এ ধরনের গল্প বটু তাকে নিয়ে করবে না। কারণ সে ছোট রফিক না। সে মোবারক। তার দিল ছোট না বড় তা নিয়ে মানুষের কোনো কৌতূহল নেই। ছোট রফিকের দিল ছোট না বড় এটা নিয়ে সবারই কৌতূহল আছে। এখন কী করা যায়? মেসে যাবে? পরিমল দাসের টাকা পয়সা মিটিয়ে আবার এসে খোঁজ নেবে জহিররা এল কি-না? করা যেতে পারে। সঙ্গে গাড়ি আছে। উঠে বসলেই হল। গাড়ি থাকার কত মজা! রিকশা বা বেবী টেক্সির মত আগে জিজ্ঞেস করতে হয় না— অমুক জায়গায় যাবে কি-না। যেতে রাজি হলেই যে সব মুশকিল আহসান তা না— শুরু হয় ভাড়া নিয়ে কচাকচি। মোবারক পরিমল দাসের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল। মনু মিয়াকে বখশিশ হিসেবে কিছু দিতে হবে। একটা লুঙ্গি কেনার টাকা। যদিও হারামজাদা মহা বদ। কী আর করা। এই দুনিয়ার সবাই বদ। কেউ বেশি কেউ কম।
পরিমল দাস মেসের বারান্দায় বসে জুতা পালিশ করাচ্ছিল। গাড়ির হর্ন শুনে তাকাল এবং যতটুকু অবাক হবার কথা তার চেয়েও বেশি অবাক হল। মোবারক গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, পরিমলদা ভাল আছেন?
পরিমল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। মোবারক বলল, রাতের বেলা জুতা পালিশ করানো ঠিক না।
পরিমল বলল, এই গাড়ি কার?
আমার গাড়ি আবার কার।
তোমার গাড়ি মানে?
মোবারক রহস্যময় গলায় বলল, সামান্য অন্যায় করে ফেলেছি পরিমলদা, কিছু মনে করবেন না। বাবা-মার সঙ্গে রাগ করে মেসে এসে লুকিয়ে ছিলাম। এখন মিটমাট হয়েছে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাচ্ছি।
বল কী?
আপনার হিসাবটা দিনতো মিটিয়ে দেই। আর মনুকে আসতে বলুন। ওকে সামান্য বখশিশ দেব।
মনুতো নাই। তার চাকরি নট হয়ে গেছে।
কেন?
মেসের স্টোর থেকে দুডজন ডিম চুরি করে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। ধরা পড়েছে হাতে নাতে।
মার দেয়া হয় নাই?
এমন মার খেয়েছে এক মাস বিছানা থেকে উঠতে পারবে না। চোখও মনে হয় একটা গেছে।
চোখ গেছে মানে কী?
ভিড়ের মধ্যে কেউ মনে হয় চোখে খামচি দিয়েছে। গলগল করে চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল।
মোবারকের মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল। চোরের মারে এ রকম ঘটনা সব সময় ঘটে। ভিড়ের সুযোগে কেউ না কেউ ভয়ংকর কিছু করে শান্ত ভঙ্গিতে চলে যায়। যে এই কাজটা করে সে এম্নিতে সহজ সাধারণ মানুষ। দশটা পাঁচটা অফিস করে। সন্ধ্যাবেলায় বাচ্চাদের পড়তে বসায়। ছুটিছাটায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যায়। বাঁদরের খাচার সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে বাঁদরের খেলা দেখে।
মনু মিয়ার একটা চোখ তাহলে তুলে ফেলেছে?
মনে হয় সে রকমই।
ভাল। দুটা কিডনি যেমন মানুষের দরকার নাই। দুটা চোখেরও দরকার। নাই। একটাই যথেষ্ট।
মোবারক পরিমল দাসের হিসাব মিটিয়ে দিল। উদাস গলায় বলল, আমার বিছানা বালিশ কাউকে দিয়ে দেবেন।
কাকে দেব?
