পরিচিত চায়ের দোকান থাকার সুবিধা আছে। মুখে অর্ডার দিতে হয় না। ইশারায় কাজ হয়। অনেক সময় ইশারাও লাগে না। বয় বাবুর্চি, কাস্টমার দেখলেই বুঝে কার কী লাগবে।
চায়ের স্টলের বয় বটু মোবারকের সামনে কাচের গ্লাসে এক গ্লাস মালাই চা রেখে চলে যাচ্ছিল। মোবারক কঠিন গলায় বলল, এই বটু শুনে যা।
বটু থমকে দাড়াল। মোবারক বলল, ইটা মাইরা গ্লাস ফেললি। আদব কায়দা জানস না? চড় দিয়া চাপার দুইটা দাঁত ফেইল্যা দেই। বজ্জাতের বাচ্চা বজ্জাত। বেয়াদবি সবের সাথে করা যায় না। ক্ষেত্রবিশেষে করা যায়।
বটু চায়ের গ্লাসটা খপ করে নামিয়ে রেখেছে ঠিকই কিন্তু তার জন্য এতটা রাগ করা যায় না। রাগটা মোবারক করেছে পাশের কাস্টমারকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। অনেকটা ঝিকে মেরে বউকে শিখানোর মত। শিক্ষাটা মনে হয় কাজে লেগেছে। পাশে বসে থাকা কাস্টমার তার দিকে তাকাচ্ছে। ব্যাটার চোখে ভয়। চুক-চুক চা খাওয়া বন্ধ করেছে।
মোবারক বটুকে বলল, এই চা নিয়ে যা, খাব না। মোবারক চাদরের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। সাধারণ সিগারেট না। বিদেশী সিগারেট— মারলবোরো। মোবারকের ইচ্ছা করছে সিগারেটের প্যাকেটটা কাস্টমারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মধুর গলায় বলে, ব্রাদার নেন একটা সিগারেট নেন।
কাজটা সে করেই ফেলত, তার আগেই চায়ের স্টলের মালিক কুদ্দুস মিয়া গলা খাকাড়ি দিল এবং চোখের ইশারায় তাকে ডাকল।
মোবারক বিরক্ত মুখে উঠে গেল। চোখের ইশারায় ডাকাডাকি এটাও তার পছন্দ না। এও এক ধরনের বেয়াদবি। মোবারক সব সহ্য করতে রাজি আছে, বেয়াদবি সহ্য করতে রাজি না।
কুদ্দুস গলা নিচু করে বলল, ঝামেলা কী?
মোবারক বলল, কোনো ঝামেলা নাই।
তোমার ডান পাশে যে বসছে তার সাথে কিছু হইছে?
না।
তারে চিনছ?
মোবারকের চোখ ছোট হয়ে গেল। কুদুসের গলা যেন কেমন কেমন। পাশের লোকটা কি বিশেষ কেউ? কুদ্দুস গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, সে হইল ছোট রফিক। কথাবার্তা, খুব সাবধান। খুবই সাবধান। তার সাথে বেয়াদবি কিছু কইরা থাকলে মাফ নিয়া নাও। সাপের মাথায় পাড়া দিলে অসুবিধা নাই। লেজে পাড়া দিলে খবর আছে।
মোবারক মুখ শুকনো করে আগের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। অন্য কোথাও বসতে পারলে ভাল হত। তবে সেটাও ঠিক হত না। ছোট রফিক ঠিকই লক্ষ্য করতো; মনে মনে ভাবত, লোকটা একটু আগে আমার পাশে বসেছে। এখন জায়গা বদলেছে।
আল্লাহ পাকের অসীম দয়া যে সে ছোট রফিকের সাথে ঝামেলা করেনি। সে শুধু বলেছে, এই চেয়ারটায় আমি বসব। তবে ছোট-রফিককে এই কথা বলাও বিরাট বেয়াদবি।
একজন যে চেয়ারে বসে আছে সেই চেয়ারে তুমি বসবে কেন? তুমি কোন দেশের লাট বাহাদুর? তুমি হলে মোবারক। তোমার দাম তিন পয়সা।
ছোট রফিক চা খাওয়া শেষ করেছে। পাঁচ টাকার একটা নোট চায়ের কাপের পাশে রাখতে রাখতে উঠে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে চায়ের দাম এবং বখশিশ একসঙ্গে দিয়েছে। ছোট রফিক মোবারকের দিকে তাকিয়ে বলল, জায়গা ছেড়ে দিলাম বসেন। আরাম করে চা খান।
