টুপি নিতে কেউ এল না। মোবারক টুপি হাতে গুলিস্তানে নেমে পড়ল। নেমে পরার আগে ছোটখাট একটা বাণিজ্যও হয়ে গেল। সে বাসের
বাসের কন্ডাকটার চোখ গরম করে বলল, কীয়ের টাকা? কন কী?
মোবারক বলল, দশ টাকার একটা নোট দিলাম। আপনি বললেন— এখন ভাংতি নাই পরে দিবেন।
কন্ডাকটার চোখ আগের চেয়েও গরম করে বলল, কী কন? দিল্লেগী করেন? ধাক্কা দিয়া চাক্কার নিচে ফেলাইয়া দিমু…।
মোবারক শান্ত গলায় অন্য পেসেঞ্জারদের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইসাব দেখলেন কী বলে? ধাক্কা দিয়ে চাকার নিচে ফেলে দেবে। তখনি আমি টাকা দিতে চাই নাই। আমি বলেছি ভাংতি নিয়ে আস তারপরে নোটটা নাও। তখন সেটা করবে না।
এক যাত্রী ক্ষিপ্ত গলায় বলল, শুওরের বাচ্চার গাল বরাবর একটা চটকনা দেন। হারামজাদার কত বড় সাহস।
চটকনা দিতে হল না। তার আগেই কন্ডাকটার একটা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল।
মোবারক বলল, এক টাকা ভাড়া কেটে রাখেন। নয় টাকা দেন।
কন্ডাকটার বিরস গলায় বলল, থাউক ভাড়া লাগব না। আফনের ভাড়া TIPI
মোবারক দর্শকদের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বলল, ভাইসাবরা দেখলেন, কীভাবে অপমান করে আমার ভাড়া নাকি মাফ।
অন্য এক ক্রুদ্ধ যাত্রী বলল, হারামজাদারে একটা চড় দেন না। দেখেন। কী? মার না খেলে শিক্ষা হবে না।
মোবারক জোরেসোরে এক চড় বসিয়ে হেঁটে চলে এল। পিছনে ফিরল না। পিছনে ফিরলে হয়ত দেখা যাবে, কন্ডাকটার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তবে চড় মারাটা বাড়াবাড়ি হয়েছে। আল্লাহপাকের হিসাবের খাতায় নাম উঠে গেছে। এমন একটা চড় কোনো না কোনো সময় মোবারককে খেতে হবে। চড়ে চড়ে কাটাকাটি হবে। সবার হিসাবে ভুল হয়, আল্লাহপাকের হিসাবে ভুল নাই। বাসের কন্ডাকটার যেমন অনেক লোকের সামনে চড় খেয়েছে, সেও অনেক লোকের সামনেই খাবে। হয়ত আজই খেত। ছোট রফিকের হাত থেকে খেত। কপাল গুণে বেঁচে গেছে।
মোবারক চা খাচ্ছে। তার নিজের পছন্দের চেয়ারে বসে খাচ্ছে। চেয়ারটা এই জন্যে পছন্দ যে এখান থেকে রাস্তা দেখা যায়। রাস্তার লোকজন তাকে এত সহজে দেখবে না। চেয়ারটা মদিনা রেস্টুরেন্টের এক কোণায়। রাস্তার লোক দোকানের দিকে তাকায়, দোকানের কোণার দিকে তাকায় না।
সন্ধ্যা হয় হয় করছে। সন্ধ্যাবেলাটা মোবারকের খারাপ লাগে। বিশ্রী একটা সময়, দিনও না, রাতও না। এই দুয়ের মাঝামাঝি একটা ব্যাপার। দিনের এক রকম মজা, রাতের আরেক রকম মজা। এই দুয়ের মাঝামাঝি সময়ের কোনো মজা নেই। সন্ধ্যা একা কাটানো যায় না। সন্ধ্যার জন্যে বন্ধু লাগে। মোবারকের মেজাজ দ্রুত খারাপ হচ্ছে। জহিরেরও দেখা নেই, বজলুরও দেখা নেই। মনে হচ্ছে এরা দুজন যুক্তি করে হাওয়া হয়ে গেছে। বজলুর জন্যে ব্যাপারটা স্বাভাবিক। সে প্রায়ই ড়ুব মারে। দু তিন দিন পরে হঠাৎ উদয় হয়। এই দু তিন দিন সে কোথায় ছিল, কী করেছে সে সম্পর্কে কিছুই বলে না। প্রাইভেট কোনো ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। সব মানুষেরই কিছু না কিছু প্রাইভেট ব্যাপার থাকে। কিন্তু জহিরের ব্যাপারটা কী? আবার কোনো অসুখ বিসুখ হয়নি তো?
