Site icon BnBoi.Com

রূপার পালঙ্ক – হুমায়ূন আহমেদ

রূপার পালঙ্ক - হুমায়ূন আহমেদ

আয়নায় নিজেকে দেখে

আয়নায় নিজেকে দেখে ছেলেরা সাধারণত মুগ্ধ হয় না। অতি বুদ্ধিমান ছেলেকেও আয়নায় খানিকটা বোকা বোকা লাগে। কিন্তু মোবারক মুগ্ধ। তার মনে হচ্ছে সে নিজেকে দেখছে না, অন্য কাউকে দেখছে। তার কোনো জমজ ভাইকে। যে ভাই কলেজে অধ্যাপনা করেন। এবং যে ভাই-এর কলাবাগান টাইপ জায়গায় একটা বাড়ি আছে। বাড়ির সামনে বাগান আছে। যে ভাই তার স্ত্রী দুই ছেলেমেয়েসহ বাগানে বসে বিকালে চা খায়। চায়ের সঙ্গে হালকা নাশতা থাকে। কোনোদিন নিমকি, কোনোদিন সমুচা।

চুল আচড়ানোই ছিল, তারপরেও মোবারক আচড়ানো চুলের উপরই কয়েকবার চিরুনী চালালো। চুলের স্টাইলটা অন্যরকম করবে কি-না ভাবল। শেষে মনে হল অন্যরকম করা ঠিক হবে না। হঠাৎ করে নতুন স্টাইলে চুল বসবে না। খাড়া খাড়া হয়ে থাকবে। যা আছে তাই ভাল। শুধু ভাল না–বেশ ভাল, যাকে বলে উত্তম।

নিজেকে উত্তম করার জন্যে মোবারককে বেশ কিছু জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে— ভোর সাতটায় গোসল। শীতের শুরুতে সকালবেলা গোসল কঠিন আজাবের একটি। সেই আজাবকে সহনীয় করার জন্যে মেসের বয় মনু মিয়াকে দুটা টাকা দিয়েছিল। কথা ছিল, দুটাকার বিনিময়ে মনু মিয়া এক কেতলি টকটকে গরম পানি বালতিতে ছেড়ে দেবে। মনু মিয়া দাঁত বের করে বলেছে, চিন্তা নাই দুই কেতলি পানি ছাড়তাছি। বলক তুলা পানি। শইল্যে ফুসকা পইড়া যাইব।

মোবারক সেই পানি মাথায় ঢেলে শিউরে উঠল। হিমালয়ের বরফগোলা পানি। মনু এক ফোঁটা গরম পানিও দেয় নি। হারামজাদাটাকে এই পানিতে চুবিয়ে দিতে পারলে মন শান্ত হত। মোবারককে বরফগোলা পানি দিয়ে গোসল সারতে হল। এক প্যাকেট লেমন শ্যাম্পু কিনেছিল। প্যাকেটে চা চামুচের এক চামুচের বেশি শ্যাম্পু হবে না। তার দামই নিল চার টাকা। শ্যাম্পু দুই নম্বরী কি-না কে জানে। মাথায় ফেনা হচ্ছে না, চোখ জ্বালাপোড়া করছে। এই শ্যাম্পু দেয়ার কারণে মাথায় আরো আধাবালতি বরফ-পানি বেশি ঢালতে হল। ভদ্র সাজার এ-কী যন্ত্রণা!

মোবারকের গায়ে ইস্ত্রী করা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ডান হাতায় পানের পিকের দাগ আছে। লাল দাগ ছিল। ধোপাখানায় পাঠানোর পর লাল দাগ হলুদ হয়েছে, এবং আরো কড়া হয়েছে। হারামজাদা ধোপার পাছায় একটা লাথি মারতে পারলে ভাল হত। ভাগ্য ভাল দাগটা এমন জায়গায় যে চট করে চোখে পড়ে না। পায়জামা ছিল না বলে প্যান্টের উপর পাঞ্জাবি পরতে হয়েছে। সেই প্যান্টও সে গতকালই ইস্ত্রী করে আনিয়েছে। সবই ভাল, শুধু স্যান্ডেলজোড়া ইজ্জত মেরে দিয়েছে। স্যান্ডেলের দিকে তাকানো যায় না। মোটরগাড়ির টায়ার দিয়ে হাফসোল করোনোটা বোকামি হয়েছে। দেখেই মনে হয় ফকিরের স্যান্ডেল। ভিক্ষার জন্যে প্রচুর হাঁটাহাঁটি করতে হবে— এটা মাথায় রেখে বানানো।

একটাই ভরসা— বড়লোকরা সাধারণত পায়ের দিকে তাকায় না। এটা অবশ্যি সাধারণ বড়লোকের কথা। অতি অতি বড়লোকরা কী করে মোবারক জানে না। আজ হয়ত জানবে। একজন অতি অতি বড়লোকের কাছে যাবার জন্যেই সকাল থেকে এই কষ্ট। শ্যাম্পুর চোখ জ্বলুনি এখনো যায় নি।

বড়লোকদের কাছে ভাল সাজ পোশাকে যেতে হয়। সাধারণ প্রচলিত ধারণা— মলিন পোশাকে উপস্থিত হলে করুণা পাওয়া যায়। মোবারক নিশ্চিতভাবে জানে ধারণা ভুল। ময়লা পোশাকে লেবেনডিস সেজে গেলে বড়লোকরা নাক কুঁচকে তাকান। ভাবটা এরকম যেন পোশাক থেকে মুরগির গুয়ের গন্ধ আসছে। এই দুর্গন্ধের হাত থেকে বাঁচার জন্যে কথাবার্তা দ্রুত শেষ করে হাতটা এমনভাবে নাড়ান যেন মুরগি তাড়াচ্ছেন। মুরগি হবার দরকার কী? একটু না হয় ঝামেলা করে ফিটফাট হওয়া গেল। তবে শ্যাম্পুটা না দিলেও হত। চোখ শুধু যে জ্বালা করছে তাই না, একটু লাল লালও হয়েছে। তার মত মানুষের লাল চোখ মানায় না। লাল চোখ মানায় শুধু মেথরদের আর অতি অতি বড়লোকদের। তাদের জন্মই হয়েছে চোখ লাল করে রাখার জন্যে।

আজ সকাল সাড়ে নটায় মোবারকের এ্যাপয়েন্টমেন্ট। দেখা হবে মুখোমুখি। এই মুখোমুখি দেখা হবার জন্যে ঝামেলা কম করতে হয় নি। টেলিফোন করতে হয়েছে পাঁচবার। যে ফার্মেসী থেকে সে টেলিফোন করে, তারা একটা কলের জন্যে পাঁচ টাকা করে নেয়। যাকে বলে দুপুরে ডাকাতি। পাঁচটা কলে পঁচিশ টাকা চলে গেল। পঁচিশ টাকা কোনো খেলা কথা না। পঁচিশ টাকায় তিনবেলা খাওয়া হয়ে যায়। টেলিফোন করাও কোনো সহজ ব্যাপার না। সব সময় সাবধান থাকা। বেফাস কিছু যদি মোবারক বলে ফেলে তাহলে সব কেঁচে যাবে। বাণিজ্যের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এক ঝাকিতে সব শেষ। প্রথম টেলিফোনটা একটা বাচ্চা মেয়ে ধরল। মিষ্টি গলা। অতি ভদ্র ব্যবহার। আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?

মোবারক থতমত খেয়ে বলল, আমার নাম মোবারক। মোবারক হোসেন।

আপনি কার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন?

মোবারক পড়ে গেল বিপদে। আসলেইতো সে কার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে? শুরুতেই দেখি সব কেচে যাচ্ছে। মোবারক হড়বড় করে বলল,

পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেখে টেলিফোন করছি।

ও আচ্ছা। আপনাকে ম্যানেজার চাচুর সঙ্গে কথা বলতে হবে।

ম্যানেজার সাহেব কি আছেন?

জ্বি আছেন। ডেকে দেব?

আচ্ছা দাও। তবে তোমার সঙ্গে একটু কথা বলে নেই। তোমার নাম কী?

আমার নাম আয়না।

বাহ্ কী সুন্দর নাম আয়না। কোন ক্লাসে পড়?

কেজি ওয়ান।

আমার নাম মোবারক ঈদ মোবারকের মোবারক। খুকি এখন তুমি ম্যানেজার সাহেবকে ডেকে দাও।

আপনি টেলিফোন ধরে থাকুন। আমি ডাকছি।

মোবারক ধরে থাকল। খুবই কায়দার টেলিফোন। নানান রকম বাজনা বাজছে। একটা শেষ হয়তো আরেকটা শুরু হয়। ম্যানেজার চাচু এসে আর টেলিফোন ধরেন না। এক সময় ধরলেন এবং ম্যানেজার টাইপ লোকদের স্বভাব মত গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, কে?শব্দটা মওলানা সাহেবদের কাফ উচ্চারণের মত। নাভি থেকে আসছে।

মোবারক নরম স্বরে বলল, স্যার আমার নাম মোবারক হোসেন। পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেখে টেলিফোন করছি। বিজ্ঞাপনটা গতকালের দুটা দৈনিক পত্রিকায়…

মোবারকের কথা শেষ করতে না দিয়েই ম্যানেজার বললেন, আপনি ইন্টারেস্টেড পার্টি?

জ্বি স্যার।

বয়স কত?

স্যার, পয়ত্রিশ। থার্টি ফাইভ ক্রস করেছে।

এটা মোবারকের আসল বয়স না। সে পাঁচ বছরের মত কমিয়েছে। কেন কমিয়েছে নিজেও জানে না।

এখন আমি ব্যস্ত আছি, কথা বলতে পারছি না। আমি কি স্যার কিছুক্ষণ পরে করব?

এক ঘণ্টা পরে করুন। তবে এই নাম্বারে না— আমি নাম্বার দিচ্ছি। কাগজ কলম আছে?

আপনি বলুন। আমার স্মৃতিশক্তি ভাল। মনে থাকবে।

ম্যানেজার সাহেব নাম্বার বলেই খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। ভাবটা যেন তিনি মহাব্যস্ত। নিঃশ্বাস ফেলার সময়ও নাই।

এরপর থেকে শুরু হল ঝামেলা— মোবারক যতবারই টেলিফোন করে বুড়ো মানুষের মত গলায় কে একজন বলে, ম্যানেজার সাহেব মিটিং-এ আছেন। পরে করেন। মোবারকের মেজাজ পুরো খারাপ হয়ে গেল। আরে তুই ব্যাটা ম্যানেজার, তোর এত কী মিটিং। তুই কি মন্ত্রী না-কি যে ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে মিটিং শুরু করবি। রাত বারটার সময় মিটিং শেষ করে ঘুমুতে যাবি। ঘুমের মধ্যেও স্বপ্ন দেখবি মিটিং করছিস। তুই হচ্ছিস চার পয়সা দামের ম্যানেজার।

যাই হোক ম্যানেজার সাহেব এক সময় টেলিফোন ধরলেন। ধমকের স্বরে বললেন, কে? আবারো সেই কাফ মার্কা কে?

মোবারক বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, স্যার আমার নাম মোবারক। মোবারক হোসেন। সকালে আপনার সঙ্গে কথা বলেছি।

সকাল থেকেতো অনেকের সঙ্গেই কথা বলছি। আপনার ব্যাপারটা কী বলুন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে টেলিফোন করছেন?

জ্বি স্যার।

আপনি কি ইন্টারেস্টেড পার্টি?

জ্বি স্যার।

আপনার বয়স কত?

পয়ত্রিশ।

আপনি এক কাজ করুন, বুধবার সকাল সাড়ে নটায় চলে আসুন। মুখোমুখি কথা হওয়া দরকার।

কোথায় আসব?

সঙ্গে কাগজ কলম আছে? ঠিকানা বলছি, লিখে নিন। কাঁটায় কাঁটায় সকাল সাড়ে নটায় চলে আসবেন। ইন্টারেস্টেড পার্টিতো আপনি একা না। আরো অনেকেই আছে। স্যার সরাসরি কথা বলবেন।

ম্যানেজার সাহেবের এই কথায় মোবারক খুবই দমে গেল। ইন্টারেস্টেড পার্টি আরো আছে মানে কী? তার ধারণা ছিল সে-ই একমাত্র ইন্টারেস্টেড পার্টি। যেহেতু সে একা, তার সুযোগ থাকবে জায়গা মত মোচড় দিয়ে দাম বাড়াতে। এখন দেখা যাচ্ছে এখানেও ইন্টারেস্টেড পার্টি। দেশটা যাচ্ছে কোথায়?

কিডনীর মত একটা জিনিস বিক্রি করতে লোকজন হামলে পড়বে এটা কী করে হয়? তোর শরীরে আছেই দুটা কিডনী। একটা বিক্রি করে দিলি, বাকিটা যদি নষ্ট হয়ে যায়– তুই যাবি কোথায়? তুইতো আর পয়সা দিয়ে এই জিনিস কিনতে পারবি না।

মোবারক স্পষ্ট কল্পনায় দেখল বুধবার সকাল সাড়ে নটা। একটা হলঘরের মত ঘরে সে বসে আছে। তার সঙ্গে মেয়ে পুরুষ মিলিয়ে আরো ত্রিশজনের মত আছে। সবার হাতে নম্বর ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। নম্বর অনুসারে ডাক পড়ছে। চাকরির ইন্টারভর মত ইন্টারভু হচ্ছে। কারো ইন্টারভু ভাল হয়েছে। সে বের হয়ে এসেছে হাসি মুখে। সবাই তাকে ঘেঁকে ধরেছে। সবার প্রশ্ন কী জিজ্ঞেস করল? কী জিজ্ঞেস করল? আবার কারো ইন্টারভু খুব খারাপ হয়েছে, বের হয়ে এসেছে কাঁদো কাঁদো মুখে। সে শুকনো গলায় বলল, ইজি ইজি কোশ্চেন জিজ্ঞেস করেছে। উত্তরও জানা ছিল, বলতে পারি নি। উত্তরটা মাথায় ছিল। মুখে আসে নি।

কী ধরনের প্রশ্ন হতে পারে? জেনারেল নলেজের দু একটা প্রশ্নতো থাকবেই।

পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব কত?

কোন তারিখে চাঁদে মানুষ প্রথম নামে?

বর্তমান পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য কী কী?

বিজ্ঞানের উপরও কিছু প্রশ্ন থাকবে। যুগটাই বিজ্ঞানের। সেই বিজ্ঞানের উপর প্রশ্ন না থাকলে হবে কীভাবে?

পেনিসিলিন কে আবিষ্কার করেন?

ফাউন্টেন পেন এবং বল পয়েন্টের মধ্যে তফাৎ কী?

লুই পাস্তুর কোন দেশের নাগরিক?

কিছু থাকবে পলিটিক্যাল প্রশ্ন।

কোল্ড ওয়ার কী?

তৃতীয় বিশ্ব মানে কী?

ইটালীর প্রেসিডেন্টের নাম কী?

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন?

এটা একটা ট্রিকি প্রশ্ন। বোর্ডের চেয়ারম্যান আওয়ামী-পন্থী না বিএনপি-পন্থী তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আওয়ামীপন্থী হলে সঙ্গে সঙ্গে বুক ফুলিয়ে বলতে হবে— জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বিএনপি-পন্থী হলে বলতে হবে মেজর জিয়া।

বোর্ডে একজন ডাক্তারও নিশ্চয়ই থাকবেন। ডাক্তার পেট টিপেটুপে দেখবেন মাল ঠিক আছে কি-না। পেট কেটে দেখতে চাইলেও অনেকে হয়ত আপত্তি করবে না। কাস্টমার জিনিস কিনবে না দেখে কেন কিনবে? দেখে শুনে কিনবে। সাইজ পছন্দ করবে, রঙ পছন্দ করবে।

 

মেস থেকে বেরুবার মুখে মনু মিয়ার সঙ্গে দেখা। কোকের বোতল ভর্তি গরম চা নিয়ে কোনো বোর্ডারের ঘরে যাচ্ছে। হারামজাদার সাহস কত বড় তার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে আছে। মনে হয় হাসছে। হারামজাদাটাকে লাথি দিয়ে কোকের বোতলসহ মেঝেতে ফেলে দেয়া উচিত। মোবারক তা করল না। শুভ কাজে যাচ্ছে, এ সময় মারামারি করা ঠিক না। গলা নামিয়ে বলল, সামনের দরজা দিয়া যাইয়েন না। বাবু আছে।

বাবু মানে পরিমল সাহা। মেসের মালিকের শালা। এবং মেসের ম্যানেজার। মোবারকের ছয়মাসের মেস ভাড়া বাকি। পরিমল বাবু তাকে দেখলে বাঘের মত ঝাপ দিয়ে পড়বেন। এই সুযোগ তাকে দেয়া ঠিক হবে না। মোবারক পেছন দরজা দিয়ে বের হল এবং তাকে যথা সময়ে সাবধান করে দেবার জন্যে মনু মিয়ার ঠাণ্ডা পানি বিষয়ক অপরাধ প্রায় ক্ষমা করে দিল।

অতি বিস্ময়কর ব্যাপার হল মোবারক দেখল ইন্টারেস্টেড পার্টিতে ঘর ভর্তি না। সে একা। যে ঘরে তাকে বসানো হয়েছে সেই ঘরও হলঘর না। ছোট ঘর। তবে বসার ঘর। সোফা আছে, মেঝেতে কার্পেট আছে, দেয়ালে পেইনটিং আছে। বড়লোকদের বসার ঘর একটা থাকে না। কয়েকটা থাকে। তাদের কাছে নানান ধরনের লোক আসে। সবাইকে এক জায়গায় বসানো হয়। না। অবস্থা বুঝে বসার ব্যবস্থা হয়।

ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে মোবারকের কথা হয়েছে। টেলিফোনে তাঁকে যেমন গম্ভীর এবং রাগী মনে হয়েছিল বাস্তবে তাঁকে মিনমিনেটাইপ মনে হল। চেহারা, চলাফেরা এবং কথাবার্তায় লজ্জিত ভঙ্গি। একটু তোতলামী আছে। মনে হয় টেলিফোন হাতে পেলে উনি বদলে যান। বন্দুক হাতে পেলে মানুষ যেমন বদলে যায়, উনিও বোধহয় টেলিফোন হাতে পেলে বদলান। ম্যানেজার সাহেবের নাম জগলু। নাম বগলু হলে ভাল হত। লম্বা বলে তাঁর মধ্যে বগা বগা ভাব আছে। জগলু সাহেবের সঙ্গে মোবারকের কিছু কথা হল।

আপনি মোবারক সাহেব?

জ্বি স্যার।

আপনি কী করেন?

কিছু করি না।

একেবারেই কিছু করেন না তা কী করে হয়? আগে কী করতেন?

শিক্ষকতা করতাম।

কথাটা পুরোপুরি ভুল না। এনজিও-ওয়ালাদের এক স্কুলে মোবারক সর্বমোট এগারো দিন পড়িয়েছে। বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র। গোটা বিশেক থুড়থুড়ো বুড়ো-বুড়ি বই-খাতা নিয়ে বসা। তাদেরকে কিছুক্ষণ স্বরে অ, স্বরে আ করানো। বুড়োবুড়িরা যে শিক্ষার মহান আলোয় আলোকিত হতে এসেছে তাও না। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুবাদে তাদের নাম রেজিস্ট্রি হয়েছে। সবাই একটা করে ছাতা পেয়েছে। ছাতায় এনজিওর নাম। ছাতা ছাড়া মাঝে মধ্যে টুকটাক উপহারের ব্যবস্থা আছে। অক্ষরজ্ঞান শেষ হলে সবাই শাড়ি লুঙ্গি পাবে এরকম গুজব শোনা যাচ্ছে। এগারো দিন পড়ানোর পর মোবারক ঈ পর্যন্ত আগালো। কিন্তু দেখা গেল ছাত্রছাত্রীরা শুরুর স্বরে অ ভুলে গেছে। মোবারক এগারো দিনের দিন এনজিও-ওয়ালাদের তিনটা ছাতা নিয়ে সড়ে পড়লো। কাজেই সে শিক্ষকতা করেছে এটা বলা ভুল হয় নি। যে একদিন পড়িয়েছে সে শিক্ষক। সারা জীবনই শিক্ষক। আবার যে একদিন চুরি করেছে সে কিন্তু সারাজীবনই চোর না। তাহলে পৃথিবীর সব মানুষই চোর হত।

আপনি তাহলে শিক্ষকতা করতেন?

জ্বি স্যার।

এখন কিছু করেন না?

করলে কি কিডনী বিক্রি করতে আসতাম?

তা ঠিক। আপনি বসুন। চা-টা খান। স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। সামান্য দেরি হবে।

কিডনী কার জন্যে দরকার?

স্যারের জন্যে। উনার দুটা কিডনী নন ফাংশানাল হয়ে গেছে। ডায়ালাইসিস করে করে এতদিন চলেছে, এখন ডাক্তাররা কিডনী ট্রান্সপ্লান্টের কথা বলছেন। আত্মীয়-স্বজনরা অনেকেই ডোনেট করতে রাজি। কিন্তু স্যার তা চান না।

মোবারক হাসি মুখে বলল, আমরা থাকতে আত্মীয়-স্বজনরা কেন কষ্ট করবে? আমরা আছি কী জন্যে?

ম্যানেজার সাহেব কিছুক্ষণ সরু চোখে তাকিয়ে থেকে আগের মত মিনমিনে গলায় বললেন, আপনি অপেক্ষা করুন। আমি যথাসময়ে ডেকে নিয়ে যাব।

মোবারক বিনীত গলায় বলল, জ্বি আচ্ছা স্যার। একটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করি, এই ঘরে কি সিগারেট খাওয়া যায়?

হ্যাঁ খাওয়া যায়। ঐ যে এসট্রে।

স্যার অনেক ধন্যবাদ।

মোবারক সিগারেট ধরালো। বড় সাহেবের কাছে যাবার আগে হাত-মুখ ধুতে হবে। মুখ কুলকুচা করতে হবে। অসুস্থ মানুষরা দূর থেকে সিগারেটের গন্ধ পায়। তাদের মেজাজ খারাপ হয়। বড় সাহেবের মেজাজ খারাপ করা একেবারেই ঠিক হবে না।

মোবারক যে চেয়ারে বসেছে তার দুটা চেয়ারের পরের চেয়ারেই সুন্দর একটা উলের চাদর পড়ে আছে। চাদরের ওপর মারলবোরো সিগারেটের একটা প্যাকেট। মনে হছে তার মত কেউ একজন এখানে বসেছিল। সে-ও কিডনী বেচতে এসেছে। বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছে। তবে যে এমন দামি চাদর গায়ে দেয় এবং মারলবোরো সিগারেট খায় সে কিডনী বেচবে কেন? তার উচিত দুএকটা কিডনী কিনে ফ্রীজে রেখে দেয়া। প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। প্রয়োজন না হলে কালোবাজারে বেচে দেবে।

ব্যস্ত ভঙ্গিতে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। রাজপুত্র রাজপুত্র চেহারা। হাতে তলোয়ারের বদলে লম্বা স্কেল। কমপ্লিট স্যুট পরা। গলায় লাল টাই। জুতাজোড়াও সম্ভবত নতুন হাটলেই মুড়ি খাওয়ার মত মচমচ শব্দ হচ্ছে। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই মোবারককে বললেন, আচ্ছা আনিস সাহেব কি চলে গেছেন?

মোবারক বিনীত ভঙ্গিতে বলল, জ্বি স্যার চলে গেলেন।

যদিও আনিস সাহেব কে মোবারক কিছুই জানে না। এ বাড়ির একজনকেই সে চেনে। ম্যানেজার জগলু।

কখন গেছেন বলতে পারেন?

এগজাক্ট টাইম বলতে পারব না। দশ এগারো মিনিট হবে। কমও হতে পারে।

আনিস সাহেবের সঙ্গে কি কোনো ফাইলপত্র ছিল?

স্যার আমি লক্ষ করিনি।

আপনার অবশ্য লক্ষ করার কথাও না। থ্যাংকস এনিওয়ে।

ভদ্রলোক যেমন ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঢুকেছিলেন তারচেয়েও ব্যস্ততার সঙ্গে চলে গেলেন। মিথ্যা কথাগুলি বলার জন্যে মোবারক তেমন দুশ্চিন্তা করছে না। এই নিয়ে পরে যদি প্রশ্ন করা হয় সে বলবে, সে আসলে বুঝতে পারে নি। সে ভেবেছে ভদ্রলোক ম্যানেজার সাহেবের কথা জানতে চেয়েছেন। ম্যানেজার জগলু সাহেব এই ঘরে কিছুক্ষণ ছিলেন, তারপর চলে গেছেন। এই অংশতো মিথ্যা না। পুরোপুরি সত্যি কথা বলা ঠিকও না। সোনার মধ্যে যেমন খাদ মিশাতে হয়। সত্যি কথার মধ্যেও সামান্য মিথ্যা মিশাতে হয়।

মোবারক চেয়ার বদলে পাশের চেয়ারে গেল। এই চেয়ার থেকে হাত বাড়িয়ে মারলবোরোর প্যাকেটটা নেয়া যায়। প্যাকেট খুলে দেখা যেতে পারে মোট কটা সিগারেট আছে। প্যাকেট ভর্তি থাকলে কিছু করার নেই। আধাআধি থাকলে একটা সিগারেট খাওয়া যেতে পারে। সিগারেটের মালিক যদি চলেও আসে তাকে বলা যাবে, ভাই একটা সিগারেট নিয়েছি। কিছু মনে করবেন না।

তেরটা সিগারেট আছে। মোবারক একটা সিগারেট ধরালো। ম্যানেজার চায়ের কথা বলে গিয়েছিলেন। সেই চা এখনো আসে নি। বিদেশী সিগারেট চায়ের সঙ্গে খেতে পারলে আরাম হত। উপায় কী? মোবারক হাত বাড়িয়ে উলের শালটা পরীক্ষা করল। হাত দিলেই বোঝা যায় দামি জিনিস। এক চাদরে মাঘ মাসের শীত পার করে দেয়া যাবে। শালের নিচে গেঞ্জি বা শার্ট কিছু না থাকলেও সমস্যা হবে না। শালের মালিককে পেলে জিজ্ঞেস করা যেত শালটার দাম কত।

মোবারক সাহেব।

ম্যানেজার জগলু এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। এই মিনমিনে লোক হাঁটেও বিড়ালের মত। টেলিফোনে হাঁটার ব্যবস্থা থাকলে বুট পরে ধপ ধপ শব্দ করে হাঁটতো।

আসুন স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন।

 

মোবারক ভেবেছিল স্যার এক বিরাট পালংকে শুয়ে আছেন। তাকে ঘিরে সেবা করার লোকজন। পাশের টেবিল ভর্তি ফলমুল। দুজন নার্স এবং একজন ডাক্তার একটু দূরে শুকনো মুখে হাঁটাহাঁটি করছে। স্যার ঠিকমত নিঃশ্বাসও নিতে পারছেন না। কাতলা মাছ পুকুর থেকে তোলার পর যেভাবে থেমে থেমে দম নেয় সেভাবে দম নিচ্ছেন। এই সময়ে তাঁর প্রিয়তমা পত্নী কপালে ভেজা রুমাল ঘসে দিচ্ছেন।

দেখা গেল সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি। অফিস ঘরের মত ঘর। স্যার বসে আছেন চেয়ারে। তার সামনে প্রচুর ফাইলপত্র। তিনি ফাইলপত্রে সিগনেচার করছেন। তার ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট। তিনি সিগারেট হাতে নিয়ে টানছেন না। ঠোঁটে রেখেই টানছেন। ঠোঁটে রেখেই অদ্ভুত কায়দায়, একটু মাথা ঝুঁকিয়ে ছাই ফেলছেন। কায়দাটা ইন্টারেস্টিং। শিখে রাখতে হবে। তাহলে সিগারেট খাবার সময় দুটা হাত খালি রাখা যায়। স্যারের গায়ে সিল্কের শার্ট। সুন্দর মেরুন রঙ। তবে তিনি লুঙ্গি পরে আছেন। প্রিয়তমা পত্নীর মুখ বিষাদময়।

স্যার সিগনেচার বন্ধ রেখে টেবিলে রাখা সোনালি চশমা চোখে দিয়ে মোবারকের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি মোবারক?

