বজলু বলল, লে হালুয়া।
বুড়ো সবৃজি কাটা বন্ধ করে শক্ত হাতে বটি ধরে আছে। বুড়ি নির্বিকার। সে আগের মতই রান্না করে যাচ্ছে। একবার শুধু চোখ সরু করে দেখল।
জহির বলল, জায়গা ক্লিয়ার করে দাও। দশ মিনিট সময়। এর মধ্যে জায়গা পরিষ্কার না করলে অসুবিধা আছে।
পলিথিনের ঘর থেকে দুটা মেয়ে উঁকি দিচ্ছে। দুজনের বয়সই আঠারো উনিশ। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। চুলে লাল ফিতা বাঁধা। এরা সাজগোজ করছিল। সাজ এখনো শেষ হয় নি। চোখে কাজল দেয়া হচ্ছে।
মোবারক বুড়োর দিকে তাকিয়ে বললো— এই দুই কন্যা কে? তোমার নাতনী?
বুড়ো বলল, তা দিয়া আপনার কি দরকার।
দরকার আছে।
হ আমার নাতনী।
এরা কি ভাড়া খাটে?
বুড়ো কিছু বলল না। মেয়ে দুটার একটা আফ্রাদী গলায় বলল, ঝামেলা কইরেন না ভাইজান।
মোবারক বলল, কোনো ঝামেলা নাই। তোমরা তোমাদের মত বাণিজ্য করবে। কিন্তু জায়গা ছাড়তে হবে। এটা আমাদের জায়গা। দশ মিনিট সময়। আমরা এখানে নেশা করব।
এমন কোনো হাসির কথা না, কিন্তু মেয়ে দুটি খিলখিল করে হাসছে। দুজনই মনে হয় খুব মজা পাচ্ছে। মেয়ে দুটির একটি বলল, আপনেরার লিশা আপনেরা করেন। আমরা না করছি?
জায়গা ছাড়বে না?
জায়গা কি আমার যে ছাড়ব? জায়গা আল্লাহ পাকের। হেতো কিলিয়ার কইরাই ধুইছে। হি হি হি।
মোবারকের মনে হল মেয়েটাকে সুন্দর লাগছে তো। একটু আগেওতো সুন্দর লাগছে না। এখন লাগছে কেন? হি হি করে হাসছে বলেই কি সুন্দর লাগছে? হাসলে মানুষকে সুন্দর দেখায়। তবে সেই হাসি আসল হাসি হতে হবে। নকল হাসিতে মানুষকে ভয়ংকর দেখায়। তবে হাসি এমন জিনিস যে তার নকল হয় খুব কম।
বজলু হঠাৎ উদার গলায় বলল, এরা থাকুক এদের মত। আয় আমরা এক কোণায় বসে পড়ি। মোবারকের মনে হল বজলু তার মনের কথাটা বলেছে। সবাই থাকবে সবার মত ঝগড়া ফ্যাসাদের দরকার কি? মেয়ে দুটা ইচ্ছা করলে তাদের সঙ্গে বসতে পারে। ইচ্ছা করলে কাস্টমারের খুঁজে যেতে পারে।
জহির মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে বলল, এই তোদের নাম কি?
তুই তুকারি করেন ক্যান? ভাল মত জিগান নাম কমু।
তোমাদের নাম কি?
আমার নাম ছুইটি, এর নাম বিউটি।
নকল নাম?
হ নকল। আমরা মানুষও নকল আমরার নামও নকল আপনেরা কি লিশা করতে আইছেন?
হুঁ।
লিশা বড়ই খারাপ জিনিস গো লিশা কইরেন না।
চুপ থাক।
আইচ্ছা যান চুপ থাকলাম। চিল্লাইয়েন না।
ছাতিম গাছের অন্য দিকটায় তারা তিনজন বসল। মেয়ে দুটি বের হয়ে গেল খদ্দেরের খুঁজে। মেয়ে দুটি যাবার আগে জহির ধমকের গলায় বলল, খবর্দার কাস্টমার নিয়া এই দিকে আসবি না। আসলে বিপদ আছে। বিল্লি মে কাট দিবে।
ছুইটি অবাক হয়ে বলল, বিল্লি মে কাট দিবে কি গো?
