তুমি জহিরের বন্ধু? জ্বি।
অদ্ভুত কথা বললা। জহিরের কোনো বন্ধু আছে বলেতো জানতাম না। জহিরের আছে শত্রু।
ও বাসায় নাই?
না নাই। সকালে রক্ত বমি করেছে। খবর শুনে দৌড় দিয়ে গেলাম। আমাকে বলে— রক্ত না বাবা। পানের পিক।
জর্দা দিয়ে পান খেয়েছি সেই পানের পিক। আরে ব্যাটা তুই আমারে পানের পিক শিখাস। কোনটা রক্ত কোনটা পানের পিক আমি জানি না?
ডাক্তারের কাছে গিয়েছে?
ও কি আর যেতে চায়। আমার বড় ছেলে বলতে গেলে কানে ধরে নিয়ে গেছে।
কোন ডাক্তারের কাছে গিয়েছে জানেন?
জানি না। তোমারে একটা কথা বলি— ডাক্তারে এখন তার কিছু হবে না। তুমি যদি চার পাঁচটা ডাক্তার পানিতে গুলে তাকে খাইয়ে দাও তারপরও কিছু হবে না। আজকে মুখ দিয়ে রক্ত পড়বে, কাল পড়বে নাক দিয়ে, তারপর পড়বে কান দিয়ে। তুমি যখন বলছ তুমি তার বন্ধু তাহলেতো সবই জান।
মোবারক অত্যন্ত বিনয়ের সলে বলল, চাচাজী আমি আসলে কিছু জানি। স্কুলে তার সঙ্গে পড়েছি। বিদেশে চলে গিয়েছিলাম— অল্প কিছুদিন হল ফিরেছি।
তাহলেতো তুমি ঘটনা কিছুই জান না।
জ্বি না। কিছু জানি না।
আমার ছেলে উচ্ছন্নে গেছে।
বলেন কী?
পরশু রাতে তিনটার সময় বাসায় ফিরেছে। আমি দরজা খুলে দিলাম— আমাকে চিনে না। আমাকে বলে— হ্যালো আপনি কে? কাকে চান?
সর্বনাশ।
নিজের বাবাকে বলে হ্যালো হ্যালো আপনি কে?
বাইরের লোককে এইসব কথা বলতে ভাল লাগে না। তুমি ওর বন্ধু। তোমাকে বললাম। রোজগার নাই, রোজগারের চেষ্টা নাই। নেশা ভাং করে।
মোবারক এক প্যাকেট সিগারেট বাড়িয়ে দিল। বিনীত গলায় বলল, বিদেশ থেকে তেমন কিছু আনতে পারি নাই চাচাজী— আপনার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট।
বৃদ্ধ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, মানুষের ছেলে পুলে দেশে বিদেশে যায়। কত কিছু আনে— আর আমারটাকে দেখ— রক্তবমি করে। পাতলা পায়খানা করে। সব কপাল। ভাঙ্গা কপাল।
মোবারক বলল, চাচাজী নেন।
বৃদ্ধ ধরা গলায় বললেন, আবার কী?
একটা লাইটার।
তোমার নামটা যেন কী বাবা। চেহারা মনে আছে। ছোট বেলায় দেখেছি নাম মনে পড়ছে না। স্মৃতিশক্তি গেছে। যার ঘরে এমন আজদহা তার স্মৃতিশক্তি থাকবে কেন? তুমিই বল থাকার কোনো কারণ আছে?
জ্বি না।
বাবা তোমার নামটা বল?
আমার নাম মোবারক।
এইতো মনে পড়েছে মোবারক। মালয়েশিয়া গিয়েছিলে তাই না?
জ্বি না।
এখন মনে পড়েছে। কুয়েত।
জ্বি না সুইজারল্যান্ডে গিয়েছিলাম।
ও হ্যাঁ হ্যাঁ সুইজারল্যান্ড। এখন মনে পড়েছে। যাওয়ার আগে দেখা করে দোয়া নিলে।
জ্বি হ্যাঁ।
বিবাহ করেছ?
