল্টা জ্বর। আমার পৃথিবী গেল উল্টা হয়ে। তোমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কবিতাগুলি পর্যন্ত আমার মাথায় উল্টা করে আসতে শুরু করেছিল। বলা যেতে পারে আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি।
মীরু বলল, মৃত্যুর মুখ থেকে পুরোপুরি ফিরে এসেছ, এমন বলা ঠিক হবে না। তেমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি এখনও মৃত্যুর মুখে বাস করছ।
আমরা সবাই তাই করছি মীরু। আমরা সবাই মৃত্যুর মুখে বাস করছি।
ফিলসফি কপচাবে না।
বারসাত হাসতে হাসতে বলল, ফিলসফি তো কপচাতেই হবে। মীরু তুমি ভুলে গেছ আমি ফিলসফির ছাত্র। খুবই খারাপ ছাত্র। তাকে কি? বিষয় তো ফিলসফি।
তোমার স্বাস্থ্য যে কতটা খারাপ হয়েছে তাকি তুমি জানো? তোমাকে টুথপিকের মত দেখাচ্ছে। শরীর কি এখন ঠিক হয়েছে?
হুঁ।
আমার তো মনে হয় না তোমার শরীর ঠিক হয়েছে। তুমি সিগারেট ধরিয়ে দুটা টান দিয়ে সিগারেট ফেলে দিলে। শরীর ঠিক থাকলে সিগারেট ফেলে দিতে না। তুমি নিঃশ্বাস নিচ্ছ হা করে। একমাত্র মাছেরাই ডাঙ্গায় এইভাবে নিঃশ্বাস নেয়। তুমি তো মাছ না।