বাবু মানে পরিমল সাহা। মেসের মালিকের শালা। এবং মেসের ম্যানেজার। মোবারকের ছয়মাসের মেস ভাড়া বাকি। পরিমল বাবু তাকে দেখলে বাঘের মত ঝাপ দিয়ে পড়বেন। এই সুযোগ তাকে দেয়া ঠিক হবে না। মোবারক পেছন দরজা দিয়ে বের হল এবং তাকে যথা সময়ে সাবধান করে দেবার জন্যে মনু মিয়ার ঠাণ্ডা পানি বিষয়ক অপরাধ প্রায় ক্ষমা করে দিল।
অতি বিস্ময়কর ব্যাপার হল মোবারক দেখল ইন্টারেস্টেড পার্টিতে ঘর ভর্তি না। সে একা। যে ঘরে তাকে বসানো হয়েছে সেই ঘরও হলঘর না। ছোট ঘর। তবে বসার ঘর। সোফা আছে, মেঝেতে কার্পেট আছে, দেয়ালে পেইনটিং আছে। বড়লোকদের বসার ঘর একটা থাকে না। কয়েকটা থাকে। তাদের কাছে নানান ধরনের লোক আসে। সবাইকে এক জায়গায় বসানো হয়। না। অবস্থা বুঝে বসার ব্যবস্থা হয়।
ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে মোবারকের কথা হয়েছে। টেলিফোনে তাঁকে যেমন গম্ভীর এবং রাগী মনে হয়েছিল বাস্তবে তাঁকে মিনমিনেটাইপ মনে হল। চেহারা, চলাফেরা এবং কথাবার্তায় লজ্জিত ভঙ্গি। একটু তোতলামী আছে। মনে হয় টেলিফোন হাতে পেলে উনি বদলে যান। বন্দুক হাতে পেলে মানুষ যেমন বদলে যায়, উনিও বোধহয় টেলিফোন হাতে পেলে বদলান। ম্যানেজার সাহেবের নাম জগলু। নাম বগলু হলে ভাল হত। লম্বা বলে তাঁর মধ্যে বগা বগা ভাব আছে। জগলু সাহেবের সঙ্গে মোবারকের কিছু কথা হল।
আপনি মোবারক সাহেব?
জ্বি স্যার।
আপনি কী করেন?
কিছু করি না।
একেবারেই কিছু করেন না তা কী করে হয়? আগে কী করতেন?
শিক্ষকতা করতাম।
কথাটা পুরোপুরি ভুল না। এনজিও-ওয়ালাদের এক স্কুলে মোবারক সর্বমোট এগারো দিন পড়িয়েছে। বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র। গোটা বিশেক থুড়থুড়ো বুড়ো-বুড়ি বই-খাতা নিয়ে বসা। তাদেরকে কিছুক্ষণ স্বরে অ, স্বরে আ করানো। বুড়োবুড়িরা যে শিক্ষার মহান আলোয় আলোকিত হতে এসেছে তাও না। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুবাদে তাদের নাম রেজিস্ট্রি হয়েছে। সবাই একটা করে ছাতা পেয়েছে। ছাতায় এনজিওর নাম। ছাতা ছাড়া মাঝে মধ্যে টুকটাক উপহারের ব্যবস্থা আছে। অক্ষরজ্ঞান শেষ হলে সবাই শাড়ি লুঙ্গি পাবে এরকম গুজব শোনা যাচ্ছে। এগারো দিন পড়ানোর পর মোবারক ঈ পর্যন্ত আগালো। কিন্তু দেখা গেল ছাত্রছাত্রীরা শুরুর স্বরে অ ভুলে গেছে। মোবারক এগারো দিনের দিন এনজিও-ওয়ালাদের তিনটা ছাতা নিয়ে সড়ে পড়লো। কাজেই সে শিক্ষকতা করেছে এটা বলা ভুল হয় নি। যে একদিন পড়িয়েছে সে শিক্ষক। সারা জীবনই শিক্ষক। আবার যে একদিন চুরি করেছে সে কিন্তু সারাজীবনই চোর না। তাহলে পৃথিবীর সব মানুষই চোর হত।
আপনি তাহলে শিক্ষকতা করতেন?
জ্বি স্যার।
এখন কিছু করেন না?
করলে কি কিডনী বিক্রি করতে আসতাম?
তা ঠিক। আপনি বসুন। চা-টা খান। স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। সামান্য দেরি হবে।
কিডনী কার জন্যে দরকার?
