মানুষটা লজ্জা পেয়ে নিচু করে বলল, খড়ম খুঁজতে আসছি।
যা কইলাম। না গেলে খড়ম দিয়া তোর মাথাত বাড়ি।
সবার সে-কী হাসি। সবচে বেশি হেসেছেন আকলিমার শাশুড়ি। আহা কী হাসিই না তিনি হাসতে পারেন। সারাক্ষণ কারণে এবং অকারণে হাসছেন। তাঁর মৃত্যুর সময়ও তার মুখে চাপা হাসি দেখা গেল। তিনি আকলিমা বেগমকে কাছে ডেকে ফিস ফিস করে বললেন, তোমার শ্বশুর সাহেবের আইজ খবর আছে। সে হুরপরী নিয়া খুব নাচানাচি করতাছে। আমি উপস্থিত হইয়া এমন ঝাটাপিটা করব। হি হি হি।
পুরনো দিনগুলি বারবার ফিরে ফিরে আসে কেন? আজ কেন নিজেকে বউ বউ লাগছে? মোবারক যে গরম শালটা গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে সেই শালটা থেকে কেন অনেক অনেক দিন আগে তার গায়ে যে চাদর তার শাশুড়ি জড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই চাদরের গন্ধ আসছে? কেন মনে হচ্ছে বাড়ি ভর্তি লোকজন। কেন মনে হচ্ছে তার মানুষটা একটু আগেই একবার খড়ম খুঁজে গিয়েছে, আবারো আসবে।
মোবারক বলল, কানতেছ কেনগো দাদিজান?
আকলিমা বেগম বললেন, কান্দি না রে। বয়স হইছে, অখন খালি খালি চউখ দিয়া পানি পড়ে।
শালটা তোমার মনে ধরছে দাদিজান?
আকলিমা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বললেন, মোবারক তুই একটা চটের বস্তা আমার শইল্যে দিয়া দে। হেই বস্তাও মনে ধরব।
তুমি খুশি হইছ দাদিজান?
আমি বেজার হইছি। খুবই বেজার হইছি। আয় কাছে আয় মুখটা দেখি।
চোখতো নাই মুখ কীভাবে দেখবা? হাত দিয়া দেখব। চউখ নাইতো কী হইছে। হাত আছে না?
মোবারক খাটে উঠে এল। আকলিমা বেগম মোবারকের চোখে মুখে হাত বুলাতে লাগলেন। মোবারকের চোখে পানি এসে গেল।
মোবারক! জ্বি।
আমারে ফালাইয়া থুইয়া তুই একলা একলা কই থাকস? কী করস? আমি যখন মরব তখন তোরে দেখতে ইচ্ছা করব না?
মোবারক উদাস গলায় বলল, এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গে থাকবা। ঢাকায় ঘর ভাড়া করব। বলতে পার ভাড়া করা হয়েছে।
ঢাকায় গিয়া থাকব ক্যামনে। এই খাট ছাড়া আমার ঘুম হয় না।
তোমার এই খাট নিয়া যাব। কোনো অসুবিধা নাই। এই খাটতো যাবেই— খাটের উপরে জিনিসপত্র যা আছে সব যাবে।
চাকরি পাইছস মোবারক?
না চাকরি পাই নাই। ব্যবসা করব সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
কিয়ের ব্যবসা?
ফুলের ব্যবসা।
তুই দেখি আগের মতই পাগলা আছস? ফুলের আবার ব্যবসা কী?
বিরাট এক দোকান দিতেছি— নাম হল FRUITS AND FLOWERS বাংলা হল, ফুল ও ফল। আমার দোকানে ফলও পাওয়া যাবে আঙ্গুর, বেদানা, নাসপাতি, আপেল, কলা, কমলা, আনারস, বানারস…
বানারসটা কী?
