আজকেও কিছু খাবেন না?
না। কিছু না খাওয়াও এক ধরনের চিকিৎসা। এই চিকিৎসার নাম উপবাস চিকিৎসা।
অন্য কিছু খাইতে ইচ্ছা করে?
এই মুহূর্তে একটা জিনিস খেতে ইচ্ছা করছে। জিনিসটার নাম মার্বেল সিঙাড়া। মার্বেলের সাইজ। একসঙ্গে দুটা-তিনটা মুখে দেয়া যায়। মগবাজার কাজি অফিসের কাছে এই সিঙাড়া বানানো হয়। মীরুর খুবই পছন্দের খাদ্য। একবার সে আটত্রিশটা সিঙাড়া খেয়ে ফেলেছিল। তখন আমি তাকে টাইটেল দিলাম সিঙাড়া কন্যা। এই অপূর্ব সিঙাড়া যে কারিগর বানায় তার নাম নেক মর্দ। অদ্ভুত নাম না?
রফিক জবাব দিল না। পেপের প্লেট নিয়ে চলে গেল। বারসাত চিৎ অবস্থা থেকে পাশে ফিরল। তার মাথায় কবিতার লাইন আসছে। সবই উল্টা হয়ে আসছে। ব্যাপারটা কী? মাথা কি পুরো খারাপ হয়ে গেল–
য়াখিরা নম্পক ন্নক্ষু ব্ধক্ষু ন্তেপ্রালজ
য়াকিআঁ যাকিআঁ গুচিণরচ লজস
বারসাত বুঝতে পারছে না তার পৃথিবী উল্টো হয়ে যাচ্ছে কি না। মাথার ভেতর বড় রকমের কোনো ঝামেলা অবশ্যই হচ্ছে। হোক ঝামেলা। মাথার ভেতর উলটপালট ঝামেলা হলে খারাপ লাগে না।
Ring a ring O roses
A pocket full of poises
Atishoo! Atishoo!
We alf fall down.
এই কবিতাটা মাথায় উল্টা আসেনি। ঠিকমতোই এসেছে। ১৬৬৫ সনে লন্ডনে যখন ভয়াবহ plague দেখা দিল তখন লন্ডনের ছেলেমেয়েরা এই ছড়াটা রাস্তায় রাস্তায় বলে বেড়াত। We all fall do down. আমরা সবাই মরে পড়ে যাব। কারণ আমাদের হয়েছে ভয়াবহ ব্যাধি–প্লেগ!
রফিক রফিক।
রফিক বিরক্ত মুখে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। বারসাত বলল, তাড়াতাড়ি বালতিটা আনো। আমি বমি করব। বমির টাইম চলে এসেছে। বমি করার পর কী হবে জানো? We all fall down.
রফিক বালতি নিয়ে এসেছে। বালতির রঙ ঘন লীল। রঙটা চোখে লাগছে। অসুস্থ অবস্থায় কটকটা হলুদ রঙ চোখে লাগে। লাল রঙ লাগে। নীল রঙ কি লাগে?
রফিক!
জি স্যার।
আমি আর বাঁচব না। আমার আত্মীয়-স্বজনকে খবর দাও।
স্যার বলেন কারে খবর দিব।
আমার মাকে খবর দিতে পার। তাকে খবর দেবার সমস্যা কী জানো? তিনি এসেই আমার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করবেন। ক্যাটক্যাট কথা বলবেন। এমন সব কথা যা শুনলে নিতান্ত ভালোমানুষের গায়েই আগুন ধরে যাবে।
স্যার কথা না বলে চুপ করে শুয়ে থাকেন। রেস্ট নেন।
কথা বলাতেই আমার রেস্ট হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের একটা বিখ্যাত গান আছে— আমার এই কথা বলাতেই আনন্দ। উঁহু ভুল করেছি, গানটা হচ্ছে— আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ। রফিক।
জি।
তুমি বিরক্ত মুখ করে হলেও আমার যথেষ্ট সেবা করেছ। আমি যদি কোটিপতি হতাম তাহলে উইল করে তোমাকে লাখ বিশেক টাকা দিয়ে। যেতাম। আমি হতদরিদ্র। বাজারে আমার দেনা হল তেইশ হাজার টাকা। বিয়ে যে আমার হয়নি সেটা একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। রফিক!
