- বইয়ের নামঃ রোদনভরা এ বসন্ত
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
রাত বারোটা দশ মিনিটে
উৎসর্গ
হিমু নামের কেউ যদি থাকতো তাহলে কোন এক জোছনার রাতে তাকে বলতাম— এই বইটি কেন আপনাকে উৎসর্গ করা হল বলুনতো? দেখি আপনার কেমন বুদ্ধি!
———
০১.
মীরু রাত বারোটা দশ মিনিটে সেভেন পয়েন্ট ফাইভ মিলিগ্রামের একটা ডরমিকাম খেয়েছে। এখন বাজছে একটা পঁচিশ, ঘুমের ওষুধ খাবার পরেও এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট পার হয়েছে। ঘুমের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং ঘুম কেটে যাচ্ছে। দেয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার শব্দ কানে আসছে! ঘুমের ওষুধ খাবার পর দেয়াল ঘড়ির শব্দ কানে আসা খারাপ লক্ষণ। তখন ধরে নিতে হবে–ঘুম কেটে যাচ্ছে।
মীরুর বিরক্তি লাগছে। আজ রাতে তার ঘুম হওয়াটা খুব দরকার। আগামীকাল তার বিয়ে। রাতে এক ফোঁটা ঘুম না হলে বিয়ের দিনে তাকে দেখা যাবে উলুম্বুষের মতো। চোখের নিচে লেপ্টে থাকবে কালি। কপালে এবং গালে তেল জমতে থাকবে। চোখ ইঞ্চিখানিক ডেবে যাবে। মীরুর এই এক সমস্যা, একরাত না ঘুমুলেই চোখ ডেবে যায়, চোখের নিচে ঘন হয়ে কালি পড়ে। কপালে এবং গালে তেলতেলে ভাব চলে আসে। সাবান দিয়ে ঘষলে তেলতেলে ভাব চলে যায় ঠিকই, কিন্তু বিশ-পঁচিশ মিনিট আবার আগের অবস্থা।
যে কোন মূল্যে মীরুকে ঘুমুতে হবে। সে গায়ের চাদর মাথা পর্যন্ত তুলে দিল। মনে মনে বলল, আমি এখন আর কোনো দুঃশ্চিন্তা করছি না। সে দুঃশ্চিন্তাহীন জীবনযাপন করছে এ রকম ভাব করে পাশ ফিরল। ঠিক করল আরো আধঘণ্টা দেখবে তারপর আরেকটা ডরমিকাম খাবে। তাতেও যদি না হয় আরেকটা। দানে দানে তিন দান।
মরিয়ম। মরিয়ম।
মীরু চাদরের ভেতর থেকে মাথা বের করল। তার নাম মরিয়ম না। তার নাম ঐন্দ্রিলা। মরিয়ম নাম অনেক আগেই বাতিল হয়েছে। কিন্তু বাবা এখনো মরিয়ম ডাকেন। অন্যরা মরিয়ম ভেঙে মীরু ডাকে। মীরু পর্যন্ত সহ্য করা যায় কিন্তু দুই হাজার তিন সনে মরিয়ম নাম সহ্য করা যায় না। পুরনো ফ্যাশন ঘুরে ঘুরে আসে। গয়নার জাবদা ডিজাইনগুলি আবার ফিরে এসেছে। একসময় হয়তো মরিয়ম টাইপ নাম রাখা ফ্যাশন হবে। তখন ঐন্দ্রিলা বদলে মরিয়ম রাখা যেতে পারে। এখন মীরুর যীশু খ্রিস্টের মা হবার কোনো শখ নেই।
সে খাট থেকে নামল। ঘুমঘুম ভাব চোখে যা ছিল, খাট থেকে নামতে গিয়ে সবটাই চলে গেল। সে বাবার শোবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
বাবা ডাকছিলে?
