জহির বলল, তোর গায়ে উলের চাদর?
মোবারক এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। যদিও তার ইচ্ছা করছে বলতে— উলের চাদর না। পাটের কোস্টার চাদর। চাদরও না, গামছা।
জহির বলল, চাদর পেয়েছিস কোথায়?
মোবারক গম্ভীর গলায় বলল, আমার নিজের চাদর। এর মধ্যে পাওয়া পাওয়ি কী?
জিনিস ভাল।
মোবারক বলল, জিনিস যে ভাল তোকে সেই সার্টিফিকেট দিতে হবে না। আমার জিনিস আমি জানি ভাল না মন্দ।
রেগে আছিস কেন?
মোবারক জবাব না দিয়ে টেবিলের উপর রাখা সিগারেটের প্যাকেট চাদরের নিচে ঢুকিয়ে ফেলল। জহিরের স্বভাব খারাপ। সামনে সিগারেটের প্যাকেট থাকলে ক্রমাগত খেয়ে যাবে। দুই মাসও হয়নি এতবড় অসুখ থেকে উঠেছে কিছু সাবধান হওয়াতো দরকার। মদের চেয়েও ক্ষতি করে সিগারেট।
জহির বলল, গরমের মধ্যে চাদর গায়ে ঘুরছিস কেন?
ইচ্ছা হয়েছে ঘুরছি। তাতে তোর কোনো সমস্যা হয়েছে?
গরমের মধ্যে উলের চাদর। তোকে দেখে আমার নিজেরই গরম লাগছে।
গরম লাগলে শার্ট প্যান্ট খুলে ন্যাংটা হয়ে যা।
জহির গলা নামিয়ে বলল, চাদরের নিচে কিছু আছে?
না।
না থাকলেও অসুবিধা নাই। আমি জিনিসপত্র নিয়ে এসেছি। সাতটা বোতল। এক নম্বরী ডাইল। সিগারেটের প্যাকেট সামলে ফেললি কেন? দেখি প্যাকেট বের কর।
মোবারক সিগারেটের প্যাকেট বের করল। জহিরের উপর তার রাগটা অতি দ্রুত কমছে। এই তার এক সমস্যা। সে রাগ ধরে রাখতে পারে না। অতি দ্রুত কমতে থাকে। শুধু যে রাগ কমছে— তা না। এখন আবার মায়াও লাগতে শুরু করেছে। কী অবস্থা করেছে শরীরের। এত বড় একটা অসুখ থেকে উঠেছে— নিজের শরীরের দিকে তাকাবে না? মনে হচ্ছে দুপুরে সে কিছু খায়ওনি। কেমন পা টেনে টেনে হাঁটছিল। পায়ে কী কিছু হয়েছে?
মোবারক বলল, দুপুরে ভাত খেয়েছিস?
না।
না কেন?
সময় পাই নাই।
সময় পাস নাই কেন? তুই কি মিনিস্টার যে মিটিং মিছিল করে দম ফেলতে পারছিস না।
মোবারক চোখের ইশারায় বটুকে ডেকে দুটা পরোটা আর শিক কাবাব দিতে বলল।
জহির হামলে পড়ে খাচ্ছে। দেখে মায়া লাগছে।
এই দুই দিন ছিলি কোথায়?
নারায়ণগঞ্জ।
সেখানে কী?
ছোট খালু মারা গেছে। খবর পেয়ে দেখতে গিয়ে বিরাট ক্যাচালের মধ্যে পড়ে গেলাম।
কী ক্যাঁচাল?
আরে টাকা নাই, পয়সা নাই। দশ গজ কাফনের কাপড় কিনতে গিয়েছে তাও টাকা শর্ট পড়েছে। খালা আমাকে ধরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করা শুরু করল–-ওরে কই যাব রে? তুই বলে যা কই যাব রে?
