মীরু বলল, অবশ্যই মিথ্যা কথা বলছেন। আমার বাবার মত বিরাট ঘুষখোরের জন্যে খোয়াজ খিজির আসবেন না। আমাদের বনানীতে একটা বাড়ি আছে। ঐ বাড়ি বানানোর প্রতিটি টাকা ঘুষের টাকা। বাড়ি বানানো শেষ করার পর বাবা যখন বাড়ির নামের জন্যে আমার কাছে এলেন আমি বাবাকে বললাম–নাম দাও ঘুষ কুটির। সেই থেকে বাবার সঙ্গে আমার গণ্ডগোল।
নিজের বাবা সম্পর্কে এইসব কি কথা বলছ মা?
সত্যি কথা সবার সম্পর্কেই বলা যায়। নিজের বাবা সম্পর্কে তো আরো বেশি বলা যায়। ভাল কথা, আপনি কি নাস্তা করেছেন?
চা-নাস্তা খেয়েছি।
তাহলে বাড়ি চলে যান। বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলবেন না। মিথ্যা কথা আমার খুব অপছন্দ। আপনি একেবারে মৃগনাভীর গন্ধ পেয়ে গেলেন। মৃগনাভির গন্ধ কখনো শুকেছেন?
না।
জিনিসটা দেখেছেন?
দেখি নাই।
আমি কি প্রমাণ করতে পেরেছি যে আপনি মিথ্যাবাদী?
ইসমাইল হোসেন পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকলেন, মীরু চলে গেল ছাদে। তার অসহ্য লাগছে। কিছুদিনের জন্যে ঢাকার বাইরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করছে।
এ বাড়ির ছাদটা খুবই সুন্দর। বাড়িওয়ালা শরফুদ্দিন সাহেবের গাছের শখ আছে। ছাদে তিনি অস্বাভাবিক সুন্দর একটা বাগান তৈরি করেছেন। বাগানে নানা জাতের অর্কিড আছে, গোলাপ আছে আর আছে বাগানবিলাস। ছাদের এই বাগানে ঢুকলেই মীরুর মাথা যেন কেমন কেমন করে।
শরফুদ্দিন সাহেব এই বাগানের ছাদে কাউকে আসতে দেন না। শুধু মীরুকে ছাদে আসার একটা চাবি দিয়েছেন। প্রতিদিন এক মিনিটের জন্যে হলেও মীরু একবার ছাদে আসে। ছাদটার নাম সে দিয়েছে অক্সিজেন সেন্টার। অক্সিজেন সেন্টারে তার নিজের একটা আলাদা জায়গা আছে। সেখানে রট আয়রনের একটা মাঝারি আকৃতির সোফা সে নিজে কিনে এনে বসিয়েছে। সোফাটা নীল অপরাজিতার ঝোপের আড়ালে এমন ভাবে রাখা যে সোফায় বসে থাকলে কেউ চট করে তাকে দেখবে না। অথচ সে অপরাজিতার পাতার ফাঁক দিয়ে সবাইকে দেখতে পাবে।
মীরু ছাদে এলে সোফায় মাথা রেখে শুয়ে থাকে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, এই সোফায় মাথা রাখা মাত্রই তার প্রচণ্ড ঘুম পায়। মীরুর ধারণা নীল অপরাজিতা গাছ থেকে কড়া কোন ঘুমের ওষুধ বাতাসে ভেসে আসে।
সুলতানা মীরুর খোঁজে ছাদে এসেছেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, আশ্চর্য কাণ্ড, তুই কি ঘুমাচ্ছিস না-কি?
মীরু বলল, হ্যাঁ।
বাসায় হুলস্থুল ঝামেলা বাধিয়ে তুই ছাদে ঘুমাচ্ছিস। আশ্চর্য! তোর কাণ্ডকারখানা বোঝা মুশকিল।
বাসায় হুলস্থুল ঝামেলা?
তুই ভাইজানকে কি বলেছিস কে জানে। ভাইজান কান্নাকাটি করছেন। ভাবীর সঙ্গে করেছেন ঝগড়া। ভাবী রাগ করে তার ভাই-এর বাসায় চলে গেছেন। বলে গেছেন আর কোনোদিন আসবেন না। কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার ডেকে এনে ভাইজানের প্রেসার মাপা হল।
প্রেসার নিশ্চয়ই নরম্যাল ছিল। ছিল না?
