আমার নাম আয়না।
বাহ্ কী সুন্দর নাম আয়না। কোন ক্লাসে পড়?
কেজি ওয়ান।
আমার নাম মোবারক ঈদ মোবারকের মোবারক। খুকি এখন তুমি ম্যানেজার সাহেবকে ডেকে দাও।
আপনি টেলিফোন ধরে থাকুন। আমি ডাকছি।
মোবারক ধরে থাকল। খুবই কায়দার টেলিফোন। নানান রকম বাজনা বাজছে। একটা শেষ হয়তো আরেকটা শুরু হয়। ম্যানেজার চাচু এসে আর টেলিফোন ধরেন না। এক সময় ধরলেন এবং ম্যানেজার টাইপ লোকদের স্বভাব মত গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, কে?শব্দটা মওলানা সাহেবদের কাফ উচ্চারণের মত। নাভি থেকে আসছে।
মোবারক নরম স্বরে বলল, স্যার আমার নাম মোবারক হোসেন। পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেখে টেলিফোন করছি। বিজ্ঞাপনটা গতকালের দুটা দৈনিক পত্রিকায়…
মোবারকের কথা শেষ করতে না দিয়েই ম্যানেজার বললেন, আপনি ইন্টারেস্টেড পার্টি?
জ্বি স্যার।
বয়স কত?
স্যার, পয়ত্রিশ। থার্টি ফাইভ ক্রস করেছে।
এটা মোবারকের আসল বয়স না। সে পাঁচ বছরের মত কমিয়েছে। কেন কমিয়েছে নিজেও জানে না।
এখন আমি ব্যস্ত আছি, কথা বলতে পারছি না। আমি কি স্যার কিছুক্ষণ পরে করব?
এক ঘণ্টা পরে করুন। তবে এই নাম্বারে না— আমি নাম্বার দিচ্ছি। কাগজ কলম আছে?
আপনি বলুন। আমার স্মৃতিশক্তি ভাল। মনে থাকবে।
ম্যানেজার সাহেব নাম্বার বলেই খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। ভাবটা যেন তিনি মহাব্যস্ত। নিঃশ্বাস ফেলার সময়ও নাই।
এরপর থেকে শুরু হল ঝামেলা— মোবারক যতবারই টেলিফোন করে বুড়ো মানুষের মত গলায় কে একজন বলে, ম্যানেজার সাহেব মিটিং-এ আছেন। পরে করেন। মোবারকের মেজাজ পুরো খারাপ হয়ে গেল। আরে তুই ব্যাটা ম্যানেজার, তোর এত কী মিটিং। তুই কি মন্ত্রী না-কি যে ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে মিটিং শুরু করবি। রাত বারটার সময় মিটিং শেষ করে ঘুমুতে যাবি। ঘুমের মধ্যেও স্বপ্ন দেখবি মিটিং করছিস। তুই হচ্ছিস চার পয়সা দামের ম্যানেজার।
যাই হোক ম্যানেজার সাহেব এক সময় টেলিফোন ধরলেন। ধমকের স্বরে বললেন, কে? আবারো সেই কাফ মার্কা কে?
মোবারক বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, স্যার আমার নাম মোবারক। মোবারক হোসেন। সকালে আপনার সঙ্গে কথা বলেছি।
সকাল থেকেতো অনেকের সঙ্গেই কথা বলছি। আপনার ব্যাপারটা কী বলুন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে টেলিফোন করছেন?
জ্বি স্যার।
আপনি কি ইন্টারেস্টেড পার্টি?
জ্বি স্যার।
আপনার বয়স কত?
পয়ত্রিশ।
আপনি এক কাজ করুন, বুধবার সকাল সাড়ে নটায় চলে আসুন। মুখোমুখি কথা হওয়া দরকার।
কোথায় আসব?
সঙ্গে কাগজ কলম আছে? ঠিকানা বলছি, লিখে নিন। কাঁটায় কাঁটায় সকাল সাড়ে নটায় চলে আসবেন। ইন্টারেস্টেড পার্টিতো আপনি একা না। আরো অনেকেই আছে। স্যার সরাসরি কথা বলবেন।
ম্যানেজার সাহেবের এই কথায় মোবারক খুবই দমে গেল। ইন্টারেস্টেড পার্টি আরো আছে মানে কী? তার ধারণা ছিল সে-ই একমাত্র ইন্টারেস্টেড পার্টি। যেহেতু সে একা, তার সুযোগ থাকবে জায়গা মত মোচড় দিয়ে দাম বাড়াতে। এখন দেখা যাচ্ছে এখানেও ইন্টারেস্টেড পার্টি। দেশটা যাচ্ছে কোথায়?
