বারসাত শুয়ে আছে তার দূর-সম্পর্কের মামার বাগানবাড়িতে। বাড়ির নাম পদ্মাকাঠের একতলা বাড়ি। বড় বড় জানালা। জানালা খুললেই চোখে পড়ে বাড়ির পেছনের পদ্ম পুকুর। পুকুরে সত্যিকার পদ্ম ফুটে আছে। মীরু এই বাড়ি দেখলে মুগ্ধ হত। সেটা সম্ভব হল না। মীরু আসেনি, বারসাতকে একা আসতে হয়েছে। বারসাত তিন বেহালাবাদক ঠিক করে রেখেছিল। এরা পদ্ম নামের বাড়ির উঠানে বসে থাকবে। বারসাত এবং মীরুর বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতে দেখলে বেহালায় বাজাতে থাকবে—
লীলাবালী লীলাবালী
বড় যুবতী কন্যা কি দিয়া সাজাইতাম তরে?
বারসাতের আসতে দেরি দেখে তিন বেহালাবাদকের মধ্যে দুজন বারান্দার সোফায় লম্বা হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। একজন জেগে রইল। সেই একজন বারসাতকে একা ঢুকতে দেখে খানিকটা বেদিশা হয়ে গেল। তারপরেও সে বেহালা হাতে নিল। বাজাব না-কি বাজাব না ভঙ্গিতে তাকাল। বারসাত বলল, লাগবে না। বেহালা বাজানোর দরকার নেই।
বেহালাবাদক বলল, আপনার কী হয়েছে? চোখ টকটকা লাল।
বারসাত বলল, আমার কিছু হয় নাই, চোখে লাল রঙ মেখেছি। মেয়েরা ঠোটে লিপস্টিক দেয়। আমি ঠোটে দিয়েছি আই স্টিক। আপনাদের তো টাকা-পয়সা আগেই দিয়ে রেখেছি এখন বাড়ি চলে যান। বিদায়।
বাজনা বাজাব না?
বাজনা বাজাতে হবে না। বাজনার দরকার ছিল আমার স্ত্রীর জন্যে। স্ত্রী নাই, বাজনাও নাই।
উনি কোথায়?
জানি না উনি কোথায়। আপনারা বিদায় হন। টা টা বাই বাই।
ভাই সাব আপনার কি জ্বর? আপনি তো দাঁড়ায়ে থাকতে পারতেছেন না।
বারসাত বলল, দাঁড়িয়ে থাকতে না পারলেও কোনো সমস্যা নেই। আমি এক্ষুনি বিছানায় শুয়ে পড়ব। এক মাস ঘুমাব। গিনিস বুক অব রেকর্ডে নাম তুলে ফেলব। একবিংশ শতাব্দীর রিপ ভ্যান উইংকেল।
বারসাত কতক্ষণ ঘুমুচ্ছে বা কতক্ষণ ঘোরের মধ্যে আছে তা সে জানে না। তার কাছে মনে হচ্ছে সে বেশির ভাগ সময় অচেতন অবস্থাতেই থাকে। মাঝে মাঝে সামান্য চেতনার মতো আসে তখন পদ্ম নামের বাগানবাড়ির কেয়ারটেকারের সঙ্গে তার কিছু কথাবার্তা হয়। কেয়ারটেকারের নাম রফিক। রফিকের চেহারা বারসাতের কাছে একেক সময় একেক রকম মনে হয়। প্রবল জ্বরের কারণেই এরকম হচ্ছে এটা বারসাত বুঝতে পারছে। মেয়েরা সাজগোছ করে চেহারা বদলায়। ছেলেদের চেহারা বদলায় না। রফিকের চেহারা একেক সময় একেক রকম দেখানোর আর কোনো কারণই নেই। জ্বর বারসাতের মাথা এলোমেলো করে দিচ্ছে।
জ্বর খুব যখন বাড়ছে তখন আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে। মাথার ভেতর ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। এক পর্যায়ে ঝিঝি পোকার ডাকটা বেহালার শব্দের মতো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তিন বেহালাবাদক বাজাচ্ছে—
লীলাবালী লীলাবালী
বড় যুবতী কন্যা কি দিয়া সাজাইতাম তরে।
বারসাত ডাকল, রফিক রফিক
রফিক প্লেটে করে কাটা পেঁপে নিয়ে ঢুকল। যে কোনো খাদ্যদ্রব্য দেখলেই বারসাতের সমস্ত শরীর মোচড় দিয়ে ওঠে। ইচ্ছা করে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যে ঢুকেছে তার গায়ে বমি করে ভাসিয়ে দেয়। এবারো একই ঘটনা ঘটল। বারসাত নিজেকে সামলে নিয়ে অনেক কষ্টে প্রায় আদুরে গলায় বলল, কেমন আছ রফিক?
