সুন্দর তুমি কীভাবে দেখলে? হাত বুলিয়ে।
আমার হাত মাইনষের চউখের চেয়ে ভাল। চউখ আন্ধাইরে দেখতে পারে না। আমার হাত পারে। খালি রঙ টা বুঝে না। ফর্সা না শ্যামলা টের পায় না।
প্র্যাকটিস করেল এইটাও হয়ত পারবে। প্র্যাকটিসে সব হয়।
তুই আসল কথা ঘুরাইতেছস। মেয়েটারে বিবাহ করবি?
মোবারক তাকিয়ে রইল। বৃদ্ধা গলা নামিয়ে বললেন, তোর নয়া শালটা আমারে যেমনে প্যাচাইয়া ধইরা আছে— সরুফা সারাজীবন তোরে ঠিক এইরকম প্যাচাইয়া ধইরা রাখব। মেয়েটারে আমি কথা দিছি তোর সাথে বিবাহ দিব।
কথাও দিয়ে ফেলছ?
হ কথা দিছি। কোনো শান্তি তুই আমারে দেস নাই। মরণের আগে এই। শান্তিটা দে।
মোবারক উদাস গলায় বলল, আচ্ছা যাও কবুল। মেয়েটা নিতান্তই শিশু, যাই হোক তোমার কথা রক্ষা। আমার দুই বন্ধু সঙ্গে থাকলে আজই যন্ত্রণা শেষ করে ফেলতাম।
খবর দিয়া তারারে আন।
মোবারক বলল, এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? কথাতো দিলাম আর কী? মরদকা বাত, হাতীকা দাঁত। এখন হাতটা ছাড়, বাইরে থেকে একটা সিগারেট খেয়ে আসি।
সিগারেট আমার সামনেই খা। আমি তো আর চউক্ষে দেখি না। কী খাস না খাস দেখব না। অসুবিধা কী?
অসুবিধা আছে।
মোবারক উঠানে এসে সিগারেট ধরাল। পরিষ্কার ঝক ঝক করছে উঠান। এককোণায় আবার কয়েকটা গাদা ফুলের গাছ। হলুদ ফুলে গাছ ভর্তি হয়ে আছে। নিশ্চয়ই সরুফা মেয়েটার কাণ্ড। ফুলের প্রতি মেয়েটার টান আছে। এটা ভাল। FRUITS AND FLOWERS এর মালিকের স্ত্রী যদি ফুল ভাল না বাসে তাহলে হবে কীভাবে? তবে মেয়েটা বড়ই লাজুক। লজ্জা দূর করতে হবে। আড়াল কন্যা হলে চলবে না। আর বাচ্চা মেয়ে মাথায় ঘোমটা কেন? ঘোমটা ফেলে বউ-মানুষরা।
সরুফা চায়ের কাপ নিয়ে আসছে। মেঝের দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে আসছে যেন একটা স্প্রিং দেয়া কাঠের মুর্তী। স্প্রিং এ চাবি দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে— যন্ত্রের মত মূর্তি এগুচ্ছে। চাবি শেষ হবে মূর্তি থেমে যাবে।
চা হাতে দিয়েই সরুফা চলে যেতে ধরেছিল— মোবারক বলল, খুকি দাঁড়াও। চা কেমন হয়েছে খেয়ে দেখি। পুরস্কার, তিরস্কার না মারস্কার।
সরুফা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ নিজের পায়ের দিকে। মনে হচ্ছে সে অল্প অল্প কাঁপছে। মোবারকের মনটা খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা তাকে ভয় পাচ্ছে না-কি? আশ্চর্য তাকে পিঁপড়াও ভয় পায় না, এই মেয়েটা ভয় পাবে কেন।
মোবারক বলল, চা ভাল হয়েছে। খুবই ভাল। পুরস্কার টাইপ ভাল।
মেয়েটা এই কথায় খুশি হয়েছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। মাথা নিচু করে আছে বলে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। দুএকটা কথা মেয়েটার সঙ্গে বলতে ইচ্ছা করছে। মজাদার কথা। মজাদার কথা সে ভালই জানে, তবে মেয়েরা কোন কথায় মজা পায় তা জানে না। বিল্লি মে কাট দিয়া গল্পটা কি করবে? মজাদার গল্প। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার কথা। না-কি কোনো ধাঁধা জিজ্ঞেস করবে। ছোট মেয়েরা ধাঁধা পছন্দ করে। একে বলে শিল্লুক ভাঙানি। শিল্পক ভাঙানির ক্ষমতা থেকে বুদ্ধির আঁচও পাওয়া যায়। মোবারক কঠিন কোনো ধাঁধা মনে করার চেষ্টা করছে। কিছুতেই মনে পড়ছে না। ব্যাপারগুলি এ রকম যখন যেটা মনে পড়ার দরকার সেটা মনে পড়ে না। যখন প্রয়োজন নেই তখন মনে পড়ে।