জহিরের হল অসুখ রাশি— এই জ্বর, এই কাশি, এই হাম। মানুষের হাম হয় একবার ছোটবেলায়। গা ভর্তি হাম বের হল। হাম ডেবে গেল, মামলা ডিসমিস। সেই হাম জহিরের হয়েছে তিনবার। জন্ডিস হল চারবার। শেষবারে এমন অবস্থা যে, কলাবাগানের জামে মসজিদের ইমাম সাহেবকে ডেকে এনে তওবা পড়ানো হল। তওবা পড়ানোর পর মিলাদ হল। বজলু সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে জহিরকে বলল— তুই এখন শিশুর মত নিস্পাপ হয়ে গেলি। বাম কাঁধের ফিরিশতা এতদিন তার খাতায় যা লিখেছে সব মুছে গেছে। আগের সব পাপ কাটাকাটি হয়ে গেছে। যে অসুখ বাঁধিয়েছিস এর মধ্যে নতুন পাপ আর কিছু করতে পারবি না। যদি মারা যাস— স্ট্রেইট বেহেশত নসিব হবে। হুরপরীরা তোকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেবে।
আল্লাহপাকের বোধহয় ইচ্ছা না জহির বেহেশতে দাখিল হয়। সে তওবা পড়ানোর দিন তিনেকের মধ্যে উঠে বসে চি চি করে বলল— তার সরষে শাক দিয়ে ফ্যান ভাত খেতে ইচ্ছা করছে। লোকজনের কানের পাশ দিয়ে গুলি যায়। জহিরের গুলি গেছে বগলের তলা দিয়ে। হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেবার সময় ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন— আপনার লিভার মারাত্মক ড্যামেজড হয়েছে। আপনি যে বেঁচে আছেন এইটাই মিরাকল। বাকি জীবন আপনাকে খুব রেগুলেটেড লাইফ মেইনটেইন করতে হবে। মাংস পারতপক্ষে খাবেন না। মাছ ভাত খাবেন। মদ্যপান করবেন না। ঈদে চান্দেও না। ড্রপার দিয়ে এক ফোঁটাও না। বুঝতে পারছেন কারো কারো জন্যে মদ খাওয়া নিষিদ্ধ। আপনার জন্যে মদের গন্ধ শোকাও নিষিদ্ধ।
বজলু এবং মোবারক দুজনই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। এবং এক সঙ্গে বলল, জ্বি আচ্ছা।
ডাক্তার সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি পেশেন্টকে জিজ্ঞেস করছি। আপনারা দুজন মাথা নাড়ছেন কেন? আপনারা কে?
স্যার আমরা জহিরের ফ্রেন্ড।
আপনারা সামনে থেকে যান। আমি আপনাদের বন্ধুকে কিছু কঠিন কথা বলব। দাঁড়িয়ে থাকবেন না। চলে যান।
ডাক্তার সাহেব অনেক কঠিন কথা বললেন। জহির ঝিমঝিম চোখে হাই তুলতে তুলতে কঠিন কথা শুনল। তাকে খুব বিচলিত মনে হল না। সে কখনোই বিচলিত হয় না।
বন্ধুর রোগমুক্তি উপলক্ষে ছোটখাট উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। আজরাইলের হাত থেকে বাইম মাছের মত পিছলে বের হয়ে আসা কোনো সহজ ব্যাপার না। যে মানুষ এমন অসাধ্য সাধন করতে পারে তার জন্যে বড় উৎসবই করা দরকার। বড় উৎসবের সামর্থ্য কোথায়? ভদকার একটা বোতল যে জোগাড় হয়েছে এটাই যথেষ্ট। এক বোতল ভদকা, খাসির চাপ, হাজির বিরিয়ানি। আসর বসেছে বজলুর ঘরে। মোবারক এবং বজলু অতি দ্রুত বোতল শেষ করছে। জহির শুকনো চোখে তাকিয়ে আছে। তার শুকনো চোখ দেখে মায়া লাগছে কিন্তু কিছু করার নেই। আগে প্রাণে বাঁচতে হবে। জহিরের গন্ধ শোঁকা নিষিদ্ধ বলেই তারা ভদকা এনেছে। ভদকার গন্ধ নেই।