আফজল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, ড্রয়িং রুমের দরজাটা বন্ধ কি দেখে তারপর ঘুমুতে যা। আমার ধারণা দরজা খোলা।
মীরু বলল, বাবা ড্রয়িং রুমের দরজা বন্ধ। আমি নিজে বন্ধ করেছি।
আফজল সাহেব বললেন, তোকে দেখতে বলেছি তুই দেখে আয়। এত কথার দরকার কী? কথা বলে যে সময় নষ্ট করলি তারচেয়ে কম সময়ে দেখে আসা যেত দরজা বন্ধ কি বন্ধ না।
মীরু বলল, আমি যাচ্ছি।
আফজল সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, সেই পানি খাবি তবে ঘোলা করে খাবি। দরজা বন্ধ না-কি খোলা আমাকে জানিয়ে তারপর ঘুমুতে যাবি।
তোমাকে জানানোর দরকার কী?
এত ব্যাখ্যা তোকে দিতে পারব না। আমাকে জানাতে বলেছি আমাকে জানাবি।
ড্রয়িং রুমের দরজা খোলা। মীরুর কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগছে। তার স্পষ্ট মনে আছে সে নিজে দরজা বন্ধ করেছে। নিশ্চয়ই কাজের ছেলে জিতু মিয়া এর মধ্যে আছে। তার বয়স নয়-দশের বেশি হবে না। এর মধ্যেই সে সিগারেটে টান দেয়া শুরু করেছে। কাছে গেলেই সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যায়। জিতু নিশ্চয়ই দরজা খুলে বাইরে সিগারেট কিনতে গিয়েছিল। ফিরে এসে দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছে।
মীরু দরজা বন্ধ করে বাবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। শীতল গলায় বলল, বাবা দরজা বন্ধই ছিল। তুমি শুধু শুধু আমাকে পাঠিয়েছ।
তুই দরজা খোলা পেয়েছিস না বন্ধ পেয়েছিস?
আমি বন্ধ পেয়েছি। বাবা তোমাকে তো আমি বলেছিলাম দরজা বন্ধ। আমি নিজে বন্ধ করেছিলাম। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করনি। অন্যকে এত অবিশ্বাস করতে নেই।
আফজল সাহেব চুপ করে রইলেন। জবাব দিলেন না। মীরু ইচ্ছা করে মিথ্যা কথাটা বলল যাতে তার বাবা কিছুটা হলেও অনুশোচনা ভোগ করেন। অন্তত একবার হলেও মনে হয়, আহারে দরজা তো বন্ধই ছিল! শুধু শুধু মেয়েটাকে ঘুম থেকে তুলেছি।
মিথ্যা বলার জন্যে মীরুর তেমন খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। সে গত এক বছর ধরে ক্রমাগত মিথ্যা বলছে। এখন মনে হচ্ছে। মিথ্যা বলাটা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। যেখানে মিথ্যা বলার কোনোই
প্রয়োজন নেই সেখানেও সে মিথ্যা বলছে।
গত সোমবার সে যাচ্ছিল ইউনিভার্সিটিতে। তার মা জাহেদা বললেন, কোথায় যাচ্ছিস?
মীরু বলল, এক বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছি।
মা বললেন, তোর আজ ক্লাস নাই?
মীরু ফুরফুরে গলায় বলল, আছে। ক্লাসে যাব না। বান্ধবীর জন্মদিন। জন্মদিনের পার্টিতে যাব।
দিনের বেলা কীসের পার্টি?
মীরু রাগী রাগী গলায় বলল, সে যদি দিনে পার্টি দেয় আমি কী করব? তাকে বলব যে আমি দিনে আসতে পারব না। আমি আসব রাত দশটার দিকে। তুই রাতে পার্টি দে।
জাহেদা অবাক হয়ে বললেন, ঝগড়া করছিস কেন?
মীরু বলল, ঝগড়া করছি না মা। তোমাকে বিষয়টা বোঝাবার চেষ্টা করছি।
তোর বান্ধবীর বাসা কোথায়?
বাসা কোথায় জানতে চাচ্ছ কেন?