মোবারক বলল, জ্বি।

বসুন।

মোবারক বসল।

আপনি এক সময় শিক্ষকতা করতেন?

জ্বি।

আমিও এক সময় শিক্ষকতা করতাম। একটা প্রাইভেট কলেজে তিন মাস পড়িয়েছি। তিন মাসে এক মাসের বেতন পেয়েছি। যাই হোক, আপনি কিডনী বিক্রি করতে চান কেন?

মোবারক বলল, টাকার জন্যে চাই স্যার। শখ করেতো আর কেউ কিডনী বিক্রি করে না।

আপনার টাকা দরকার?

জ্বি স্যার।

কত টাকা চাচ্ছেন?

আমার দরকার দুই লাখ টাকা।

আরো কিছু মানুষ এসেছে যারা আপনার মত কিডনী বিক্রি করতে চায়। তবে তারা চাচ্ছে পঞ্চাশ হাজার। আপনি এত চাচ্ছেন কেন? আপনার কিডনীর কোয়ালিটি কি ভাল?

খুব ভাল হবারতো কথা না। আপনারটা হল মেড ইন বাংলাদেশ। মেড ইন বাংলাদেশের জিনিস সাধারণত ভাল হয় না।

মোবারক চুপ করে রইল। ভদ্রলোক রসিকতা করছেন। রসিকতায় মজা পেয়ে তার হাসা উচিত কিনা সে বুঝতে পারছে না। বোকা সেজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা যায়। সেটাই মনে হয় ভাল হবে।

দুই লাখ টাকা দিয়ে কী করবেন?

একটা ব্যবসা করার ইচ্ছা।

কী ব্যবসা?

এখনো চিন্তা করি নাই। আগেভাগে চিন্তা করে তো কোনো লাভ নাই।

বিবাহ করেছেন?

জ্বি-না।

আচ্ছা ঠিক আছে। আপনার সঙ্গে আমার কথা শেষ হয়েছে। আপনাকে জগলু একজন ডাক্তারের ঠিকানা দেবে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ডাক্তার বোধহয় কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষা করবেন। তারপর তিনি যদি ok বলেন, তখন কিডনীর দরদাম নিয়ে আমরা বসব।

জ্বি আচ্ছা।

থাকেন কোথায়?

একটা মেসে থাকি?

দেশের বাড়ি কোথায়?

নেত্রকোনা।

আপনাদের নেত্রকোনায় বিশেষ এক ধরনের মিস্টি পাওয়া যায়। মিষ্টিটার নাম বালিশ। বালিশ মিষ্টি কখনো খেয়েছেন?

জ্বি স্যার।

খেতে কেমন?

চমচমের মত।

এখন আপনি যেতে পারেন।

মোবারক উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনাকে একটা কথা বলব স্যার?

বলুন।

আপনাকে দেখে মোটেই অসুস্থ মনে হচ্ছে না।

আমিতো অসুস্থ না। শরীরের একটা যন্ত্র কাজ করছে না। এটাকে অসুখ বলা ঠিক না।

স্যার যাই। স্লামালিকুম।

ওয়ালাইকুম সালাম।

স্যার আবার সিগনেচারে মন দিলেন। মানুষটার বয়স পঞ্চাশ। দেখে অনেক কম লাগছে। কিডনী নষ্ট হয়ে গেলে চেহারা সুন্দর হয় কি-না কে জানে। ভদ্রলোককে সুন্দর লাগছে। চোখে মুখে গোলাপী আভা। দীর্ঘদিন ভাল ভাল খাবার খেলেও হয়ত চোখে মুখে গোলাপী আভা আসে।

 

আবার পুরনো জায়গায় ফিরে আসা। ম্যানেজার সাহেব না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা। পাশের চেয়ারে চাদর এবং সিগারেট আগের মতই আছে। আশ্চর্য! মালিক কোথায়? বারোটা সিগারেট থেকে আরেকটা কমলে তেমন ক্ষতি কী হবে?

মোবারক একটা সিগারেট ধরালো। একটা পকেটে রেখে দিল। রাজপ্রাসাদ থেকে বের হয়ে একটা ধরাতে হবে। ভাল সিগারেটের সত্যিকার স্বাদ তখন পাওয়া যাবে।

ম্যানেজার সাহেব আসতে দেরি করছেন। টেবিলে বেশ কিছু ম্যাগাজিন আছে। যে-কোনো একটা হাতে নিলে ধর্ষণের কোনো সচিত্র প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। সময় কাটানোর জন্যে খুন এবং ধর্ষণ বিবরণের তুলনা হয় না। মোবারকের ম্যাগাজিন পড়তে ইচ্ছা করছে না। সে চাদরটা হাতে নিয়ে সুন্দর করে ভাজ করে সামনে রাখল। ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে কথা শেষ করে উঠে যাবার সময় খুব সহজ ভঙ্গিতে চাদরটা নিয়ে উঠে যাওয়া যাবে। যেতে হবে ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে গল্প করতে করতে। তখন কেউ যদি কিছু বলে, তাহলে অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে বলতে হবে— কী সর্বনাশ, কার চাদর আমি নিয়ে যাচ্ছি। এই দীর্ঘ সময়ে কেউ যখন চাদরটার খোঁজ করেনি তখন আশা করা যায় যে শেষ পাঁচ মিনিটও কেউ খোঁজ করবে না। বাকিটা কপাল।

ম্যানেজার সাহেব ঢুকলেন। হাতে একটা কাগজ। কাগজে ডাক্তার সাহেবের ঠিকানা লেখা। ম্যানেজার সাহেব পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ডাক্তার সাহেবকে সব জানানো আছে। আপনি উনার কাছে কার্ডটা শুধু দেবেন। নিন কার্ডটা রাখুন। হারাবেন না।

মোবারক বলল, জ্বি আচ্ছা।

ম্যানেজার সাহেব গলা নিচু করে বললেন, আপনাকে একটা ভাল পরামর্শ দেই। কিডনীর দাম নিয়ে দরাদরিতে যাবেন না। এটা স্যারের হাতে ছেড়ে দিলে আপনার লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না। বুঝতে পারছেন?

জ্বি পারছি।

স্যার যদি আপনার উপর খুশি হন, তাহলে বাকি জীবনের জন্যে আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন। কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট কোথায় হবে জানেন?

জ্বি-না।

সুইজারল্যান্ড। বিনা খরচায় সুইজারল্যান্ড দেখে চলে আসবেন।

পাসপোর্ট কি করিয়ে ফেলব?

আগে সব ঠিকঠাক হোক।

মোবারক বলল, আমার উপর একটু দোয়া রাখবেন ভাই সাহেব। যেন বাণিজ্যটা হয়।

ম্যানেজার সরু চোখে তাকান। মোবারকের বাণিজ্য কথাটা তার মনে হয় পছন্দ হল না।

মোবারক বলল, স্যার উঠি? বলতে বলতেই চাদর হাতে সহজ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। সিগারেটের প্যাকেট আগেই পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে। ম্যানেজার সাহেব কিছু বললেন না। চাদর নিয়ে লোকটা চলে যাচ্ছে এটা মনে হয় তার চোখে পড়ছে না।

হাঁটতে হবে স্বাভাবিক ভাবে। গল্পগুজবে ম্যানেজার সাহেবকে ভুলিয়ে রাখতে হবে। মোবারক বলল, আয়না কোথায় ম্যানেজার সাহেব।

জগলু ভুরু কুঁচকে বলল, আয়না কোথায় মানে কি?

আয়না নামের মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে।

আয়না নামে কেউ এ বাড়িতে নেই।

অবশ্যই আছে। আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। কেজি ওয়ানে পড়ে।

ম্যানেজার বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছে। তাকিয়ে থাকুক। মোবারক এগুচেচ্ছ। আর একটু গেলেই মুক্তি।

শেষ বাধা গেট। গেটের দারোয়ান কিছু জিজ্ঞেস না করলেই হয়। মনে হয় জিজ্ঞেস করবে না। দারোয়ান দুই জনেরই বয়স অল্প। অল্প বয়েসী দারোয়ানরা সন্দেহপ্রবণ হয় না। বুড়োগুলি হয়।

মোবারক কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই গেট পার হল। এখন কেউ গেট খুলে বের হয়ে আসবে এবং তার কাছে ছুটে এসে বলবে, আমার কাশ্মিরী শাল নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। কার্তিক মাসের শুরু, বাতাসে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব থাকলেও শাল গায়ে দেয়ার মত না। তাতে কী? মোবারক শাল গায়ে দিয়ে ফেলল। চৈত্র মাসেও কমপ্লিট স্যুট পরা লোক দেখা গেলে সেও শাল গায়ে দিতে পারে। জিনিসটা খুব তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দিতে হবে। বিক্রির আগে কিছুদিন ব্যবহার করা। অনেকটা ধোপর মত। ধোপার দোকানে শাড়ি ধুতে পাঠালে, ধোপার বউ সেই শাড়ি এক দুবেলা পরে। ধোপর বাড়িতে শাড়ি গেছে, ধোপার বউ সেই শাড়ি পরেনি এমন কখনো হয়

মাফলার পরার মত শীত পড়েনি

মাফলার পরার মত শীত পড়েনি, কিন্তু মোবারকের গলায় মাফলার। মাথায় পশমি টুপি। গায়ে উলের চাদর। পশমি টুপি এবং চাদরের কারণে তার চেহারা বদলে গেছে। আয়নায় সে তার নতুন চেহারা দেখেনি, না দেখলেও চেহারা যে বদলেছে এটা নিশ্চিত। চায়ের দোকানের মালিক কুদ্দুস মিয়া কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, কেডা মোবারক না?

মোবারক জবাব না দিয়ে হাই তুলল। পোশাক মানুষের আচার আচরণও বদলে দেয়। টুপি এবং উলের চাদর গায়ে দেয়ার পর থেকে মোবারকের অন্য রকম লাগছে। খাতির জমানো টাইপ কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। কুদ্দুস মিয়া তার বন্ধুস্থানীয় মানুষ। সে একটা প্রশ্ন করবে আর মোবারক জবাব দেবে না— এ রকম আগে কখনো হয়নি।

চা খাইবা মোবারক?

মোবারক এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। চায়ের স্টলে ঢুকলে। চায়ের স্টলের

কোনো নাম থাকে না, এর নাম আছে— মদিনা রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টের নামের সঙ্গে মিল রেখেই বোধ হয় কুদ্দুসের লেবাসেও ইসলামী ভাব আছে। পায়ের গোড়ালি স্পর্শ করে এ রকম তিনটা পাঞ্জাবী তার আছে। তার মুখ ভর্তি চাপ দাড়ি। মাথায় সব সময় কিস্তি টুপি। তার পাশ দিয়ে হাঁটলে আতরের গন্ধ পাওয়া যায়। তবে তার এই পোশাকের সঙ্গে ধর্মকর্মের সম্পর্ক নাই। নবীজী তাকে স্বপ্নে এ ধরনের পোষাক পরতে বলেছেন বলেই সে পরে। এর বেশি কিছু না। নবীজীর কথা শুনে এ ধরনের পোশাকে পরা শুরু করার পর থেকে নাকি তার ব্যবসার সুবিধা হয়েছে। তবে চা বিক্রি ছাড়াও তার অন্য ব্যবসা আছে। সেই ব্যবসা নবীজীর পছন্দ হবার কোন কারণ নেই।

মোবারকের মেজাজ সামান্য খারাপ। সে যে চেয়ারে বসে সেখানে একজন কাস্টমার বসে আছে। কাস্টমার যেভাবে চা খাচ্ছে তাতে মনে হয় চা শেষ করতে ঘণ্টাখানিক সময় লাগাবে। আরে ব্যাটা পিরিচে ঢেলে লম্বা টান দে। এক টানে ঝামেলা শেষ। তুই বিড়াল নাকি? বিড়ালের মত চুকচুক করে চা খাচ্ছিস। এক কাপ চা খেতে যদি এক ঘণ্টা লাগিয়ে দিস অন্য কাজ কখন করবি?

অত্যন্ত বিরক্ত মুখে মোবারক কাস্টমারের সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, ব্রাদার একটু সরে পাশের চেয়ারে বসেন।

কাস্টমার চায়ের কাপ নামিয়ে শান্ত গলায় বলল, কেন?

এই চেয়ারটায় আমি বসব।

খালি চেয়ার তো আরো আছে সেখানে বসেন।

অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কথা। চায়ের দোকান প্রায় ফাঁকা। যে-কোনো জায়গায় বসা যায়। যে আরাম করে বসে চা খাচ্ছে তাকে সরিয়ে তার জায়গাতে বসতে হবে কেন? কাস্টমারের কথায় মোবারকের রাগ হবার কোনোই কারণ নেই। কিন্তু রাগ লাগছে। ইচ্ছা করছে হারামজাদাটার বিশেষ জায়গায় কোঁৎ করে একটা লাথি মারতে। দুটা বিচির যে কোনো একটায় লাগলেই খবর আছে। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে। মোবারক নিজেকে সামলালো। এইসব ঝামেলায় একা যাওয়া ঠিক না। একা মানে বোকা। সে উদাস ভাব নিয়ে কাস্টমারের পাশে বসল।

পরিচিত চায়ের দোকান থাকার সুবিধা আছে। মুখে অর্ডার দিতে হয় না। ইশারায় কাজ হয়। অনেক সময় ইশারাও লাগে না। বয় বাবুর্চি, কাস্টমার দেখলেই বুঝে কার কী লাগবে।

চায়ের স্টলের বয় বটু মোবারকের সামনে কাচের গ্লাসে এক গ্লাস মালাই চা রেখে চলে যাচ্ছিল। মোবারক কঠিন গলায় বলল, এই বটু শুনে যা।

বটু থমকে দাড়াল। মোবারক বলল, ইটা মাইরা গ্লাস ফেললি। আদব কায়দা জানস না? চড় দিয়া চাপার দুইটা দাঁত ফেইল্যা দেই। বজ্জাতের বাচ্চা বজ্জাত। বেয়াদবি সবের সাথে করা যায় না। ক্ষেত্রবিশেষে করা যায়।

বটু চায়ের গ্লাসটা খপ করে নামিয়ে রেখেছে ঠিকই কিন্তু তার জন্য এতটা রাগ করা যায় না। রাগটা মোবারক করেছে পাশের কাস্টমারকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। অনেকটা ঝিকে মেরে বউকে শিখানোর মত। শিক্ষাটা মনে হয় কাজে লেগেছে। পাশে বসে থাকা কাস্টমার তার দিকে তাকাচ্ছে। ব্যাটার চোখে ভয়। চুক-চুক চা খাওয়া বন্ধ করেছে।

মোবারক বটুকে বলল, এই চা নিয়ে যা, খাব না। মোবারক চাদরের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। সাধারণ সিগারেট না। বিদেশী সিগারেট— মারলবোরো। মোবারকের ইচ্ছা করছে সিগারেটের প্যাকেটটা কাস্টমারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মধুর গলায় বলে, ব্রাদার নেন একটা সিগারেট নেন।

কাজটা সে করেই ফেলত, তার আগেই চায়ের স্টলের মালিক কুদ্দুস মিয়া গলা খাকাড়ি দিল এবং চোখের ইশারায় তাকে ডাকল।

মোবারক বিরক্ত মুখে উঠে গেল। চোখের ইশারায় ডাকাডাকি এটাও তার পছন্দ না। এও এক ধরনের বেয়াদবি। মোবারক সব সহ্য করতে রাজি আছে, বেয়াদবি সহ্য করতে রাজি না।

কুদ্দুস গলা নিচু করে বলল, ঝামেলা কী?

মোবারক বলল, কোনো ঝামেলা নাই।

তোমার ডান পাশে যে বসছে তার সাথে কিছু হইছে?

না।

তারে চিনছ?

মোবারকের চোখ ছোট হয়ে গেল। কুদুসের গলা যেন কেমন কেমন। পাশের লোকটা কি বিশেষ কেউ? কুদ্দুস গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, সে হইল ছোট রফিক। কথাবার্তা, খুব সাবধান। খুবই সাবধান। তার সাথে বেয়াদবি কিছু কইরা থাকলে মাফ নিয়া নাও। সাপের মাথায় পাড়া দিলে অসুবিধা নাই। লেজে পাড়া দিলে খবর আছে।

মোবারক মুখ শুকনো করে আগের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। অন্য কোথাও বসতে পারলে ভাল হত। তবে সেটাও ঠিক হত না। ছোট রফিক ঠিকই লক্ষ্য করতো; মনে মনে ভাবত, লোকটা একটু আগে আমার পাশে বসেছে। এখন জায়গা বদলেছে।

আল্লাহ পাকের অসীম দয়া যে সে ছোট রফিকের সাথে ঝামেলা করেনি। সে শুধু বলেছে, এই চেয়ারটায় আমি বসব। তবে ছোট-রফিককে এই কথা বলাও বিরাট বেয়াদবি।

একজন যে চেয়ারে বসে আছে সেই চেয়ারে তুমি বসবে কেন? তুমি কোন দেশের লাট বাহাদুর? তুমি হলে মোবারক। তোমার দাম তিন পয়সা।

ছোট রফিক চা খাওয়া শেষ করেছে। পাঁচ টাকার একটা নোট চায়ের কাপের পাশে রাখতে রাখতে উঠে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে চায়ের দাম এবং বখশিশ একসঙ্গে দিয়েছে। ছোট রফিক মোবারকের দিকে তাকিয়ে বলল, জায়গা ছেড়ে দিলাম বসেন। আরাম করে চা খান।

মোবারক মুখ হাসিহাসি করার একটা চেষ্টা করল। ছোট রফিক সেই হাসিমুখ দেখার জন্যে অপেক্ষা করল না। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যাচ্ছে। কুদ্দুস মিয়া ক্যাশবাক্স ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সালাম দিল। ছোট রফিক সেদিকে না তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সালাম নিল। কোনো দিকে না তাকিয়েও চারদিকে কী হচ্ছে বুঝতে পারা বিরাট ব্যাপার। মোবারক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বটু চা দে। মালাই চা না, নরম্যাল চা।

বটু গলা নামিয়ে বলল, উনারে চিনেছেন? ছোট রফিক। একবার আমারে পঞ্চাশ টাকার চকচকা নোট বখশিশ দিছিল।

মোবারক উদাস গলায় বলল, ভাল।

তার এখন বেশ ভালও লাগছে।

নিজের চেয়ারে আরাম করে পা তুলে বসে এখন মারলবোরো সিগারেট টানতে টানতে চা খাওয়া যায়। আজ অল্পের উপর দিয়ে ফাড়া কেটেছে। মোবারকের সামান্য আফসোসও হচ্ছে। ছোট রফিককে চেয়ার ছাড়তে না বলে সে যদি ভদ্রভাবে পাশে বসত এবং সিগারেট সাধত তাহলে কত ভাল। হত। সে রকম খাতির হলে এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করা যেত, ভাইজান আপনাকে ছোট রফিক বলে কেন? আপনি যদি ছোট রফিক হন— বড় রফিকটা কে? হা হা হা। ভাইজান রসিকতা করলাম। কিছু মনে করবেন না।

ছোটখাট মানুষ হলে ছোট রফিক ডাকা যায়। কিন্তু মানুষটা মোটেই ছোটখাট না— লম্বা। তবে রোগা। গাল বসে গেছে। চেহারা ভাল। দেখে মনে হয় কোনো ব্যাংকে ট্যাংকে কাজ করে। মানুষটার গলার স্বরে রাগ আছে, কিন্তু চেহারায় কোনো রাগ নেই। বয়স কত হবে— চল্লিশ পঁয়তাল্লিশের বেশি হবে না। মোবারকের বয়স আটত্রিশ। কিন্তু তাকে দেখা যায় পঁয়তাল্লিশের মত। সব চুল পেকে যাওয়ায় এই অবস্থা হয়েছে। নিয়মিত কলপ করাও সমস্যা। একেকবার কলপে ত্রিশ টাকা লাগে। পশমি টুপিটা পাওয়ায় বিরাট কাজ হয়েছে। মাথা ঢেকে ঘোরাঘুরি করলে কে বুঝবে টুপির নিচের চুল কাঁচা না পাকা? টুপিটাও সুন্দর! এই টুপি আল্লাহ পাকের তরফ থেকে সরাসরি পাওয়া উপহার। আল্লাহপাক তার নাদান বান্দাদের জন্য মাঝে মাঝে সামান্য উপহার পাঠান। বান্দা ভাল না মন্দ সেদিকে তাকান না। এত কিছু দেখলে তার চলে না।

 

দোতলা বাসের দোতলায় বসে মোবারক আসছিল মীরপুর থেকে। তার আগারগাঁয়ে নেমে যাবার কথা। বসে থাকতে ভাল লাগছিল বলে নামল না। যতদূর যাওয়া যায় যাওয়া থাক। এর মধ্যে আল্লাহ পাকের একটা ইশারা অবশ্যই আছে। বাস যখন প্রেসক্লাবের কাছাকাছি তখন তার পাশের একজন যাত্রী তাড়াহুড়া করে নেমে গেল। মোবারক দেখে সিটের উপর একটা নীল আর শাদা রঙের মিশেল দেয়া পশমি টুপি। মোবারক চট করে জায়গা বদল করে পাশের সিটে চলে এল। টুপির উপর খানিকক্ষণ বসে থাকা অত্যন্ত জরুরি। টুপির মালিক ফিরে আসতে পারে। যদি ফিরে আসে তাহলে সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বলতে হবে— আরে এইতো আপনার টুপি! জিনিস পত্র সাবধানে রাখবেন না?

টুপি নিতে কেউ এল না। মোবারক টুপি হাতে গুলিস্তানে নেমে পড়ল। নেমে পরার আগে ছোটখাট একটা বাণিজ্যও হয়ে গেল। সে বাসের

বাসের কন্ডাকটার চোখ গরম করে বলল, কীয়ের টাকা? কন কী?

মোবারক বলল, দশ টাকার একটা নোট দিলাম। আপনি বললেন— এখন ভাংতি নাই পরে দিবেন।

কন্ডাকটার চোখ আগের চেয়েও গরম করে বলল, কী কন? দিল্লেগী করেন? ধাক্কা দিয়া চাক্কার নিচে ফেলাইয়া দিমু…।

মোবারক শান্ত গলায় অন্য পেসেঞ্জারদের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইসাব দেখলেন কী বলে? ধাক্কা দিয়ে চাকার নিচে ফেলে দেবে। তখনি আমি টাকা দিতে চাই নাই। আমি বলেছি ভাংতি নিয়ে আস তারপরে নোটটা নাও। তখন সেটা করবে না।

এক যাত্রী ক্ষিপ্ত গলায় বলল, শুওরের বাচ্চার গাল বরাবর একটা চটকনা দেন। হারামজাদার কত বড় সাহস।

চটকনা দিতে হল না। তার আগেই কন্ডাকটার একটা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল।

মোবারক বলল, এক টাকা ভাড়া কেটে রাখেন। নয় টাকা দেন।

কন্ডাকটার বিরস গলায় বলল, থাউক ভাড়া লাগব না। আফনের ভাড়া TIPI

মোবারক দর্শকদের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বলল, ভাইসাবরা দেখলেন, কীভাবে অপমান করে আমার ভাড়া নাকি মাফ।

অন্য এক ক্রুদ্ধ যাত্রী বলল, হারামজাদারে একটা চড় দেন না। দেখেন। কী? মার না খেলে শিক্ষা হবে না।

মোবারক জোরেসোরে এক চড় বসিয়ে হেঁটে চলে এল। পিছনে ফিরল না। পিছনে ফিরলে হয়ত দেখা যাবে, কন্ডাকটার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তবে চড় মারাটা বাড়াবাড়ি হয়েছে। আল্লাহপাকের হিসাবের খাতায় নাম উঠে গেছে। এমন একটা চড় কোনো না কোনো সময় মোবারককে খেতে হবে। চড়ে চড়ে কাটাকাটি হবে। সবার হিসাবে ভুল হয়, আল্লাহপাকের হিসাবে ভুল নাই। বাসের কন্ডাকটার যেমন অনেক লোকের সামনে চড় খেয়েছে, সেও অনেক লোকের সামনেই খাবে। হয়ত আজই খেত। ছোট রফিকের হাত থেকে খেত। কপাল গুণে বেঁচে গেছে।

মোবারক চা খাচ্ছে। তার নিজের পছন্দের চেয়ারে বসে খাচ্ছে। চেয়ারটা এই জন্যে পছন্দ যে এখান থেকে রাস্তা দেখা যায়। রাস্তার লোকজন তাকে এত সহজে দেখবে না। চেয়ারটা মদিনা রেস্টুরেন্টের এক কোণায়। রাস্তার লোক দোকানের দিকে তাকায়, দোকানের কোণার দিকে তাকায় না।

সন্ধ্যা হয় হয় করছে। সন্ধ্যাবেলাটা মোবারকের খারাপ লাগে। বিশ্রী একটা সময়, দিনও না, রাতও না। এই দুয়ের মাঝামাঝি একটা ব্যাপার। দিনের এক রকম মজা, রাতের আরেক রকম মজা। এই দুয়ের মাঝামাঝি সময়ের কোনো মজা নেই। সন্ধ্যা একা কাটানো যায় না। সন্ধ্যার জন্যে বন্ধু লাগে। মোবারকের মেজাজ দ্রুত খারাপ হচ্ছে। জহিরেরও দেখা নেই, বজলুরও দেখা নেই। মনে হচ্ছে এরা দুজন যুক্তি করে হাওয়া হয়ে গেছে। বজলুর জন্যে ব্যাপারটা স্বাভাবিক। সে প্রায়ই ড়ুব মারে। দু তিন দিন পরে হঠাৎ উদয় হয়। এই দু তিন দিন সে কোথায় ছিল, কী করেছে সে সম্পর্কে কিছুই বলে না। প্রাইভেট কোনো ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। সব মানুষেরই কিছু না কিছু প্রাইভেট ব্যাপার থাকে। কিন্তু জহিরের ব্যাপারটা কী? আবার কোনো অসুখ বিসুখ হয়নি তো?

