বড় সাহেব বললেন, বিছানায় বোস। এই ঘরে ইচ্ছে করেই আমি সোফা বা চেয়ার রাখিনি। সোফা চেয়ার থাকলেই রোগী দেখতে এসে লোকজন বসে পড়ত। মানুষের স্বভাব হচ্ছে একবার বসলে সে উঠতে চায় না।
মোবারক বড় সাহেবের পায়ের কাছে খুব সাবধানে বসল। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে লোকটাকে তার পছন্দ হচ্ছে। এটা খুবই ভাল লক্ষণ যে লোকটার শরীরে তার শরীরের একটা অংশ থাকবে সেই লোকটা পছন্দের না হলেতো মুশকিল।
বড় সাহেব হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে একটা কমলা নিয়ে মোবারকের দিকে গড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, কমলা খাও।
কমলা মোবারকের খুবই অপছন্দের ফল। কিন্তু বড় সাহেব দিচ্ছেন না খাওয়াটা বিরাট বেয়াদবী। মোবারক কমলার খোসা ছড়াচ্ছে। তার প্রধান চিন্তা খোসাগুলি কোথায় ফেলবে? ময়লা ফেলার ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না। খোসা হাতে নিয়ে বসে থাকতে হবে না-কি।
মোবারক।
জ্বি স্যার।
বলতো দেখি একটা কমলার কয়টা কোয়া থাকে।
স্যার বলতে পারছি না।
বড় সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, দশটা কোয়া থাকে। তুমি গুনে দেখ।
মোবারক গুনে দেখল আসলেই দশটা কোয়া। কেউ একজন আগে ভাগে না গুণে বলে দিচ্ছে কমলার দশটা কোয়া এটা এমন কিছু ব্যাপার না। আগে গুণে দেখেছে। তবু মোবারক খুবই অবাক হয়েছে এমন ভঙ্গি করল।
বড় সাহেব গল্প বলার ভঙ্গিতে সহজ গলায় বললেন, আমার বাবা ছিলেন বাংলা বাজারে প্রুফ রিডার। হত-দরিদ্র মানুষ। আমরা ছিলাম তিন ভাই বোন। শীতের সময় বাবা মাঝে মধ্যে একটা কমলা নিয়ে ফিরতেন। কোয়া ভাগাভাগি করে তিন ভাই বোনকে দিতেন। একটা কোয়া সব সময় বেশি হত। সেই থেকেই আমি জানি কমলার দশটা কোয়া।
মোবারক বলল, বাড়তি কোয়াটা কে পেত স্যার?
আমার বোন পেত। পৃথিবীর সব বাবার মত আমার বাবাও তাঁর কন্যাকেই সবচে বেশি আদর করতেন। এই গল্পটা তোমাকে কেন বললাম তুমি জান?
জ্বি-না স্যার।
গল্পটা তোমাকে বললাম, কারণ আজ আমার টোটেল এ্যাসেট প্রায় ১০০ কোটি টাকা। পুরনো দিনের কথা আমার কখনোই মনে পড়ে না। কিন্তু কমলা দেখলেই মনে হয় এর ভেতর দশটা কোয়া।
আপনার বাবা কি আপনার এই অবস্থা দেখে গেছেন?
দেখে যান নি। তার জন্যে আমার খুব যে কষ্ট হয় তাও কিন্তু না। এই পথিবীতে সব মানুষই একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করতে আসে। বাবা এসেছিলেন হত দরিদ্র প্রুফ রিডারের চরিত্রে অভিনয় করতে। তিনি চমৎকার অভিনয় করে বিদায় নিয়েছেন।
স্যার আপনি খুবই সুন্দর করে কথা বলেন।
দ্যাটস ট্রু— আমি অবশ্যই খুব সুন্দর করে কথা বলি। সুন্দর করে কথা বলি বলেই মিথ্যা কথাগুলি সত্যির মত করে বলি। বাবার জন্যে আমার কষ্ট হয় না— এটা খুবই মিথ্যা কথা। উনার জন্যে ভয়ঙ্কর কষ্ট হয়। কমলাটা খাও মোবারক। হাতে নিয়ে বসে আছ কেন?
