মোবারক ঘর থেকে বের হবার আগে আরেকবার বড় সাহেবের দিকে তাকালো। আশ্চর্য, বড় সাহেব তার দিকেই তাকিয়ে আছেন।
রাত এমন কিছু না
রাত এমন কিছু না। এগারোটাও বাজে নি। রাত শুরু হয় একটা থেকে। কাজেই রাত এখনো শুরুই হয় নি। বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলা হয়ে গেছে। তিনি নিশ্চয়ই রাত তিনটার সময় আবারো তার সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন না। তাঁর কাছে ছুটি নেয়া আছে। দাদিজানকে দেখতে যাবার ছুটি। কাজেই মোবারক এখন ঘর থেকে বের হতে পারে। দুই বন্ধুকে খুঁজে বের করতে পারে। তিন বন্ধু মিলে রাস্তায় খানিকক্ষণ হেঁটে ছাতিম গাছের নিচে বসতে পারে। জহিরকে টাকা দিলে সে ম্যাজিসিয়ানদের মত শূন্য থেকেও জিনিসপত্র জোগাড় করে ফেলতে পারে। পঁচিশ হাজার টাকার পুরোটা খরচ হয়নি এখনো কিছু আছে। কত আছে সে জানে না। গোনা হয় নি। টাকা গুনলে টাকা কমে। তার কথা না, তার দাদিজান আকলিমা বেগমের কথা। টাকা নিয়ে তার একটা শ্লোকও আছে। সেই টাকা অবশ্যি কাগজের টাকা না, রূপার টাকা। তাঁর সময়কার টাকা।
চার মাসের নাতিন আমার ষোল মাসের পেট
একশত তার উপপতি স্বামী হল এক।
ধাতুতেই জন্ম কিন্তু নাই তার মা
এই শিল্পকে ভাঙ্গাইয়া দিয়া, নাতিন নিয়া যা।
টাকার ধাঁধাটা বন্ধুদের জিজ্ঞেস করতে হবে। যে পারবে সে একশ টাকা পাবে। একশ না পাঁচশ। টাকার পরিমাণ না বাড়ালে মজা জমে না। আশ্চর্যের ব্যাপার যে কোনো জিনিস জমার জন্যে টাকা লাগে।
মোবারক বেরুবার জন্যে তৈরি হল। তৈরি হওয়া মানে দাদিজানের জন্যে কেনা শালটা বগলের নিচে নিয়ে নেয়া। বাড়ি থেকে বের হবার সময় ঝামেলা হবে কি-না বুঝতে পারছে না। দারোয়ান হয়ত বলে বসবে— রাত এগারোটার পর বের হতে হলে পাশ লাগবে। পাশ থাকলে বের হবেন। পাশ না থাকলে নাই। পাশ আছে?
কুকুর ছেড়ে দিয়েছে কি-না কে জানে। দুটা ভয়ংকর কুকুর এ বাড়িতে আছে। দূর থেকে সে দেখেছে। রাতে বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে কুকুর ছাড়া হয়। বড়লোকের বাড়ির কুকুর গায়ের গন্ধে বুঝে ফেলে কে বড়লোক কে গরীব লোক। তারপর ঝাঁপ দিয়ে গরীবের উপর পরে। পশুও গরীব ধনী চেনে।
কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই মোবারক গেট পার হল। দারোয়ান একটা কথাও জিজ্ঞেস করল না। কুকুর দুটাও ছাড়া ছিল। তারাও চোখ উঁচু করে তাকে দেখে চোখ নামিয়ে নিল। এরা কি টের পেয়ে গেছে যে মোবারক। সাধারণ কেউ না। সে হল Fruits and Flowers এর মালিক।
গেটের বাইরে এসে মোবারকের মনে পড়ল সে আসল জিনিস ফেলে গেছে। দুই বন্ধুর জন্যে দুটা স্যুয়েটার কিনেছিল, স্যুয়েটার সঙ্গে নেয়া হয় নি। থাক স্যুয়েটার। স্যুয়েটারের জন্যে ঢুকলে আর হয়ত বের হওয়া যাবে না।