জহিরের হল অসুখ রাশি— এই জ্বর, এই কাশি, এই হাম। মানুষের হাম হয় একবার ছোটবেলায়। গা ভর্তি হাম বের হল। হাম ডেবে গেল, মামলা ডিসমিস। সেই হাম জহিরের হয়েছে তিনবার। জন্ডিস হল চারবার। শেষবারে এমন অবস্থা যে, কলাবাগানের জামে মসজিদের ইমাম সাহেবকে ডেকে এনে তওবা পড়ানো হল। তওবা পড়ানোর পর মিলাদ হল। বজলু সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে জহিরকে বলল— তুই এখন শিশুর মত নিস্পাপ হয়ে গেলি। বাম কাঁধের ফিরিশতা এতদিন তার খাতায় যা লিখেছে সব মুছে গেছে। আগের সব পাপ কাটাকাটি হয়ে গেছে। যে অসুখ বাঁধিয়েছিস এর মধ্যে নতুন পাপ আর কিছু করতে পারবি না। যদি মারা যাস— স্ট্রেইট বেহেশত নসিব হবে। হুরপরীরা তোকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেবে।

আল্লাহপাকের বোধহয় ইচ্ছা না জহির বেহেশতে দাখিল হয়। সে তওবা পড়ানোর দিন তিনেকের মধ্যে উঠে বসে চি চি করে বলল— তার সরষে শাক দিয়ে ফ্যান ভাত খেতে ইচ্ছা করছে। লোকজনের কানের পাশ দিয়ে গুলি যায়। জহিরের গুলি গেছে বগলের তলা দিয়ে। হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেবার সময় ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন— আপনার লিভার মারাত্মক ড্যামেজড হয়েছে। আপনি যে বেঁচে আছেন এইটাই মিরাকল। বাকি জীবন আপনাকে খুব রেগুলেটেড লাইফ মেইনটেইন করতে হবে। মাংস পারতপক্ষে খাবেন না। মাছ ভাত খাবেন। মদ্যপান করবেন না। ঈদে চান্দেও না। ড্রপার দিয়ে এক ফোঁটাও না। বুঝতে পারছেন কারো কারো জন্যে মদ খাওয়া নিষিদ্ধ। আপনার জন্যে মদের গন্ধ শোকাও নিষিদ্ধ।

বজলু এবং মোবারক দুজনই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। এবং এক সঙ্গে বলল, জ্বি আচ্ছা।

ডাক্তার সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি পেশেন্টকে জিজ্ঞেস করছি। আপনারা দুজন মাথা নাড়ছেন কেন? আপনারা কে?

স্যার আমরা জহিরের ফ্রেন্ড।

আপনারা সামনে থেকে যান। আমি আপনাদের বন্ধুকে কিছু কঠিন কথা বলব। দাঁড়িয়ে থাকবেন না। চলে যান।

ডাক্তার সাহেব অনেক কঠিন কথা বললেন। জহির ঝিমঝিম চোখে হাই তুলতে তুলতে কঠিন কথা শুনল। তাকে খুব বিচলিত মনে হল না। সে কখনোই বিচলিত হয় না।

বন্ধুর রোগমুক্তি উপলক্ষে ছোটখাট উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। আজরাইলের হাত থেকে বাইম মাছের মত পিছলে বের হয়ে আসা কোনো সহজ ব্যাপার না। যে মানুষ এমন অসাধ্য সাধন করতে পারে তার জন্যে বড় উৎসবই করা দরকার। বড় উৎসবের সামর্থ্য কোথায়? ভদকার একটা বোতল যে জোগাড় হয়েছে এটাই যথেষ্ট। এক বোতল ভদকা, খাসির চাপ, হাজির বিরিয়ানি। আসর বসেছে বজলুর ঘরে। মোবারক এবং বজলু অতি দ্রুত বোতল শেষ করছে। জহির শুকনো চোখে তাকিয়ে আছে। তার শুকনো চোখ দেখে মায়া লাগছে কিন্তু কিছু করার নেই। আগে প্রাণে বাঁচতে হবে। জহিরের গন্ধ শোঁকা নিষিদ্ধ বলেই তারা ভদকা এনেছে। ভদকার গন্ধ নেই।

মোবারক বলল, নিয়ম রক্ষার জন্য এক ফোঁটা খাবি নাকি রে জহির। জাস্ট ওয়ান ড্রপ। জিভ বের কর। জিভের আগায় এক ফোঁটা দিয়ে দেই।

জহির না-সূচক মাথা নাড়ল। মোবারক বলল, থাক কোনো দরকার নেই। তুই শুয়ে থাক। বিরিয়ানি গরম আছে। গরম গরম খেয়ে শুয়ে পড়। আমি মাথা বানিয়ে দেব।

বজলু বলল, ডাক্তার যে মৃত্যুর ভয় দেখাল, কাজটা কি ঠিক করল? মৃত্যুর কথা বলার তুমি কে? মৃত্যুর মালিক হলেন আল্লাহ্। তিনি ইচ্ছা করলে মৃত্যু হবে। ইচ্ছা না করলে দশ বোতল ভদকা খেলেও কিছু হবে না। জহিরের কি বাঁচার আশা ছিল? ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছিল না? তারপরেও বাঁচল কীভাবে? আরে বাবা তুমি ডাক্তার হয়েছ বলে যা ইচ্ছা তাই বলবে? তোমার মত ডাক্তার আমি  দিয়েও পুছি না। রোগ যদি হয়, অষুধ দিয়ে রোগ সারাবে। বড় বড় কথা কী জন্যে? আমি বজলুর রহমান তোমার কথার উপরে পেচ্ছাব করি।

মোবারক বলল, আমি পেচ্ছাব করে দেই।

আধা বোতল ভদকা শেষ হবার পরেও দেখা গেল নেশা যে ভাবে হওয়া উচিত সেভাবে হচ্ছে না। ছাড়া ছাড়া নেশা হচ্ছে। এই ভাব আসছে, এই চলে যাচ্ছে। নেশার ব্যাপারটা বড়ই অদ্ভুত। কোনো কোনো দিন কিছু খেতে হয় না, বোতল দেখেই নেশা হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো দিন যতই খাও কিছু হবে না। মাথা ঝিম ঝিম করবে, বমি ভাব হবে কিন্তু আসল যে জিনিস—‘ভাব’ সেটা আসবে না।

বজলু বিরক্ত মুখে বলল, নেশা হচ্ছে না। ব্যাপারটা কী? মোবারক তোর অবস্থা কী?

মোবারক বিরস মুখে বলল, মনে হয় পানি খাচ্ছি। মিনারেল ওয়াটার।

এতদিন পর হাসপাতাল থেকে বন্ধু রিলিজ পেয়েছে। সেই আনন্দে যদি একটু নেশাও না হয় তাহলে বন্ধুর ফিরে আসার দরকার কী ছিল? বজলু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কাজকর্ম সব সময় তিনজন একত্রে করেছি। আজ দুইজন, একজন থেকেও নেই। এই জন্যেই কিছু হচ্ছে না। বোতল শেষ করে লাভ নেই, বাদ দে।

জহির তখন ক্ষীণ গলায় বলল, বেশি করে পানি মিশিয়ে সামান্য একটু দে। তিন চার ফোঁটার বেশি না। নিয়ম রক্ষার জন্যে খাওয়া।

দরকার নেই। বাদ দে। এতবড় অসুখ থেকে উঠলি।

খাই এক ফোঁটা। এক ফোঁটায় আর কী হবে?

জহিরকে সামান্য দেয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে দুই বন্ধুর নেশা কঁকিয়ে এল। বজলু বলল, বোতলতো শেষ হয়ে আসছে। তিন বোতল ফেন্সি নিয়ে আসি। ভদকার পরে ফেন্সি— উড়াল দেয়া নেশা হবে। ফেন্সি জহিরও খেতে পারবে। ডাক্তার মদ খেতে নিষেধ করেছে ফেন্সি খেতে নিষেধ করেনি। তাছাড়া ফেন্সি অষুধের মত— কফ সিরাপ। কীরে জহির ফেন্সি খাবি একটা?

জহির বলল, না।

আমোদ ফূর্তিই যদি না করলি বেঁচে থেকে লাভটা কী? সকালে চিড়া ভিজানো পানি এক গ্লাস চিরতার রস, বিকালে জাউ ভাত। রাতে এক পিস আটার রুটি। সিগারেট না, মদ না, গাঁজা না। এই ভাবে বেঁচে থেকে লাভ কী— নায়লনের একটা দড়ি কিনে নিয়ে আসি, ঝুলে পড়।

মোবারক উদাস গলায় বলল, এটা মন্দ না। দুই বোতল ফেন্সি আন আর তিন গজ নায়লনের দড়ি। ব্লু কালার।

ব্লু কালার কেন?

বজলু গম্ভীর গলায় বলল, মৃত্যুর রঙ নীল। এই জন্যে।

এত কিছুর পরেও জহির এক ফোঁটা মুখে দিল না। দুই বন্ধুরই খুব মেজাজ খারাপ হল। সাতশ টাকার বোতলে সাত টাকার নেশা হল না। ধরে যাওয়া নেশা একবার চটে গেলে কিছুতেই কিছু হয় না। ঝিম ভাব হয়— ঝিম ভাব আর নেশা এক না। পর পর তিন রাত অঘুমো থাকলেও ঝিম ভাব হয়।

 

মোবারক নড়ে চড়ে বসল। চায়ের স্টলের বাইরে জহির এসে দাঁড়িয়েছে। ইঁদুরের মত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তাকে খুঁজছে বলাই বাহুল্য। গাধার গাধা— সে জানে না মোবারক কোথায় বসে? তুই পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ সব দিক দেখে ফেললি— আসল দিক দেখলি না? তোর কি ব্রেইনে সমস্যা হয়েছে? নাকি সন্ধ্যাবেলাতেই কিছু খেয়ে এসেছিস? দাড়ি শেভ নাই। চুল উস্কুখুস্কু। একটা শার্ট গায়ে দিয়েছে যার পাঁচটা বোতামের মধ্যে দুটা নাই। শার্টের ফাঁক দিয়ে বুকের লোম বের হয়ে আছে। তুই ভেবেছিস কী? তোর বুকের লোম দেখে মেয়েরা মূৰ্ছা যাবে? কাঁধে আবার বাহারি ব্যাগ। ব্যাগের পেট ফুলে আছে। কে জানে কী আছে ব্যাগে।

জহির মোবারককে দেখেছে। জহিরের মুখ ভর্তি হাসি। যেন দশ বছর পরে পুরনো বন্ধুর দেখা পাওয়া গেল। মোবারকের মেজাজ চট করে খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে বলল, তোর হাসি মুখে আমি পেচ্ছাব করে দেই। আরে শুওরের বাচ্চা গত দুই দিন তুই ছিলি কোথায়? এমন তো না যে বিয়ে করেছিস শাশুড়িকে সালাম করতে যেতে হবে। শালীর গালে ধরে রং ঢং করতে হবে।

জহির এসে মোবারকের সামনে বসল। বসেই মোবারকের মারলবোরো সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে সিগারেট বের করল। যেন তার শ্বশুরের টাকায় কেনা সিগারেট। শ্বশুর চায়ের স্টলের টেবিলে ফেলে রেখে গিয়েছিল। এখন জামাইকে পাঠিয়েছে খুঁজে নিয়ে যাবার জন্যে। বন্ধুর সিগারেট খাচ্ছে— আচ্ছা ঠিক আছে খাক। এত দামি বিদেশী সিগারেট, একবার জিজ্ঞেস করবে না সিগারেটের এই প্যাকেট কোত্থেকে পাওয়া গেল? নাকে মুখে কেমন ধুঁয়া ছাড়ছে, যেন তার শ্বশুর বাড়ির সস্তা ধুঁয়া।

জহির বলল, আছিস কেমন?

মোবারক জবাব দিল না। তার কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না। সবচে ভাল হত যদি উঠে চলে যেতে পারত। উঠে চলে যাওয়া এক সপ্তাহের জন্যে ড়ুব মারা। তোরা দুই দিনের জন্যে ড়ুব দিতে পারলে আমিও এক সপ্তাহের জন্যে ড়ুব দিতে পারি।

জহির বলল, তোর গায়ে উলের চাদর?

মোবারক এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। যদিও তার ইচ্ছা করছে বলতে— উলের চাদর না। পাটের কোস্টার চাদর। চাদরও না, গামছা।

জহির বলল, চাদর পেয়েছিস কোথায়?

মোবারক গম্ভীর গলায় বলল, আমার নিজের চাদর। এর মধ্যে পাওয়া পাওয়ি কী?

জিনিস ভাল।

মোবারক বলল, জিনিস যে ভাল তোকে সেই সার্টিফিকেট দিতে হবে না। আমার জিনিস আমি জানি ভাল না মন্দ।

রেগে আছিস কেন?

মোবারক জবাব না দিয়ে টেবিলের উপর রাখা সিগারেটের প্যাকেট চাদরের নিচে ঢুকিয়ে ফেলল। জহিরের স্বভাব খারাপ। সামনে সিগারেটের প্যাকেট থাকলে ক্রমাগত খেয়ে যাবে। দুই মাসও হয়নি এতবড় অসুখ থেকে উঠেছে কিছু সাবধান হওয়াতো দরকার। মদের চেয়েও ক্ষতি করে সিগারেট।

জহির বলল, গরমের মধ্যে চাদর গায়ে ঘুরছিস কেন?

ইচ্ছা হয়েছে ঘুরছি। তাতে তোর কোনো সমস্যা হয়েছে?

গরমের মধ্যে উলের চাদর। তোকে দেখে আমার নিজেরই গরম লাগছে।

গরম লাগলে শার্ট প্যান্ট খুলে ন্যাংটা হয়ে যা।

জহির গলা নামিয়ে বলল, চাদরের নিচে কিছু আছে?

না।

না থাকলেও অসুবিধা নাই। আমি জিনিসপত্র নিয়ে এসেছি। সাতটা বোতল। এক নম্বরী ডাইল। সিগারেটের প্যাকেট সামলে ফেললি কেন? দেখি প্যাকেট বের কর।

মোবারক সিগারেটের প্যাকেট বের করল। জহিরের উপর তার রাগটা অতি দ্রুত কমছে। এই তার এক সমস্যা। সে রাগ ধরে রাখতে পারে না। অতি দ্রুত কমতে থাকে। শুধু যে রাগ কমছে— তা না। এখন আবার মায়াও লাগতে শুরু করেছে। কী অবস্থা করেছে শরীরের। এত বড় একটা অসুখ থেকে উঠেছে— নিজের শরীরের দিকে তাকাবে না? মনে হচ্ছে দুপুরে সে কিছু খায়ওনি। কেমন পা টেনে টেনে হাঁটছিল। পায়ে কী কিছু হয়েছে?

মোবারক বলল, দুপুরে ভাত খেয়েছিস?

না।

না কেন?

সময় পাই নাই।

সময় পাস নাই কেন? তুই কি মিনিস্টার যে মিটিং মিছিল করে দম ফেলতে পারছিস না।

মোবারক চোখের ইশারায় বটুকে ডেকে দুটা পরোটা আর শিক কাবাব দিতে বলল।

জহির হামলে পড়ে খাচ্ছে। দেখে মায়া লাগছে।

এই দুই দিন ছিলি কোথায়?

নারায়ণগঞ্জ।

সেখানে কী?

ছোট খালু মারা গেছে। খবর পেয়ে দেখতে গিয়ে বিরাট ক্যাচালের মধ্যে পড়ে গেলাম।

কী ক্যাঁচাল?

আরে টাকা নাই, পয়সা নাই। দশ গজ কাফনের কাপড় কিনতে গিয়েছে তাও টাকা শর্ট পড়েছে। খালা আমাকে ধরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করা শুরু করল–-ওরে কই যাব রে? তুই বলে যা কই যাব রে?

আমার নিজের যাওয়ার নাই ঠিক, আমি কী করে বলব— কই যাবে? দাফন করতে যাবে, আমি বললাম, খালা আমাকে পাঁচটা মিনিট সময় দেন। চা খাবার নাম করে আসছি। চা খেতে বের হয়ে ফুটলাম।

ভাল করেছিস।

ঘর ভর্তি বাচ্চা কাচ্চা। এর মধ্যে একটার আবার উঠেছে জ্বর। মাথায় পানি ঢালাঢলি হচ্ছে। বিশ্রী অবস্থা।

মোবারক বলল, তুই গেলি কেন খামাখা। যাওয়াটাই ভুল হয়েছে।

জহির থমথমে গলায় বলল, বিরাট ভুল হয়েছে। যাওয়া উচিত হয় নাই। আমার যাবার কোন ইচ্ছা ছিল না, বাবা বলল, জহির যা দেখে আয়। আমি নড়তে পারছি না। নয়ত আমি যেতাম। আমি ভাবলাম যাই। ছোটবেলা কিছুদিন খালার সঙ্গে ছিলাম। খালা খালু দুইজনই খুব আদর করত। খালার চেয়ে বরং খালুর আদর ছিল বেশি। এই জন্যই চলে গেছি। গিয়ে পড়লাম কাঁচালে। এমন মনটা খারাপ হয়েছে কিছুই ভাল লাগে না। কাদলে মনটা হালকা হত। কান্নার চেষ্টা করেছি। কান্না আসে না–এখন করব কী বল? নেশা করলে যদি চোখে পানি আসে এই জন্যেই ছয়টা বোতল নিয়েছি।

টাকা কই পেয়েছিস?

জহির জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল।

মোবারক আবার বলল, টাকা কোথায় পেয়েছিস?

জহির কথা শুনতে পায়নি এমন ভাব করে আরেকটা সিগারেট ধরাল।

কেউ কোনো কথা বলতে না চাইলে সেই কথা শোনার জন্যে চাপাচাপি করা ঠিক না। মোবারক চুপ করে গেল। বলার হলে সে নিজেই বলবে। পেটে জিনিস পড়লেই হড়বড় করে কথা বের হবে। জিনিস পড়ার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে সেটাই হল কথা। বজলুর এখনো দেখা নাই। বজলু থাকে তার ছোট বোনের সঙ্গে ঝিকাতলায়। ঠিকানা আছে। কিন্তু বজলুর কঠিন নিষেধ যেন তার খোঁজে কখনো যাওয়া না হয়। নিষেধ হোক যাই হোক একবার যাওয়া দরকার। মানুষটার অসুখ বিসুখও তো হতে পারে। বন্ধু যদি বন্ধুর খোঁজ না করে কে করবে? পাড়ার লোকে করবে? পাড়ার লোকের কী দায় পড়েছে?

মোবারক বলল, তোর পায়ে কী হয়েছে?

জহির বলল, রগে টান পড়েছে মনে হয়।

ল্যাংড়া হয়ে যাবি তো।

হুঁ।

তোর তো দেখি শরীর একেবারে গেছে।

গেলে কী আর করা? শরীর দিয়ে কী হয়? এত বড় যে গামা পালোয়ান শরীর দিয়ে সে করলটা কী?

তোর জিহ্বা কালো হয়ে গেছে। তোর মধ্যে একটা সাপ সাপ ভাব চলে এসেছে।

জহির হঠাৎ বিরাট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দোস্ত মনটা খারাপ, খুবই খারাপ।

কী জন্যে মন খারাপ বলে ফেল। শুনলে তোরও মন খারাপ হবে। তাহলে বাদ দে।

জহির কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎ বিড়বিড় করে বলল, ছোটখালা এক হাজার টাকা দিয়েছিল। তার কাছে তো ছিল না। ধারধোর করে এনে দিয়েছে। চা খাওয়ার নাম করে ঐ টাকা নিয়ে ফুটে গেছি।

জিনিসপত্র ঐ টাকায় কিনেছিস?

হুঁ। দোস্ত খুবই খারাপ লাগছে। একবার ভাবলাম লাফ দিয়ে কোনো ট্রাকের নিচে পড়ে যাই।

পড়লি না কেন?

ট্রাকের সামনে ঝাপ দিতে ইচ্ছা করে, ঝাপ দেই না। ছাদে উঠে ঝাপ দিয়ে নিচে পড়তে ইচ্ছা করে, ঝাপ দেই না। সাহস নাইরে দোস্ত, সাহস নাই। এই দুনিয়ায় আসল জিনিসের নাম— সাহস। যার সাহস আছে তার সবই আছে। যার সাহস নাই তার কিছুই নাই।

ক্যাশ বক্স ফেলে কুদ্দুস উঠে এসে মোবারকের পাশে বসল। গলা নামিয়ে বলল, গায়ের শাল কি বিক্রি হবে?

মোবারক উদাস গলায় বলল, দামে পুষালে বিক্রি।

কুদ্দুস শাল পরীক্ষা করতে করতে বলল, সেকেন্ড হ্যান্ড ব্যবহারী জিনিস। তিনশ টাকা। যদি পুষায় জিনিস রেখে যাও, কাল দাম নিবা।

পুষাল না।

পুষালে নাই। আমারটা আমি বললাম। তিনশ।

ভাল বলেছ। এখন ফুটে যাও।

কুদ্দুস যেভাবে এসেছিল সেইভাবে চলে গেল। হাসিমুখে বসল ক্যাশবাক্সে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, দুনিয়াটা বড়ই আনন্দময়।

তারা তাদের জায়গায় চলে এসেছে

তারা তাদের জায়গায় চলে এসেছে।

সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের পুলিশ ফাঁড়ির একটু পেছনে ঝাকড়া বাদাম গাছের নিচটাই তাদের জায়গা। একদিকে শিশু পার্ক, একদিকে পুলিশ ফাঁড়ি, বাকি দুদিকে ঘন ঘাছপালা। বাগানের এই অংশটা ঠিক বাগান বলে মনে হয় না । মনে হয় জংলা জায়গা। ছাতিম গাছটাকেও জংলা গাছের মতই লাগে। গাছটা নিচু, দাঁড়ালে ছাদের মত ছড়ানো ডালে মাথা লেগে যাবে। কিন্তু বসতে কোনো অসুবিধা নেই। গাছটা এমনভাবে ছড়িয়েছে যে মাথার উপর প্রকাণ্ড ছাতা ধরে আছে এমন মনে হয়। শুধু মনে হওয়া-হওয়ি না। গাছটা আসলেই ছাতার কাজ করে। একবার তারা গাছের নিচে বসে আছে নামলো ঝুম বৃষ্টি। একটা ফোঁটা পানি তাদের গায়ে পড়ল না।

মোবারকদের পছন্দের জায়গার আরো কিছু বিশেষত্ব আছে। প্রথম বিশেষত্ব হচ্ছে— সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সন্ধ্যার পর থেকে নানান ধরনের লোকজন এবং মেয়ে মানুষ ঘোরাফেরা করে কিন্তু এই দিকে কেউ আসে না। জায়গাটা ভাল না; গরম— এমন কথা প্রচলিত আছে। মাস দুএক আগে আঠারো উনিশ বছরের একটি মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। তারও আগে বর্ষার সময় মাথা নেই একটা পুরুষের শরীর পাওয়া গেছে। শরীরটা বস্তায় ভরে মুখ সেলাই করে এই ছাতিম গাছের নিচেই ফেলে রাখা হয়েছিল। মৃতদেহ পচে গলে বিকট গন্ধ ছড়ানো শুরু করার পর পুলিশ এসে বস্তা নিয়ে যায়। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়।

মুণ্ডুহীন লাশ শিরোনামে কয়েকটা প্রতিবেদন ছাপা হবার পর পাঠক এবং পত্রিকা দুইই ক্লান্ত হবার কারণে ব্যাপারটা থেমে যায়। তবে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে চা এবং চায়ের সঙ্গে অন্যসব বস্তু যারা বিক্রি শুরু করে তারা জমাটি এক ভূতের গল্প চালু করে দেয়। নিশুতি রাতে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ নাকি মাথা নেই একটা মানুষ দেখা যায়। মানুষটা বাগানের লোকদের কাছে তার মাথাটা কোথায় তা জানতে চায়।

সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। প্রেমিকা বাড়ি ফিরতে চাচ্ছে, প্রেমিক দিচ্ছে না। অন্ধকারে প্রেমিকাকে যতক্ষণ পাশে রাখা যায়। দুজনেরই ঝিম ঝিম অবস্থা। তখন মাথা নেই লাশ গাছের আড়াল থেকে শরীরটা বের করে বলবে, এক্সকিউজ মি আপা। আমার মাথাটা কোথায় বলতে পারেন?

এই ধরনের গল্প কেউ বিশ্বাস করে না, তবে পুরোপুরি অবিশ্বাসও করে না। মানুষের মনের একটা অংশ উদ্ভট এবং বিচিত্র গল্প বিশ্বাস করতে পছন্দ করে।

রাত দশটা। মোবারক, জহির এবং বজলু— তিনজনই আছে। বজলু যথারীতি গম্ভীর হয়ে আছে, কথা বলছে না। ছাতিম গাছের নিচে বসার সময় একবার শুধু বলেছে, আমার কাজ আছে। আমি দশ পনেরো মিনিট থাকব।

জহির বলেছে, থাকিস না। তোকে কি আমরা শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি? যার যার শিকল তার তার হাতে। তুই তোর শিকল বাজাতে বাজাতে চলে যা।

বজলু বলেছে, আজ কিছু খাবও না। তোরা খাওয়ার জন্যে পাছরা পাছরি করিস না।

জহির বিরক্ত হয়ে বলেছে, তুই কি কচি খোকা যে ফিডিং বোতলে করে তোকে মদ খাওয়াতে হবে? না খেলে না খাবি। চলে যেতে চাইলে চলে যা। এখনি চলে যা।

বজলু বলেছে, চলে যাব?