সরুফা চলে যেতে ধরতেই মোবারক বলল, আচ্ছা দেখি তোমার বুদ্ধি কেমন। একটা শিল্লুক দেই ভাঙ্গাও দেখি— বল কোন ফুল মানুষ সব সময় নাকের কাছে রাখে কিন্তু কোনো গন্ধ পায় না। চিন্তা ভাবনা করে বল। ফুলটা ছোট। নানান রঙের হয়— কোনোটা শাদা, কোনোটা হলুদ, কোনোটা লাল। নাকের কাছে রাখলেও কোনো গন্ধ নাই।
সরুফা বিড়বিড় করে বলল, বলতে পারতেছি না।
মেয়েটার মুখ কেমন হয়ে গেছে। উত্তর না দিতে পারার কষ্টে সে যেন মরে যাচ্ছে।
মোবারকের মায়া লাগছে। শিল্পকটা কঠিন হয়ে গেছে। এমন কঠিন শিল্লুক মেয়েটার পারার কথা না।
মোবারক বলল, এই ফুলটি হল নাক ফুল। তোমার নাকেওতো এখন একটা আছে। বল এই ফুলের গন্ধ আছে?
জ্বি না।
আচ্ছা এইটা বলদেখি–
ঘর আছে দরজা নাই
মানুষ আছে কথা নাই।
সরুফা বলল, কব্বর।
হয়েছে। তোমারতো ভাল বুদ্ধি। এখন যাও আরেক কাপ চা বানিয়ে আন। চিনি বেশি করে দেবে। আমি চিনি বেশি খাই। রান্না বান্নার জন্যে ব্যস্ত হয়ো না। আমার কাছে খাওয়া দাওয়াটা কোনো বড় ব্যাপার না। খুব যদি ক্ষিধা লাগে তাহলে নিজের একটা পা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলব।
সরুফা অবাক হয়ে তাকাচ্ছে।
মোবারক বলল, মাকড়সা কী করে জান? মাকড়াসার যখন খুব ক্ষিধে লাগে তখন সে নিজের পা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে। তাতে কোনো অসুবিধা হয়। টিকটিকির খসে পড়া লেজ যেমন গজায়, মাকড়সারও তেমন পা গজায়।
এইসব কী কন?
সত্যি কথা বলছি। সবই বিজ্ঞানের কথা।
আমার বিশ্বাস হইতেছে না।
বিশ্বাস না হবারই কথা। চোখের সামনে কত মাকড়সা ঘুরঘুর করে। কিন্তু আমরা কি জানি এরা ক্ষিধার সময় নিজের পা ছিঁড়ে খায়। এই জাতীয় আরো অদ্ভুত অনেক কথা আছে। তোমাকে ধীরে স্থীরে বলব।
সরুফা দাঁড়িয়ে আছে, যাচ্ছে না। বেচারীর বোধহয় এ রকম গল্প আরো শুনতে ইচ্ছা করছে। মোবারক দড়ি কাটার একটা ম্যাজিক জানে। দড়ি কেটে জোড়া দিয়ে দেয়া। ফুটপাতে দন্তরোগ-যম মাজন বিক্রি করে এক লোক নানান রকম ম্যাজিক দেখায়। তার মধ্যে সবচে বিস্ময়কর ম্যাজিকটা হল দড়ি কেটে জোড়া দেয়া। মোবারক এই ম্যাজিক দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিল যে ম্যাজিসিয়ানকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ম্যাজিকের কৌশল শিখে নিয়েছিল। ম্যাজিকটা ভাল হলেও কৌশলটা খুবই সহজ। মুল দড়ি কাটা হয় না। দুই ইঞ্চি লম্বা ছোট্ট একটা দড়ির টুকরা কাটা হয়। সেই টুকরাটা লুকানো থাকে হাতের তালুতে। দড়ির ম্যাজিকটা সরুফাঁকে দেখানো যেতে পারে। গ্রামের মেয়ে ভাল জিনিসতো কিছুই দেখে না। খুশি হবে। মেয়েটাকে সঙ্গে করে সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যেতে পারলে হত। বরফ টরফ দেখে খুশি হত। অন্যের খুশি দেখার মধ্যেও আনন্দ আছে।