ম্যানেজার সাহেব ঢুকলেন। হাতে একটা কাগজ। কাগজে ডাক্তার সাহেবের ঠিকানা লেখা। ম্যানেজার সাহেব পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ডাক্তার সাহেবকে সব জানানো আছে। আপনি উনার কাছে কার্ডটা শুধু দেবেন। নিন কার্ডটা রাখুন। হারাবেন না।
মোবারক বলল, জ্বি আচ্ছা।
ম্যানেজার সাহেব গলা নিচু করে বললেন, আপনাকে একটা ভাল পরামর্শ দেই। কিডনীর দাম নিয়ে দরাদরিতে যাবেন না। এটা স্যারের হাতে ছেড়ে দিলে আপনার লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না। বুঝতে পারছেন?
জ্বি পারছি।
স্যার যদি আপনার উপর খুশি হন, তাহলে বাকি জীবনের জন্যে আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন। কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট কোথায় হবে জানেন?
জ্বি-না।
সুইজারল্যান্ড। বিনা খরচায় সুইজারল্যান্ড দেখে চলে আসবেন।
পাসপোর্ট কি করিয়ে ফেলব?
আগে সব ঠিকঠাক হোক।
মোবারক বলল, আমার উপর একটু দোয়া রাখবেন ভাই সাহেব। যেন বাণিজ্যটা হয়।
ম্যানেজার সরু চোখে তাকান। মোবারকের বাণিজ্য কথাটা তার মনে হয় পছন্দ হল না।
মোবারক বলল, স্যার উঠি? বলতে বলতেই চাদর হাতে সহজ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। সিগারেটের প্যাকেট আগেই পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে। ম্যানেজার সাহেব কিছু বললেন না। চাদর নিয়ে লোকটা চলে যাচ্ছে এটা মনে হয় তার চোখে পড়ছে না।
হাঁটতে হবে স্বাভাবিক ভাবে। গল্পগুজবে ম্যানেজার সাহেবকে ভুলিয়ে রাখতে হবে। মোবারক বলল, আয়না কোথায় ম্যানেজার সাহেব।
জগলু ভুরু কুঁচকে বলল, আয়না কোথায় মানে কি?
আয়না নামের মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
আয়না নামে কেউ এ বাড়িতে নেই।
অবশ্যই আছে। আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। কেজি ওয়ানে পড়ে।
ম্যানেজার বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছে। তাকিয়ে থাকুক। মোবারক এগুচেচ্ছ। আর একটু গেলেই মুক্তি।
শেষ বাধা গেট। গেটের দারোয়ান কিছু জিজ্ঞেস না করলেই হয়। মনে হয় জিজ্ঞেস করবে না। দারোয়ান দুই জনেরই বয়স অল্প। অল্প বয়েসী দারোয়ানরা সন্দেহপ্রবণ হয় না। বুড়োগুলি হয়।
মোবারক কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই গেট পার হল। এখন কেউ গেট খুলে বের হয়ে আসবে এবং তার কাছে ছুটে এসে বলবে, আমার কাশ্মিরী শাল নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। কার্তিক মাসের শুরু, বাতাসে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব থাকলেও শাল গায়ে দেয়ার মত না। তাতে কী? মোবারক শাল গায়ে দিয়ে ফেলল। চৈত্র মাসেও কমপ্লিট স্যুট পরা লোক দেখা গেলে সেও শাল গায়ে দিতে পারে। জিনিসটা খুব তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দিতে হবে। বিক্রির আগে কিছুদিন ব্যবহার করা। অনেকটা ধোপর মত। ধোপার দোকানে শাড়ি ধুতে পাঠালে, ধোপার বউ সেই শাড়ি এক দুবেলা পরে। ধোপর বাড়িতে শাড়ি গেছে, ধোপার বউ সেই শাড়ি পরেনি এমন কখনো হয়
মাফলার পরার মত শীত পড়েনি
মাফলার পরার মত শীত পড়েনি, কিন্তু মোবারকের গলায় মাফলার। মাথায় পশমি টুপি। গায়ে উলের চাদর। পশমি টুপি এবং চাদরের কারণে তার চেহারা বদলে গেছে। আয়নায় সে তার নতুন চেহারা দেখেনি, না দেখলেও চেহারা যে বদলেছে এটা নিশ্চিত। চায়ের দোকানের মালিক কুদ্দুস মিয়া কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, কেডা মোবারক না?