জহির বলেছে, অবশ্যই চলে যাবি। তোর মত বন্ধু আমি ‘  ’ দিয়েও পুছি না।

বজলু সঙ্গে সঙ্গে উঠে হাঁটা দিয়েছে। জহির বা মোবারক এটা নিয়ে মোটেও ব্যস্ত হয়নি। কারণ দুজনই জানে বজলু ফিরে আসবে। কতক্ষণে ফিরবে এটা বলা যাচ্ছে না। পাঁচ মিনিটেও ফিরতে পারে আবার ঘণ্টা দুই পরেও ফিরতে পারে। তবে কিছুদিন হল বজলু বদলাচ্ছে। অতি দ্রুত বদলাচ্ছে। তাকে কয়েকদিন না-কি ছোট রফিকের সঙ্গে দেখা গেছে। তার বন্ধুরা বজলুকে এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তবে আজ হয়ত মোবারক জিজ্ঞেস করবে। রাগ করে বজলুর চলে যাওয়া বা ফিরে আসা কোনো ঘটনা না। তবে এ রকম ঘটনা ঘটলে খুবই রাগ লাগে। নেশার জন্যে রাগটা খারাপ। যে রেগে থাকে তাকে কোনো কিছুতেই ধরে না। নেশার খরচ জলে যায়।

জহির কাঁধের ব্যাগ থেকে বোতল বের করল। জমাটি নেশা করার কিছু নিয়ম কানুন আছে। নেশার সব কিছু চোখের সামনে রাখতে হয়। ভাগ্য ভাল থাকলে সুন্দর করে সাজানো বোতল দেখলেই নেশা হয়ে যায়। নেশা তো আর কিছু না— মনের একটা বিশেষ ভাব। সেই বিশেষ ভাবে হুট করে উঠা যায় না। একতলা থেকে দোতলায় উঠতে হলে যেমন অনেকগুলি সিঁড়ি পার হতে হয়। এক ভাব থেকে আরেক ভাবে যেতেও সিঁড়ি টপকাতে হয়। কেউ দুটা তিনটা সিঁড়ি এক সঙ্গে টপকায়। কেউ সিঁড়ি টপকানোর সময় পা পিছলে পড়ে যায়, উপরের তলায় উঠতেই পারে না। আসল ভাবের জায়গায় যারা উঠবে তারা প্রতিটি সিঁড়ি আস্তে আস্তে পার হবে। কারণ প্রতিটি সিঁড়ির কিছু আলাদা মজা আছে। আলাদা ভাব আছে।

জহির বলল, পুড়িয়াও আছে। দিব?

মোবারক বলল, এখন না।

আয় ডাইল দিয়ে শুরু করি। বজলু ফিরে আসুক তখন পুড়িয়া। ডাইরেক্ট একশন।

মোবারক জবাব দিল না। তার মানে ডাইল দিয়ে শুরুর ব্যাপারে তার আপত্তি নেই। ডাইল হল ফেন্সিডিল। ইদানীং চালু হয়েছে ফেন্সিডিলের বোতলে একটা দশ মিলিগ্রাম ইউনিকট্রিন ট্যাবলেট ছেড়ে দেয়া। ট্যাবলেটটা পুরোপুরি গুলে না। আধাগলা হয়ে তলায় পড়ে থাকে। সেই পড়ে থাকা অংশটা খাওয়ার নিয়ম নেই।

ভাবে বসার প্রথম পনেরো মিনিট বেশ জটিল। একেক জন একেক মুডে থাকে। কেউ কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ বিরক্ত হয়ে যায়। কেউ রাগ করে। কেউ ধুম করে বলে বসে, না আজ শরীর ভাল না। আজ কিছু খাব না। তখন একজনকে থাকতে হয় যে সবাইকে সামলে সুমলে রাখে। সে হল সামালদার। তাকে মেজাজ খারাপ করলে চলবে না। ভাবের আসর নষ্ট হয়ে যাবে। প্রথম দশ পনেরো মিনিট কষ্ট করে পার করে দিলে বাকি সময়টা নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না। প্রথম পনেরো মিনিটের ধাক্কাটা সব সময় সামলায় জহির। কোনো বিষয়ে তার ধৈর্য নেই কিন্তু ভাবের আসরে তার ধৈর্য অসীম।

জহির ফেন্সিডিলের একটা বোতলের মুখ খুলে মোবারকের দিকে এগিয়ে দিল। মোবারক হাত বাড়াল না। বরং ছাতিম গাছে হেলান দিয়ে উদাস হয়ে গেল। জহির চিন্তিত গলায় বলল, খেতে ইচ্ছা করছে না?

মোবারক এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না।

ঘটনা খারাপ। শুরুতেই কেউ বেঁকে বসলে সমস্যা। জহির শান্ত গলায় বলল, খেতে ইচ্ছা না করলে খাস না। রোজই এই বিষ খাওয়া লাগবে তার কোনো কথা নেই। ইচ্ছা না হলে খাবি না।

জহির নিজেই বোতলে চুমুক দিল। গলা করুণ করে বলল, অনেক কষ্টের টাকায় এই বিষ কিনেছি। একজন রাগ করে চলে যাবে। একজন খাবে না। ভাল কথা। আমি খাব। আমার হল কষ্টের টাকা। আমি ছাগল কোরবানি দিয়েছি। আমি না খেলে হবে?

জহির পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করল। দলামচা সিগারেট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সাধারণ সিগারেট না। বিশেষ সিগারেট। তামাকের সঙ্গে জিনিস মেশানো হয়েছে। সিগারেটে মিশানোর জিনিসও কয়েক পদের আছে। একটা আছে সামান্য টানলেই মাথার তালু জ্বলে। আরেকটায় হাই প্যালপটিশনের মত মাথায় প্যালপিটিশন। এই দুইটাই খারাপ। জিনজির নামে একটা পাওয়া যায়— এক্সপোর্ট কোয়ালিটি। বাজারের সেরা। জহির ওস্তাদ লোক। সে জিনজির ছাড়া অন্য কিছু আনবে না। টাকা পয়সা না থাকলেও জহিরের নজর উঁচা।

জহির বলল, সিগারেটও না?

মোবারক বলল, না।

পান খা একটা। মিষ্টি পান আছে। জর্দা দিয়ে একটা পান খেলে ভাল লাগবে। ময়মনসিংহের মিকচার জর্দা। বেহেশতী জিনিস।

মোবারক না-সূচক মাথা নেড়ে নিজের সিগারেট বের করল। জহির ধরালো তার বিশেষ সিগারেট। দুজনের সিগারেটের আগুন ওঠানামা করছে। শীত শীতও লাগছে। মোবারকের গায়ে দামি শাল, মাথায় পশমি টুপি তারপরেও তারই শীতটা বেশি লাগছে। জহির তার বোতলে একবারই চুমুক দিয়েছে। একা একা ভাবের আসর শুরু করা যায় না। সঙ্গী লাগে। ভাল কাজ মানুষ একা করতে পারে। বেশির ভাগ সময় তাই করে। কিন্তু কোনো মন্দ কাজই মানুষ একা করতে পারে না। মন্দ কাজে সঙ্গী সাথি লাগে, উৎসাহদাতা লাগে। তালি বাজানোর নোক লাগে।

মোবারক বলল, তুই দেখি আজ মেলা খরচ করেছিস। এক হাজার টাকার পুরোটাই শেষ?

জহিরের মুখে সামান্য হাসির আভা। মোবারক কথা বলা শুরু করেছে। এটা ভাল লক্ষণ। এখন যদি বজলু চলে আসে তাহলেই আসর জমে যাবে। আজকের সাপ্লাই ভাল। শুধু ভাল না, খুবই ভাল। জহিরের কাপড়ের ব্যাগে ভদকার একটা বোতল আছে। পুরো বোতল না, অর্ধেকেরও কম আছে। এটা জহির ইচ্ছা করে রেখে দিয়েছে ফিনিশিং দেয়ার জন্যে। ফিনিশিং-এর জন্য ভদকার মত জিনিস হয় না। যে জাতি ভদকার মত আসলি চিজ বের করেছে সেই জাতি আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারল না। পাছায় লাথি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল এটা ভাবাই যায় না।

গাছপালার ফাঁক দিয়ে কে যেন আসছে। তার মুখেও জ্বলন্ত সিগারেট। হ্যাঁ বজলুই ফিরে আসছে। জহির নিশ্চিন্ত হয়ে নিঃশ্বাস ফেলল। তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। ভাবের আসর এখনি শুরু হবে।

বজলুকে আসতে দেখেই মোবারকের মনে হয় মুড ভাল হয়ে গেছে। সে জহিরের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, দেখি একটা বোতল। সামান্য খাব। দুই চুমুক।

জহির নিজের বোতল এগিয়ে দিল। এবং অতি দ্রুত আরেকটা বোতলের মুখ খুলল। বোতলের টিনের মুখায় লেগে হাত মনে হয় কেটেছে। রক্ত বের হচ্ছে। বের হোক। এত কিছু দেখলে চলবে না। বজলু এসে দাঁড়ানো মাত্র তার হাতে বোতল তুলে দিতে হবে। জহিরের এত আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে সে কেঁদে ফেলবে।

 

জমিয়ে কুয়াশা পড়ছে। চারপাশ ঝাপসা। ছাতিম গাছের পাতায় শিশির জমেছে। মাঝে মাঝে দুএকটা ফোঁটা এদের গায়ে পড়ছে। যার গায়েই ফোঁটা পড়ছে সেই বিস্মিত হবার ভঙ্গি করে বলছে, গাছ মুতে দিয়েছে। এই রসিকতায় হেসে তিনজনই গড়াগড়ি খাচ্ছে। ভাবের রাজ্যে কোনো রসিকতাই পুরনো হয় না। প্রথমবার যেমন হাসি হাসে সপ্তমবারেও তেমন হাসি হাসে। বরং বেশি হাসে। এই হাসি এই আনন্দ যে-কোনো মুহূর্তে গভীর বিষাদে রূপান্তরিত হতে পারে। এদের এখনো হচ্ছে না কারণ এরা তিন জন। আনন্দের ভাব প্রবল থাকে যখন সংখ্যায় তিন বা তিনের বেশি থাকে। দুজন থাকলে উল্টোটা হয়।

এদের পোষাক আশাকেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। মোবারকের শাল এবং মাথার টুপি জহির গায়ে দিয়ে বসে আছে। মোবারক বসে আছে গেঞ্জি গায়ে কারণ তার শার্টে ডাইল পড়ে গেছে। জহির বসে আছে, বাকি দুজন মাথার নিচে হাত দিয়ে শুয়ে আছে।

মোবারক বলল, ক্ষিধে লেগেছে।

বজলু উঠে বসতে বসতে বলল, ক্ষিধে লেগেছে।

জহির বলল, ক্ষিধার চোটে পেট জ্বলে যাচ্ছে।

ভাবের রাজ্যে ভিন্নমতের স্থান নেই। সবাই সব বিষয়ে একমত হয়। এখানেও তাই। একজনের ক্ষিধে লাগলে সবার লাগতে হবে।

বজলু বলল, ক্ষিধে লাগলে মাকড়সা কী করে জানিস?

মোবারক উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইল, কী করে?

যদি পোকা মাকড় না থাকে তাহলে নিজের একটা দুটা পা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে। ক্ষিধা মিটায়।

বলিস কী?

হুঁ। পা খেয়ে ফেললেও সমস্যা নেই। মাকড়সাদের পা আবার গজায়। টিকটিকির মত। টিকটিকির যেমন লেজ গজায়। মাকড়সারও পা গজায়।

জহির সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, দোস্ত সত্যি কথা বলছিস তো?

বজলু বিরক্ত হয়ে বলল, আমি কোনদিন মিথ্যা বললাম? তোরা বুকে হাত দিয়ে বল, মিথ্যা কোনদিন বলেছি?

না, তা অবশ্যি ঠিক।

মাকড়সার পা খাওয়ার বিষয়ে যা বললাম, এটাও ঠিক। আমরা মাকড়সা হলে ভাল হত। নিজেদের পা নিজেরা খেয়ে বসে থাকতাম। কিংবা আমি খেতাম মোবারকেরটা। মোবারক খেত আমারটা।

মোবারক ঘেন্নায় মুখ কুঁচকে বলল, অসম্ভব। আমি মরে গেলেও মানুষ খাব না।

খাওয়ার ব্যবস্থা নেই বলে তুই খাচ্ছিস না। খাবার ব্যবস্থা থাকলে তুই খেতি।

খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও খেতাম না।

তুই নিজেকে বেশি চিনে ফেলেছিস?

আমাকে আমি চিনি না আর তুই চিনে ফেললি?

অবশ্যই আমি তোকে চিনি। চোর চিনতে সময় লাগে না। তুই একটা বিরাট চোর। থিফ নাম্বার ওয়ান। থিফ অফ বাগদাদের মত তুই হলি থিফ অফ ঢাকা।

মোবারক হতভম্ব গলায় বলল, আমি চোর?

বজলু বলল, অবশ্যই চোর। তুই বুকে হাত দিয়ে বল যে শালটা তুই গায়ে দিয়েছিস এটা চুরির মাল না?

মোবারক বুকে হাত দিয়ে বলল, এই শালটা আমার এক দূর সম্পর্কের মামার। মামার কাছে একটা কাজে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় মামা বললেন, আমার একটা পুরনো শাল আছে। নিয়ে যা।

এ রকম দিলদরিয়া মামা তোর আছে? এক কথায় শাল দিয়ে দিল?

হার্ট বড় লোকজন পৃথিবীতে আছে না? আমার এই মামার হার্ট খুবই বড়। সব সময় না। মাঝে মাঝে বড়। মনে কর আমার একশ টাকার দরকার। আমি যদি মামার পায়ে ধরে কেঁদে পা ভিজিয়েও দেই কোনো লাভ হবে না। আবার কোনোদিন চলে আসার সময় হুট করে বলবে–ধর রিকশা ভাড়া নিয়ে যা। বলেই একটা একশ টাকার নোট ধরিয়ে দেবে।

তুই যে শুধু চোর তাই না, তুই মিথ্যা কুমার। সমানে মিথ্যা কথা বলছিস।

আমি যদি মিথ্যা বলে থাকি তাহলে আমি অসতী মায়ের জারজ সন্তান।

জহির বলল, আহা তোরা কী শুরু করলি। চুপ কর না। সামান্য ভদকা আছে এক ঢোক করে হবে। ফিনিশিং টাচ। এখন খাবি না পরে খাবি?

বজলু বলল, এখনই খাব। পরে আবার কী?

জিনিস কিন্তু শেষ। আর কিছুই নাই।

লাগবে না। ভদকা পেটে এক ফোঁটা পড়লেই হবে।

জহির বলল, তোরা চাইলে আমি ব্যবস্থা করি। আমার কাছে টাকা আছে।

মোবারক বলল, কত টাকা আছে?

বজলু বলল, খবরদার কত টাকা আছে বলবি না। মোবারক হাপিস করে দেবে। হারামজাদা বিরাট চোর। থিফ অফ ঢাকা।

মোবারক চোখ লাল করে বলল, আমি যদি চোর হয়ে থাকি তাহলে এই মাটি ছুঁয়ে বলছি— আমি অসতী মায়ের গর্ভের জারজ সন্তান।

জহির বলল, তোরা একটু চুপ করবি? চেঁচামেচি শুরু করলি কেন?

মোবারক বলল, তাতে তোর অসুবিধা হচ্ছে? তুই ঝিম মেরে বসে আছিস বসে থাক।

জহির বলল, কোলকাতার একটা গল্প মনে পড়েছে।

জহির বছর তিনেক আগে চারদিনের জন্য কোলকাতায় গিয়েছিল। সেই গল্প তিন বছরেও শেষ হয় নি। কোনোদিন শেষ হবে বলেও মনে হচ্ছে না। যে-কোনো পরিস্থিতিতে যে-কোনো উপলক্ষে তার কোলকাতার একটা গল্প থাকে। জহির উৎসাহের সঙ্গে শুরু করল।

হয়েছে কী— রাত তখন দুটা, আমি আর শিবেন ট্যাক্সি করে যাচ্ছি। রাস্তাঘাট ফাঁকা। যাচ্ছি গড়িয়াহাটার দিকে। গড়িয়াহাটা জায়গাটা কোথায় বলি…

গড়িয়াহাটা জায়গা কোথায় বলতে হবে না। তুই গল্প শেষ কর।

আমাদের ট্যাক্সির ড্রাইভার পাঞ্জাবি। শিখ। মাথায় পাগড়ি…।

মাথায় কী বলার দরকার নাই। শিখরা মাথায় পাগড়ি পরে সবাই জানে। গল্প শেষ কর।

ট্যাক্সি যাচ্ছে। আমার ঝিমুনির মত এসেছে।

ঝিমুনির মত আসবে আবার কী? তোরতো ঝিমুনি লেগেই আছে।

প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ হার্ড ব্রেক। আমার ঘুম গেল ভেঙে। শিখ ড্রাইভার বলল, সে আর যাবে না।

মোবারক বলল, যাবে না মানে। মাঝপথে প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দেবে? ইয়ারকি? লাথি মেরে হারামজাদাকে ট্যাক্সি থেকে ফেলে দেয়া দরকার। তুই কী করলি?

আমি ভদ্রভাবে বললাম, ভাই কেন যাবেন না। সমস্যা কী?

বাংলায় বললি?

হিন্দিতেই বলেছি। ভুল হিন্দি। ট্যাক্সি ড্রাইভাররা আবার ভুল হিন্দিটাই ভাল বুঝে। সব সময় ভুল হিন্দি শুনেতো।

হিন্দিটা কী?

ভাইয়া! কেউ নাহি জায়েগি। প্রবলেম কিয়া হুয়া?

ড্রাইভার কী বলল?

ড্রাইভার বলল, বিল্লি মে কাট দিয়া।

কী বলল আবার বল।

বলল— বিল্লি মে কাট দিয়া।

এর মানে কী?

জহির রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, মানে হচ্ছে তার গাড়ির সামনে দিয়ে একটা বিড়াল চলে গেছে। বিড়ালটা রাস্তার এক পাশ থেকে আরেক পাশে গিয়েছে।

তাতে সমস্যা কী?

সমস্যা আছে। শিখ ড্রাইভাররা বিশ্বাস করে গাড়ির সামনের রাস্তা যদি বিল্লি মে কাট দেয় তাহলে মহাবিপদ। এ্যাকসিডেন্ট হবেই। তখন তারা কিছুতেই গাড়ি ঐ রাস্তা দিয়ে চালাবে না। গাড়ি রাস্তার এক পাশে নিয়ে অপেক্ষা করবে। অন্য কোনো গাড়ি যদি পার হয় তাহলেই বিল্লি কাটার দোষ কাটা যাবে।

বাক্যটা কী?

বিল্লি মে কাট দিয়া।

তিনজনই একসঙ্গে হাসতে শুরু করল। এর পরের ঘটনা অতি বিচিত্র। কিছুক্ষণের জন্যে হাসি থামে, তখন একজন বলে, বিল্লি মে কাট দিয়া। সঙ্গে সঙ্গে সমবেত হাসি শুরু হয়। সেই হাসি থামতেই আরেকজন বলে, বিল্লি মে কাট দিয়া। আবারো হাসি শুরু হয়। হাসতে হাসতে এদের চোখে পানি এসে গেল। তাতেও হাসি থামে না।

সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে পুলিশ টহলে আসে রাত একটার দিকে। টহল মানে চাঁদা তোলা। নিশিকন্যাদের রোজগারের একটা অংশ পুলিশকে দিতে হয়। এদের সঙ্গে যে সব কাস্টমার থাকে, ধমক ধমক দিয়ে তাদের কাছ থেকেও কিছু আদায়ের চেষ্টা করা হয়। তবে নেশারুদের এরা ঘটায় না।

হাসির শব্দে আকৃষ্ট হয়ে দুজন টহল পুলিশ এগিয়ে এল। ওদের গায়ে টর্চের আলো ফেলে বলল, কী হয়েছে?

তিনজনই হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বলল, বিল্লি মে কাট দিয়া। বিল্লি মে কাট দিয়া।

পুলিশ টর্চ নিভিয়ে চলে গেল। তার কিছুক্ষণ তার আধবুড়ো এক লোককে দেখা গেল। ভীত চেহারা। সে সঙ্গে মেয়ে নিয়ে এসেছে। নিরিবিলি জায়গা খুঁজছে। বজলু বলল, এই যে ওল্ড ব্রাদার, অন্য জায়গায় যান। এই জায়গাটা ভাল না। এই জায়গা বিল্লি মে কাট দিয়া।

 

রাত অনেক হয়েছে। তিন বন্ধুই পাশাপাশি শুয়ে আছে। তাদের গায়ে মোবারকের শাল। জহির ঘুমুচ্ছে। শান্তির গাঢ় ঘুম। জেগে আছে মোবারক এবং বজলু। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাদের আলোয় কুয়াশা চকচক করছে। মোবারকের কাছে কুয়াশাটাকে মনে হচ্ছে হালকা শাদা পশমে বোনা বিশাল এক চাদর। কেউ একজন যেন পৃথিবীতে বিশাল এক চাদর পাঠিয়েছে। যে চাদর দিয়ে পৃথিবীর সব দুঃখী মানুষকে ঢেকে দেয়া যায়।

মোবারক একটা হাত রাখল বজলুর গায়ে।

বজলু বলল, কিছু বলবি?

মোবারক বলল, দোস্ত তোকে একটা মিথ্যা কথা বলেছি। আমি আসলেই চোর। এই শালটা আমি চুরি করে এনেছি।

বাদ দে।

না দোস্ত বাদ দিব কেন? আমি চোর। বিরাট চোর। আমি অসতী মায়ের জারজ সন্তান।

আহ্ বাদ দে না।

মোবারক কাঁদতে শুরু করল। জহির বলল, দোস্ত কাঁদিস না। কান্না থামা। তোর পায়ে ধরি কান্না থামা।

মোবারক কাঁদছে। মোবারকের কান্না দেখে বজলুরও কান্না পেয়ে গেছে। সেও কাঁদছে। তাদের গায়ে গাঢ় হয়ে কুয়াশা পড়ছে। কান্না থামানোর জন্যে জহির একবার মোবারকের পায়ে ধরছে আরেকবার ধরছে বজলুর পায়ে।

আজ মোবারকের বসার জায়গা হয়েছে

আজ মোবারকের বসার জায়গা হয়েছে অন্য একটা ঘরে। প্রমোশন না ডিমোশন বোঝা যাচ্ছে না। এই ঘরটা আগেরটার চেয়ে বড়। তবে মেঝেতে কার্পেট নেই, দেয়ালে পেইনটিং নেই। সোফা আছে। সোফার কভার ময়লা। প্রথমবারের ঘরে মোবারক একা বসে ছিল। এই ঘরে আরো লোকজন আছে। সবার মধ্যে এক ধরনের ব্যস্ততা। মোবারক কিছুক্ষণ বসতেই বড় ট্রে ভর্তি চা নিয়ে একজন ঢুকল। সে সবাইকে চা দিচ্ছে। গণ-চা হয় খুব কুৎসিত হবে, আর নয়তো খুব ভাল হবে। এই চা-টা ভাল। শুধু চা না, দেখা গেল আরেকজন প্লেট ভর্তি কেক নিয়ে এসেছে। কেকের প্লেট রাখা হয়েছে সামনের টেবিলে। কেউ কেক নিচ্ছে না। মনে হচ্ছে দ্রতা করছে। মোবারক উঠে গিয়ে দুই পিস নিয়ে নিল। একটা আপাতত জমা থাকুক চায়ের কাপের পিরিচে।

কিছুক্ষণ পর পর ম্যানেজার সাহেব ঢুকছেন। একজন দুজন করে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন। ম্যানেজার সাহেব আজ স্যুট পরেছেন। ভদ্রলোককে স্যুটে একেবারেই মানাচ্ছে না। টাই-এ ইস্ত্রী নেই বলে টাই এর মাথা উঁচু হয়ে আছে। মনে হচ্ছে টাইটা মাথা উঁচু করে আশে পাশে কি হচ্ছে দেখার চেস্টা করছে। কোনো কারণে ম্যানেজার সাহেবের মনও মনে হয় খারাপ। তাঁকে মিয়ানো মুড়ির মত লাগছে।

ম্যানেজার সাহেব মোবারকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বোঝাই যাচ্ছে ডাক পড়েছে। এক পিস কেক এখনো রয়ে গেছে, খাওয়া হয় নি। থাক ফিরে এসে খাওয়া যাবে।

মোবারক সাহেব কেমন আছেন?

জ্বি ভাল।

আসুন আমার সঙ্গে।

কোথায় যাব? বড় সাহেবের কাছে?

আপাতত আমার ঘরে।

আপনি নিজে এলেন কেন? কাউকে দিয়ে ডেকে পাঠালেই হত।

ডেকে পাঠানোর লোক নেই। অফিস স্টাফের দুইজন আজ আসেই নি। একজন গেছে ছুটিতে।

স্যার, আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি— আপনার উপর চাপ বেশি পড়েছে। আপনার বিশ্রাম দরকার।

ম্যানেজার সাহেব এই গভীর আন্তরিকতায় অভিভূত হলেন না। বিষাদময় মুখ করে মোবারককে অফিসে নিয়ে গেলেন। মোবারককে তার সামনের চেয়ার বসতে বললেন।

মোবারক বলল, স্যার, ডাক্তারের রিপোর্ট কি এসেছে?

হ্যাঁ এসেছে। রিপোর্ট পজেটিভ।

আপনার এই ঘরে কি সিগারেট খাওয়া যায়?

হ্যাঁ যায়।

মোবারক সিগারেট ধরাল। ম্যানেজার সাহেব বললেন, ঝামেলা যখন ঘাড়ে এসে পড়ে একসঙ্গে আসে। আমার হয়েছ মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা। কোন হেল্পিং হ্যান্ড নাই— অথচ আজকের মধ্যে আপনার পাসপোর্ট করাতে হবে। ভিসার জন্যে কাল পাসপোর্ট জমা দেব। কোথায় যাওয়া হবে সেটা নিয়ে ফ্যাকড়া বেঁধেছে।

কী ফ্যাকড়া?

স্যারের বড় মেয়ের জামাই বলছে অপারেশনটা ইংল্যান্ডে করাতে–কুইনস হসপিটাল। তার নাকি চেনা জানা আছে। এদিকে মেজো মেয়ের জামাই থাকেন সুইজারল্যান্ডে; তিনি সেখানে সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

কোথায় যাওয়া হবে এখনো ঠিক হয় নি?

ঠিক হয়েছে। সুইজারল্যান্ডে যাওয়া হবে। আসগর সাহেব এটা নিয়ে খুবই আপসেট। স্যারের সঙ্গে উনার যাবার কথা। উনি মনে হয় যাবেন না।

অজগর সাহেব কি উনার বড় মেয়ের জামাই?

জ্বি। অজগর না-আসগর। চলুন উনার সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দেই।

উনার সঙ্গে কথা বলে কী হবে?

আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলেন।

চলুন যাই।

বসুন এক কাপ চা খেয়ে যাই। সকালে বাসা থেকে যে বের হয়েছি এক কাপ চা পর্যন্ত খেতে পারি নি। আপনি খাবেন?

অবশ্যই খাব। আপনি একা একা চা খাবেন এটা হয় না। এক্সকিউজ মি স্যার আপনিও কি বড় সাহেবের সঙ্গে যাবেন?

এখনও বুঝতে পারছি না। একবার ঠিক হচ্ছে যাব। একবার ঠিক হচ্ছে যাব না। টোটেল কেওস।

আপনি গেলে খুব ভাল হয়।

কেন?