স্যারের জন্যে। উনার দুটা কিডনী নন ফাংশানাল হয়ে গেছে। ডায়ালাইসিস করে করে এতদিন চলেছে, এখন ডাক্তাররা কিডনী ট্রান্সপ্লান্টের কথা বলছেন। আত্মীয়-স্বজনরা অনেকেই ডোনেট করতে রাজি। কিন্তু স্যার তা চান না।
মোবারক হাসি মুখে বলল, আমরা থাকতে আত্মীয়-স্বজনরা কেন কষ্ট করবে? আমরা আছি কী জন্যে?
ম্যানেজার সাহেব কিছুক্ষণ সরু চোখে তাকিয়ে থেকে আগের মত মিনমিনে গলায় বললেন, আপনি অপেক্ষা করুন। আমি যথাসময়ে ডেকে নিয়ে যাব।
মোবারক বিনীত গলায় বলল, জ্বি আচ্ছা স্যার। একটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করি, এই ঘরে কি সিগারেট খাওয়া যায়?
হ্যাঁ খাওয়া যায়। ঐ যে এসট্রে।
স্যার অনেক ধন্যবাদ।
মোবারক সিগারেট ধরালো। বড় সাহেবের কাছে যাবার আগে হাত-মুখ ধুতে হবে। মুখ কুলকুচা করতে হবে। অসুস্থ মানুষরা দূর থেকে সিগারেটের গন্ধ পায়। তাদের মেজাজ খারাপ হয়। বড় সাহেবের মেজাজ খারাপ করা একেবারেই ঠিক হবে না।
মোবারক যে চেয়ারে বসেছে তার দুটা চেয়ারের পরের চেয়ারেই সুন্দর একটা উলের চাদর পড়ে আছে। চাদরের ওপর মারলবোরো সিগারেটের একটা প্যাকেট। মনে হছে তার মত কেউ একজন এখানে বসেছিল। সে-ও কিডনী বেচতে এসেছে। বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছে। তবে যে এমন দামি চাদর গায়ে দেয় এবং মারলবোরো সিগারেট খায় সে কিডনী বেচবে কেন? তার উচিত দুএকটা কিডনী কিনে ফ্রীজে রেখে দেয়া। প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। প্রয়োজন না হলে কালোবাজারে বেচে দেবে।
ব্যস্ত ভঙ্গিতে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। রাজপুত্র রাজপুত্র চেহারা। হাতে তলোয়ারের বদলে লম্বা স্কেল। কমপ্লিট স্যুট পরা। গলায় লাল টাই। জুতাজোড়াও সম্ভবত নতুন হাটলেই মুড়ি খাওয়ার মত মচমচ শব্দ হচ্ছে। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই মোবারককে বললেন, আচ্ছা আনিস সাহেব কি চলে গেছেন?
মোবারক বিনীত ভঙ্গিতে বলল, জ্বি স্যার চলে গেলেন।
যদিও আনিস সাহেব কে মোবারক কিছুই জানে না। এ বাড়ির একজনকেই সে চেনে। ম্যানেজার জগলু।
কখন গেছেন বলতে পারেন?
এগজাক্ট টাইম বলতে পারব না। দশ এগারো মিনিট হবে। কমও হতে পারে।
আনিস সাহেবের সঙ্গে কি কোনো ফাইলপত্র ছিল?
স্যার আমি লক্ষ করিনি।
আপনার অবশ্য লক্ষ করার কথাও না। থ্যাংকস এনিওয়ে।
ভদ্রলোক যেমন ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঢুকেছিলেন তারচেয়েও ব্যস্ততার সঙ্গে চলে গেলেন। মিথ্যা কথাগুলি বলার জন্যে মোবারক তেমন দুশ্চিন্তা করছে না। এই নিয়ে পরে যদি প্রশ্ন করা হয় সে বলবে, সে আসলে বুঝতে পারে নি। সে ভেবেছে ভদ্রলোক ম্যানেজার সাহেবের কথা জানতে চেয়েছেন। ম্যানেজার জগলু সাহেব এই ঘরে কিছুক্ষণ ছিলেন, তারপর চলে গেছেন। এই অংশতো মিথ্যা না। পুরোপুরি সত্যি কথা বলা ঠিকও না। সোনার মধ্যে যেমন খাদ মিশাতে হয়। সত্যি কথার মধ্যেও সামান্য মিথ্যা মিশাতে হয়।