জ্বি না।
দেশে যখন এসেছ বিবাহ কর। দেশের একটা মেয়ের গতি হোক। আমার আজদহা যে বিয়ে করে ঘর সংসার করবে এই আশা করি না। এখন পরের ছেলের বিবাহ দেখে শান্তি পাওয়া।
সন্ধ্যার দিকে মোবারক কুদুসের দোকানে গেল। যদি ওদের পাওয়া যায়। তাছাড়া কুদ্দুসকে এক প্যাকেট সিগারেট দিতে হবে। হাজার হলেও বন্ধু মানুষ। বিপদে আপদে বাকিতে চা খাওয়ায়। গাড়িটা রাখতে হবে কুদুসের চায়ের দোকানের সামনে। কয়েকবার হর্ণ দিয়ে নামতে হবে। এই সময় ছোট রফিক থাকলে ভাল হয়। সে অবশ্য ছোট রফিকের সঙ্গে খুবই দ্র ব্যবহার করবে। এক প্যাকেট সিগারেট ছোট রফিককেও দেয়া যেতে পারে। সিগারেট দেয়ার পর সৌজন্যমূলক কিছু কথাবার্তা। যেমন—
ভাই ভাল আছেন? আপনার কথা শুনেছি— এর আগে একবার দেখা হয়েছিল। চিনতে পারিনি। কেমন আছেন ভাই?
অতি ডেনজারাস লোক। বেশি খাতির দেখানো ঠিক না। এদের কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায়। এদের কাছে মানুষের জীবনের দাম পাঁচ পয়সা।
আল্লাহ পাকের দুনিয়াতে কত অদ্ভুত ব্যাপারই না আছে। কালো যে রঙ সেই রঙেরও কত পদ। পাতিল কালো, কাক কালো, ময়না কালো। মন্দ মানুষেরও কত অদ্ভুত পদ। পৃথিবীর সবচে মন্দ মানুষটা কে জানা গেলে ভাল হত। পৃথিবীর সবচে মন্দ মানুষ এবং পৃথিবীর সবচে ভাল মানুষ— এই দুজনকে যদি মুখোমুখি বসিয়ে দেয়া যেত। তারা যদি খানিকক্ষণ গল্প করে কী নিয়ে গল্প করবে?
কুদ্দুস আজ দোকানে আসেনি। তার শালীর বিয়ে। রাতে একবার ফিরতে পারে। কখন ফিরবে কেউ জানে না। মোবারক এক ঘণ্টা অপেক্ষা করল। এই এক ঘণ্টায় চার কাপ মালাই চা খেয়ে ফেলল। কাজটা ঠিক হচ্ছে না। কিডনির হয়ত ক্ষতি হচ্ছে। একজনের বায়না করা কিডনির ক্ষতি করা ঠিক না। চায়ের দোকানে চুপচাপ বসে থাকাও ঠিক না। উঠে যাবার মুখে বটুকে একটা একশ টাকার নোট দিল চায়ের দাম বাবদ। বটু বিরক্ত মুখে বলল, ছোট নোট দেন।
মোবারক উদাস গলায় বলল, ছোট নোট নাইরে। সবই বড় নোট।
কথা সত্যি না। ভাংতি টাকা এখন মোবারকের কাছে আছে। চার কাপ চায়ের দাম একশ টাকার নোটে দেয়ার পেছনে কারণ আছে। বটু যখন ভাংতি নিয়ে আসবে তখন সে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলবে— ভাংতি রেখে দে বখসিশ।
ছোট রফিক একবার বটুকে চা খেয়ে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বখশিশ হিসেবে দিয়ে ছিল। এমন কোনো লোক নেই যার সঙ্গে বটু এই গল্প করেনি। গল্প করার সময় বটুর চোখ মুখ অন্যরকম হয়ে যেত। এই গল্প করার সময় বটুর চোখ স্থির হয়ে যায়। স্বরও কেমন খসখসে হয়ে যায় ছোট রফিক লোকটা ভাল না মন্দ এইটা আমি জানি না। এইটা আমারে জিগাইয়া লাভ নাই। আমি জানি না। আমি খালি জানি লোকটার দিল কতবড়। মানুষটার ওজন যদি হয় একমণ তার দিলের ওজন সাত মণ।