আমিতো আর কাউকে চিনি না। শুধু আপনাকেই চিনি। আপনাকে নিয়ে দেশটা ঘুরে ফিরে দেখতাম। শুনেছি সুইজারল্যান্ডের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোহর।

ম্যানেজার সাহেব কিছু বললেন না। দ্রুত চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন।

চলুন আসগর সাহবের কাছে নিয়ে যাই। ভদ্রলোক খুবই মুডি। উনি কী কথা বলেন, না বলেন শুধু শুনে যাবেন। কোনো আগুমেন্টে যাবেন না।

জ্বি আচ্ছা।

আপনার ছবি তুলতে হবে। পাসপোর্টের জন্যেও ছবি লাগবে। ভিসার জন্যে ছবি লাগবে। গাড়ি দিয়ে দেব, ছবি তুলে নিয়ে আসবেন। পাসপোর্ট ফরমে সই করে যাবেন।

জ্বি আচ্ছা।

আপনি বরং এক কাজ করুন স্যারের বাড়িতে আপনাকে একটা রুমের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। জিনিসপত্র নিয়ে উঠে আসুন। কখন কোন প্রয়োজন হয়। এ বাড়িতে থাকতে কোনো অসুবিধা আছে?

জ্বি না।

চলুন আসগর সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আসি। কথাবার্তা সাবধানে বলবেন। উনার মেজাজ আজ অত্যন্ত খারাপ।

 

আসগর সাহেব বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। তাঁর সামনের ছোট্ট টি টেবিল ভর্তি রাজ্যের পত্রিকা। মোবারককে দেখে ভদ্রলোক চোখ তুলে তাকালেন। মোবারক ভদ্রলোককে সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল। উনি সেই মানুষ যিনি প্রথম দিন অত্যন্ত ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে মোবারককে জিজ্ঞেস করেছেন আনিস সাহেব কি চলে গেছেন?

এই মুহূর্তে ভদ্রলোক যে খুব রেগে আছেন তা মনে হল না। রাগ থাকলেও খবরের কাগজে ধর্ষণ জাতীয় খবর পড়ে মনে হয় রাগ পড়ে গেছে। ম্যানজোর সাহেব তাঁর বিখ্যাত মিনমিনে গলায় বললেন, স্যার ইনিই মোবারক হোসেন।

মোবারক হোসেনটা কে?

কিডনি ডোনার।

ও আচ্ছা আচ্ছা। আপনি বসুন। ম্যানেজার সাহেব আপনি চলে যান। আপনার দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।

জ্বি আচ্ছা।

আসগর সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, ইদানীং লক্ষ করছি আপনি কুঁজো হয়ে হাটছেন? Why? আপনার বাথরুমে আয়না আছে না?

জ্বি আছে।

দয়া করে একটু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখুন— স্যুট পরা লোক যখন কুঁজো হয়ে থাকে তখন তাকে কেমন দেখায়। Please do that.

জ্বি আচ্ছা।

মোবারক লক্ষ করল ম্যানেজার সাহেব বারান্দা থেকে যাবার সময় সত্যি সত্যি কুঁজো হয়েই যাচ্ছেন। আগে কুঁজো হয়ে হাঁটছিলেন না। আসগর সাহেবের কথা শোনার পর থেকে কুঁজো হয়ে হাঁটছেন।

আসগর সাহেব হাত থেকে পত্রিকা নামিয়ে বললেন, আপনি হলেন কিডনি ডোনার!

জ্বি স্যার।

ভেরি গুড। হিউমেন বডির দুটা কিডনির কোনো প্রয়োজন নেই। একটাই মোর দ্যান সাফিসিয়েন্ট। একটা কিডনিতে বাকি জীবন আপনি হেসে খেলে পার করতে পারবেন। আপনি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন না।

মোবারক তার মুখ হাসি হাসি করে দেখাবার চেষ্টা করল যে সে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত না। তবে মনে মনে বলল, একটা কিডনিই যদি মানুষের জন্যে যথেষ্ট হয় তাহলে তুই তোর দুটা থেকে একটা দিয়ে দিচ্ছিস না কেন? তুই জামাই মানুষ। শ্বশুরের জীবন রক্ষার জন্য তুই কিছু করবি না? তোর একটা দায়িত্ব আছে? শ্বশুরের সম্পত্তিতো তোরা জামাইরাই হাতাবি। এক কাজ কর— তুই একটা কিডনি দে আর সুইজারল্যান্ডের জামাই দিক একটা। শ্বশুর পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাক।

আসগর সাহেব বললেন, অপারেশন যেটা হবে সেটাও রুটিন অপারেশন। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট এত হচ্ছে যে ব্যাপারটা টনসিল তোলার মত সহজ হয়ে গিয়েছে। কিছুদিন আগেও কোনো ফরেন বডি শরীর এক্সসেপ্ট করত না। শরীরের Immune systems allow করত না। নতুন একটা ড্রাগ এই প্রবলেম একশ ভাগ সলভ করেছে। ড্রাগটার নাম…।

জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হচ্ছে। ইচ্ছা থাকলেও এই জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় অংশ গ্রহণ করা মোবারকের পক্ষে সম্ভব না। হাসি হাসি মুখে বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই।

অপারেশনটা সুইজারল্যান্ডে হচ্ছে শুনেছেন বোধহয়?

জ্বি।

A very wrong decision. সুইসরা ঘড়ি বানানো ছাড়া আর কিছু পারে। কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টতো আর ঘড়ি বানানো না। জটিল মেডিক্যাল প্রসিডিউর। ঠিক না?

অবশ্যই ঠিক।

অপারেশন এমন হসপিটালে হওয়া উচিত যেখানে সকাল বিকাল এই অপারেশন হচ্ছে। যেমন ধরেন ব্যাংককের আমেরিকান হসপিটাল। কিংবা ইন্ডিয়ার মাদ্রাজ। আমার ফার্স্ট চয়েস ছিল মাদ্রাজ। অবশ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিতে এ ধরনের অপারেশনের কিছু রিস্ক আছে। পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারটা হয় না। যে কারণে আমি ইংল্যান্ডের কুইনস হসপিটালের কথা বলেছিলাম।

স্যার আপনি খুব ভাল কথা বলেছেন। অতি ভাল সাজেশন।

আসগর সাহেব হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, এ বাড়ির সমস্যা হচ্ছে— এই বাড়ির লোকজন ভাল কথা, ভাল সাজেশন বলে কিছু বিশ্বাস করে না। কেউ একটা ভাল সাজেশন দিলে এরা ইমিডিয়েটলি সেটা কমোডে ফেলে ফ্ল্যাস করে দেবে। সেই আইডিয়া বর্জ্য পদার্থের সঙ্গে চলে যাবে সিউয়ারেজে।

মোবারক মুখ হাসি হাসি করে রাখলেও মনে মনে বলল, ব্যাটা শুধু তোর সাজেশনস না, তোকে শুদ্ধ কমোডে ফেলে ফ্ল্যাস করে দেয়া দরকার। আমি এখানে বসার পর থেকে তুই সমানে কথা বলে যাচ্ছিস। তুইতো কথা বলেই কুল পাস না। তুই সাজেশনস কখন দিবি?

আসগর সাহেব মোটামুটি হতাশ গলায় বললেন, আমার একটা সাজেশন ছিল— দুজন ডোনার নিয়ে যাওয়া। যাতে একজন ডোনারের ব্যাপারে শেষ মুহূর্তে কোনো কমপ্লিকেশন হলে অন্য একজন স্ট্যান্ডবাই থাকে। এমনতো না যে ডোনার পাওয়া যাচ্ছে না বা টাকার অভাব হয়েছে। আমি কি কিছু ভুল বলছি?

অবশ্যই না। স্যার আপনিও কি যাচ্ছেন?

আমাকেতো যেতেই হবে। রুমা যেতে পারবে না। কারণ রুমার ছেলে স্কলাসটিকায় পড়ে। স্কুল থেকে ওরা একটা ড্রামা করছে ছেলে সেখানে সুযোগ পেয়েছে। চার্লস ডিকেন্সের আলিভার টুইস্ট। আঠারো তারিখে স্টেজ হবে। চিফ গেস্ট হলো আমেরিকান এ্যাম্বেসেডর। এত বড় একটা অনুষ্ঠানে বাবা-মা কেউ থাকবে না— তাতো হয় না।

মোবারক বলল, অবশ্যই হয় না। এতে শিশুমনের উপর একটা চাপ পড়ে। চাপের কারণে পরবর্তি সময়ে এইসব ছেলেপুলে গাধা টাইপ হয়ে যায়। স্যার আমি উঠি? আমার আবার পাসপোর্টের জন্যে ছবি তুলতে হবে।

আসগর সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, এখনো পাসপোর্ট হয় নি? কুঁজো ম্যানেজারটা করছে কী? একেতো কানে ধরে উঠবোস করানো দরকার।

মোবারক অতিরিক্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, স্যার যাই। আপনার সঙ্গে কথা বলে এত ভাল লেগেছে।

আসগর সাহেব জবাব না দিয়ে হাতে আরেকটা খবরের কাগজ তুলে নিলেন।

 

মোবারক পাসপোর্টের ফরমে সই করতে করতে বলল, সুইজারল্যান্ড জায়গাটিতে শীত কেমন পড়ে?

ম্যানজোর সাহেব বললেন, ভাল শীত। বরফ পড়ে। সারা ইউরোপ থেকে লোকজন স্কী করতে সুইজারল্যান্ডে আসে।

শীতের কাপড় চোপড়তো সঙ্গে নেয়া দরকার।

ম্যানেজার সাহেব বললেন, হুঁ।

মোবারক চিন্তায় পড়ে গেল। হুঁ বলে চুপ কলে গেলেতো হবে না। শীতের কাপড় কেনার টাকা পয়সা লাগবে না! গরম কাপড় ছাড়াওতো কিছু কাপড় দরকার। বিদেশ যাত্রা বলে কথা। মহাত্মা গান্ধী হলে নেংটি পরে প্লেনে উঠে পড়া যেত। সঙ্গে দড়ি বাঁধা দুর্বল ছাগী থাকলেও কেউ কিছু বলত না। ছাগীটাকে তার পাশের সীটে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করত। প্লেনের মধ্যেই ছাগলের দুধ দোয়ানোর ব্যবস্থা হত। এয়ার হোস্টেসরা হেল্প করতেন।

লজ্জা করে চুপ করে থাকা বিরাট বোকামি হবে। টাকা চেয়ে ফেলা দরকার। কাপড় চোপড়ের জন্যে আলাদা টাকা যদি না দেয় তাহলে বরং এই টাকাটা কিডনির দামের সঙ্গে এডজাস্ট করে দেবে। কিডনির দাম কখন দেবে সেটাও পরিষ্কার হওয়া দরকার। বড়লোকের কারবার— এরা জিনিস হাতে না পেয়ে দাম দেবে বলে মনে হয় না। খোদা না করুক অপারেশন টেবিলে সে যদি মারা যায় তাহলে কী হবে। টাকাটা পাবে কে?

মোবারক খুক খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে নিচু গলায় বলল, ম্যানেজার সাহেব, কাপড় চোপড় কেনার জন্যে আমার কিছু টাকা দরকার।

ম্যানেজার মুখ তুলে তাকাল। মনে হচ্ছে এমন অদ্ভুত কথা সে জীবনে শুনেনি।

মোবারক তেলতেলে মুখ করে বলল, হাতে তো সময় বেশি নেই। কাপড় চোপড় এখনি কেনা দরকার।

ম্যানেজার এখনো তাকিয়ে আছে। চোখের পলক ফেলছে না। মোবারক হাই তোলার ভঙ্গি করতে করতে বলল, বন্ধু বান্ধবের কাছে কিছু ধারদেনা আছে। যাওয়ার আগে শোধ করে যেতে চাই। কিছুতো বলা যায় না, ধরেন। উল্টা-পাল্টা কিছু যদি হয়।

উল্টা-পাল্টা মানে?

আপনার স্যার কিডনি নিয়ে বেঁচে উঠলেন— আমি গেলাম ফুটে।

আপনি ফুটে গেলেন মানে?

ফুটে গেলাম মানে মরে গেলাম। ফুল ফোঁটা আর মানুষ ফোঁটা আলাদা ব্যাপার।

এখন আপনার কত টাকা দরকার?

মোবারক বিপদে পড়ে গেল। এটা একটা ঝামেলার প্রশ্ন। কত টাকা এরা দেয়ার জন্যে প্রস্তুত তা না জেনে টাকা চাওয়াটা ঠিক হবে না। এরা কত টাকা দিতে পারে সেটা জানারও তো কোনো বুদ্ধি নেই।

মোবারক ক্ষীণ গলায় বলল, সেটা আপনার বিবেচনা। আর গরম কাপড় চোপড়ে কত লাগে তাও জানি না। কাপড় বানানো হয় না অনেক দিন।

ম্যানেজার সাহেব বললেন, আপনাকে একটা বুদ্ধি দিচ্ছি— নতুন গরম কাপড় কিনতে যাবেন না। বঙ্গবাজার চলে যান, সস্তায় প্রচুর ভাল কাপড় পাবেন। ফিটিং-এ সমস্যা হলে দরজি দিয়ে ফিটিং করিয়ে নেবেন। হাজার খানিক টাকায় সব কাপড় হয়ে যাবে।

জ্বি আচ্ছা। আর বন্ধু-বান্ধবের কাছে কিছু ঋণ ছিল। ঋণ রেখে মরতে চাই না।

মরবেন কেন?

মোবারক বলল, দুদিন থেকে মনের মধ্যে কুডাক শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে মারা যাব। এই জন্যে ঠিক করেছি আত্মীয়-স্বজন সবার সঙ্গে দেখাও করে যাব। আমার নিকট আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। দাদিজান বেঁচে আছেন। থাকেন নেত্রকোনায়। উনাকে দেখতে যেতে হবে। ভাবছি উনার জন্যে একটা শাড়ি, আর গরম চাদর নিয়ে যাব। বুড়ি খুশি হবে। ভাল একটা গরম চাদরের দাম কত হবে ম্যানেজার সাহেব জানেন?

জানি না।

সস্তায় পুরনো গরম চাদর অবশ্যই পাওয়া যাবে। পাওয়া গেলেও বুড়িকে নতুন চাদরই দিতে চাই। দাম যতই হোক। বুড়ির দিন শেষ। মরেইতো যাবে। নতুন গরম চাদর গায়ে দিয়ে মরুক। মৃত্যুর সময় ঠাণ্ডা কম লাগবে।

ম্যানেজার সাহেব বললেন, কিছু ক্যাশ আমি দিচ্ছি। কেনাকাটা যা করার করুন। যে কাজগুলি আপনাকে করতে হবে তা হল— প্রথমেই বার কপি ছবি তুলবেন। পোলারয়েড ক্যামেরায় ছবি সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেবে। আপনার সঙ্গে লোক দিয়ে দিচ্ছি, সে ছবি নিয়ে চলে যাবে। গাড়ি আপনার সঙ্গে থাকুক।

গাড়ি মানে?

আপনাকে একটা গাড়ি দিয়ে দিচ্ছি। ইচ্ছা করলে সারাদিন গাড়ি রাখতে পারেন। সন্ধ্যার দিকে গাড়ি এবং আপনার কাপড় চোপড় নিয়ে চলে আসবেন। এখানে আপনার জন্যে রুম রেডি করে রাখব। সুইজারল্যান্ড যাবার আগ পর্যন্ত আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন।

মোবারকের অস্বস্তি লাগছে। ব্যাপার বোঝা যাচ্ছেনা। এরা কি তাকে বন্দি করে ফেলছে? এদের চোখের নজর থেকে বাইরে যাওয়া যাবে না এই অবস্থা।

স্যার আমার তো একটু দাদির সঙ্গে দেখা করা দরকার।

দাদির সঙ্গে আপনি তো আর আজই দেখা করছেন না। ভিসা হয়ে যাক, তারপর স্যারকে বলে একদিনের ছুটি নিয়ে ঘুরে আসবেন।

মোবারক ইতস্তত করে বলল, আজ থেকেই এই বাড়িতে থাকার আমি প্রয়োজন দেখি না। শেষ কয়েকটা দিন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, গল্প করে কাটাতে পারলে ভাল হয়।

ম্যানেজার সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, মোটেই ভাল হয় না। আপনার জন্যে সব ব্যবস্থা করা থাকবে। সন্ধ্যার মধ্যে আপনি অবশ্যই এ বাড়িতে ফিরে আসবেন। আজ সন্ধ্যার পর স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।

একবার তো কথা হয়েছে। আর কথা বলাবলির কী আছে?

ম্যানেজার সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, স্যার বলেছেন সন্ধ্যার পর আপনার সঙ্গে কথা বলবেন এই জন্যেই আপনাকে আসতে হবে। নিন এইখানে সই করুন।

মোবারকের বুক ধক করে উঠল, কোথায় সই করিয়ে নিচ্ছে কে জানে। আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়— এই জাতীয় কোনো লেখা নাতো?

মোবারক বিড়বিড় করে বলল, সই করব কেন?

টাকা নেবেন, সই করবেন না? অডিটের কাছে আমাকে হিসাব দিতে হবে না? গরিব মানুষের টাকা পয়সার হিসাব থাকে না, কিন্তু ধনী মানুষের প্রতিটি পয়সার হিসাব থাকে।

মোবারক সই করল। কত টাকা তাকে দেয়া হচ্ছে পাশে লেখা আছে। লেখা অংকটা বিশ্বাস হচ্ছে না। পঁচিশ হাজার টাকা। মোবারকের মনে হচ্ছে টাকা আসলে দুই হাজার পাঁচশ। একটা শূন্য বেশি লেখা হয়েছে। দশমিকের ফুটা বসাতে গণ্ডগোল হয়ে গেছে। এই টাকায় ম্যানেজার সাহেবের কোনো কমিশন আছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। কমিশন তো থাকবেই। টাকা পয়সার লেনদেন হবে, কমিশন থাকবে না। তা হয় না।

 

মোবারক গাড়িতে বসে আছে। গাড়ির মালিক যেভাবে বসে সে সেইভাবেই বসেছে। পেছনের সীটে বসেছে। একটা হাত ছড়িয়ে দিয়ে একটুখানি কাত হয়ে বসা। মোবারকের পকেটে সত্যি সত্যি পঁচিশ হাজার টাকা। একশ টাকার দুটো ব্যান্ডেল, পঞ্চাশ টাকার একটা বান্ডেল। প্যান্টের পকেট ফুলে আছে। গাড়ি থেকে নামার সময় ভাল করে চেক করতে হবে। একটা বান্ডেল পড়ে গেলে সর্বনাশ।

মোবারক বলল, ড্রাইভার সাহেব আপনার গাড়িতে তেল আছে তো?

ড্রাইভার বলল, জ্বি আছে।

মোবারক উদাস গলায় বলল, না থাকলেও সমস্যা নেই। তেল নিয়ে নেব। গাড়িতে গান শোনার ব্যবস্থা কি আছে?

জ্বি আছে।

দিন গান দিন।

ইংরেজি না বাংলা?

ইংরেজি বাংলা হিন্দি একটা দিলেই হয়। আর শুনুন গাড়ি একটু স্লো চালান। তাড়াহুড়ার কিছু নাই। প্রথমে একটা ফটোগ্রাফারের দোকানে যেতে হবে, ছবি তুলতে হবে।

গাড়ি চলছে। গান বাজছে। ইংরেজি গান— কী অদ্ভুত গানের কথা—

Five Six Seven Eight
My boot scooting Baby
Is driving me crazy

বান্ডেল খুলে টাকা বের করতে মায়া লাগছে

বান্ডেল খুলে টাকা বের করতে মায়া লাগছে। মায়া করে লাভ নেই। টাকা খরচ করতেই হবে। টাকার বান্ডেল দেখিয়েতো আর সওদা করা যাবে না। এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট কিনতে গিয়ে মোবারক পুরো কার্টুনই কিনে ফেলল। হঠাৎ এতগুলি টাকা পাওয়া গেছে। বন্ধুবান্ধবকে কিছু না দিলে নিজেকে চশমখোরের মত লাগবে। ড্রাইভার বেচারা তাকে নিয়ে ঘুরছে। তাকেও এক প্যাকেট সিগারেট দেয়া দরকার। সে খুশি থাকবে। মানুষের উচিত তার সাধ্যমত সবাইকে খুশি রাখা।

মোবারক হাসি মুখে বলল, ড্রাইভার সাহেব আপনার নাম কী?

ড্রাইভার বলল, স্যার আমার নাম কিসমত।

ড্রাইভার তাকে স্যার বলছে এটাও বিস্ময়ের ঘটনা। ইতিহাসের বই-এ লিখে রাখার মত ঘটনা।

কিসমতের দেশ কোথায়?

কুমিল্লা।

কুমিল্লা অত্যন্ত ভাল জায়গা। বিউটিফুল। আপনি সিগারেট খান?

জ্বি সামান্য বদঅভ্যাস আছে।

মোবারক বেনসনের প্যাকেট এগিয়ে দিল। উদার গলায় বলল, আমার সামনেই খান। কোনো অসুবিধা নেই। তবে ধূমপান ছাড়ার চেষ্টা করবেন। অতি পাজি নেশা। লাভের লাভ কিছু হয় না শুধু ক্ষতি।

ড্রাইভার বিস্মিত হয়ে সিগারেটের প্যাকেট নিল। মোবারক বলল, রাস্তার পাশে যে চায়ের স্টল আছে তার কোনো একটার সামনে থামান। আসুন চা খাই। ফুটপাত টি। এর মজাই আলাদা। চা খেতে খেতে সওদাপাতি কোথায় করব ভেবে নেই।

ড্রাইভার ফুটপাতের এক চায়ের দোকানে থামল। গাড়ির দরজা খোলা রেখে গাড়িতে বসে চা খাওয়ার আনন্দই অন্যরকম। মোবারকের মনে হল বেহেশতেও নিশ্চয়ই এ জাতীয় ব্যবস্থা আছে। বেহেশতবাসিরা গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গাড়ির ড্রাইভার একজন হুর। বেহেশতের ফুটপাতে গাড়ি থামছে। ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে এক গেলমান চা নিয়ে দৌড়ে চলে এল।

ড্রাইভার সাহেব!

জ্বি স্যার।

গানের ক্যাসেটগুলি আমার পছন্দ হচ্ছে না। Five Six Seven Eight কী রকম গান? এটা হল ধারাপাতের নামতা। গরম কাপড়ের দোকানে যাবার আগে কোনো একটা ক্যাসেটের দোকানে যাবেন। পুরনো দিনের গান কিনতে হবে— একটা গান লিখ আমার জন্যে টাইপ।

জ্বি আচ্ছা।

ইচক দানা বিচুক দানা ঐ গানটা খোঁজ করতে হবে। এক সময় হিট গান ছিল। আরেকটা হিট গান হল মেরা জুতা হায় জাপানী। আগে এইসব গান চায়ের দোকানে বাজাত। এখন আর চায়ের দোকানে গান বাজে না। আগে চারিদিকে আনন্দ ছিল। এখন চারদিকে নিরানন্দ।

খাঁটি কথা বলেছেন স্যার।

ড্রাইভার সাহেব আপনার ক্ষিধে লাগলে বলবেন। ভাল কোনো রেস্টুরেন্টে ঢুকে খেয়ে নেব। লজ্জা করবেন না। আর এই একশটা টাকা রাখুন। আমি যখন বাজার সদাই করব তখন আপনার যদি চা-পান খেতে ইচ্ছা করে খাবেন। লজ্জার কিছু নাই।

চা খেতে খেতে মোবারক আজকের দিনের কর্মকাণ্ডের খসড়া মনে মনে তৈরি করে ফেলল। কাগজ কলম থাকলে ভাল হত, লিখে ফেলা যেত। মনের লেখা ঠিক থাকে না। উলট পালট হয়ে যায়।

ড্রাইভার সাহেবের কাছে কি কাগজ কলম আছে?

জ্বি স্যার আছে।

এক পিস কাগজ আর কলম দিনতো লিস্ট করে ফেলি।

ড্রাইভার কাগজ কলম দিল। মোবারক লিস্ট করতে গিয়ে দেখে কিছুই মনে আসছে না। যা করতে হবে তা হল কাগজ কলম হাতে নিয়েই থাকতে হবে। কিছু একটা মনে হলেই লিখে ফেলা। আপাতত তিনটা আইটেম মনে এসেছে। এই আইটেমগুলি লিখে ফেলা যায়—

১. ক্যাসেট পুরনো দিনের গান।

ইচুক দানা বিচুকদানা, মেরা জুতা, একটা গান লিখ। হেমন্তের কোনো এক গাঁয়ের বধু, জগন্ময়ের চিঠি।

২. দাদিজানের জন্যে গরম শাল। দাম দিয়ে কিনতে হবে। ফাইন কোয়ালিটি। ফাইনের উপরেও যদি কিছু থাকে। সুপার ফাইন।

৩. পরিমল দাস। (শয়তান নাম্বার ওয়ান।)

মোবারক ঠিক করল পরিমল দাসের সঙ্গে সে অত্যন্ত ভদ্র ব্যবহার করবে। মাসে চারশ টাকা করে ছয় মাসে হয় চব্বিশশ টাকা। কচকচে একশ টাকার নোটে চব্বিশশ টাকা দেবে। টাকার সঙ্গে এক প্যাকেট বেনসন। এবং একটা লাইটার। টাকাটা দিয়ে বলবে, অসুবিধায় ছিলাম বলে এতদিন দিতে পারি নি। নিজগুনে ক্ষমা করে দেবেন। ছয় মাসে সিট রেন্ট না দেয়ার পরেও যে আপনি মেস থেকে বের করে দেন নি এটা অনেক বড় ব্যাপার। আপনি আমার সঙ্গে যত খারাপ ব্যবহারই করেন না কেন আপনাকে কিছুতেই খারাপ লোক বলা যাবে না। আপনি আসলে অতি মহৎ ব্যক্তি। মেসের ম্যানেজারী করে ধর্ম কর্ম করলে এতদিনে বড় সাধু হয়ে যেতেন।

 

শালের দোকানের সেলসম্যান বলল, স্যার বলুন কোন প্রাইস রেঞ্জের ভেতর মাল দেখাব।

মোবারক বলল, ভাল কিছু দেখান। আমি আমার দাদিজানের জন্যে কিনছি। বুড়ো মানুষ কয়দিন আর বাঁচবে। একটা ভাল শাল গায়ে দিয়ে মরুক।

কালার কী দেখাব স্যার?

কালার কোনো ব্যাপার না। দাদিজান চোখে দেখেন না। চোখে দেখেন বলেই জিনিসটা হতে হবে সুপার ফাইন। যেন হাত দিলেই কোয়ালিটি বোঝা যায়।

মাখনের মত মোলায়েম শাল দেখাব। হাতে নিলে মনে হবে শাল হাতের মধ্যে গলে যাচ্ছে। পাহাড়ি কচি ভেড়ার গায়ের পশমের শাল। তাও সব পশম না। পেটের পশম। পিঠের পশমের না।

পিঠের পশমের সমস্যা কী?

