মোবারক মুখ হাসি হাসি করে রাখলেও মনে মনে বলল, ব্যাটা শুধু তোর সাজেশনস না, তোকে শুদ্ধ কমোডে ফেলে ফ্ল্যাস করে দেয়া দরকার। আমি এখানে বসার পর থেকে তুই সমানে কথা বলে যাচ্ছিস। তুইতো কথা বলেই কুল পাস না। তুই সাজেশনস কখন দিবি?
আসগর সাহেব মোটামুটি হতাশ গলায় বললেন, আমার একটা সাজেশন ছিল— দুজন ডোনার নিয়ে যাওয়া। যাতে একজন ডোনারের ব্যাপারে শেষ মুহূর্তে কোনো কমপ্লিকেশন হলে অন্য একজন স্ট্যান্ডবাই থাকে। এমনতো না যে ডোনার পাওয়া যাচ্ছে না বা টাকার অভাব হয়েছে। আমি কি কিছু ভুল বলছি?
অবশ্যই না। স্যার আপনিও কি যাচ্ছেন?
আমাকেতো যেতেই হবে। রুমা যেতে পারবে না। কারণ রুমার ছেলে স্কলাসটিকায় পড়ে। স্কুল থেকে ওরা একটা ড্রামা করছে ছেলে সেখানে সুযোগ পেয়েছে। চার্লস ডিকেন্সের আলিভার টুইস্ট। আঠারো তারিখে স্টেজ হবে। চিফ গেস্ট হলো আমেরিকান এ্যাম্বেসেডর। এত বড় একটা অনুষ্ঠানে বাবা-মা কেউ থাকবে না— তাতো হয় না।
মোবারক বলল, অবশ্যই হয় না। এতে শিশুমনের উপর একটা চাপ পড়ে। চাপের কারণে পরবর্তি সময়ে এইসব ছেলেপুলে গাধা টাইপ হয়ে যায়। স্যার আমি উঠি? আমার আবার পাসপোর্টের জন্যে ছবি তুলতে হবে।
আসগর সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, এখনো পাসপোর্ট হয় নি? কুঁজো ম্যানেজারটা করছে কী? একেতো কানে ধরে উঠবোস করানো দরকার।
মোবারক অতিরিক্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, স্যার যাই। আপনার সঙ্গে কথা বলে এত ভাল লেগেছে।
আসগর সাহেব জবাব না দিয়ে হাতে আরেকটা খবরের কাগজ তুলে নিলেন।
মোবারক পাসপোর্টের ফরমে সই করতে করতে বলল, সুইজারল্যান্ড জায়গাটিতে শীত কেমন পড়ে?
ম্যানজোর সাহেব বললেন, ভাল শীত। বরফ পড়ে। সারা ইউরোপ থেকে লোকজন স্কী করতে সুইজারল্যান্ডে আসে।
শীতের কাপড় চোপড়তো সঙ্গে নেয়া দরকার।
ম্যানেজার সাহেব বললেন, হুঁ।
মোবারক চিন্তায় পড়ে গেল। হুঁ বলে চুপ কলে গেলেতো হবে না। শীতের কাপড় কেনার টাকা পয়সা লাগবে না! গরম কাপড় ছাড়াওতো কিছু কাপড় দরকার। বিদেশ যাত্রা বলে কথা। মহাত্মা গান্ধী হলে নেংটি পরে প্লেনে উঠে পড়া যেত। সঙ্গে দড়ি বাঁধা দুর্বল ছাগী থাকলেও কেউ কিছু বলত না। ছাগীটাকে তার পাশের সীটে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করত। প্লেনের মধ্যেই ছাগলের দুধ দোয়ানোর ব্যবস্থা হত। এয়ার হোস্টেসরা হেল্প করতেন।
লজ্জা করে চুপ করে থাকা বিরাট বোকামি হবে। টাকা চেয়ে ফেলা দরকার। কাপড় চোপড়ের জন্যে আলাদা টাকা যদি না দেয় তাহলে বরং এই টাকাটা কিডনির দামের সঙ্গে এডজাস্ট করে দেবে। কিডনির দাম কখন দেবে সেটাও পরিষ্কার হওয়া দরকার। বড়লোকের কারবার— এরা জিনিস হাতে না পেয়ে দাম দেবে বলে মনে হয় না। খোদা না করুক অপারেশন টেবিলে সে যদি মারা যায় তাহলে কী হবে। টাকাটা পাবে কে?
