রানার হাতে একটা পেনসিল-টর্চ। প্রয়োজনের সময় কোনো জিনিসই কাজ করে না। রানার পেনসিল-টর্চও কাজ করছে না। বোতাম টিপে টিপে তার হাত ব্যথা হয়ে গেছে। অথচ এই পেনসিল-টর্চ রওনা হবার আগের দিন কেনা হয়েছে। রানা উঁচু গলায় বলল, কেউ ট্রেন থেকে নামবে না, আনটিল ফার্দার অর্ডার। যে যেখানে আছ সেখানেই থাকো। মালের দিকে লক্ষ রাখো। নো মুভমেন্ট।
আনুশকা বলল, খামাখা চিৎকার কোরো না তো। শুধু শুধু হৈচৈ করছ কেন?
শুধু শুধু হৈচৈ করছি? বাতি নেই কিছু নেই, এর মধ্যে একটা-কিছু যদি হয়?
কী হবে?
অনেক কিছুই হতে পারে। জরী কোথায়? জরীকে তো দেখছি না।
রানা, তোমার আলগা মাতব্বরি অসহ্য লাগছে।
অসহ্য লাগলেও কিছু করার নেই। সহ্য করে নিতে হবে। জরী কোথায়?
শুভ্র বলল, জরী অন্য কামরায় ঘুমুচ্ছে। তার শরীর ভালো না।
রানা রাগী গলায় বলল, অন্য কামরায় ঘুমুচ্ছে মানে? কে ডিসিশান দিল? আমি কিছুই জানি না, আর দলের একজন মেম্বার অন্য কামরায় চলে গেল!
আনুশকা বলল, চিৎকার বন্ধ করো তো রানা। যথেষ্ট চিৎকার হয়েছে। তুমি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানো। ইতোমধ্যে ভোর হবে। আমরা নামব।
দলের ভালোমন্দ আমি দেখব না?
তোমাকে কিছু দেখতে হবে না। অনেক দেখেছ।
রানা রাগ করে ট্রেন থেকে নেমে গেল। নামার সময় নইমার পা মাড়িয়ে দিয়ে গেল। ব্যাপারটা অনিচ্ছাকৃত। কিন্তু নইমার ধারণা, রানা এই কাজটা ইচ্ছা করেই করেছে। নইমা অল্পতেই কাতর হয়। পায়ের ব্যথায় সে কাতরাচ্ছে। নীরা বলল, তুই এমনভাবে চিৎকার করছিস, তাতে মনে হচ্ছে হাঁটুর নিচ থেকে তোর পা খুলে পড়ে গেছে।
ব্যথা পেলে চিৎকার করব না?
এমন কিছু ব্যথা পাস নি যে ট্রেনের সব মানুষকে সেটা জানাতে হবে।
খামাখা ঝগড়া করছিস কেন? পায়ের চামড়া খুলে গেছে—আর…
তোর এত নরম চামড়ার পা তুই ফেলে ছড়িয়ে বসে আছিস কেন? কোলে নিয়ে বসে থাকলেই হতো।
নইমা কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়াল। পায়ে স্যান্ডেল পরল। আনুশকা বলল, যাচ্ছিস কোথায়? নইমা বলল, দ্যাটস নান অব ইয়োর বিজনেস।
নইমা ট্রেন থেকে নেমে গেল। সে হাঁটতে শুরু করেছে ওভারব্রিজের দিকে।
জরীর খুব ভালো ঘুম হয়েছে। এসি দেয়া স্লিপিং বার্থের ব্যবস্থা ভালো। শুধু কামরাটা বেশি ঠাণ্ডা। কামরার অ্যাটেনডেন্ট বালিশ এবং কম্বল দিয়েছে। একা একটা কামরার দরজা বন্ধ করে ঘুমানোর আলাদা আনন্দ আছে। জরী অনেক দিন পর খুব আরাম করে ঘুমুল। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখল—সেইসব স্বপ্নও আনন্দময় স্বপ্ন। ভয়ংকর কোনো দুঃস্বপ্ন নয়।
এখন ট্রেন থেমে আছে। চিটাগাং এসে গেছে এটা সে বুঝতে পারছে। তার পরেও বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। জীবনের আনন্দময় সময়ের একটি হচ্ছে ঘুম-ঘুম ভাব নিয়ে শুয়ে থাকা।
দুবার টোকা পড়ল দরজায়। জরী বলল, কে?