আছে বানারসও আছে। দেখতে আনারসের মত। সাইজে, ছোট।
আকলিমা বেগম মুগ্ধ হয়ে নাতির কথা শুনছেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আরো একজন মুগ্ধ হয়ে কথা শুনছে। তার নাম সরুফা। বাবা-মা মরা মেয়ে। আকলিমা বেগমের দেখাশোনা করে। এই বাড়িতেই থাকে। বয়স চৌদ্দ পনেরো। মেয়েটা অস্বাভাবিক ধরনের লাজুক। আজ তার লজ্জা আকাশ স্পর্শ করছে কারণ আকলিমা বেগম তাকে অসংখ্যবার বলেছেন তার এক নাতি আছে। নাম মোবারক। তিনি মৃত্যুর আগে অতি অবশ্যই মোবারকের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে যাবেন। সরুফাঁকে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে কখনো চিন্তা করতে হবে না।
মোবারক নামের মানুষটা চলে এসেছে। মানুষটাকে সে যত দেখছে ততই ভাল লাগছে। কী অদ্ভুত মানুষ, ঘরে ঢুকেই একটা চাদর দিয়ে দাদিকে পেঁচিয়ে ফেলল। কোনো কথা নাই। পা ছুঁয়ে সালাম নাই। তারপরই মানুষটা তার দিকে তাকিয়ে বলল— এই খুকি। তুমি দাদিজানের দেখাশোনা কর? শোন তুমি কি চা বানাতে পার। আমি চা পাতা নিয়ে এসেছি। চা বানাওতো। যদি চা ভাল হয় তাহলে পুরস্কার, ভাল না হলে তিরস্কার। আর যদি খুব খারাপ হয় তাহলে— মারস্কার। হা হা হা।
সরুফার তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এমন অসাধারণ একজন মানুষের সঙ্গে তার বিয়ে হবে! তার বাপ নেই, মা নেই। তাকে আত্মীয় স্বজনরা ঘরে জায়গা দেয় না। সে তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দিল অন্যের বাড়িতে। তারই কি-না এমন একটা ভাল ছেলের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে?
বাড়িতে মেহমান এসেছে। সরুফার হাতে কত কাজ। রান্নাবান্নার আয়োজন দেখতে হবে। মাছ আনতে হবে। মুরগির ব্যবস্থা করতে হবে। অথচ সে দরজার আড়াল থেকে নড়তেই পারছে না। মানুষটা দাদিজানের সঙ্গে যে সব কথা বলছে তার সবই শুনতে ইচ্ছা করছে।
ইচ্ছা করলেও উপায় নেই। এত দূর থেকে সব কথা কি আর শোনা যায়? আর শোনা গেলেও যে কথা বলছে তার মুখতো দেখা যাচ্ছে না। যে কথা বলছে তার মুখ না দেখলে মনে হয় কথাটা বুঝি পুরোপুরি শোনা হল না। কিছু বোধহয় বাদ রয়ে গেল।
বৃদ্ধা বললেন, সরুফা মেয়েটারে কেমন দেখলি?
মোবারক বলল, দেখলাম আর কোথায়? ওতো দরজার আড়ালে আড়ালে থাকে। ও হচ্ছে আড়াল-কন্যা। হা হা হা।
তুই এমন কথায় কথায় হাসতেছস ক্যান? তোর হইছেটা কী?
মোবারক বলল, অনেকদিন পর তোমাকে দেখে মন ভাল হয়ে গেছে। আমার অবস্থা হয়েছে তোমার শাশুড়ির মত। কারণ ছাড়াই হিহি-হাহা-হোহো।
বৃদ্ধা হাত বাড়িয়ে মোবারকের বা হাত ধরলেন। শক্ত করে ধরলেন। শাস্তি দেবার আগে দুষ্ট ছেলেকে মা যেভাবে খপ করে ধরেন সেই ভঙ্গিতে ধরা। ছেলে হাজার চেষ্টা করেও ছুটে যেতে পারবে না।
মোবারক শোন। সরুফারে তুই বিবাহ কর। সরুফা খুবই দুঃখী মেয়ে আর তুইও খুব দুঃখী। দুঃখে দুঃখে সুখ। আমার কোনো কথাইতো তুই রাখস না। এইটা রাখ। মেয়েটা কত সুন্দর এইটা ভাল কইরা দেখছস?