কিডনীর মত একটা জিনিস বিক্রি করতে লোকজন হামলে পড়বে এটা কী করে হয়? তোর শরীরে আছেই দুটা কিডনী। একটা বিক্রি করে দিলি, বাকিটা যদি নষ্ট হয়ে যায়– তুই যাবি কোথায়? তুইতো আর পয়সা দিয়ে এই জিনিস কিনতে পারবি না।
মোবারক স্পষ্ট কল্পনায় দেখল বুধবার সকাল সাড়ে নটা। একটা হলঘরের মত ঘরে সে বসে আছে। তার সঙ্গে মেয়ে পুরুষ মিলিয়ে আরো ত্রিশজনের মত আছে। সবার হাতে নম্বর ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। নম্বর অনুসারে ডাক পড়ছে। চাকরির ইন্টারভর মত ইন্টারভু হচ্ছে। কারো ইন্টারভু ভাল হয়েছে। সে বের হয়ে এসেছে হাসি মুখে। সবাই তাকে ঘেঁকে ধরেছে। সবার প্রশ্ন কী জিজ্ঞেস করল? কী জিজ্ঞেস করল? আবার কারো ইন্টারভু খুব খারাপ হয়েছে, বের হয়ে এসেছে কাঁদো কাঁদো মুখে। সে শুকনো গলায় বলল, ইজি ইজি কোশ্চেন জিজ্ঞেস করেছে। উত্তরও জানা ছিল, বলতে পারি নি। উত্তরটা মাথায় ছিল। মুখে আসে নি।
কী ধরনের প্রশ্ন হতে পারে? জেনারেল নলেজের দু একটা প্রশ্নতো থাকবেই।
পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব কত?
কোন তারিখে চাঁদে মানুষ প্রথম নামে?
বর্তমান পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য কী কী?
বিজ্ঞানের উপরও কিছু প্রশ্ন থাকবে। যুগটাই বিজ্ঞানের। সেই বিজ্ঞানের উপর প্রশ্ন না থাকলে হবে কীভাবে?
পেনিসিলিন কে আবিষ্কার করেন?
ফাউন্টেন পেন এবং বল পয়েন্টের মধ্যে তফাৎ কী?
লুই পাস্তুর কোন দেশের নাগরিক?
কিছু থাকবে পলিটিক্যাল প্রশ্ন।
কোল্ড ওয়ার কী?
তৃতীয় বিশ্ব মানে কী?
ইটালীর প্রেসিডেন্টের নাম কী?
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন?
এটা একটা ট্রিকি প্রশ্ন। বোর্ডের চেয়ারম্যান আওয়ামী-পন্থী না বিএনপি-পন্থী তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আওয়ামীপন্থী হলে সঙ্গে সঙ্গে বুক ফুলিয়ে বলতে হবে— জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বিএনপি-পন্থী হলে বলতে হবে মেজর জিয়া।
বোর্ডে একজন ডাক্তারও নিশ্চয়ই থাকবেন। ডাক্তার পেট টিপেটুপে দেখবেন মাল ঠিক আছে কি-না। পেট কেটে দেখতে চাইলেও অনেকে হয়ত আপত্তি করবে না। কাস্টমার জিনিস কিনবে না দেখে কেন কিনবে? দেখে শুনে কিনবে। সাইজ পছন্দ করবে, রঙ পছন্দ করবে।
মেস থেকে বেরুবার মুখে মনু মিয়ার সঙ্গে দেখা। কোকের বোতল ভর্তি গরম চা নিয়ে কোনো বোর্ডারের ঘরে যাচ্ছে। হারামজাদার সাহস কত বড় তার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে আছে। মনে হয় হাসছে। হারামজাদাটাকে লাথি দিয়ে কোকের বোতলসহ মেঝেতে ফেলে দেয়া উচিত। মোবারক তা করল না। শুভ কাজে যাচ্ছে, এ সময় মারামারি করা ঠিক না। গলা নামিয়ে বলল, সামনের দরজা দিয়া যাইয়েন না। বাবু আছে।