পিঠে সূর্যের আলো বেশি পড়ে, পশম শক্ত হয়ে যায়। দাম স্যার সামান্য বেশি পড়বে। তবে জিনিসের মত জিনিস।

দেখি কেমন জিনিস। বুড়িকে কোনোদিন কিছু দেয়া হয় না। দেব যখন ভাল জিনিসই দেই। আর আপনার এখানে ভাল স্যুয়েটার আছে?

পিওর আফগান উলের স্যুয়েটার আছে। শুধু স্যুয়েটার গায়ে দিয়ে বরফের চাঙে শুয়ে থাকতে পারবেন। কিচ্ছু হবে না। বরং গরমে ঘামাচি হয়ে যাবে।

আমার দুই বন্ধুর জন্যে দুটা ভাল স্যুয়েটার বের করেন। আপনার এখানে সিগারেট খাওয়া যায়?

জ্বি না স্যার। কাপড়ের দোকানতো। তবে আপনি খান অসুবিধা নেই। দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন।

মোবারক বসল। তার খুবই ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে সে ভাবের জগতে চলে এসেছে। একা একা এসেছে বলে সামান্য মন খারাপ হচ্ছে। শাল এবং স্যুয়েটার কেনা হয়ে গেলেই জহির এবং বজলুকে খুঁজে বের করতে হবে। দুপুরে পুরনো ঢাকায় গিয়ে কাচ্চি বিরিয়ানী খাওয়া যায়। কাচ্চি বিরিয়ানী সঙ্গে চিকেন কোরমা। রাতে ছাতিম গাছের নিচে ভাল জিনিস নিয়ে বসতে হবে। বিদেশী জিনিস। সমস্যা হচ্ছে সন্ধ্যার পর বড় সাহেব কথা বলবেন। উনার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে আসতে হবে। দাদিজানের কথা বলে ছুটি নিতে হবে। বিদেশ যাবার আগে মুরুব্বীদের দোয়াতো নিতেই হবে। বড় সাহেব আপত্তি করবেন বলেতো মনে হয় না।

 

বজলু বা জহির কাউকেই পাওয়া গেল না। বজলু যে বাসায় থাকে সে বাসায় এক ভদ্রলোক বের হয়ে কঠিন গলায় বললেন, বজলু নামে কেউ এখানে থাকে না।

মোবারক বলল, কতদিন ধরে থাকে না!

অনেক দিন।

কোথায় থাকে জানেন?

জানি না।

আমি বজলুর ফ্রেন্ড। তার জন্যে একটা চাকরির খোঁজ এনেছি। বান্দরবানে ফরেস্টে। মাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতন। বেতনের বাইরে এক্সট্রা ইনকামও আছে। আজকের মধ্যেই ছবিসহ বায়োডাটা জমা দিতে হবে। যদি একটু কাইন্ডলি বলেন, কোথায় গেলে তাকে পাব।

কোথায় গেলে পাবেন আমি জানি না।

ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

মোবারকের মন সামান্য খারাপ হল। ভদ্রলোক যদি তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতেন তাহলে ভদ্রলোকেরই লাভ হত। এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট পেয়ে যেতেন।

প্যাকেট আশি টাকা। প্রতিটা সিগারেট চার টাকা। খারাপ কী?

জহিরও বাসায় নেই। জহিরের বাবা বারান্দায় বসে ছিলেন। মোবারকের সঙ্গে তার কয়েকবার দেখা হয়েছে, তারপরেও তিনি মোবারককে চিনতে পারলেন না। মনে হয় চোখে ছানী পড়েছে। ছানী পড়া লোকজন রোদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালবাসে। এই লোকও রোদের দিকে তাকিয়ে আছে।

তুমি জহিরের বন্ধু? জ্বি।

অদ্ভুত কথা বললা। জহিরের কোনো বন্ধু আছে বলেতো জানতাম না। জহিরের আছে শত্রু।

ও বাসায় নাই?

না নাই। সকালে রক্ত বমি করেছে। খবর শুনে দৌড় দিয়ে গেলাম। আমাকে বলে— রক্ত না বাবা। পানের পিক।

জর্দা দিয়ে পান খেয়েছি সেই পানের পিক। আরে ব্যাটা তুই আমারে পানের পিক শিখাস। কোনটা রক্ত কোনটা পানের পিক আমি জানি না?

ডাক্তারের কাছে গিয়েছে?

ও কি আর যেতে চায়। আমার বড় ছেলে বলতে গেলে কানে ধরে নিয়ে গেছে।

কোন ডাক্তারের কাছে গিয়েছে জানেন?

জানি না। তোমারে একটা কথা বলি— ডাক্তারে এখন তার কিছু হবে না। তুমি যদি চার পাঁচটা ডাক্তার পানিতে গুলে তাকে খাইয়ে দাও তারপরও কিছু হবে না। আজকে মুখ দিয়ে রক্ত পড়বে, কাল পড়বে নাক দিয়ে, তারপর পড়বে কান দিয়ে। তুমি যখন বলছ তুমি তার বন্ধু তাহলেতো সবই জান।

মোবারক অত্যন্ত বিনয়ের সলে বলল, চাচাজী আমি আসলে কিছু জানি। স্কুলে তার সঙ্গে পড়েছি। বিদেশে চলে গিয়েছিলাম— অল্প কিছুদিন হল ফিরেছি।

তাহলেতো তুমি ঘটনা কিছুই জান না।

জ্বি না। কিছু জানি না।

আমার ছেলে উচ্ছন্নে গেছে।

বলেন কী?

পরশু রাতে তিনটার সময় বাসায় ফিরেছে। আমি দরজা খুলে দিলাম— আমাকে চিনে না। আমাকে বলে— হ্যালো আপনি কে? কাকে চান?

সর্বনাশ।

নিজের বাবাকে বলে হ্যালো হ্যালো আপনি কে?

বাইরের লোককে এইসব কথা বলতে ভাল লাগে না। তুমি ওর বন্ধু। তোমাকে বললাম। রোজগার নাই, রোজগারের চেষ্টা নাই। নেশা ভাং করে।

মোবারক এক প্যাকেট সিগারেট বাড়িয়ে দিল। বিনীত গলায় বলল, বিদেশ থেকে তেমন কিছু আনতে পারি নাই চাচাজী— আপনার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট।

বৃদ্ধ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, মানুষের ছেলে পুলে দেশে বিদেশে যায়। কত কিছু আনে— আর আমারটাকে দেখ— রক্তবমি করে। পাতলা পায়খানা করে। সব কপাল। ভাঙ্গা কপাল।

মোবারক বলল, চাচাজী নেন।

বৃদ্ধ ধরা গলায় বললেন, আবার কী?

একটা লাইটার।

তোমার নামটা যেন কী বাবা। চেহারা মনে আছে। ছোট বেলায় দেখেছি নাম মনে পড়ছে না। স্মৃতিশক্তি গেছে। যার ঘরে এমন আজদহা তার স্মৃতিশক্তি থাকবে কেন? তুমিই বল থাকার কোনো কারণ আছে?

জ্বি না।

বাবা তোমার নামটা বল?

আমার নাম মোবারক।

এইতো মনে পড়েছে মোবারক। মালয়েশিয়া গিয়েছিলে তাই না?

জ্বি না।

এখন মনে পড়েছে। কুয়েত।

জ্বি না সুইজারল্যান্ডে গিয়েছিলাম।

ও হ্যাঁ হ্যাঁ সুইজারল্যান্ড। এখন মনে পড়েছে। যাওয়ার আগে দেখা করে দোয়া নিলে।

জ্বি হ্যাঁ।

বিবাহ করেছ?

জ্বি না।

দেশে যখন এসেছ বিবাহ কর। দেশের একটা মেয়ের গতি হোক। আমার আজদহা যে বিয়ে করে ঘর সংসার করবে এই আশা করি না। এখন পরের ছেলের বিবাহ দেখে শান্তি পাওয়া।

সন্ধ্যার দিকে মোবারক কুদুসের দোকানে গেল। যদি ওদের পাওয়া যায়। তাছাড়া কুদ্দুসকে এক প্যাকেট সিগারেট দিতে হবে। হাজার হলেও বন্ধু মানুষ। বিপদে আপদে বাকিতে চা খাওয়ায়। গাড়িটা রাখতে হবে কুদুসের চায়ের দোকানের সামনে। কয়েকবার হর্ণ দিয়ে নামতে হবে। এই সময় ছোট রফিক থাকলে ভাল হয়। সে অবশ্য ছোট রফিকের সঙ্গে খুবই দ্র ব্যবহার করবে। এক প্যাকেট সিগারেট ছোট রফিককেও দেয়া যেতে পারে। সিগারেট দেয়ার পর সৌজন্যমূলক কিছু কথাবার্তা। যেমন—

ভাই ভাল আছেন? আপনার কথা শুনেছি— এর আগে একবার দেখা হয়েছিল। চিনতে পারিনি। কেমন আছেন ভাই?

অতি ডেনজারাস লোক। বেশি খাতির দেখানো ঠিক না। এদের কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায়। এদের কাছে মানুষের জীবনের দাম পাঁচ পয়সা।

আল্লাহ পাকের দুনিয়াতে কত অদ্ভুত ব্যাপারই না আছে। কালো যে রঙ সেই রঙেরও কত পদ। পাতিল কালো, কাক কালো, ময়না কালো। মন্দ মানুষেরও কত অদ্ভুত পদ। পৃথিবীর সবচে মন্দ মানুষটা কে জানা গেলে ভাল হত। পৃথিবীর সবচে মন্দ মানুষ এবং পৃথিবীর সবচে ভাল মানুষ— এই দুজনকে যদি মুখোমুখি বসিয়ে দেয়া যেত। তারা যদি খানিকক্ষণ গল্প করে কী নিয়ে গল্প করবে?

কুদ্দুস আজ দোকানে আসেনি। তার শালীর বিয়ে। রাতে একবার ফিরতে পারে। কখন ফিরবে কেউ জানে না। মোবারক এক ঘণ্টা অপেক্ষা করল। এই এক ঘণ্টায় চার কাপ মালাই চা খেয়ে ফেলল। কাজটা ঠিক হচ্ছে না। কিডনির হয়ত ক্ষতি হচ্ছে। একজনের বায়না করা কিডনির ক্ষতি করা ঠিক না। চায়ের দোকানে চুপচাপ বসে থাকাও ঠিক না। উঠে যাবার মুখে বটুকে একটা একশ টাকার নোট দিল চায়ের দাম বাবদ। বটু বিরক্ত মুখে বলল, ছোট নোট দেন।

মোবারক উদাস গলায় বলল, ছোট নোট নাইরে। সবই বড় নোট।

কথা সত্যি না। ভাংতি টাকা এখন মোবারকের কাছে আছে। চার কাপ চায়ের দাম একশ টাকার নোটে দেয়ার পেছনে কারণ আছে। বটু যখন ভাংতি নিয়ে আসবে তখন সে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলবে— ভাংতি রেখে দে বখসিশ।

ছোট রফিক একবার বটুকে চা খেয়ে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বখশিশ হিসেবে দিয়ে ছিল। এমন কোনো লোক নেই যার সঙ্গে বটু এই গল্প করেনি। গল্প করার সময় বটুর চোখ মুখ অন্যরকম হয়ে যেত। এই গল্প করার সময় বটুর চোখ স্থির হয়ে যায়। স্বরও কেমন খসখসে হয়ে যায় ছোট রফিক লোকটা ভাল না মন্দ এইটা আমি জানি না। এইটা আমারে জিগাইয়া লাভ নাই। আমি জানি না। আমি খালি জানি লোকটার দিল কতবড়। মানুষটার ওজন যদি হয় একমণ তার দিলের ওজন সাত মণ।

এ ধরনের গল্প বটু তাকে নিয়ে করবে না। কারণ সে ছোট রফিক না। সে মোবারক। তার দিল ছোট না বড় তা নিয়ে মানুষের কোনো কৌতূহল নেই। ছোট রফিকের দিল ছোট না বড় এটা নিয়ে সবারই কৌতূহল আছে। এখন কী করা যায়? মেসে যাবে? পরিমল দাসের টাকা পয়সা মিটিয়ে আবার এসে খোঁজ নেবে জহিররা এল কি-না? করা যেতে পারে। সঙ্গে গাড়ি আছে। উঠে বসলেই হল। গাড়ি থাকার কত মজা! রিকশা বা বেবী টেক্সির মত আগে জিজ্ঞেস করতে হয় না— অমুক জায়গায় যাবে কি-না। যেতে রাজি হলেই যে সব মুশকিল আহসান তা না— শুরু হয় ভাড়া নিয়ে কচাকচি। মোবারক পরিমল দাসের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল। মনু মিয়াকে বখশিশ হিসেবে কিছু দিতে হবে। একটা লুঙ্গি কেনার টাকা। যদিও হারামজাদা মহা বদ। কী আর করা। এই দুনিয়ার সবাই বদ। কেউ বেশি কেউ কম।

 

পরিমল দাস মেসের বারান্দায় বসে জুতা পালিশ করাচ্ছিল। গাড়ির হর্ন শুনে তাকাল এবং যতটুকু অবাক হবার কথা তার চেয়েও বেশি অবাক হল। মোবারক গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, পরিমলদা ভাল আছেন?

পরিমল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। মোবারক বলল, রাতের বেলা জুতা পালিশ করানো ঠিক না।

পরিমল বলল, এই গাড়ি কার?

আমার গাড়ি আবার কার।

তোমার গাড়ি মানে?

মোবারক রহস্যময় গলায় বলল, সামান্য অন্যায় করে ফেলেছি পরিমলদা, কিছু মনে করবেন না। বাবা-মার সঙ্গে রাগ করে মেসে এসে লুকিয়ে ছিলাম। এখন মিটমাট হয়েছে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাচ্ছি।

বল কী?

আপনার হিসাবটা দিনতো মিটিয়ে দেই। আর মনুকে আসতে বলুন। ওকে সামান্য বখশিশ দেব।

মনুতো নাই। তার চাকরি নট হয়ে গেছে।

কেন?

মেসের স্টোর থেকে দুডজন ডিম চুরি করে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। ধরা পড়েছে হাতে নাতে।

মার দেয়া হয় নাই?

এমন মার খেয়েছে এক মাস বিছানা থেকে উঠতে পারবে না। চোখও মনে হয় একটা গেছে।

চোখ গেছে মানে কী?

ভিড়ের মধ্যে কেউ মনে হয় চোখে খামচি দিয়েছে। গলগল করে চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল।

মোবারকের মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল। চোরের মারে এ রকম ঘটনা সব সময় ঘটে। ভিড়ের সুযোগে কেউ না কেউ ভয়ংকর কিছু করে শান্ত ভঙ্গিতে চলে যায়। যে এই কাজটা করে সে এম্নিতে সহজ সাধারণ মানুষ। দশটা পাঁচটা অফিস করে। সন্ধ্যাবেলায় বাচ্চাদের পড়তে বসায়। ছুটিছাটায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যায়। বাঁদরের খাচার সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে বাঁদরের খেলা দেখে।

মনু মিয়ার একটা চোখ তাহলে তুলে ফেলেছে?

মনে হয় সে রকমই।

ভাল। দুটা কিডনি যেমন মানুষের দরকার নাই। দুটা চোখেরও দরকার। নাই। একটাই যথেষ্ট।

মোবারক পরিমল দাসের হিসাব মিটিয়ে দিল। উদাস গলায় বলল, আমার বিছানা বালিশ কাউকে দিয়ে দেবেন।

কাকে দেব?

যাকে ইচ্ছা দিবেন।

পরিমল দাস লজ্জিত গলায় বলল, না বুঝে আপনাকে অনেক কটু কথা বলেছি। ভাই মনে কিছু রাখবেন না।

আচ্ছা রাখব না। মনু মিয়াকে কি হাসপাতালে নিয়ে গেছে?

না। মেরে মেসের সামনে ফেলে রেখেছিল। কিছুক্ষণ পরে নিজেই হেঁটে কোথায় যেন চলে গেছে।

মোবারক পকেট থেকে দুটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে পরিমলের দিকে

এগিয়ে দিল।

টাকাটা রাখুন। মনু মিয়া যদি কখনো আসে টাকাটা তাকে দেবেন।

জ্বি আচ্ছা।

আমার কি কোনো চিঠি পত্র আছে? বলতে পারছি না। এতে আপনার ঘরেই আছে। আমি ঘরে ঢুকব না। আপনি যান দেখে আসুন।

পরিমল অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে চিঠির খুঁজে গেল। মোবারক অপেক্ষা করছে। প্রতি মাসে একটা চিঠি সে দাদিজানের কাছ থেকে পায়। গত মাসে চিঠি আসে নি। এ মাসেও না। বুড়ি মরে গেছে কি-না কে জানে।

পরিমল ফিরে এসে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, চিঠি নাই।

তাকে দেখে মনে হচ্ছে চিঠি না আসার অপরাধে সে অপরাধী।

মোবারক তার থাকার ঘর দেখে মুগ্ধ

মোবারক তার থাকার ঘর দেখে মুগ্ধ। মনে মনে কয়েকবার বলল— খাইছে রে! খাটের উপর বিছানো চাদর দেখে প্রথম যে ইচ্ছাটা হল তা হচ্ছে চাদর গুটিয়ে হ্যান্ড ব্যাগে সামলে ফেলা। বড়ই বাহারী চাদর। খাটের পাশের টেবিলে নগ্নপরী লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। এই পরী কোনোমতে কুদ্দুসের হাতে ধরিয়ে দিতে পারলে কুদ্দুস চোখ বন্ধ করে দু হাজার টাকা দিবে। পরীর পায়ের কাছে এসট্রে আছে। এসট্রের রঙ গাঢ় লাল। মনে হচ্ছে জবা ফুল ফুটে আছে। এসট্রেটা অবশ্যই পাঞ্জাবির পকেটে ফেলে চলে যাওয়া যায়। এ বাড়ির লোকজন নিশ্চয়ই জিনিসপত্রের হিসেব রাখে না। প্রতি সন্ধ্যায় ম্যানেজার টাইপ একজন জাবদা খাতা এবং কলম নিয়ে উপস্থিত হয়ে জিনিসপত্রের রোলকল কি করবে? তার এ্যাসিস্টেন্ট একটা করে নাম বলবে আর সে জাবদা খাতায় টিক মার্ক দেবে—

১টা পরী

১টা লাল এসট্রে

১টা পাথরের বৌদ্ধ মূর্তি

১টা রঙিন TV ১৮ ইঞ্চি

১টা দেয়াল ঘড়ি

৪টা পেনটিং

১টা পানির জগ

১টা ফ্লাস্ক

৩টা ফুলদানী

১টা টেবিল ঘড়ি

এমন সিস্টেম যেহেতু নাই পরীক্ষামুলক ভাবে এসট্রে সামলে দেখা যেতে পারে।

একজন কাজের লোক মোবারকের সঙ্গে আছে। তার চোখে মুখে বিরক্তি। ট্রেনের টিকিট চেকার যখন হঠাৎ দেখে ফার্স্ট ক্লাস এসি কামরায় লুঙ্গিপরা প্যাসেঞ্জার পান খাচ্ছে এবং ভুড়ি বের করে ভুড়ি চুলকাচ্ছে তখন প্রচণ্ড রাগতে গিয়েও রাগ সামলায় কারণ এই প্যাসেঞ্জারের টিকিট আছে। মোবারকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাজের লোকেরও সেই ট্রেনের টিকিট চেকারের মত অবস্থা। মোবারককে বের করে দিতে পারলে সে খুশি হয়। বের করা সম্ভব হচ্ছে না— মোবারকের টিকিট আছে।

মোবারক বলল, এই ঘরে এসি নাই?

এমন ভাবে বলল যেন এসি না থাকলে রাতে তার ঘুমুতে সমস্যা হবে।

কাজের লোক থমথমে গলায় বলল, শীতের দিনে এসি দিয়া কী করবেন?

মোবারক বিরক্ত গলায় বলল, এসি দিয়ে কী করব সেটা আমার ব্যাপার। আছে কি-না বল।

জ্বি আছে।

এসি ছাড়। ঘর ঠাণ্ডা করে লেপ গায়ে শুয়ে থাকার অন্য আরাম। টিভিতে আছে দেখতে পাচ্ছি। ভিসিআর আছে?

ভিসিআর এই ঘরে নাই।

অন্য ঘর থেকে জোগাড় করে ফিট করে দাও। রাতে ঘুম না হলে ছবি দেখব। ক্যাসেট আছে না?

ইংরেজি ক্যাসেট আছে।

হিন্দি জোগাড় কর। একটা ছবি আমার অনেক দিন থেকে দেখার শখ। আমার বন্ধু জহির এই ছবি দশবার দেখেছে। নাম হল রোজা। একটা কাগজে নামটা লিখে নিয়ে যাও। ভিডিওর দোকান থেকে নিয়ে আসবে। পারবে না?

না।

তোমার নাম কী?

আমার নাম সুলতান।

শুধু সুলতান, না সুলতান মিয়া?

আমার নাম মোহাম্মদ সুলতান।

শোন মোহাম্মদ সুলতান— আমার দিকে এই ভাবে তাকাবে না। আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আমার শরীর থেকে কিডনি না নেয়া পর্যন্ত আমার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করতে হবে। কিডনি না দিয়ে আমি যদি এখন ফুটে যাই তোমার বড় সাহেব বিরাট বিপদে পড়বে। বুঝতে পারছ?

মোহাম্মদ সুলতান কিছু বলল না। মোবারক বলল, এখন বল রোজা জোগাড় করা যাবে না?

জ্বি যাবে।

ভেরি গুড। তুমি রোজা দেখেছ?

জ্বি না।

কোনো অসুবিধা নেই। আমার সঙ্গে দেখবে।

আপনার ডিনার কি এই ঘরে দিয়া যাব?

ঘরে ছাড়া অন্য কোথাও খাওয়ার ব্যবস্থা আছে?

গেস্ট ডাইনিং হল আছে।

খুবই ভাল কথা। ডিনার গেস্ট ডাইনিং হলে দিবে। মেনু কী?

আমি জানি না— বাবুর্চি জানে।

বাবুর্চির কাছ থেকে জেনে আস। আরেকটা কথা এই ঘরেতো গান শোনার কোনো ব্যবস্থা দেখছি না। একটা ক্যাসেট প্লেয়ার বা মিউজিক সেন্টার জোগাড় কর। আমি কিছু ক্যাসেট কিনেছি— গাড়িতে আছে। নিয়ে আস। আমার ফেভারিট সব গান আছে—ইচুক দানা বিচুক দানা দানার উপর দানা। শুনেছ এই গান?

জ্বি না।

আমার সাথে শুনবে কোনো সমস্যা নেই। ম্যানেজার সাহেব বলেছিলেন বড় সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলবেন। কখন বলবেন জান?

জ্বি না।

জেনে আস। যদি উনার দেরি হয় তাহলে আমি গোসল করব। বাথরুমে গরম পানির ব্যবস্থা আছে?

জ্বি আছে।

গরম পানি কীভাবে ছাড়ে দেখিয়ে দিয়ে যাও। গোসলের আগে কফি খাব। মগ ভর্তি করে এক মগ কফি আন। এক্সট্রা চিনি আনবে। আমি চিনি

বেশি খাই।

সুলতান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। মোবারক মানিব্যাগ খুলে একশ টাকার একটা নোট বের করল– সুলতানের বখশিশ। বড় জায়গায় থাকলে মন বড় হয়ে যায়। একশ টাকার কমে বখশিশ দিতে ইচ্ছা করে না। মোবারক বিছানায় বসে ইচুক দানা বিচুক দানা গানটার সুর শীষে তুলতে চেষ্টা করছে। সুরটা ঠিকমত আসছে না।

সুলতান কফির মগ নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, বড় সাহেব আপনেরে ডাকে। কফি শেষ কইরা উনার সঙ্গে দেখা করেন।

বড় সাহেবের ঘরে আর কে আছে?

এখন কেউ নাই। স্যার একা।

কেন স্যারের বেগম সাহেব কোথায়?

বেগম সাহেব স্যারের সাথে থাকেন না। আলাদা বাড়িতে থাকেন।

কেন?

স্যারের সাথে বনিবনা হয় না।

অসুখে দেখতেও আসেন না?

প্রত্যেক দিনই একবার করে আসেন। আজও সকালে আসছিলেন।

তোমার স্যার লোক কেমন?

লোক অত্যন্ত ভাল। খালি রাগ বেশি।

মোবারক কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলল, ভাল মানুষের রাগ থাকে বেশি। যারা মিচকা শয়তান তারা রাগে না। পাছায় লাথি মারলেও লাথি খেয়ে হাসবে। শোন সুলতান আমি যদি দশ পনেরো মিনিট পরে যাই কোনো অসুবিধা আছে? গোসল করে ফিটফাট হয়ে যেতে চেয়েছিলাম।

আপনি এখনি চলেন।

 

মোবারক সরাসরি বড় সাহেবের শোবার ঘরে ঢুকতে পারল না। তাকে জুতা খুলে রাখতে হল। বাথরুমে ঢুকে ডেটল-পানি দিয়ে হাত মুখ ধুতে হল। প্রথমবার যখন তাঁর সঙ্গে দেখা হয় তখন এ ধরনের ব্যবস্থা ছিল না। এখন কেন কে বলবে?

ঘরের মুখেই ডাক্তার। ডাক্তার সাহেব অত্যন্ত সুদর্শন। টিভির প্যাকেজ প্রেমের নাটকে নায়ক হিসেবে খুব মানানসই। ডাক্তার সাহেব লজ্জিত মুখে বললেন, আমরা স্যারের ঘরটাকে স্টেরাইল রাখার চেষ্টা করছি। একটু এক্সট্রা প্রিকশন। আপনার ইনকনভেনিয়েন্সের জন্যে দুঃখিত। যান স্যারের সঙ্গে কথা বলুন। আমি পাশের ঘরেই আছি।

মোবারক ভীত মুখে ঘরে ঢুকল। যদিও ভয় করার তেমন কোনো কারণ নেই। বড় সাহেব নিশ্চয়ই তাকে ধমক দেবেন না।

মানুষটাকে আজ খুবই অসুস্থ লাগছে। হাত-পা-মুখ কেমন হলুদ হলুদ। এটা অবশ্যি হলুদ পায়জামা পাঞ্জাবির জন্যেও হতে পারে। তবে উনার চোখ উজ্বল। তারচেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার ভদ্রলোকের মুখ হাসি হাসি।

মোবারক বলল, স্যার কেমন আছেন?