জহির উদাস গলায় বলল, যখন কাট দিবে তখন বুঝবি কী। এখন বুঝবি atti
বিউটি বলল, আপনেরা ভদ্রলোকের ছেলে। আপনেরা তুই তুকারি করেন ক্যান।
বজলু বলল, আমরা ভদ্দরলোকের ছেলে তোদের কে বলল? আমরা বিল্লি কাট দিয়া মানুষ। আমাদেরকে বিল্লি কেটে দিয়েছে। বজলুর কথা শেষ হবার আগেই জহির এবং মোবারক হাসতে শুরু করল। বোতল খোলার আগেই তিনজন চলে যাচ্ছে ভাবের জগতে। আজকের ভাব হবে জটিল ভাব। রাতটা বড়ই আনন্দে কাটবে।
বুড়ো বুড়ির রান্না হয়ে গেছে। দুজনে গল্প করতে করতে খাওয়া দাওয়া করছে। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে তারা বড়ই আনন্দে আছে। মোবারকরা তেমন আনন্দে নেই। বজলু শীষ দিয়ে কি একটা গান বাজাচ্ছে। গানের সুর এতই করুণ যে চোখে পানি এসে যাচ্ছে।
দুটি মেয়ের একটি (ছুইটি) ফিরে এসে তিন বন্ধুর পাশে বসেছে। মনে হচ্ছে তিন বন্ধুকে দেখে মেয়েটা খুব মজা পাচ্ছে।
বজলু শীষ বাজানো বন্ধ করতেই মোবারক বলল, দোস্ত একটা কথা বলি। ইচ্ছা হলে জবাব দিবি ইচ্ছা হলে দিবি না। তুই কি ছোট রফিকের দলে ঢুকেছিস?
বজলু বলল, হুঁ।
কাজটা কি ঠিক হয়েছে?
ঠিক হয় নাই। কিন্তু উপায় কী? আমার বাঁচা লাগবে না?
মোবারক বলল, দোস্ত তুই ছোট রফিকের কথা ভুলে যা। আমি আমাদের তিনজনের জন্যে ব্যবস্থা করেছি।
বজলু কঠিন গলায় বলল, তুই হলি ছিছকা চোর। থিফ অফ ঢাকা। তুই কি ব্যবস্থা করবি? চোরের দল করবি? চোরের দলের লীডার হবি। আমি চুরির মধ্যে নাই। আমি ভদ্দরলোকের ছেলে। আমার বাবা ছিলেন স্কুল টিচার।
ছোট রফিকের সাথে থেকে তুইতো মানুষ খুন করবি।
হুঁ করব। যার কপালে খুন লেখা থাকবে সে খুন হবে। আমার কি করার আছে। আমার কিছু করার নাই।
কঠিন তর্কাতর্কিতে নেশা কেটে যায়। আজ কাটছে না। বরং আজ নেশা আরো চেপে আসছে।
জহির বলল, আমি পিশাব করতে যাচ্ছি তোরা কেউ যাবি আমার সাথে? কাটাকুটি খেলবি? সঙ্গে সঙ্গেই তিনজন উঠে দাঁড়াল। জহির বরল, বুড়ো বুড়ির পলিথিনের বাড়িতে পিশাব করলে কেমন হয়। আমাদের জায়গা দখল করে আছে শাস্তি হওয়া দরকার না?
বজলু বলল অবশ্যই শাস্তি হওয়া দরকার। ওদের গায়েই পেশাব করা দরকার। তা না করে আমরা ওদের রাজপ্রাসাদ ভিজিয়ে দেব।
ছুইটি বিড় বিড় করে বলল, লিশা কি খারাপ জিনিসগো। কি খারাপ জিনিস।
বৃদ্ধা আকলিমা বেগম
বৃদ্ধা আকলিমা বেগম রেলিং দেয়া খাটের মাঝখানে জুবথবু হয়ে বসে আছেন। তাঁর সাজানো জীবন-যাপন এই মুহূর্তে খানিকটা এলোমেলো, কারণ তাঁর গায়ে পাতলা ফিনফিনে একটা গরম চাদর জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নিজেকে তার বউ বউ মনে হচ্ছে। অনেক অনেক কাল আগে বউ সেজে তিনি এই খাটের মাঝখানে ঠিক এই ভাবেই বসেছিলেন। তখন ছিল পৌষ মাস। তিনি শীতে মাঝে মাঝে কাঁপছিলেন বলে তাঁর শাশুড়ি এসে তার গায়ে চাদর দিয়ে দিলেন। বাড়ি ভর্তি কত লোক, কত আনন্দ, কত উল্লাস। আকলিমা বেগমের তরুণ বর— হাসিখুশি এবং খানিকটা বোকাসোকা ধরনের মানুষটা কারণে অকারণে ঘরে ঢুকে পড়ছে এবং মায়ের বকা খাচ্ছে— তোর হইছেটা কী? মুরগির ছাও এর লাহান এইখানে ঘুরতাছ।