মোবারক কমলার একটা কোয়া মুখে দিল। তার হঠাৎ করে খুব মনটা খারাপ হয়েছে। সে যেন চোখের সামনে বড় সাহেবের দরিদ্র বাবাকে দেখতে পাচ্ছে। বেচারা কমলার কোয়া ভাগ করছে।
বড় সাহেব শান্ত গলায় বললেন, চোখটা মোছ মোবারক। আমার গল্প শুনে তোমার চোখে পানি এসেছে। আমি খুবই লজ্জা পাচ্ছি। আমি কোনো স্টোরি টেলার না। আমি রসকষহীন বিজনেস ম্যান। তোমারওতো বিজনেসম্যান হবার ইচ্ছা তাই না?
জ্বি।
কীসের বিজনেস করবে ভেবেছ কিছু?
জ্বি-না।
তুমি ভাব নি, কিন্তু আমি ভেবেছি। তুমি আধুনিক একটা ফলের দোকান দাও। বাংলাদেশের মানুষ এখন ফল খাওয়া শুরু করেছে। যেহেতু দেশে এখন ফ্রী ইকনমি, তুমি যে-কোনো দেশ থেকে ফল আমদানী করতে পার। তোমার ফলের দোকানে পৃথিবীর সব দেশের সব রকম ফল পাওয়া যাবে। স্ট্রবেরী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের লটকন। দোকানটার একটা অংশ থাকবে ফুলের জন্যে। টাটকা ফল এবং টাটকা ফুল বিক্রি হবে। একটা দাগ ধরা ফলও দোকানে থাকতে পারবে না। একটা বাসি ফুলও থাকতে পারবে না। পুরো দোকানটা হবে এয়ারকন্ডিশন্ড। তোমার দোকানের নামও আমি ঠিক করে রেখেছি।
FRUITS
AND
FLOWER
মোবারক ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার আমার কাছে স্বপ্নের মত লাগছে।
বড় সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, মানুষের ধারণা বিজনেসম্যানরা স্বপ্ন দেখতে পারেন না। স্বপ্ন দেখার অধিকার শুধু কবিদের, গল্পকারদের, চিত্রকরদের। খুব ভুল ধারণা। প্রতিটি সাকসেসফুল বিজনেসম্যান হচ্ছেন একজন ড্রিমার। এক অর্থে কবি সাহিত্যিকদের চেয়ে তারা বড় ড্রিমার। কবি সাহিত্যিকরা তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারেন না, একজন ব্যবসায়ী ড্রিমার পারেন। ব্যবসায়ীদের স্বপ্নগুলি খুব জাগতিক হয় এটাও অবশ্যি একটা কারণ।
বড় সাহেব হঠাৎ চুপ করে গেলেন। মনে হচ্ছে তাঁর কোনো শারিরীক অসুবিধা হচ্ছে। মোবারক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার আমি কি এখন যাব?
তিনি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
মোবারক বলল, আমার দাদিজান থাকেন নেত্রকোনায়, উনাকে একটু কি দেখে আসব?
অবশ্যই দেখে আসবে। আর শোন মোবারক তোমার শরীরের একটা অংশ আমি ব্যবহার করব। আমি ধরে নিচ্ছি এটা তোমার একটা উপহার। সেই কারণেই আমি FRUITS AND FLOWERS তুমি যাতে করতে পার সেই ব্যবস্থা করব। ভালমতই করব। আমার উপহারটাও খারাপ হবে না।
মোবারক বলল, স্যার দেখবেন আমরা তিনজন জান দিয়ে খাটব।
বড় সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, তোমরা তিনজন মানে!
আমার দুইজন খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে স্যার।
ভাল। একজন বন্ধু থাকাই ভাগ্যের কথা। তোমার আছে দুজন। তুমিতো ভাগ্যবান মানুষ। আচ্ছা তুমি এখন যাও— শরীরটা ভাল লাগছে না। কথা বলে আরাম পাচ্ছি না। আমি বিশ্রাম করব।