আমার নিজের যাওয়ার নাই ঠিক, আমি কী করে বলব— কই যাবে? দাফন করতে যাবে, আমি বললাম, খালা আমাকে পাঁচটা মিনিট সময় দেন। চা খাবার নাম করে আসছি। চা খেতে বের হয়ে ফুটলাম।
ভাল করেছিস।
ঘর ভর্তি বাচ্চা কাচ্চা। এর মধ্যে একটার আবার উঠেছে জ্বর। মাথায় পানি ঢালাঢলি হচ্ছে। বিশ্রী অবস্থা।
মোবারক বলল, তুই গেলি কেন খামাখা। যাওয়াটাই ভুল হয়েছে।
জহির থমথমে গলায় বলল, বিরাট ভুল হয়েছে। যাওয়া উচিত হয় নাই। আমার যাবার কোন ইচ্ছা ছিল না, বাবা বলল, জহির যা দেখে আয়। আমি নড়তে পারছি না। নয়ত আমি যেতাম। আমি ভাবলাম যাই। ছোটবেলা কিছুদিন খালার সঙ্গে ছিলাম। খালা খালু দুইজনই খুব আদর করত। খালার চেয়ে বরং খালুর আদর ছিল বেশি। এই জন্যই চলে গেছি। গিয়ে পড়লাম কাঁচালে। এমন মনটা খারাপ হয়েছে কিছুই ভাল লাগে না। কাদলে মনটা হালকা হত। কান্নার চেষ্টা করেছি। কান্না আসে না–এখন করব কী বল? নেশা করলে যদি চোখে পানি আসে এই জন্যেই ছয়টা বোতল নিয়েছি।
টাকা কই পেয়েছিস?
জহির জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল।
মোবারক আবার বলল, টাকা কোথায় পেয়েছিস?
জহির কথা শুনতে পায়নি এমন ভাব করে আরেকটা সিগারেট ধরাল।
কেউ কোনো কথা বলতে না চাইলে সেই কথা শোনার জন্যে চাপাচাপি করা ঠিক না। মোবারক চুপ করে গেল। বলার হলে সে নিজেই বলবে। পেটে জিনিস পড়লেই হড়বড় করে কথা বের হবে। জিনিস পড়ার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে সেটাই হল কথা। বজলুর এখনো দেখা নাই। বজলু থাকে তার ছোট বোনের সঙ্গে ঝিকাতলায়। ঠিকানা আছে। কিন্তু বজলুর কঠিন নিষেধ যেন তার খোঁজে কখনো যাওয়া না হয়। নিষেধ হোক যাই হোক একবার যাওয়া দরকার। মানুষটার অসুখ বিসুখও তো হতে পারে। বন্ধু যদি বন্ধুর খোঁজ না করে কে করবে? পাড়ার লোকে করবে? পাড়ার লোকের কী দায় পড়েছে?
মোবারক বলল, তোর পায়ে কী হয়েছে?
জহির বলল, রগে টান পড়েছে মনে হয়।
ল্যাংড়া হয়ে যাবি তো।
হুঁ।
তোর তো দেখি শরীর একেবারে গেছে।
গেলে কী আর করা? শরীর দিয়ে কী হয়? এত বড় যে গামা পালোয়ান শরীর দিয়ে সে করলটা কী?
তোর জিহ্বা কালো হয়ে গেছে। তোর মধ্যে একটা সাপ সাপ ভাব চলে এসেছে।
জহির হঠাৎ বিরাট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দোস্ত মনটা খারাপ, খুবই খারাপ।
কী জন্যে মন খারাপ বলে ফেল। শুনলে তোরও মন খারাপ হবে। তাহলে বাদ দে।
জহির কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎ বিড়বিড় করে বলল, ছোটখালা এক হাজার টাকা দিয়েছিল। তার কাছে তো ছিল না। ধারধোর করে এনে দিয়েছে। চা খাওয়ার নাম করে ঐ টাকা নিয়ে ফুটে গেছি।
জিনিসপত্র ঐ টাকায় কিনেছিস?
হুঁ। দোস্ত খুবই খারাপ লাগছে। একবার ভাবলাম লাফ দিয়ে কোনো ট্রাকের নিচে পড়ে যাই।
পড়লি না কেন?
ট্রাকের সামনে ঝাপ দিতে ইচ্ছা করে, ঝাপ দেই না। ছাদে উঠে ঝাপ দিয়ে নিচে পড়তে ইচ্ছা করে, ঝাপ দেই না। সাহস নাইরে দোস্ত, সাহস নাই। এই দুনিয়ায় আসল জিনিসের নাম— সাহস। যার সাহস আছে তার সবই আছে। যার সাহস নাই তার কিছুই নাই।