মোবারক দড়ির খুঁজে দাদিজানের ঘরে ঢুকল। যে-কোনো জিনিস দাদিজানের খাটে থাকবেই। তাঁর রেলিং দেয়া খাট ভর্তি নানা ধরনের, নানান সাইজের টিন, বাক্স, পেটরা। কোনোটায় চিড়া, কোনোটায় মুড়ি। কোনোটায় আমসত্ব। এই মহিলার সব কিছু হাতের কাছে থাকা চাই।
দাদিজান তোমার কাছে দড়ি আছে। চিকন দড়ি?
আছে। কী করবি?
কাজ আছে— দড়ি দাওতো।
তুই ব আমার কাছে। তোর শইল্যের গন্ধ বিস্মরণ হইছিলাম। অখন গন্ধ পাইতেছি।
গন্ধটা কেমন?
ভাল গন্ধ। তুই থাকবি কয় দিন?
কয়দিন মানে? দুপুরে ভাত খেয়েই রওনা।
কস কী তুই?
উপায় নাই। বিদেশ যাব। কাজ কর্ম বাকি আছে। তুমি কোনো চিন্তা করবা না। দেশে ফিরেই গ্রামে চলে আসব। বন্ধু দুজনকে সাথে নিয়ে আসব। আর শোন সরুফার বিয়ের ব্যাপারে যা বলেছ— সেটা ফাইন্যাল।
বৃদ্ধা হাসছেন। হাসতে হাসতে বললেন, মেয়ে পছন্দ হয়েছে?
মোবারক বলল, খুব বেশি না। মোটামুটি হয়েছে। মেয়ের লজ্জা বেশি। তার উপর বুদ্ধি সামান্য কম আছে। সহজ একটা শিল্পক দিয়েছি ভাঙ্গাতে পারে নাই। যাই হোক এইসব কথা তাকে বলে লাভ নাই। বেচারী মনে কষ্ট পাবে। বাচ্চা মেয়ে মনে কষ্ট দিয়ে লাভ কী?
বৃদ্ধা শব্দ করে হেসে ফেললেন। মোবারক বিষ্মিত হয়ে বলল, হাস কেন?
বৃদ্ধা বললেন, মেয়েটারে তোর খুব বেশি পছন্দ হইছে এইজন্যে হাসতেছি। মনের খুশিতে হাসতেছি। কি আমি ভুল কইছি?
মোবারক জবাব দিল না। বৃদ্ধা ঘোরলাগা গলায় বললেন, আমার অনেক দিনের ইচ্ছা তোর বিবাহ দিব। তুই নয়া বউরে নিয়া রুপার পালঙ্কে বাসর করবি।
মোবারক অবাক হয়ে বলল, রুপার পালঙ্ক পাব কোথায়?
এই পালঙ্কইতো রুপার পালঙ্ক। তোর দাদাজান আর আমি যে পালঙ্কে জীবন শুরু করছি। যে পালংকে তোর বাবা তোর মারে নিয়া প্রথম ঘুমাইতে গেছে সেই পালঙ্ক রুপার পালঙ্ক না?