আহ বড় আনন্দ লাগছে। শীষ দিয়ে গানের সুর তুলতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছা করলেও উপায় নেই। সে শীষ দিতে পারে না। পারে বজলু। শুধু যে পারে তা না অসম্ভব সুন্দর করে পারে। মনে হয় শীষ না যেন বাঁশি বাজছে। বজলুকে আজ ধরতে হবে। মুশকিল হচ্ছে হারামজাদার গায়ে চর্বি বেশি। তাকে কোনো অনুরোধ করলে চর্বির উপরও আরেক পরত চর্বি জমে যায়। জমলে জমবে আজ বজলুকে ধরতে হবে। অনেকদিন তার শীষ শোনা হয় না। বাচুপানকা দিন ভুলা না যা না গানটা বাজাতে বলতে হবে। তবে শুরুতে না। ভাবের জগতে উঠার পর। সাধারণ গান-বাজনা একরকম, ভাবের গানবাজনা অন্যরকম। ভাবের গান-বাজনায় মনটা উদাস হয় অনেক বেশি। বাচুপানকা দিন গানটা এম্নিতে শুনলে চোখে পানি আসবে না, কিন্তু ভাবের জগতে থাকার সময় শুনলে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়বে।
মোবারক কুদ্দুসের চায়ের দোকানের দিকে রওনা হল। তার মন বলছে দুজনকে সেখানেই পাওয়া যাবে। আর না পাওয়া গেলে মোবারক যে ভাবেই হোক খুঁজে বের করবে।
বজলু এবং জহিরকে চায়ের দোকানেই পাওয়া গেল। দুজনই আরাম করে মালাই চা খাচ্ছিল। মোবারককে দেখে উঠে দাঁড়াল। যেন তারা জানত এক্ষুণী মোবারক জিনিসপত্র নিয়ে উপস্থিত হবে।
জাহিরের বগলে একটা ক্রাচ। সে ক্রাচ নিয়ে যে ভাবে হাঁটছে তাতে মনে হচ্ছে তার জন্মই হয়েছে বগলে ক্রাচ নিয়ে। এবং এতে সে মোটেই দুঃখিত না, বরং আনন্দিত। সে চোখ ছোট করে বলল, জিনিসটা উপকারী। ধর মারামারি লেগে গেল— বগল থেকে ক্রাচ নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়লি। হা হা হা।
বজলু ভুরু কুঁচকে তাকাল। জহিরের রসিকতায় সে মজা পাচ্ছে না। তবে মোবারক মজা পাচ্ছে। জহিরের কথা তার মনে ধরেছে। সে কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে তারা তিন বন্ধু বগলে ক্রাচ নিয়ে ঘুরছে। কোনো একটা ঝামেলা বাধল বের হয়ে এল তিন অস্ত্র।
মোবারক বলল, তুই কি পুরোপুরি ল্যাংড়া হয়ে গেছিস?
জহির বলল, হ্যাঁ।
বলে দাঁত বের করে হাসল। পুরোপুরি ল্যাংড়া হওয়াতেও সে আনন্দিত। কিছু কিছু সময় মানুষের জীবনে আসে যখন সব কিছুতেই আনন্দ লাগে। ধাক্কা দিয়ে কেউ রাস্তায় ফেলে দিল, একটা দাঁত গেল ভেঙ্গে। তার মধ্যে আনন্দ। জহিরের এই সময় চলছে।
ছাতিম গাছের তলাটা বেদখল হয়ে আছে। এক বুড়োবুড়ি নীল পলিথিনের ছাউনি দিয়ে রাতারাতি সংসার পেতে বসেছে। ইটের চুলায় রান্না হচ্ছে। বুড়ি রান্না করছে। বুড়ো বটি পেতে কাটাকুটি করছে। রাত বাজে একটা। এই সময়ে কীসের রান্না কে জানে?
পলিথিনের নীল বাড়ির ভেতর থেকে গল্পগুজব এবং হাসাহাসির শব্দ আসছে। আনন্দময় সংসার যাত্রা।