ভদ্রলোক হাসিমুখে মাথা ঝাঁকালেন যার অর্থ— আমি ভাল আছি। তারপরই বললেন, মোবারক বস।

মোবারক ধাঁধায় পড়ে গেল। কোথায় বসবে? ঘরটা বড়। বেশ বড়। কিন্তু বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। খাটের দুপাশে দুটা টেবিল আছে। একটা টেবিল ভর্তি বই, অন্য টেবিলটায় অষুধপত্র। মোবারক নিশ্চয়ই টেবিলের উপর উঠে বসবে না। স্যারের বিছানায় বসার প্রশ্নই উঠে না। তাহলে কোথায় বসবে মেঝেতে? না-কি পাশের ঘর থেকে মোড়া জাতীয় কিছু নিয়ে আসবে। পাশের ঘরে ডাক্তার সাহেব আছেন। উনাকে বললে উনিও হয়ত সমস্যা সমাধান করে দেবেন।

বড় সাহেব আজ তাকে তুমি তুমি করে বলছেন। এটা ভাল। তুমি বলার মধ্যে কাছের মানুষ, কাছের মানুষ ভাব আছে। বড় সাহেব তার নাম মনে রেখেছেন— এটা বিস্ময়কর। যদিও সে বড় সাহেবের নাম জানে না। নাম জানাটা উচিত ছিল। আজ এই ঘর থেকে বের হয়েই নামটা জেনে নিতে 361

বড় সাহেব বললেন, বিছানায় বোস। এই ঘরে ইচ্ছে করেই আমি সোফা বা চেয়ার রাখিনি। সোফা চেয়ার থাকলেই রোগী দেখতে এসে লোকজন বসে পড়ত। মানুষের স্বভাব হচ্ছে একবার বসলে সে উঠতে চায় না।

মোবারক বড় সাহেবের পায়ের কাছে খুব সাবধানে বসল। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে লোকটাকে তার পছন্দ হচ্ছে। এটা খুবই ভাল লক্ষণ যে লোকটার শরীরে তার শরীরের একটা অংশ থাকবে সেই লোকটা পছন্দের না হলেতো মুশকিল।

বড় সাহেব হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে একটা কমলা নিয়ে মোবারকের দিকে গড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, কমলা খাও।

কমলা মোবারকের খুবই অপছন্দের ফল। কিন্তু বড় সাহেব দিচ্ছেন না খাওয়াটা বিরাট বেয়াদবী। মোবারক কমলার খোসা ছড়াচ্ছে। তার প্রধান চিন্তা খোসাগুলি কোথায় ফেলবে? ময়লা ফেলার ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না। খোসা হাতে নিয়ে বসে থাকতে হবে না-কি।

মোবারক।

জ্বি স্যার।

বলতো দেখি একটা কমলার কয়টা কোয়া থাকে।

স্যার বলতে পারছি না।

বড় সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, দশটা কোয়া থাকে। তুমি গুনে দেখ।

মোবারক গুনে দেখল আসলেই দশটা কোয়া। কেউ একজন আগে ভাগে না গুণে বলে দিচ্ছে কমলার দশটা কোয়া এটা এমন কিছু ব্যাপার না। আগে গুণে দেখেছে। তবু মোবারক খুবই অবাক হয়েছে এমন ভঙ্গি করল।

বড় সাহেব গল্প বলার ভঙ্গিতে সহজ গলায় বললেন, আমার বাবা ছিলেন বাংলা বাজারে প্রুফ রিডার। হত-দরিদ্র মানুষ। আমরা ছিলাম তিন ভাই বোন। শীতের সময় বাবা মাঝে মধ্যে একটা কমলা নিয়ে ফিরতেন। কোয়া ভাগাভাগি করে তিন ভাই বোনকে দিতেন। একটা কোয়া সব সময় বেশি হত। সেই থেকেই আমি জানি কমলার দশটা কোয়া।

মোবারক বলল, বাড়তি কোয়াটা কে পেত স্যার?

আমার বোন পেত। পৃথিবীর সব বাবার মত আমার বাবাও তাঁর কন্যাকেই সবচে বেশি আদর করতেন। এই গল্পটা তোমাকে কেন বললাম তুমি জান?

জ্বি-না স্যার।

গল্পটা তোমাকে বললাম, কারণ আজ আমার টোটেল এ্যাসেট প্রায় ১০০ কোটি টাকা। পুরনো দিনের কথা আমার কখনোই মনে পড়ে না। কিন্তু কমলা দেখলেই মনে হয় এর ভেতর দশটা কোয়া।

আপনার বাবা কি আপনার এই অবস্থা দেখে গেছেন?

দেখে যান নি। তার জন্যে আমার খুব যে কষ্ট হয় তাও কিন্তু না। এই পথিবীতে সব মানুষই একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করতে আসে। বাবা এসেছিলেন হত দরিদ্র প্রুফ রিডারের চরিত্রে অভিনয় করতে। তিনি চমৎকার অভিনয় করে বিদায় নিয়েছেন।

স্যার আপনি খুবই সুন্দর করে কথা বলেন।

দ্যাটস ট্রু— আমি অবশ্যই খুব সুন্দর করে কথা বলি। সুন্দর করে কথা বলি বলেই মিথ্যা কথাগুলি সত্যির মত করে বলি। বাবার জন্যে আমার কষ্ট হয় না— এটা খুবই মিথ্যা কথা। উনার জন্যে ভয়ঙ্কর কষ্ট হয়। কমলাটা খাও মোবারক। হাতে নিয়ে বসে আছ কেন?

মোবারক কমলার একটা কোয়া মুখে দিল। তার হঠাৎ করে খুব মনটা খারাপ হয়েছে। সে যেন চোখের সামনে বড় সাহেবের দরিদ্র বাবাকে দেখতে পাচ্ছে। বেচারা কমলার কোয়া ভাগ করছে।

বড় সাহেব শান্ত গলায় বললেন, চোখটা মোছ মোবারক। আমার গল্প শুনে তোমার চোখে পানি এসেছে। আমি খুবই লজ্জা পাচ্ছি। আমি কোনো স্টোরি টেলার না। আমি রসকষহীন বিজনেস ম্যান। তোমারওতো বিজনেসম্যান হবার ইচ্ছা তাই না?

জ্বি।

কীসের বিজনেস করবে ভেবেছ কিছু?

জ্বি-না।

তুমি ভাব নি, কিন্তু আমি ভেবেছি। তুমি আধুনিক একটা ফলের দোকান দাও। বাংলাদেশের মানুষ এখন ফল খাওয়া শুরু করেছে। যেহেতু দেশে এখন ফ্রী ইকনমি, তুমি যে-কোনো দেশ থেকে ফল আমদানী করতে পার। তোমার ফলের দোকানে পৃথিবীর সব দেশের সব রকম ফল পাওয়া যাবে। স্ট্রবেরী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের লটকন। দোকানটার একটা অংশ থাকবে ফুলের জন্যে। টাটকা ফল এবং টাটকা ফুল বিক্রি হবে। একটা দাগ ধরা ফলও দোকানে থাকতে পারবে না। একটা বাসি ফুলও থাকতে পারবে না। পুরো দোকানটা হবে এয়ারকন্ডিশন্ড। তোমার দোকানের নামও আমি ঠিক করে রেখেছি।

FRUITS
AND
FLOWER

মোবারক ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার আমার কাছে স্বপ্নের মত লাগছে।

বড় সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, মানুষের ধারণা বিজনেসম্যানরা স্বপ্ন দেখতে পারেন না। স্বপ্ন দেখার অধিকার শুধু কবিদের, গল্পকারদের, চিত্রকরদের। খুব ভুল ধারণা। প্রতিটি সাকসেসফুল বিজনেসম্যান হচ্ছেন একজন ড্রিমার। এক অর্থে কবি সাহিত্যিকদের চেয়ে তারা বড় ড্রিমার। কবি সাহিত্যিকরা তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারেন না, একজন ব্যবসায়ী ড্রিমার পারেন। ব্যবসায়ীদের স্বপ্নগুলি খুব জাগতিক হয় এটাও অবশ্যি একটা কারণ।

বড় সাহেব হঠাৎ চুপ করে গেলেন। মনে হচ্ছে তাঁর কোনো শারিরীক অসুবিধা হচ্ছে। মোবারক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার আমি কি এখন যাব?

তিনি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।

মোবারক বলল, আমার দাদিজান থাকেন নেত্রকোনায়, উনাকে একটু কি দেখে আসব?

অবশ্যই দেখে আসবে। আর শোন মোবারক তোমার শরীরের একটা অংশ আমি ব্যবহার করব। আমি ধরে নিচ্ছি এটা তোমার একটা উপহার। সেই কারণেই আমি FRUITS AND FLOWERS তুমি যাতে করতে পার সেই ব্যবস্থা করব। ভালমতই করব। আমার উপহারটাও খারাপ হবে না।

মোবারক বলল, স্যার দেখবেন আমরা তিনজন জান দিয়ে খাটব।

বড় সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, তোমরা তিনজন মানে!

আমার দুইজন খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে স্যার।

ভাল। একজন বন্ধু থাকাই ভাগ্যের কথা। তোমার আছে দুজন। তুমিতো ভাগ্যবান মানুষ। আচ্ছা তুমি এখন যাও— শরীরটা ভাল লাগছে না। কথা বলে আরাম পাচ্ছি না। আমি বিশ্রাম করব।

মোবারক ঘর থেকে বের হবার আগে আরেকবার বড় সাহেবের দিকে তাকালো। আশ্চর্য, বড় সাহেব তার দিকেই তাকিয়ে আছেন।

রাত এমন কিছু না

রাত এমন কিছু না। এগারোটাও বাজে নি। রাত শুরু হয় একটা থেকে। কাজেই রাত এখনো শুরুই হয় নি। বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলা হয়ে গেছে। তিনি নিশ্চয়ই রাত তিনটার সময় আবারো তার সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন না। তাঁর কাছে ছুটি নেয়া আছে। দাদিজানকে দেখতে যাবার ছুটি। কাজেই মোবারক এখন ঘর থেকে বের হতে পারে। দুই বন্ধুকে খুঁজে বের করতে পারে। তিন বন্ধু মিলে রাস্তায় খানিকক্ষণ হেঁটে ছাতিম গাছের নিচে বসতে পারে। জহিরকে টাকা দিলে সে ম্যাজিসিয়ানদের মত শূন্য থেকেও জিনিসপত্র জোগাড় করে ফেলতে পারে। পঁচিশ হাজার টাকার পুরোটা খরচ হয়নি এখনো কিছু আছে। কত আছে সে জানে না। গোনা হয় নি। টাকা গুনলে টাকা কমে। তার কথা না, তার দাদিজান আকলিমা বেগমের কথা। টাকা নিয়ে তার একটা শ্লোকও আছে। সেই টাকা অবশ্যি কাগজের টাকা না, রূপার টাকা। তাঁর সময়কার টাকা।

চার মাসের নাতিন আমার ষোল মাসের পেট
একশত তার উপপতি স্বামী হল এক।
ধাতুতেই জন্ম কিন্তু নাই তার মা
এই শিল্পকে ভাঙ্গাইয়া দিয়া, নাতিন নিয়া যা।

টাকার ধাঁধাটা বন্ধুদের জিজ্ঞেস করতে হবে। যে পারবে সে একশ টাকা পাবে। একশ না পাঁচশ। টাকার পরিমাণ না বাড়ালে মজা জমে না। আশ্চর্যের ব্যাপার যে কোনো জিনিস জমার জন্যে টাকা লাগে।

মোবারক বেরুবার জন্যে তৈরি হল। তৈরি হওয়া মানে দাদিজানের জন্যে কেনা শালটা বগলের নিচে নিয়ে নেয়া। বাড়ি থেকে বের হবার সময় ঝামেলা হবে কি-না বুঝতে পারছে না। দারোয়ান হয়ত বলে বসবে— রাত এগারোটার পর বের হতে হলে পাশ লাগবে। পাশ থাকলে বের হবেন। পাশ না থাকলে নাই। পাশ আছে?

কুকুর ছেড়ে দিয়েছে কি-না কে জানে। দুটা ভয়ংকর কুকুর এ বাড়িতে আছে। দূর থেকে সে দেখেছে। রাতে বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে কুকুর ছাড়া হয়। বড়লোকের বাড়ির কুকুর গায়ের গন্ধে বুঝে ফেলে কে বড়লোক কে গরীব লোক। তারপর ঝাঁপ দিয়ে গরীবের উপর পরে। পশুও গরীব ধনী চেনে।

কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই মোবারক গেট পার হল। দারোয়ান একটা কথাও জিজ্ঞেস করল না। কুকুর দুটাও ছাড়া ছিল। তারাও চোখ উঁচু করে তাকে দেখে চোখ নামিয়ে নিল। এরা কি টের পেয়ে গেছে যে মোবারক। সাধারণ কেউ না। সে হল Fruits and Flowers এর মালিক।

গেটের বাইরে এসে মোবারকের মনে পড়ল সে আসল জিনিস ফেলে গেছে। দুই বন্ধুর জন্যে দুটা স্যুয়েটার কিনেছিল, স্যুয়েটার সঙ্গে নেয়া হয় নি। থাক স্যুয়েটার। স্যুয়েটারের জন্যে ঢুকলে আর হয়ত বের হওয়া যাবে না।

আহ বড় আনন্দ লাগছে। শীষ দিয়ে গানের সুর তুলতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছা করলেও উপায় নেই। সে শীষ দিতে পারে না। পারে বজলু। শুধু যে পারে তা না অসম্ভব সুন্দর করে পারে। মনে হয় শীষ না যেন বাঁশি বাজছে। বজলুকে আজ ধরতে হবে। মুশকিল হচ্ছে হারামজাদার গায়ে চর্বি বেশি। তাকে কোনো অনুরোধ করলে চর্বির উপরও আরেক পরত চর্বি জমে যায়। জমলে জমবে আজ বজলুকে ধরতে হবে। অনেকদিন তার শীষ শোনা হয় না। বাচুপানকা দিন ভুলা না যা না গানটা বাজাতে বলতে হবে। তবে শুরুতে না। ভাবের জগতে উঠার পর। সাধারণ গান-বাজনা একরকম, ভাবের গানবাজনা অন্যরকম। ভাবের গান-বাজনায় মনটা উদাস হয় অনেক বেশি। বাচুপানকা দিন গানটা এম্নিতে শুনলে চোখে পানি আসবে না, কিন্তু ভাবের জগতে থাকার সময় শুনলে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়বে।

মোবারক কুদ্দুসের চায়ের দোকানের দিকে রওনা হল। তার মন বলছে দুজনকে সেখানেই পাওয়া যাবে। আর না পাওয়া গেলে মোবারক যে ভাবেই হোক খুঁজে বের করবে।

বজলু এবং জহিরকে চায়ের দোকানেই পাওয়া গেল। দুজনই আরাম করে মালাই চা খাচ্ছিল। মোবারককে দেখে উঠে দাঁড়াল। যেন তারা জানত এক্ষুণী মোবারক জিনিসপত্র নিয়ে উপস্থিত হবে।

জাহিরের বগলে একটা ক্রাচ। সে ক্রাচ নিয়ে যে ভাবে হাঁটছে তাতে মনে হচ্ছে তার জন্মই হয়েছে বগলে ক্রাচ নিয়ে। এবং এতে সে মোটেই দুঃখিত না, বরং আনন্দিত। সে চোখ ছোট করে বলল, জিনিসটা উপকারী। ধর মারামারি লেগে গেল— বগল থেকে ক্রাচ নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়লি। হা হা হা।

বজলু ভুরু কুঁচকে তাকাল। জহিরের রসিকতায় সে মজা পাচ্ছে না। তবে মোবারক মজা পাচ্ছে। জহিরের কথা তার মনে ধরেছে। সে কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে তারা তিন বন্ধু বগলে ক্রাচ নিয়ে ঘুরছে। কোনো একটা ঝামেলা বাধল বের হয়ে এল তিন অস্ত্র।

মোবারক বলল, তুই কি পুরোপুরি ল্যাংড়া হয়ে গেছিস?

জহির বলল, হ্যাঁ।

বলে দাঁত বের করে হাসল। পুরোপুরি ল্যাংড়া হওয়াতেও সে আনন্দিত। কিছু কিছু সময় মানুষের জীবনে আসে যখন সব কিছুতেই আনন্দ লাগে। ধাক্কা দিয়ে কেউ রাস্তায় ফেলে দিল, একটা দাঁত গেল ভেঙ্গে। তার মধ্যে আনন্দ। জহিরের এই সময় চলছে।

ছাতিম গাছের তলাটা বেদখল হয়ে আছে। এক বুড়োবুড়ি নীল পলিথিনের ছাউনি দিয়ে রাতারাতি সংসার পেতে বসেছে। ইটের চুলায় রান্না হচ্ছে। বুড়ি রান্না করছে। বুড়ো বটি পেতে কাটাকুটি করছে। রাত বাজে একটা। এই সময়ে কীসের রান্না কে জানে?

পলিথিনের নীল বাড়ির ভেতর থেকে গল্পগুজব এবং হাসাহাসির শব্দ আসছে। আনন্দময় সংসার যাত্রা।

বজলু বলল, লে হালুয়া।

বুড়ো সবৃজি কাটা বন্ধ করে শক্ত হাতে বটি ধরে আছে। বুড়ি নির্বিকার। সে আগের মতই রান্না করে যাচ্ছে। একবার শুধু চোখ সরু করে দেখল।

জহির বলল, জায়গা ক্লিয়ার করে দাও। দশ মিনিট সময়। এর মধ্যে জায়গা পরিষ্কার না করলে অসুবিধা আছে।

পলিথিনের ঘর থেকে দুটা মেয়ে উঁকি দিচ্ছে। দুজনের বয়সই আঠারো উনিশ। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। চুলে লাল ফিতা বাঁধা। এরা সাজগোজ করছিল। সাজ এখনো শেষ হয় নি। চোখে কাজল দেয়া হচ্ছে।

মোবারক বুড়োর দিকে তাকিয়ে বললো— এই দুই কন্যা কে? তোমার নাতনী?

বুড়ো বলল, তা দিয়া আপনার কি দরকার।

দরকার আছে।

হ আমার নাতনী।

এরা কি ভাড়া খাটে?

বুড়ো কিছু বলল না। মেয়ে দুটার একটা আফ্রাদী গলায় বলল, ঝামেলা কইরেন না ভাইজান।

মোবারক বলল, কোনো ঝামেলা নাই। তোমরা তোমাদের মত বাণিজ্য করবে। কিন্তু জায়গা ছাড়তে হবে। এটা আমাদের জায়গা। দশ মিনিট সময়। আমরা এখানে নেশা করব।

এমন কোনো হাসির কথা না, কিন্তু মেয়ে দুটি খিলখিল করে হাসছে। দুজনই মনে হয় খুব মজা পাচ্ছে। মেয়ে দুটির একটি বলল, আপনেরার লিশা আপনেরা করেন। আমরা না করছি?

জায়গা ছাড়বে না?

জায়গা কি আমার যে ছাড়ব? জায়গা আল্লাহ পাকের। হেতো কিলিয়ার কইরাই ধুইছে। হি হি হি।

মোবারকের মনে হল মেয়েটাকে সুন্দর লাগছে তো। একটু আগেওতো সুন্দর লাগছে না। এখন লাগছে কেন? হি হি করে হাসছে বলেই কি সুন্দর লাগছে? হাসলে মানুষকে সুন্দর দেখায়। তবে সেই হাসি আসল হাসি হতে হবে। নকল হাসিতে মানুষকে ভয়ংকর দেখায়। তবে হাসি এমন জিনিস যে তার নকল হয় খুব কম।

বজলু হঠাৎ উদার গলায় বলল, এরা থাকুক এদের মত। আয় আমরা এক কোণায় বসে পড়ি। মোবারকের মনে হল বজলু তার মনের কথাটা বলেছে। সবাই থাকবে সবার মত ঝগড়া ফ্যাসাদের দরকার কি? মেয়ে দুটা ইচ্ছা করলে তাদের সঙ্গে বসতে পারে। ইচ্ছা করলে কাস্টমারের খুঁজে যেতে পারে।

জহির মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে বলল, এই তোদের নাম কি?

তুই তুকারি করেন ক্যান? ভাল মত জিগান নাম কমু।

তোমাদের নাম কি?

আমার নাম ছুইটি, এর নাম বিউটি।

নকল নাম?

হ নকল। আমরা মানুষও নকল আমরার নামও নকল আপনেরা কি লিশা করতে আইছেন?

হুঁ।

লিশা বড়ই খারাপ জিনিস গো লিশা কইরেন না।

চুপ থাক।

আইচ্ছা যান চুপ থাকলাম। চিল্লাইয়েন না।

ছাতিম গাছের অন্য দিকটায় তারা তিনজন বসল। মেয়ে দুটি বের হয়ে গেল খদ্দেরের খুঁজে। মেয়ে দুটি যাবার আগে জহির ধমকের গলায় বলল, খবর্দার কাস্টমার নিয়া এই দিকে আসবি না। আসলে বিপদ আছে। বিল্লি মে কাট দিবে।

ছুইটি অবাক হয়ে বলল, বিল্লি মে কাট দিবে কি গো?

জহির উদাস গলায় বলল, যখন কাট দিবে তখন বুঝবি কী। এখন বুঝবি atti

বিউটি বলল, আপনেরা ভদ্রলোকের ছেলে। আপনেরা তুই তুকারি করেন ক্যান।

বজলু বলল, আমরা ভদ্দরলোকের ছেলে তোদের কে বলল? আমরা বিল্লি কাট দিয়া মানুষ। আমাদেরকে বিল্লি কেটে দিয়েছে। বজলুর কথা শেষ হবার আগেই জহির এবং মোবারক হাসতে শুরু করল। বোতল খোলার আগেই তিনজন চলে যাচ্ছে ভাবের জগতে। আজকের ভাব হবে জটিল ভাব। রাতটা বড়ই আনন্দে কাটবে।

বুড়ো বুড়ির রান্না হয়ে গেছে। দুজনে গল্প করতে করতে খাওয়া দাওয়া করছে। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে তারা বড়ই আনন্দে আছে। মোবারকরা তেমন আনন্দে নেই। বজলু শীষ দিয়ে কি একটা গান বাজাচ্ছে। গানের সুর এতই করুণ যে চোখে পানি এসে যাচ্ছে।

দুটি মেয়ের একটি (ছুইটি) ফিরে এসে তিন বন্ধুর পাশে বসেছে। মনে হচ্ছে তিন বন্ধুকে দেখে মেয়েটা খুব মজা পাচ্ছে।

বজলু শীষ বাজানো বন্ধ করতেই মোবারক বলল, দোস্ত একটা কথা বলি। ইচ্ছা হলে জবাব দিবি ইচ্ছা হলে দিবি না। তুই কি ছোট রফিকের দলে ঢুকেছিস?

বজলু বলল, হুঁ।

কাজটা কি ঠিক হয়েছে?

ঠিক হয় নাই। কিন্তু উপায় কী? আমার বাঁচা লাগবে না?

মোবারক বলল, দোস্ত তুই ছোট রফিকের কথা ভুলে যা। আমি আমাদের তিনজনের জন্যে ব্যবস্থা করেছি।

বজলু কঠিন গলায় বলল, তুই হলি ছিছকা চোর। থিফ অফ ঢাকা। তুই কি ব্যবস্থা করবি? চোরের দল করবি? চোরের দলের লীডার হবি। আমি চুরির মধ্যে নাই। আমি ভদ্দরলোকের ছেলে। আমার বাবা ছিলেন স্কুল টিচার।

ছোট রফিকের সাথে থেকে তুইতো মানুষ খুন করবি।

হুঁ করব। যার কপালে খুন লেখা থাকবে সে খুন হবে। আমার কি করার আছে। আমার কিছু করার নাই।

কঠিন তর্কাতর্কিতে নেশা কেটে যায়। আজ কাটছে না। বরং আজ নেশা আরো চেপে আসছে।

জহির বলল, আমি পিশাব করতে যাচ্ছি তোরা কেউ যাবি আমার সাথে? কাটাকুটি খেলবি? সঙ্গে সঙ্গেই তিনজন উঠে দাঁড়াল। জহির বরল, বুড়ো বুড়ির পলিথিনের বাড়িতে পিশাব করলে কেমন হয়। আমাদের জায়গা দখল করে আছে শাস্তি হওয়া দরকার না?

বজলু বলল অবশ্যই শাস্তি হওয়া দরকার। ওদের গায়েই পেশাব করা দরকার। তা না করে আমরা ওদের রাজপ্রাসাদ ভিজিয়ে দেব।

ছুইটি বিড় বিড় করে বলল, লিশা কি খারাপ জিনিসগো। কি খারাপ জিনিস।

বৃদ্ধা আকলিমা বেগম

বৃদ্ধা আকলিমা বেগম রেলিং দেয়া খাটের মাঝখানে জুবথবু হয়ে বসে আছেন। তাঁর সাজানো জীবন-যাপন এই মুহূর্তে খানিকটা এলোমেলো, কারণ তাঁর গায়ে পাতলা ফিনফিনে একটা গরম চাদর জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নিজেকে তার বউ বউ মনে হচ্ছে। অনেক অনেক কাল আগে বউ সেজে তিনি এই খাটের মাঝখানে ঠিক এই ভাবেই বসেছিলেন। তখন ছিল পৌষ মাস। তিনি শীতে মাঝে মাঝে কাঁপছিলেন বলে তাঁর শাশুড়ি এসে তার গায়ে চাদর দিয়ে দিলেন। বাড়ি ভর্তি কত লোক, কত আনন্দ, কত উল্লাস। আকলিমা বেগমের তরুণ বর— হাসিখুশি এবং খানিকটা বোকাসোকা ধরনের মানুষটা কারণে অকারণে ঘরে ঢুকে পড়ছে এবং মায়ের বকা খাচ্ছে— তোর হইছেটা কী? মুরগির ছাও এর লাহান এইখানে ঘুরতাছ।

মানুষটা লজ্জা পেয়ে নিচু করে বলল, খড়ম খুঁজতে আসছি।

যা কইলাম। না গেলে খড়ম দিয়া তোর মাথাত বাড়ি।

সবার সে-কী হাসি। সবচে বেশি হেসেছেন আকলিমার শাশুড়ি। আহা কী হাসিই না তিনি হাসতে পারেন। সারাক্ষণ কারণে এবং অকারণে হাসছেন। তাঁর মৃত্যুর সময়ও তার মুখে চাপা হাসি দেখা গেল। তিনি আকলিমা বেগমকে কাছে ডেকে ফিস ফিস করে বললেন, তোমার শ্বশুর সাহেবের আইজ খবর আছে। সে হুরপরী নিয়া খুব নাচানাচি করতাছে। আমি উপস্থিত হইয়া এমন ঝাটাপিটা করব। হি হি হি।

পুরনো দিনগুলি বারবার ফিরে ফিরে আসে কেন? আজ কেন নিজেকে বউ বউ লাগছে? মোবারক যে গরম শালটা গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে সেই শালটা থেকে কেন অনেক অনেক দিন আগে তার গায়ে যে চাদর তার শাশুড়ি জড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই চাদরের গন্ধ আসছে? কেন মনে হচ্ছে বাড়ি ভর্তি লোকজন। কেন মনে হচ্ছে তার মানুষটা একটু আগেই একবার খড়ম খুঁজে গিয়েছে, আবারো আসবে।

মোবারক বলল, কানতেছ কেনগো দাদিজান?