যাকে ইচ্ছা দিবেন।
পরিমল দাস লজ্জিত গলায় বলল, না বুঝে আপনাকে অনেক কটু কথা বলেছি। ভাই মনে কিছু রাখবেন না।
আচ্ছা রাখব না। মনু মিয়াকে কি হাসপাতালে নিয়ে গেছে?
না। মেরে মেসের সামনে ফেলে রেখেছিল। কিছুক্ষণ পরে নিজেই হেঁটে কোথায় যেন চলে গেছে।
মোবারক পকেট থেকে দুটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে পরিমলের দিকে
এগিয়ে দিল।
টাকাটা রাখুন। মনু মিয়া যদি কখনো আসে টাকাটা তাকে দেবেন।
জ্বি আচ্ছা।
আমার কি কোনো চিঠি পত্র আছে? বলতে পারছি না। এতে আপনার ঘরেই আছে। আমি ঘরে ঢুকব না। আপনি যান দেখে আসুন।
পরিমল অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে চিঠির খুঁজে গেল। মোবারক অপেক্ষা করছে। প্রতি মাসে একটা চিঠি সে দাদিজানের কাছ থেকে পায়। গত মাসে চিঠি আসে নি। এ মাসেও না। বুড়ি মরে গেছে কি-না কে জানে।
পরিমল ফিরে এসে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, চিঠি নাই।
তাকে দেখে মনে হচ্ছে চিঠি না আসার অপরাধে সে অপরাধী।
মোবারক তার থাকার ঘর দেখে মুগ্ধ
মোবারক তার থাকার ঘর দেখে মুগ্ধ। মনে মনে কয়েকবার বলল— খাইছে রে! খাটের উপর বিছানো চাদর দেখে প্রথম যে ইচ্ছাটা হল তা হচ্ছে চাদর গুটিয়ে হ্যান্ড ব্যাগে সামলে ফেলা। বড়ই বাহারী চাদর। খাটের পাশের টেবিলে নগ্নপরী লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। এই পরী কোনোমতে কুদ্দুসের হাতে ধরিয়ে দিতে পারলে কুদ্দুস চোখ বন্ধ করে দু হাজার টাকা দিবে। পরীর পায়ের কাছে এসট্রে আছে। এসট্রের রঙ গাঢ় লাল। মনে হচ্ছে জবা ফুল ফুটে আছে। এসট্রেটা অবশ্যই পাঞ্জাবির পকেটে ফেলে চলে যাওয়া যায়। এ বাড়ির লোকজন নিশ্চয়ই জিনিসপত্রের হিসেব রাখে না। প্রতি সন্ধ্যায় ম্যানেজার টাইপ একজন জাবদা খাতা এবং কলম নিয়ে উপস্থিত হয়ে জিনিসপত্রের রোলকল কি করবে? তার এ্যাসিস্টেন্ট একটা করে নাম বলবে আর সে জাবদা খাতায় টিক মার্ক দেবে—
১টা পরী
১টা লাল এসট্রে
১টা পাথরের বৌদ্ধ মূর্তি
১টা রঙিন TV ১৮ ইঞ্চি
১টা দেয়াল ঘড়ি
৪টা পেনটিং
১টা পানির জগ
১টা ফ্লাস্ক
৩টা ফুলদানী
১টা টেবিল ঘড়ি
এমন সিস্টেম যেহেতু নাই পরীক্ষামুলক ভাবে এসট্রে সামলে দেখা যেতে পারে।
একজন কাজের লোক মোবারকের সঙ্গে আছে। তার চোখে মুখে বিরক্তি। ট্রেনের টিকিট চেকার যখন হঠাৎ দেখে ফার্স্ট ক্লাস এসি কামরায় লুঙ্গিপরা প্যাসেঞ্জার পান খাচ্ছে এবং ভুড়ি বের করে ভুড়ি চুলকাচ্ছে তখন প্রচণ্ড রাগতে গিয়েও রাগ সামলায় কারণ এই প্যাসেঞ্জারের টিকিট আছে। মোবারকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাজের লোকেরও সেই ট্রেনের টিকিট চেকারের মত অবস্থা। মোবারককে বের করে দিতে পারলে সে খুশি হয়। বের করা সম্ভব হচ্ছে না— মোবারকের টিকিট আছে।