রফিক হড়বড় করে বলল, আমি তো ভালোই আছি। আফনের অবস্থাটা কী কন দেহি।
আমিও ভালোই আছি শুধু এই মাছি দুটা খুব বিরক্ত করছে। মাছি দুটা মারতে পারলে একশ টাকা বকশিশ পাবে। বড় মাছিটা মারতে পারলে পাবে সত্তর টাকা আর ছোটটা মারতে পারলে ত্রিশ। দেখ তো মারতে পার কি না।
একশ টাকা বকশিশ রফিককে কাবু করতে পারল না। সে পেঁপের প্লেট বিছানার পাশের টেবিলে রাখল। কঠিন কোনো কথা বলবে এর রকম ভঙ্গিতে বারসাতের খাটের পাশে এসে দাঁড়াল। থমথমে গলায় বলল, স্যার আমি আপনেরে দুইটা কথা বলব মন দিয়া শুনেন।
বারসাত বলল, তোমার কথা আমি মন দিয়েই শুনি রফিক। মীরুর কথা যতটা মন দিয়ে শুনি ততটা মন দিয়ে হয়তো শুনি না। সেটা সম্ভবও না। তারপরেও…
স্যার আপনি কথা কইয়েন না। আমি কী বলতেছি শুনেন। আপনার আল্লাহর দোহাই লাগে।
বল শুনছি।
আপনের শরীর খুবই খারাপ। আপনারে এইখানে রাখতে কোনো ভরসা পাই না। আপনের এইখানে মৃত্যু হলে আমরা বিরাট বিপদে পড়ব।
বিপদের কী আছে? মানুষের মৃত্যু হয় না? মৃত্যু হলে এখানে কবর দিয়ে দিবে। কিংবা আমাকে ইটসহ বস্তায় ভরে পদ্ম পুকুরে ফেলে দেবে। কোনো সমস্যা নাই।
স্যার শুনেন, উল্টাপাল্টা কথা বলে লাভ নাই। আজ সন্ধ্যায় আমি টেম্পো ভাড়া করে আনতেছি। আমি আপনারে নিজে ঢাকায় দিয়ে আসব।
রফিক এখন তুমি আমার কথা মন দিয়ে শোনো আমার শরীরের যে অবস্থা–পথেই মারা যাব তখন তুমি বিরাট বিপদে পড়বে। পুলিশ তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। তোমার সঙ্গে নিরীহ বেবিটেক্সিওয়ালাকে ধরে নিয়ে যাবে। হেভি প্যাদানি দেবে। পুলিশের পাদানি খেয়েছ কখনো? মারাত্মক জিনিস।
স্যার আপনি ঢাকার বাড়ির আত্মীয়-স্বজনের ঠিকানা দেন। আমি তাদের নিয়া আসি।
তোমাকে এইসব কিছু করতে হবে না। আমি শরীরে বল পাওয়া শুরু করেছি। এক-দুই দিনের ভেতর উঠে বসব। তখন তুমি একটা বেবিটেক্সি ডেকে আনবে। আমি বেবিটেক্সিতে উঠে ফুড়ুৎ করে চলে যাব। আমার সঙ্গে তোমাকে আসতে হবে না। কাজেই পথে যদি মারা যাই তোমাকে কেউ ধরবে না। বেবিটেক্সিওয়ালাকে ধরবে।
স্যার আপনি এত কথা বলতেছেন কেন?
শরীর যে ঠিক হতে শুরু করেছে এটা তোমাকে বোঝানোর জন্যে এত কথা বলছি। এখন তুমি দয়া করে পেঁপের পিরিচটা সামনে থেকে নাও। তোমাকে তো বলেছি আমার সামনে কোনো খাদ্যদ্রব্য আনবে না। আমি বাতাস খেয়ে বাঁচব। এখন থেকে আমি বায়ু-ভুক।