আকলিমা বেগম বললেন, কান্দি না রে। বয়স হইছে, অখন খালি খালি চউখ দিয়া পানি পড়ে।

শালটা তোমার মনে ধরছে দাদিজান?

আকলিমা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বললেন, মোবারক তুই একটা চটের বস্তা আমার শইল্যে দিয়া দে। হেই বস্তাও মনে ধরব।

তুমি খুশি হইছ দাদিজান?

আমি বেজার হইছি। খুবই বেজার হইছি। আয় কাছে আয় মুখটা দেখি।

চোখতো নাই মুখ কীভাবে দেখবা? হাত দিয়া দেখব। চউখ নাইতো কী হইছে। হাত আছে না?

মোবারক খাটে উঠে এল। আকলিমা বেগম মোবারকের চোখে মুখে হাত বুলাতে লাগলেন। মোবারকের চোখে পানি এসে গেল।

মোবারক! জ্বি।

আমারে ফালাইয়া থুইয়া তুই একলা একলা কই থাকস? কী করস? আমি যখন মরব তখন তোরে দেখতে ইচ্ছা করব না?

মোবারক উদাস গলায় বলল, এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গে থাকবা। ঢাকায় ঘর ভাড়া করব। বলতে পার ভাড়া করা হয়েছে।

ঢাকায় গিয়া থাকব ক্যামনে। এই খাট ছাড়া আমার ঘুম হয় না।

তোমার এই খাট নিয়া যাব। কোনো অসুবিধা নাই। এই খাটতো যাবেই— খাটের উপরে জিনিসপত্র যা আছে সব যাবে।

চাকরি পাইছস মোবারক?

না চাকরি পাই নাই। ব্যবসা করব সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

কিয়ের ব্যবসা?

ফুলের ব্যবসা।

তুই দেখি আগের মতই পাগলা আছস? ফুলের আবার ব্যবসা কী?

বিরাট এক দোকান দিতেছি— নাম হল FRUITS AND FLOWERS বাংলা হল, ফুল ও ফল। আমার দোকানে ফলও পাওয়া যাবে আঙ্গুর, বেদানা, নাসপাতি, আপেল, কলা, কমলা, আনারস, বানারস…

বানারসটা কী?

আছে বানারসও আছে। দেখতে আনারসের মত। সাইজে, ছোট।

আকলিমা বেগম মুগ্ধ হয়ে নাতির কথা শুনছেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আরো একজন মুগ্ধ হয়ে কথা শুনছে। তার নাম সরুফা। বাবা-মা মরা মেয়ে। আকলিমা বেগমের দেখাশোনা করে। এই বাড়িতেই থাকে। বয়স চৌদ্দ পনেরো। মেয়েটা অস্বাভাবিক ধরনের লাজুক। আজ তার লজ্জা আকাশ স্পর্শ করছে কারণ আকলিমা বেগম তাকে অসংখ্যবার বলেছেন তার এক নাতি আছে। নাম মোবারক। তিনি মৃত্যুর আগে অতি অবশ্যই মোবারকের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে যাবেন। সরুফাঁকে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে কখনো চিন্তা করতে হবে না।

মোবারক নামের মানুষটা চলে এসেছে। মানুষটাকে সে যত দেখছে ততই ভাল লাগছে। কী অদ্ভুত মানুষ, ঘরে ঢুকেই একটা চাদর দিয়ে দাদিকে পেঁচিয়ে ফেলল। কোনো কথা নাই। পা ছুঁয়ে সালাম নাই। তারপরই মানুষটা তার দিকে তাকিয়ে বলল— এই খুকি। তুমি দাদিজানের দেখাশোনা কর? শোন তুমি কি চা বানাতে পার। আমি চা পাতা নিয়ে এসেছি। চা বানাওতো। যদি চা ভাল হয় তাহলে পুরস্কার, ভাল না হলে তিরস্কার। আর যদি খুব খারাপ হয় তাহলে— মারস্কার। হা হা হা।

সরুফার তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এমন অসাধারণ একজন মানুষের সঙ্গে তার বিয়ে হবে! তার বাপ নেই, মা নেই। তাকে আত্মীয় স্বজনরা ঘরে জায়গা দেয় না। সে তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দিল অন্যের বাড়িতে। তারই কি-না এমন একটা ভাল ছেলের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে?

বাড়িতে মেহমান এসেছে। সরুফার হাতে কত কাজ। রান্নাবান্নার আয়োজন দেখতে হবে। মাছ আনতে হবে। মুরগির ব্যবস্থা করতে হবে। অথচ সে দরজার আড়াল থেকে নড়তেই পারছে না। মানুষটা দাদিজানের সঙ্গে যে সব কথা বলছে তার সবই শুনতে ইচ্ছা করছে।

ইচ্ছা করলেও উপায় নেই। এত দূর থেকে সব কথা কি আর শোনা যায়? আর শোনা গেলেও যে কথা বলছে তার মুখতো দেখা যাচ্ছে না। যে কথা বলছে তার মুখ না দেখলে মনে হয় কথাটা বুঝি পুরোপুরি শোনা হল না। কিছু বোধহয় বাদ রয়ে গেল।

বৃদ্ধা বললেন, সরুফা মেয়েটারে কেমন দেখলি?

মোবারক বলল, দেখলাম আর কোথায়? ওতো দরজার আড়ালে আড়ালে থাকে। ও হচ্ছে আড়াল-কন্যা। হা হা হা।

তুই এমন কথায় কথায় হাসতেছস ক্যান? তোর হইছেটা কী?

মোবারক বলল, অনেকদিন পর তোমাকে দেখে মন ভাল হয়ে গেছে। আমার অবস্থা হয়েছে তোমার শাশুড়ির মত। কারণ ছাড়াই হিহি-হাহা-হোহো।

বৃদ্ধা হাত বাড়িয়ে মোবারকের বা হাত ধরলেন। শক্ত করে ধরলেন। শাস্তি দেবার আগে দুষ্ট ছেলেকে মা যেভাবে খপ করে ধরেন সেই ভঙ্গিতে ধরা। ছেলে হাজার চেষ্টা করেও ছুটে যেতে পারবে না।

মোবারক শোন। সরুফারে তুই বিবাহ কর। সরুফা খুবই দুঃখী মেয়ে আর তুইও খুব দুঃখী। দুঃখে দুঃখে সুখ। আমার কোনো কথাইতো তুই রাখস না। এইটা রাখ। মেয়েটা কত সুন্দর এইটা ভাল কইরা দেখছস?

সুন্দর তুমি কীভাবে দেখলে? হাত বুলিয়ে।

আমার হাত মাইনষের চউখের চেয়ে ভাল। চউখ আন্ধাইরে দেখতে পারে না। আমার হাত পারে। খালি রঙ টা বুঝে না। ফর্সা না শ্যামলা টের পায় না।

প্র্যাকটিস করেল এইটাও হয়ত পারবে। প্র্যাকটিসে সব হয়।

তুই আসল কথা ঘুরাইতেছস। মেয়েটারে বিবাহ করবি?

মোবারক তাকিয়ে রইল। বৃদ্ধা গলা নামিয়ে বললেন, তোর নয়া শালটা আমারে যেমনে প্যাচাইয়া ধইরা আছে— সরুফা সারাজীবন তোরে ঠিক এইরকম প্যাচাইয়া ধইরা রাখব। মেয়েটারে আমি কথা দিছি তোর সাথে বিবাহ দিব।

কথাও দিয়ে ফেলছ?

হ কথা দিছি। কোনো শান্তি তুই আমারে দেস নাই। মরণের আগে এই। শান্তিটা দে।

মোবারক উদাস গলায় বলল, আচ্ছা যাও কবুল। মেয়েটা নিতান্তই শিশু, যাই হোক তোমার কথা রক্ষা। আমার দুই বন্ধু সঙ্গে থাকলে আজই যন্ত্রণা শেষ করে ফেলতাম।

খবর দিয়া তারারে আন।

মোবারক বলল, এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? কথাতো দিলাম আর কী? মরদকা বাত, হাতীকা দাঁত। এখন হাতটা ছাড়, বাইরে থেকে একটা সিগারেট খেয়ে আসি।

সিগারেট আমার সামনেই খা। আমি তো আর চউক্ষে দেখি না। কী খাস না খাস দেখব না। অসুবিধা কী?

অসুবিধা আছে।

মোবারক উঠানে এসে সিগারেট ধরাল। পরিষ্কার ঝক ঝক করছে উঠান। এককোণায় আবার কয়েকটা গাদা ফুলের গাছ। হলুদ ফুলে গাছ ভর্তি হয়ে আছে। নিশ্চয়ই সরুফা মেয়েটার কাণ্ড। ফুলের প্রতি মেয়েটার টান আছে। এটা ভাল। FRUITS AND FLOWERS এর মালিকের স্ত্রী যদি ফুল ভাল না বাসে তাহলে হবে কীভাবে? তবে মেয়েটা বড়ই লাজুক। লজ্জা দূর করতে হবে। আড়াল কন্যা হলে চলবে না। আর বাচ্চা মেয়ে মাথায় ঘোমটা কেন? ঘোমটা ফেলে বউ-মানুষরা।

সরুফা চায়ের কাপ নিয়ে আসছে। মেঝের দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে আসছে যেন একটা স্প্রিং দেয়া কাঠের মুর্তী। স্প্রিং এ চাবি দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে— যন্ত্রের মত মূর্তি এগুচ্ছে। চাবি শেষ হবে মূর্তি থেমে যাবে।

চা হাতে দিয়েই সরুফা চলে যেতে ধরেছিল— মোবারক বলল, খুকি দাঁড়াও। চা কেমন হয়েছে খেয়ে দেখি। পুরস্কার, তিরস্কার না মারস্কার।

সরুফা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ নিজের পায়ের দিকে। মনে হচ্ছে সে অল্প অল্প কাঁপছে। মোবারকের মনটা খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা তাকে ভয় পাচ্ছে না-কি? আশ্চর্য তাকে পিঁপড়াও ভয় পায় না, এই মেয়েটা ভয় পাবে কেন।

মোবারক বলল, চা ভাল হয়েছে। খুবই ভাল। পুরস্কার টাইপ ভাল।

মেয়েটা এই কথায় খুশি হয়েছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। মাথা নিচু করে আছে বলে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। দুএকটা কথা মেয়েটার সঙ্গে বলতে ইচ্ছা করছে। মজাদার কথা। মজাদার কথা সে ভালই জানে, তবে মেয়েরা কোন কথায় মজা পায় তা জানে না। বিল্লি মে কাট দিয়া গল্পটা কি করবে? মজাদার গল্প। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার কথা। না-কি কোনো ধাঁধা জিজ্ঞেস করবে। ছোট মেয়েরা ধাঁধা পছন্দ করে। একে বলে শিল্লুক ভাঙানি। শিল্পক ভাঙানির ক্ষমতা থেকে বুদ্ধির আঁচও পাওয়া যায়। মোবারক কঠিন কোনো ধাঁধা মনে করার চেষ্টা করছে। কিছুতেই মনে পড়ছে না। ব্যাপারগুলি এ রকম যখন যেটা মনে পড়ার দরকার সেটা মনে পড়ে না। যখন প্রয়োজন নেই তখন মনে পড়ে।

সরুফা চলে যেতে ধরতেই মোবারক বলল, আচ্ছা দেখি তোমার বুদ্ধি কেমন। একটা শিল্লুক দেই ভাঙ্গাও দেখি— বল কোন ফুল মানুষ সব সময় নাকের কাছে রাখে কিন্তু কোনো গন্ধ পায় না। চিন্তা ভাবনা করে বল। ফুলটা ছোট। নানান রঙের হয়— কোনোটা শাদা, কোনোটা হলুদ, কোনোটা লাল। নাকের কাছে রাখলেও কোনো গন্ধ নাই।

সরুফা বিড়বিড় করে বলল, বলতে পারতেছি না।

মেয়েটার মুখ কেমন হয়ে গেছে। উত্তর না দিতে পারার কষ্টে সে যেন মরে যাচ্ছে।

মোবারকের মায়া লাগছে। শিল্পকটা কঠিন হয়ে গেছে। এমন কঠিন শিল্লুক মেয়েটার পারার কথা না।

মোবারক বলল, এই ফুলটি হল নাক ফুল। তোমার নাকেওতো এখন একটা আছে। বল এই ফুলের গন্ধ আছে?

জ্বি না।

আচ্ছা এইটা বলদেখি–

ঘর আছে দরজা নাই
মানুষ আছে কথা নাই।

সরুফা বলল, কব্বর।

হয়েছে। তোমারতো ভাল বুদ্ধি। এখন যাও আরেক কাপ চা বানিয়ে আন। চিনি বেশি করে দেবে। আমি চিনি বেশি খাই। রান্না বান্নার জন্যে ব্যস্ত হয়ো না। আমার কাছে খাওয়া দাওয়াটা কোনো বড় ব্যাপার না। খুব যদি ক্ষিধা লাগে তাহলে নিজের একটা পা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলব।

সরুফা অবাক হয়ে তাকাচ্ছে।

মোবারক বলল, মাকড়সা কী করে জান? মাকড়াসার যখন খুব ক্ষিধে লাগে তখন সে নিজের পা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে। তাতে কোনো অসুবিধা হয়। টিকটিকির খসে পড়া লেজ যেমন গজায়, মাকড়সারও তেমন পা গজায়।

এইসব কী কন?

সত্যি কথা বলছি। সবই বিজ্ঞানের কথা।

আমার বিশ্বাস হইতেছে না।

বিশ্বাস না হবারই কথা। চোখের সামনে কত মাকড়সা ঘুরঘুর করে। কিন্তু আমরা কি জানি এরা ক্ষিধার সময় নিজের পা ছিঁড়ে খায়। এই জাতীয় আরো অদ্ভুত অনেক কথা আছে। তোমাকে ধীরে স্থীরে বলব।

সরুফা দাঁড়িয়ে আছে, যাচ্ছে না। বেচারীর বোধহয় এ রকম গল্প আরো শুনতে ইচ্ছা করছে। মোবারক দড়ি কাটার একটা ম্যাজিক জানে। দড়ি কেটে জোড়া দিয়ে দেয়া। ফুটপাতে দন্তরোগ-যম মাজন বিক্রি করে এক লোক নানান রকম ম্যাজিক দেখায়। তার মধ্যে সবচে বিস্ময়কর ম্যাজিকটা হল দড়ি কেটে জোড়া দেয়া। মোবারক এই ম্যাজিক দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিল যে ম্যাজিসিয়ানকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ম্যাজিকের কৌশল শিখে নিয়েছিল। ম্যাজিকটা ভাল হলেও কৌশলটা খুবই সহজ। মুল দড়ি কাটা হয় না। দুই ইঞ্চি লম্বা ছোট্ট একটা দড়ির টুকরা কাটা হয়। সেই টুকরাটা লুকানো থাকে হাতের তালুতে। দড়ির ম্যাজিকটা সরুফাঁকে দেখানো যেতে পারে। গ্রামের মেয়ে ভাল জিনিসতো কিছুই দেখে না। খুশি হবে। মেয়েটাকে সঙ্গে করে সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যেতে পারলে হত। বরফ টরফ দেখে খুশি হত। অন্যের খুশি দেখার মধ্যেও আনন্দ আছে।

মোবারক দড়ির খুঁজে দাদিজানের ঘরে ঢুকল। যে-কোনো জিনিস দাদিজানের খাটে থাকবেই। তাঁর রেলিং দেয়া খাট ভর্তি নানা ধরনের, নানান সাইজের টিন, বাক্স, পেটরা। কোনোটায় চিড়া, কোনোটায় মুড়ি। কোনোটায় আমসত্ব। এই মহিলার সব কিছু হাতের কাছে থাকা চাই।

দাদিজান তোমার কাছে দড়ি আছে। চিকন দড়ি?

আছে। কী করবি?

কাজ আছে— দড়ি দাওতো।

তুই ব আমার কাছে। তোর শইল্যের গন্ধ বিস্মরণ হইছিলাম। অখন গন্ধ পাইতেছি।

গন্ধটা কেমন?

ভাল গন্ধ। তুই থাকবি কয় দিন?

কয়দিন মানে? দুপুরে ভাত খেয়েই রওনা।

কস কী তুই?

উপায় নাই। বিদেশ যাব। কাজ কর্ম বাকি আছে। তুমি কোনো চিন্তা করবা না। দেশে ফিরেই গ্রামে চলে আসব। বন্ধু দুজনকে সাথে নিয়ে আসব। আর শোন সরুফার বিয়ের ব্যাপারে যা বলেছ— সেটা ফাইন্যাল।

বৃদ্ধা হাসছেন। হাসতে হাসতে বললেন, মেয়ে পছন্দ হয়েছে?

মোবারক বলল, খুব বেশি না। মোটামুটি হয়েছে। মেয়ের লজ্জা বেশি। তার উপর বুদ্ধি সামান্য কম আছে। সহজ একটা শিল্পক দিয়েছি ভাঙ্গাতে পারে নাই। যাই হোক এইসব কথা তাকে বলে লাভ নাই। বেচারী মনে কষ্ট পাবে। বাচ্চা মেয়ে মনে কষ্ট দিয়ে লাভ কী?

বৃদ্ধা শব্দ করে হেসে ফেললেন। মোবারক বিষ্মিত হয়ে বলল, হাস কেন?

বৃদ্ধা বললেন, মেয়েটারে তোর খুব বেশি পছন্দ হইছে এইজন্যে হাসতেছি। মনের খুশিতে হাসতেছি। কি আমি ভুল কইছি?

মোবারক জবাব দিল না। বৃদ্ধা ঘোরলাগা গলায় বললেন, আমার অনেক দিনের ইচ্ছা তোর বিবাহ দিব। তুই নয়া বউরে নিয়া রুপার পালঙ্কে বাসর করবি।

মোবারক অবাক হয়ে বলল, রুপার পালঙ্ক পাব কোথায়?

এই পালঙ্কইতো রুপার পালঙ্ক। তোর দাদাজান আর আমি যে পালঙ্কে জীবন শুরু করছি। যে পালংকে তোর বাবা তোর মারে নিয়া প্রথম ঘুমাইতে গেছে সেই পালঙ্ক রুপার পালঙ্ক না?

একটু আগে বৃদ্ধা হাসছিলেন। এখন কাঁদছেন। মোবারকের চোখেও পানি এসে গেল। পানিতে ঝাপসা চোখে পালঙ্ক দেখছে বলেই হয়ত তার মনে হল পালঙ্কটা ঝকমক করছে। আসলেই যেন এটা রুপার পালঙ্ক।

ঢাকায় পৌঁছতে পৌঁছতে মোবারকের রাত

ঢাকায় পৌঁছতে পৌঁছতে মোবারকের রাত দশটা বেজে গেল। সে বলে গিয়েছিল রাতে ফিরবে। রাত দশটাও রাত, দুটাও রাত। কাজেই এক্ষুনী যে বড় সাহেবের রাজপ্রাসাদে বন্দি হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। রাত দুটার দিকে গেলেই হবে। গেটে দারোয়ান থাকে। দারোয়ান নিশ্চয়ই গেট খুলে দিবে। এবং সে নিশ্চয়ই কৈফিয়ত তলব করবে না, গলার রগ ফুলিয়ে বলবে না— এত রাত হল কেন? যদি জিজ্ঞেস করেও বললেই হবে রাজেন্দ্রপুরের কাছে বাস এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। সে অল্পের জন্যে বেঁচেছে। একজন মারা গেছে, কয়েকজনের অবস্থা ক্রিটিক্যাল। সে নিজেও বুকে ব্যথা পেয়েছে। হাসপাতাল থেকে এক্সরে করিয়ে তারপর এসেছে। দেরী হবার এই কারণ। তবে জিজ্ঞেস করবে বলে মনে হয় না।

মোবারক কুদুসের চায়ের দোকানে চলে গেল। আজ একটু শীত পড়েছে। বড় সাহেবের বাড়ি থেকে আনা চাদরটা থাকলে ভাল হত। চাদরটা জহিরকে দিয়েছিল। জহির নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে ব্যবস্থা করে ফেলেছে বিক্রি করে দিয়েছে।

জহিরের একটা খোঁজ নেয়া অত্যন্ত জরুরি। রক্তবমি বন্ধ হয়েছেতো বটেই। পাতলা পায়খানা অনেকদিন থাকে। রক্তবমির মত জটিল ব্যাধি অল্প সময় থাকে। জহিরের শরীর যদি ভাল থাকে আর বজলুকে যদি পাওয়া যায়— তিনজনের আসর বসাতে হবে। সে কিছু খাবে না। সে শুধু দেখবে। আসরে উপস্থিত থাকার আনন্দও কম না। বন্ধুদের কাছ থেকে সে অনেক কিছু গোপন করেছে— কিডনি বিক্রির ব্যাপারটা গোপন করা উচিত হয় নি। খুবই অন্যায়। হয়েছে। ওদেরকে বুঝিয়ে বলতে হবে।

সরুফার ব্যাপারটাও বলতে হবে। একটু অন্যভাবে বলতে হবে। দাদিজানের শেষ ইচ্ছা। কী আর করি। দাদিজানের কথা ফেলি কী করে? বাবা মা মারা গিয়েছিলেন আমি যখন কোলের শিশু। দাদিজানই আমাকে বড় করেছেন। দাদিজান সেই কারণে একই সঙ্গে আমার দাদি, আমার মা এবং আমার বাবা। একের ভেতর তিন। উনার শেষ ইচ্ছা অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। কাজেই বাধ্য হয়ে স্বীকার করেছি। মেয়ের চেহারা ছবি মোটামুটি। বুদ্ধির সামান্য শর্ট। কী আর করা…। ইত্যাদি…।

চায়ের দোকানে বজলু বা জহির কেউ নেই। ছোট রফিক আছে। সে বসে আছে মোবারকের চেয়ারে। তার সামনে এক কাপ চা। কিন্তু সে চা খাচ্ছে না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে কারো জন্যে অপেক্ষা করছে। সে রাস্তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মোবারক চায়ের দোকানে ঢোকার পর সে কঠিন দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মোবারকের দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।

মোবারককে দেখেই কুদ্দুস বলল, তুমি ছিলা কই? বজলু আধা পাগল হইয়া তোমারে খুঁজতেছে।

মোবারক বলল, কেন?

জহিরের খবর কিছু জান না? রক্তবমি করতেছে। চাইর ব্যাগ রক্ত দেওয়া হইছে। কোনো লাভ হয় নাই। এই যাত্রা বাঁচব বইল্যা মনে হয় না। আমি দেখতে গেছিলাম। আমারে চিনে নাই।

সে আছে কোথায়?

মেডিকেলে। দুই নম্বর ওয়ার্ড।

 

মোবারক জহিরের বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মোবারকের পাশে বজলু। বজলু ফিসফিস করে বলল, তোকে দেখে খুবই সাহস পাচ্ছি। মনটা ভেঙে গিয়েছিল বুঝলি। আজ সারাদিন ছয় কাপ চা ছাড়া কিছু খাইনি। তুই ছিলি কোথায়?

মোবারক জবাব দিল না। সে একদৃষ্টিতে জহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। জহিরকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে মানুষ না, মর্গের কোনো মৃতদেহ।

বজলু বলল, রক্ত বমিটা বন্ধ হয়েছে। তবে ডাক্তার বলেছে আশা খুবই কম।

মোবারক জহিরের মুখের কাছে মুখ নিয়ে ডাকল, এই জহির। জহির!

জহির চোখ মেলল।

মোবারক বলল, আমাদেরকে চিনতে পারছিস? চিনতে পারলে কথা বলার দরকার নেই। একটু চোখের পাতি নাড়া। তাহলেই বুঝব চিনতে পারছিস।

জহির চোখের পাতি নাড়ল এবং দুই বন্ধুকে অবাক করে দিয়ে সামান্য হাসল।

বজলু বিস্মিত হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল— আরে ব্যাটা দেখি হাসে। ব্যাটাকেতো বিল্লি মে কাট দিয়া।

মোবারক বলল, দোস্ত ঝুলে থাক। খবরদার মরবি না। খবরদার না। কোনো চিন্তা নেই। আমি সব ব্যবস্থা করেছি। দোস্ত আমি কিডনি বেঁচে দিয়েছি। অনেক টাকা পাব। দেখবি এই টাকা দিয়ে আমি আমাদের ভাগ্য বদলে ফেলব— FRUITS AND FLOWERS. বিশ্বাস কর দোস্ত সত্যি কথা বলছি। সবই সত্যি। এক বর্ণ মিথ্যা না।

কথা বলতে বলতে মোবারকের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।

ঝাপসা চোখে তার হঠাৎ মনে হল জহির যে খাটে শুয়ে আছে সেটা সাধারণ খাট না। খাটটা রুপার তৈরি। রুপার পালঙ্ক।

 

পরিশিষ্ট

মোবারক তার কিডনি বিক্রি করতে পারে নি। তাদের বিদেশ যাত্রার আগের দিন বড় সাহেব হঠাৎ করে মারা যান। মোবারক ফিরে যায় আগের জীবনে। ছাতিম গাছের নিচে তিন বন্ধু বসে থাকে। মাঝে মাঝে তারা ভাবের জগতে চলে যায়, তখন সময়টা বড় আনন্দে কাটে। বজলু হঠাৎ বলে, জহির, তোর বিল্লির গল্পটা বলতো। বিল্লি মে কাট দিয়া।

জহির সঙ্গে সঙ্গে গল্প শুরু করে।

তিন বন্ধু প্রাণ খুলে হাসে।

শুধু পূর্ণিমার রাতে মোবারকের খুব কষ্ট হয়। আকাশ ভেঙে জোছনা নামে। মোবারকের মনে হয় সমস্ত পৃথিবীটাই বুঝি বিশাল এক রুপার পালঙ্ক। এত প্রকাণ্ড এক পালঙ্কে সে বসে আছে একা। অনেক দূরে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে লাজুক একটা মেয়ে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একবার যদি বলা যায়, খুকি এসো। সে ছুটে চলে আসবে। কিন্তু মোবারক বলতে পারছে না। কারণ কথাগুলি বলার জন্যে তাকে রুপার পালঙ্ক থেকে নেমে মেয়েটার কাছে যেতে হবে। সে যেতে পারছে না। যে রুপার পালঙ্কে সে বসে আছে সেখান থেকে নামার ক্ষমতা তার নেই।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদের আলো তীব্র হয়। রুপার পালঙ্ক ঝকমক করতে থাকে।

Exit mobile version