হ্যাঁ প্রেসার নরম্যাল। তুই কি করে বুঝলি?
বাবার বেশির ভাগ কর্মকাণ্ডই ভান।
নিজের বাবা সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলা কি ভাল?
নিজের কথা সম্পর্কে কেউ বলার চেয়ে নিজের বাবা সম্পর্কে কথা বলাই কি ভাল না?
তোর সঙ্গে যুক্তি-তর্কে যাব না। যুক্তি-তর্ক আমি পারি না। আমি ভাইজানকে ঠিক করে ফেলেছি। উনি এখন নরম্যাল। তোর দায়িত্ব হচ্ছে ভাবীকে নরম্যাল করে বাসায় নিয়ে আসা।
ঠিক আছে নিয়ে আসব। তুমি বস তো আমার পাশে।
সুলতানা বসলেন। মীরু বলল, তোমাকে দিয়ে আমি একটা ছোট্ট এক্সপেরিমেন্ট করতে চাই।
কি এক্সপেরিমেন্ট?
তুমি চোখ বন্ধ করে এই সোফায় কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবে। আমি দেখতে চাই তোমার ঘুম আসে কি না। আমি এই সোফাটার নাম দিয়েছি ঘুম সোফা। এখানে মাথা রেখে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলেই ঘুম পায়।
তাহলে এক কাজ কর। সোফাটা আমাকে দিয়ে দে। আমি বাসায় নিয়ে যাই। আমার রাতে এক্কেবারেই ঘুম হয় না। এখন থেকে ঘুম সোফায় শুয়ে ঘুমুব।
মীরু বলল, ফুপু সোফা দেয়া যাবে না। সোফা এখানে থাকবে। ঘুমাতে চাইলে তোমাকে আমাদের বাড়ির ছাদে এসে ঘুমাতে হবে। এত কথা বলে লাভ নেই। শুয়ে পড়।
সুলতানা বাধ্য মেয়ের মত শুয়ে পড়লেন।
মীরু বলল, চোখ বন্ধ কর।
সুলতানা চোখ বন্ধ করলেন। মীরু বলল, আমি এখন চলে যাচ্ছি। তুমি চোখ বন্ধ করে থাক। আমি পনেরো মিনিট পরে এসে খোঁজ নেব ঘুম এসেছে কি না।
সুলতানা খপ করে মীরুর হাত ধরে বললেন, তুই পাগল হয়েছিস আমি একা একা ছাদে বসে থাকব? ভয়েই মরে যাব। তুই যা করতে বলবি আমি করব। কিন্তু তোকে আমার পাশে বসে থাকতে হবে। আমি এই লোহার সোফায় মাথা রেখে ঘুমুতে পারব না। তোর কোলে মাথা রেখে ঘুমাব। তুই আমার চুলে হাত বুলিয়ে দে।
সুলতানা মীরুর কোলে মাথা রাখলেন। মীরু ফুপুর চুলে হাত বুলাতে লাগল। সুলতানা ঘুম ঘুম গলায় বললেন, নাসের তোর খুব প্রশংসা করছিল। তার ধারণা তুই হচ্ছিস তার দেখা পাঁচজন শ্রেষ্ঠ মানুষের একজন।
বাকি চারজন কে?
বাকি চারজন কে আমি জিজ্ঞেস করিনি। বাকি চারজনকে দিয়ে আমার দরকার নেই। পাঁচজনের মধ্যে তুই আছিস এটাই বড় কথা।
মীরু বলল, নাসের সাহেব আমার বিষয়ে সব গল্প কি করেছেন? আমি যে তাকে নিয়ে বারসাত নামের এক লোককে খুঁজছিলাম সেই গল্প বলেছেন?
না তো। বারসাতটা কে? ঐ যে ছবি আঁকনেওয়ালা?
হুঁ।
প্রাইভেট টিউশনি করে জীবন চালায়?
হ্যাঁ।
এইসব পরজীবী, প্যারাসাইট টাইপ মানুষের নাম মনেও করবি না। এই শ্রেণীর মানুষ গল্প করার জন্য বা সঙ্গে নিয়ে ঘুরার জন্যে খুব ভাল। স্বামী হিসেবে এরা ভয়ংকর খারাপ।