একটু আগে বৃদ্ধা হাসছিলেন। এখন কাঁদছেন। মোবারকের চোখেও পানি এসে গেল। পানিতে ঝাপসা চোখে পালঙ্ক দেখছে বলেই হয়ত তার মনে হল পালঙ্কটা ঝকমক করছে। আসলেই যেন এটা রুপার পালঙ্ক।
ঢাকায় পৌঁছতে পৌঁছতে মোবারকের রাত
ঢাকায় পৌঁছতে পৌঁছতে মোবারকের রাত দশটা বেজে গেল। সে বলে গিয়েছিল রাতে ফিরবে। রাত দশটাও রাত, দুটাও রাত। কাজেই এক্ষুনী যে বড় সাহেবের রাজপ্রাসাদে বন্দি হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। রাত দুটার দিকে গেলেই হবে। গেটে দারোয়ান থাকে। দারোয়ান নিশ্চয়ই গেট খুলে দিবে। এবং সে নিশ্চয়ই কৈফিয়ত তলব করবে না, গলার রগ ফুলিয়ে বলবে না— এত রাত হল কেন? যদি জিজ্ঞেস করেও বললেই হবে রাজেন্দ্রপুরের কাছে বাস এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। সে অল্পের জন্যে বেঁচেছে। একজন মারা গেছে, কয়েকজনের অবস্থা ক্রিটিক্যাল। সে নিজেও বুকে ব্যথা পেয়েছে। হাসপাতাল থেকে এক্সরে করিয়ে তারপর এসেছে। দেরী হবার এই কারণ। তবে জিজ্ঞেস করবে বলে মনে হয় না।
মোবারক কুদুসের চায়ের দোকানে চলে গেল। আজ একটু শীত পড়েছে। বড় সাহেবের বাড়ি থেকে আনা চাদরটা থাকলে ভাল হত। চাদরটা জহিরকে দিয়েছিল। জহির নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে ব্যবস্থা করে ফেলেছে বিক্রি করে দিয়েছে।
জহিরের একটা খোঁজ নেয়া অত্যন্ত জরুরি। রক্তবমি বন্ধ হয়েছেতো বটেই। পাতলা পায়খানা অনেকদিন থাকে। রক্তবমির মত জটিল ব্যাধি অল্প সময় থাকে। জহিরের শরীর যদি ভাল থাকে আর বজলুকে যদি পাওয়া যায়— তিনজনের আসর বসাতে হবে। সে কিছু খাবে না। সে শুধু দেখবে। আসরে উপস্থিত থাকার আনন্দও কম না। বন্ধুদের কাছ থেকে সে অনেক কিছু গোপন করেছে— কিডনি বিক্রির ব্যাপারটা গোপন করা উচিত হয় নি। খুবই অন্যায়। হয়েছে। ওদেরকে বুঝিয়ে বলতে হবে।
সরুফার ব্যাপারটাও বলতে হবে। একটু অন্যভাবে বলতে হবে। দাদিজানের শেষ ইচ্ছা। কী আর করি। দাদিজানের কথা ফেলি কী করে? বাবা মা মারা গিয়েছিলেন আমি যখন কোলের শিশু। দাদিজানই আমাকে বড় করেছেন। দাদিজান সেই কারণে একই সঙ্গে আমার দাদি, আমার মা এবং আমার বাবা। একের ভেতর তিন। উনার শেষ ইচ্ছা অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। কাজেই বাধ্য হয়ে স্বীকার করেছি। মেয়ের চেহারা ছবি মোটামুটি। বুদ্ধির সামান্য শর্ট। কী আর করা…। ইত্যাদি…।
চায়ের দোকানে বজলু বা জহির কেউ নেই। ছোট রফিক আছে। সে বসে আছে মোবারকের চেয়ারে। তার সামনে এক কাপ চা। কিন্তু সে চা খাচ্ছে না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে কারো জন্যে অপেক্ষা করছে। সে রাস্তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মোবারক চায়ের দোকানে ঢোকার পর সে কঠিন দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মোবারকের দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
মোবারককে দেখেই কুদ্দুস বলল, তুমি ছিলা কই? বজলু আধা পাগল হইয়া তোমারে খুঁজতেছে।
মোবারক বলল, কেন?
জহিরের খবর কিছু জান না? রক্তবমি করতেছে। চাইর ব্যাগ রক্ত দেওয়া হইছে। কোনো লাভ হয় নাই। এই যাত্রা বাঁচব বইল্যা মনে হয় না। আমি দেখতে গেছিলাম। আমারে চিনে নাই।
সে আছে কোথায়?
মেডিকেলে। দুই নম্বর ওয়ার্ড।
মোবারক জহিরের বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মোবারকের পাশে বজলু। বজলু ফিসফিস করে বলল, তোকে দেখে খুবই সাহস পাচ্ছি। মনটা ভেঙে গিয়েছিল বুঝলি। আজ সারাদিন ছয় কাপ চা ছাড়া কিছু খাইনি। তুই ছিলি কোথায়?
মোবারক জবাব দিল না। সে একদৃষ্টিতে জহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। জহিরকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে মানুষ না, মর্গের কোনো মৃতদেহ।