জি।
দুটা মাছি আমার নাকের কাছে ভ্যান ভ্যান করছিল। এরা কোথায় গেছে একটু দেখ তো। এদেরকে ধরার জন্যে একশ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলাম। জীবিত বা মৃত একশ টাকা দেয়া হবে।
স্যার আপনি শুয়ে থাকেন আমি মাথায় পানি ঢালি।
যা ঢালতে ইচ্ছা হয় ঢাল। একটাই শুধু কথা, আমার মা যদি আমার খোঁজে চলে আসে তাহলে বলবে আমি মারা গেছি। বলতে পারবে না?
অবশ্যই বলতে পারবে। বলতে না পারার কিছু নেই। সামান্য মিথ্যা বলা হবে। তবে ঠিক মিথ্যাও না। আমি তো মারাই যাচ্ছি। আমি যদি অতি বিখ্যাত কেউ হতাম তাহলে তুমি একটা বই লিখতে পারতে–
বারসাত আলীর সঙ্গে
শেষ কিছু সময়।
আমি বিখ্যাত কেউ না। বিখ্যাত কেউ হবার কোনো সম্ভাবনাও আমার মধ্যে নেই। আমার মত মানুষরা জীবন শুরু করে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে। জীবন শেষ করে কোচিং সেন্টারের ম্যানেজার হিসেবে।
রফিক বারসাতের মাথায় পানি ঢালতে শুরু করেছে। বারসাত কথা। বলা বন্ধ করেছে। তবে এখন তার অন্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। তার কাছে। মনে হচ্ছে বিছানার পাশে তার মা দাড়িয়ে আছেন। তাঁর মুখ থেকে জর্দার গন্ধ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। জর্দার কড়া গন্ধের কারণে বারসাত বুঝতে পারছে না— তার মা কি সত্যি সত্যি চলে এসেছেন না কি সে যা দেখছে। ঘোরের মধ্যে দেখছে।
মাকে দেখতে ইচ্ছা করছে না। বারসাত চোখ বন্ধ করল। তাতেও লাভ হল না। চোখ বন্ধ অবস্থাতেও সে তার মাকে পরিষ্কার দেখতে পেল।
লাভের মধ্যে লাভ আগের মা জর্দার গন্ধ নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ছিলেন। এই মা কথা বলা শুরু করলেন।
এই তোর কী হয়েছে?
জানি না।
শরীর থেকে চামড়া উঠছে না কি?
শরীর থেকে চামড়া উঠবে কেন? আমি কি সাপ?
শরীর থেকে চামড়া ওঠা রোগ তোর বাপেরও হয়েছিল। এই রোগেই সে মারা গেল। এটা তোদের বংশের ধারা। চামড়া ওঠা রোগে মৃত্যু।
দুষ্ট লোকে বলে বাবা মারা গেছেন তোমার ক্যাটক্যাটানি শুনে। বাবা যখন মৃত্যুশয্যায় তখনো তুমি তার কানের কাছে দিনরাত ক্যাটক্যাট করেছ।
তোর বাপের সঙ্গে কী করেছি সেটা তোর বাপের আর আমার ব্যাপার। রোজ হাশরে আমার মধ্যে আর তোর বাপের মধ্যে ফয়সালা হবে।
ফয়সালা হলে তো ভালোই।
লোকমুখে শুনলাম তুই গোপনে বিয়ে করেছিস।
বিয়ে করার চেষ্টা করেছিলাম মা। শেষ মুহূর্তে পাত্রী আসেনি বলে বিয়ে হয়নি।
তাহলে তো ভালোই হল। এখন তুই আমার বোনের মেয়েকে বিয়ে কর।
ফাতিলকে বিয়ে করতে বলছ?
ফাতিলটা আবার কে?
লতিফাকে উল্টো করে বললাম ফাতিল। এখন বেশির ভাগ শব্দ আমার। মাথায় উল্টো করে আসছে।