মোবারক জবাব না দিয়ে হাই তুলল। পোশাক মানুষের আচার আচরণও বদলে দেয়। টুপি এবং উলের চাদর গায়ে দেয়ার পর থেকে মোবারকের অন্য রকম লাগছে। খাতির জমানো টাইপ কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। কুদ্দুস মিয়া তার বন্ধুস্থানীয় মানুষ। সে একটা প্রশ্ন করবে আর মোবারক জবাব দেবে না— এ রকম আগে কখনো হয়নি।
চা খাইবা মোবারক?
মোবারক এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। চায়ের স্টলে ঢুকলে। চায়ের স্টলের
কোনো নাম থাকে না, এর নাম আছে— মদিনা রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টের নামের সঙ্গে মিল রেখেই বোধ হয় কুদ্দুসের লেবাসেও ইসলামী ভাব আছে। পায়ের গোড়ালি স্পর্শ করে এ রকম তিনটা পাঞ্জাবী তার আছে। তার মুখ ভর্তি চাপ দাড়ি। মাথায় সব সময় কিস্তি টুপি। তার পাশ দিয়ে হাঁটলে আতরের গন্ধ পাওয়া যায়। তবে তার এই পোশাকের সঙ্গে ধর্মকর্মের সম্পর্ক নাই। নবীজী তাকে স্বপ্নে এ ধরনের পোষাক পরতে বলেছেন বলেই সে পরে। এর বেশি কিছু না। নবীজীর কথা শুনে এ ধরনের পোশাকে পরা শুরু করার পর থেকে নাকি তার ব্যবসার সুবিধা হয়েছে। তবে চা বিক্রি ছাড়াও তার অন্য ব্যবসা আছে। সেই ব্যবসা নবীজীর পছন্দ হবার কোন কারণ নেই।
মোবারকের মেজাজ সামান্য খারাপ। সে যে চেয়ারে বসে সেখানে একজন কাস্টমার বসে আছে। কাস্টমার যেভাবে চা খাচ্ছে তাতে মনে হয় চা শেষ করতে ঘণ্টাখানিক সময় লাগাবে। আরে ব্যাটা পিরিচে ঢেলে লম্বা টান দে। এক টানে ঝামেলা শেষ। তুই বিড়াল নাকি? বিড়ালের মত চুকচুক করে চা খাচ্ছিস। এক কাপ চা খেতে যদি এক ঘণ্টা লাগিয়ে দিস অন্য কাজ কখন করবি?
অত্যন্ত বিরক্ত মুখে মোবারক কাস্টমারের সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, ব্রাদার একটু সরে পাশের চেয়ারে বসেন।
কাস্টমার চায়ের কাপ নামিয়ে শান্ত গলায় বলল, কেন?
এই চেয়ারটায় আমি বসব।
খালি চেয়ার তো আরো আছে সেখানে বসেন।
অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কথা। চায়ের দোকান প্রায় ফাঁকা। যে-কোনো জায়গায় বসা যায়। যে আরাম করে বসে চা খাচ্ছে তাকে সরিয়ে তার জায়গাতে বসতে হবে কেন? কাস্টমারের কথায় মোবারকের রাগ হবার কোনোই কারণ নেই। কিন্তু রাগ লাগছে। ইচ্ছা করছে হারামজাদাটার বিশেষ জায়গায় কোঁৎ করে একটা লাথি মারতে। দুটা বিচির যে কোনো একটায় লাগলেই খবর আছে। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে। মোবারক নিজেকে সামলালো। এইসব ঝামেলায় একা যাওয়া ঠিক না। একা মানে বোকা। সে উদাস ভাব নিয়ে কাস্টমারের পাশে বসল।