মোবারক খুক খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে নিচু গলায় বলল, ম্যানেজার সাহেব, কাপড় চোপড় কেনার জন্যে আমার কিছু টাকা দরকার।
ম্যানেজার মুখ তুলে তাকাল। মনে হচ্ছে এমন অদ্ভুত কথা সে জীবনে শুনেনি।
মোবারক তেলতেলে মুখ করে বলল, হাতে তো সময় বেশি নেই। কাপড় চোপড় এখনি কেনা দরকার।
ম্যানেজার এখনো তাকিয়ে আছে। চোখের পলক ফেলছে না। মোবারক হাই তোলার ভঙ্গি করতে করতে বলল, বন্ধু বান্ধবের কাছে কিছু ধারদেনা আছে। যাওয়ার আগে শোধ করে যেতে চাই। কিছুতো বলা যায় না, ধরেন। উল্টা-পাল্টা কিছু যদি হয়।
উল্টা-পাল্টা মানে?
আপনার স্যার কিডনি নিয়ে বেঁচে উঠলেন— আমি গেলাম ফুটে।
আপনি ফুটে গেলেন মানে?
ফুটে গেলাম মানে মরে গেলাম। ফুল ফোঁটা আর মানুষ ফোঁটা আলাদা ব্যাপার।
এখন আপনার কত টাকা দরকার?
মোবারক বিপদে পড়ে গেল। এটা একটা ঝামেলার প্রশ্ন। কত টাকা এরা দেয়ার জন্যে প্রস্তুত তা না জেনে টাকা চাওয়াটা ঠিক হবে না। এরা কত টাকা দিতে পারে সেটা জানারও তো কোনো বুদ্ধি নেই।
মোবারক ক্ষীণ গলায় বলল, সেটা আপনার বিবেচনা। আর গরম কাপড় চোপড়ে কত লাগে তাও জানি না। কাপড় বানানো হয় না অনেক দিন।
ম্যানেজার সাহেব বললেন, আপনাকে একটা বুদ্ধি দিচ্ছি— নতুন গরম কাপড় কিনতে যাবেন না। বঙ্গবাজার চলে যান, সস্তায় প্রচুর ভাল কাপড় পাবেন। ফিটিং-এ সমস্যা হলে দরজি দিয়ে ফিটিং করিয়ে নেবেন। হাজার খানিক টাকায় সব কাপড় হয়ে যাবে।
জ্বি আচ্ছা। আর বন্ধু-বান্ধবের কাছে কিছু ঋণ ছিল। ঋণ রেখে মরতে চাই না।
মরবেন কেন?
মোবারক বলল, দুদিন থেকে মনের মধ্যে কুডাক শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে মারা যাব। এই জন্যে ঠিক করেছি আত্মীয়-স্বজন সবার সঙ্গে দেখাও করে যাব। আমার নিকট আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। দাদিজান বেঁচে আছেন। থাকেন নেত্রকোনায়। উনাকে দেখতে যেতে হবে। ভাবছি উনার জন্যে একটা শাড়ি, আর গরম চাদর নিয়ে যাব। বুড়ি খুশি হবে। ভাল একটা গরম চাদরের দাম কত হবে ম্যানেজার সাহেব জানেন?
জানি না।
সস্তায় পুরনো গরম চাদর অবশ্যই পাওয়া যাবে। পাওয়া গেলেও বুড়িকে নতুন চাদরই দিতে চাই। দাম যতই হোক। বুড়ির দিন শেষ। মরেইতো যাবে। নতুন গরম চাদর গায়ে দিয়ে মরুক। মৃত্যুর সময় ঠাণ্ডা কম লাগবে।
ম্যানেজার সাহেব বললেন, কিছু ক্যাশ আমি দিচ্ছি। কেনাকাটা যা করার করুন। যে কাজগুলি আপনাকে করতে হবে তা হল— প্রথমেই বার কপি ছবি তুলবেন। পোলারয়েড ক্যামেরায় ছবি সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেবে। আপনার সঙ্গে লোক দিয়ে দিচ্ছি, সে ছবি নিয়ে চলে যাবে। গাড়ি আপনার সঙ্গে থাকুক।