কাগজপত্র দেখালাম না?
কাগজপত্রের দাম নাই।
মনিরুজ্জামান সাহেব, পুলিশে কাজ করছি। দশ বছর ধরে—এই দশ বছরে একটা জিনিস শিখেছি-মানুষের চেয়ে বেশি মিথ্যা বলে কাগজ।
সিগনেচার আপনি বিশ্বাস করেন না?
জি না।
আমি কিন্তু জানি কী করে বিশ্বাস করাতে হয়। বিশ্বাস করাবার মতো ব্যবস্থা নিয়ে আসব।
আসুন। বিশ্বাস করাতে পারলে আমি ওনাকে ছেড়ে দেব। আপনি নিয়ে চলে যাবেন। শান্তি দিতে চাইলে দেবেন। পথেই কোথাও গলা টিপে মেরে ফেলতে পারেন। আপনার সমস্যা হবে না। ডাক্তাররা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আপনার কথামতো দেবে। পুলিশও ফাইনাল রিপোর্ট যা চাইবেন তাই দেবে।
শুধু আপনি দিবেন না?
জি না।
কোন দিবেন না?
কারণ আমি মানুষটা খারাপ।
আমি ঠিক এক ঘণ্টা পরে আসব।
এক ঘন্টা পরে এলে হবে না। আপনাকে বিকেলে আসতে বলেছি—আপনি বিকেলে আসবেন।
হাতিঘোড়া গেল তল, চার পয়সার ওসি বলে কত জল?
ওসি সাহেব হাই বলল, মনিরুজ্জামান বলল, মেয়েটা কোথায়? আমি ঐ মেয়েটার সঙ্গে কথা বলব। আমাকে কথাও বলতে দেবেন না?
দেব। কথা বলতে দেব।
মনিরুজ্জামান হারুনুর রশীদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল।
হারুনুর রশীদ অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্ৰাউন পেপারের প্যাকেট হাতে নিয়ে ঝট করে ব্রিফকেসে ভরে ফেলল। কাজটা সে করল দেখার মতো দ্রুততায়।
পাগলী নতুন শাড়ি পরেছে। মাথায় চুল আঁচড়েছে। তাকে আর চেনা যাচ্ছে না। সে নিজেও মনে হয় হকচকিয়ে গেছে। চুপচাপ বসে আছে, কোনোরকম হৈচৈ করছে না। কিছুক্ষণ পরপর নিজের দুটা হাত তার চোখের সামনে ধরে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কী যেন দেখছে। জরী বলল, তুমি কী দেখো?
পাগলী হাসল।
নাম কী তোমার?
পাগলী জবাব দিল না।
তোমার কি শাড়িটা পছন্দ হয়েছে?
পাগলী হ্যা-সূচক মাথা নাড়ল এবং আবারও তার দুটা হাত চোখের সামনে মেলে ধরল।
মুনা বলল, জরী আপা, মেয়েটাকে কী সুন্দর লাগছে দেখছেন?
হুঁ, দেখছি।
এত সুন্দর একটা মেয়ে পথে ঘোরে! আশ্চর্য!
নইমা শুয়ে আছে। কম্বল বিছানো হয়েছে। কম্বলের উপর ফুলতোলা নতুন চান্দর। নতুন বালিশ। সবই আনানো হয়েছে। নইমা বালিশে মাথা রেখেই ঘুমুচ্ছে। তার জ্বর এসেছে। মুনা বসে আছে। নইমার মাথার কাছে।
আনুশকা বলল, ওর জ্বর কি বেশি মুনা?
হুঁ।
সমস্যা হয়ে গেল তো!
আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না। আপা কোনো সমস্যা আছে। শান্তমুখে বসে আছেন।
আনুশকা হাসল। মুনা বলল, আপা, আমাদেরকে কি ওরা এখানে রাতেও আটকে রাখবে?
না, ছেড়ে দেবে। সন্ধ্যার আগেই ছেড়ে দেবে।
কীভাবে বলছেন?