মোবারক মুখ হাসিহাসি করার একটা চেষ্টা করল। ছোট রফিক সেই হাসিমুখ দেখার জন্যে অপেক্ষা করল না। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যাচ্ছে। কুদ্দুস মিয়া ক্যাশবাক্স ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সালাম দিল। ছোট রফিক সেদিকে না তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সালাম নিল। কোনো দিকে না তাকিয়েও চারদিকে কী হচ্ছে বুঝতে পারা বিরাট ব্যাপার। মোবারক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বটু চা দে। মালাই চা না, নরম্যাল চা।
বটু গলা নামিয়ে বলল, উনারে চিনেছেন? ছোট রফিক। একবার আমারে পঞ্চাশ টাকার চকচকা নোট বখশিশ দিছিল।
মোবারক উদাস গলায় বলল, ভাল।
তার এখন বেশ ভালও লাগছে।
নিজের চেয়ারে আরাম করে পা তুলে বসে এখন মারলবোরো সিগারেট টানতে টানতে চা খাওয়া যায়। আজ অল্পের উপর দিয়ে ফাড়া কেটেছে। মোবারকের সামান্য আফসোসও হচ্ছে। ছোট রফিককে চেয়ার ছাড়তে না বলে সে যদি ভদ্রভাবে পাশে বসত এবং সিগারেট সাধত তাহলে কত ভাল। হত। সে রকম খাতির হলে এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করা যেত, ভাইজান আপনাকে ছোট রফিক বলে কেন? আপনি যদি ছোট রফিক হন— বড় রফিকটা কে? হা হা হা। ভাইজান রসিকতা করলাম। কিছু মনে করবেন না।
ছোটখাট মানুষ হলে ছোট রফিক ডাকা যায়। কিন্তু মানুষটা মোটেই ছোটখাট না— লম্বা। তবে রোগা। গাল বসে গেছে। চেহারা ভাল। দেখে মনে হয় কোনো ব্যাংকে ট্যাংকে কাজ করে। মানুষটার গলার স্বরে রাগ আছে, কিন্তু চেহারায় কোনো রাগ নেই। বয়স কত হবে— চল্লিশ পঁয়তাল্লিশের বেশি হবে না। মোবারকের বয়স আটত্রিশ। কিন্তু তাকে দেখা যায় পঁয়তাল্লিশের মত। সব চুল পেকে যাওয়ায় এই অবস্থা হয়েছে। নিয়মিত কলপ করাও সমস্যা। একেকবার কলপে ত্রিশ টাকা লাগে। পশমি টুপিটা পাওয়ায় বিরাট কাজ হয়েছে। মাথা ঢেকে ঘোরাঘুরি করলে কে বুঝবে টুপির নিচের চুল কাঁচা না পাকা? টুপিটাও সুন্দর! এই টুপি আল্লাহ পাকের তরফ থেকে সরাসরি পাওয়া উপহার। আল্লাহপাক তার নাদান বান্দাদের জন্য মাঝে মাঝে সামান্য উপহার পাঠান। বান্দা ভাল না মন্দ সেদিকে তাকান না। এত কিছু দেখলে তার চলে না।
দোতলা বাসের দোতলায় বসে মোবারক আসছিল মীরপুর থেকে। তার আগারগাঁয়ে নেমে যাবার কথা। বসে থাকতে ভাল লাগছিল বলে নামল না। যতদূর যাওয়া যায় যাওয়া থাক। এর মধ্যে আল্লাহ পাকের একটা ইশারা অবশ্যই আছে। বাস যখন প্রেসক্লাবের কাছাকাছি তখন তার পাশের একজন যাত্রী তাড়াহুড়া করে নেমে গেল। মোবারক দেখে সিটের উপর একটা নীল আর শাদা রঙের মিশেল দেয়া পশমি টুপি। মোবারক চট করে জায়গা বদল করে পাশের সিটে চলে এল। টুপির উপর খানিকক্ষণ বসে থাকা অত্যন্ত জরুরি। টুপির মালিক ফিরে আসতে পারে। যদি ফিরে আসে তাহলে সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বলতে হবে— আরে এইতো আপনার টুপি! জিনিস পত্র সাবধানে রাখবেন না?