আমি। আমি শুভ্ৰ। আমরা এসে গেছি।
জরী পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, ও, আচ্ছা।
শুভ্র বলল, এখন আমরা নামব।
জরী হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি আরো খানিকক্ষণ শুয়ে থাকতে চাই শুভ্ৰ। এই ধরো, পাঁচ মিনিট।
তোমার গায়ে কি জ্বর আছে?
বুঝতে পারছি না। মনে হয় আছে। শুভ্ৰ, তুমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে না। তুমি নেমে যাও। আমি নিজে নিজেই নামব।
আচ্ছা। রাতে তোমার কি ভালো ঘুম হয়েছে?
খুব ভালো ঘুম হয়েছে।
রানার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। মাথায় রক্ত ওঠার মতো অনেকগুলি কারণের একটি হচ্ছে নইম ট্রেন থেকে নেমে কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ওভারব্রিজে উঠে গেছে। রানার একবার ইচ্ছা করছিল, ডেকে জিজ্ঞেস করে—যাচ্ছ কোথায়? শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে নি। কী দরকার? যাক যেখানে ইচ্ছা। তার দায়িত্ব কী? সে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে গেলে সবাই রেগে যায়। কী দরকার সবাইকে রাগিয়ে? হু কেয়ারস? গো টু হেল।
রানা খানিকক্ষণ নির্বিকার থাকতে চেষ্টা করেছে। শেষটায় রওনা হয়েছে খোঁজ নিতে। ওদের ভালো লাগুক বা না লাগুক, খোঁজ তো রাখতেই হবে। রানা পুরো স্টেশন খুঁজে এলো। নইমা নেই। কোনো মানে হয়? জলজ্যান্ত একটা মেয়ে তো। হারিয়ে যেতে পারে না বা বাতাসেও মিলিয়ে যেতে পারে না। হয়েছেটা কী? আনুশকাকে ঘটনাটা জানানো দরকার। সে শুনে হয়তো এমন কিছু বলবে, যাতে আবার মাথায় রক্ত উঠে যাবে।
কিছু বলবে?
নইমা কোথায়?
প্ল্যাটফর্মে নেমেছে।
আমি তো কোথাও দেখলাম না।
আনুশকা হাই তুলতে, আছে কোথাও। ব্যস্ত হবার কিছু নেই।
একটা মেয়ের কোনো ট্রেস নেই আর আমি ব্যস্ত হব না?
ট্রেস থাকবে না কেন? ট্রেস ঠিকই আছে। তুমি খুঁজে পাচ্ছ না।
রানা রাগ সামলাতে একটু দূরে সরে গেল। সিগারেট ধরাল। আর তখন দুজন পুলিশকে এগিয়ে আসতে দেখল। তাদের সঙ্গে সাদা পোশাকের একজন। সেও যে পুলিশের তা বোঝা যাচ্ছে। তারা থমকে দাঁড়াল। সাদা পোশাক পরা লোকটি এগিয়ে এলো।
আপনি কি ঢাকা থেকে আসছেন?
জি।
কয়েকজনের একটা পিকনিক পার্টি?
জি।
চারটি মেয়ে আছে আপনাদের দলে?
ওদের একজনের নাম জরী?
জি।
আপনাদের সবাইকে থানায় যেতে হবে।
কী বললেন?
আপনাদের থানায় যেতে হবে।
কেন?
ঢাকা থেকে ম্যাসেজ এসেছে, আপনারা মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রীকে জোর করে ধরে নিয়ে চলে এসেছেন।
কী বলছেন এসব!
আমাদের কাছে ইনফরমেশন যা আছে তাই বলছি।
রানার হাতের সিগারেট নিভে গেছে। সে নেভা সিগারেটই টানছে। তার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। এ কী সমস্যা! এই সমস্যায় উদ্ধারের পথ কী? পুলিশের সঙ্গে প্রতিটি কথা মেপে বলতে হয়। বিচার-বিবেচনা করে বলতে হয়। মাথায় কোনো বুদ্ধি, কোনো বিচার-বিবেচনা আসছে না। বরং হঠাৎ করে প্রচণ্ড বাথরুম পেয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, এই মুহুর্তে বাথরুমে ছুটে না গেলে সমস্যা হয়ে যাবে। প্যান্ট ভিজে কেলেঙ্কারি হবে। রানা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, স্যার, আপনারা ঠিক বলছেন?