আমাদের সঙ্গে শুভ্ৰ আছে না? শুভ্রর কোনো সমস্যা তার বাবা-মা হতে দেবেন না।
ওনারা তো আর জানেন না এখানে কী হচ্ছে।
ইতোমধ্যে জেনে গেছেন বলে আমার ধারণা। তারা তাদের ছেলের ওপর লক্ষ রাখবেন না, তা হয় না।
আনুশকার কথার মাঝখানেই মনিরুজ্জামান এসে দাঁড়াল। জরী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। ভূত দেখলেও কেউ এত চমকায় না।
মনিরুজ্জামান বলল, খেল তো ভালো দেখালে। যাই হোক, এখন সমস্ত খেলার অবসান হয়েছে। বিকেলে তোমাকে নিয়ে ঢাকা রওনা হব।
আমাকে নিয়ে ঢাকা রওনা হবেন মানে? আমি আপনার সঙ্গে ঢাকা যাব কেন?
স্বামীর সঙ্গে কোথাও যাবে না, এটা কেমন কথা?
আপনি আমার স্বামী?
অবশ্যই। বিয়ের কাবিননামাও নিয়ে এসেছি। ওসি সাহেবকে দেখলাম।
বিয়ের কাবিননামা?
এক লক্ষ এক টাকা কাবিনের কাবিননামা। বিকেলের মধ্যে তোমার বড় চাচাও চলে আসবেন।
জরীর মুখে কথা আটকে গেল। কী একটা কথা অনেক বার বলতে গিয়েও বলতে পারল না।
মনিরুজ্জামান হৃষ্ট গলায় বলল, আচ্ছা যাই—দেখা হবে বিকেলে।
জরী তাকাল আনুশকার দিকে। আনুশকা হাসছে। আনুশকার হাসি দেখে পাগলীও হাসতে লাগল। এতে নইমার ঘুম ভেঙে গেলো। সে উঠে বসল এবং আনন্দিত গলায় বলল, কী হয়েছে? কী হয়েছে?
মনিরুজ্জামান আর দাঁড়াল না। তার অনেক কাজ বাকি আছে। কাজ শেষ করতে হবে। নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। ওসির স্ক্রু টাইট দিতে হবে, তবে যাবার আগে দলের ছেলেগুলিকে দেখে যাওয়া দরকার।
রানা দেখল, থ্রি পিস সুট পরা এক ভদ্রলোক আসছেন। সে উৎসাহের সঙ্গে উঠে বসল। মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কেউ আসছে। তাদের মুক্তির ব্যবস্থা হচ্ছে। রানাই আগ বাড়িয়ে বলল, স্লামালিকুম।
মনিরুজ্জামান বলল, ওয়ালাইকুম সালাম। আপনারা ভালো?
জি স্যার, আছি মোটামুটি।
কষ্ট হয় নি তো?
মোতালেব বলল, কোনো কষ্ট হয় নি। অত্যন্ত আনন্দে সময় কাটছে। সময় কি ব্যাপার আগে জানতাম না। এখন জানি। আরো বৎসরখানেক এখানে থাকতে পারলে সায়েন্সের অনেক কিছু শিখতাম। আপনাকে তো ভাই চিনতে পারিছ না-আপনার পরিচয়?
আমার নাম মনিরুজ্জামান। আমি জরীর হাসবেন্ড।
কার হাসবেন্ড?
জরীর। আমি তাকে নিতে এসেছি। বিকেলে ওকে নিয়ে চলে যাব। আপনারা যেখানে যাচ্ছেন চলে যান। আপনাদের ওপর আমার কোনো রাগ নেই। আপনাদের একটু সমস্যা হলো—তার জন্যে আমার স্ত্রীর হয়ে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
রানা বলল, কী বললেন? আপনি কে?
জরীর হাসবেন্ড।
শুভ্ৰ বিস্মিত হয়ে বলল, জরী তো বিয়ে করে নি!
মনিরুজ্জামান হাসিমুখে বলল, আপনাদের তাই বুঝিয়েছে, ঘটনা ভিন্ন। বিয়ে হয়েছে, কাবিন হয়েছে। এক লক্ষ এক টাকা মোহরানা। যাই, কেমন? খোদা হাফেজ।
মনিরুজ্জামান হন।হন করে এগুচ্ছে। তার পেছনে হারুনুর রশীদ। হারুনুর রশীদ যে এতটা লম্বা তা আগে বোঝা যায় নি। এখন বোঝা যাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, একটা তালগাছ ব্রিফকেস হাতে কুজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।