বাক্যটা কী?
বিল্লি মে কাট দিয়া।
তিনজনই একসঙ্গে হাসতে শুরু করল। এর পরের ঘটনা অতি বিচিত্র। কিছুক্ষণের জন্যে হাসি থামে, তখন একজন বলে, বিল্লি মে কাট দিয়া। সঙ্গে সঙ্গে সমবেত হাসি শুরু হয়। সেই হাসি থামতেই আরেকজন বলে, বিল্লি মে কাট দিয়া। আবারো হাসি শুরু হয়। হাসতে হাসতে এদের চোখে পানি এসে গেল। তাতেও হাসি থামে না।
সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে পুলিশ টহলে আসে রাত একটার দিকে। টহল মানে চাঁদা তোলা। নিশিকন্যাদের রোজগারের একটা অংশ পুলিশকে দিতে হয়। এদের সঙ্গে যে সব কাস্টমার থাকে, ধমক ধমক দিয়ে তাদের কাছ থেকেও কিছু আদায়ের চেষ্টা করা হয়। তবে নেশারুদের এরা ঘটায় না।
হাসির শব্দে আকৃষ্ট হয়ে দুজন টহল পুলিশ এগিয়ে এল। ওদের গায়ে টর্চের আলো ফেলে বলল, কী হয়েছে?
তিনজনই হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বলল, বিল্লি মে কাট দিয়া। বিল্লি মে কাট দিয়া।
পুলিশ টর্চ নিভিয়ে চলে গেল। তার কিছুক্ষণ তার আধবুড়ো এক লোককে দেখা গেল। ভীত চেহারা। সে সঙ্গে মেয়ে নিয়ে এসেছে। নিরিবিলি জায়গা খুঁজছে। বজলু বলল, এই যে ওল্ড ব্রাদার, অন্য জায়গায় যান। এই জায়গাটা ভাল না। এই জায়গা বিল্লি মে কাট দিয়া।
রাত অনেক হয়েছে। তিন বন্ধুই পাশাপাশি শুয়ে আছে। তাদের গায়ে মোবারকের শাল। জহির ঘুমুচ্ছে। শান্তির গাঢ় ঘুম। জেগে আছে মোবারক এবং বজলু। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাদের আলোয় কুয়াশা চকচক করছে। মোবারকের কাছে কুয়াশাটাকে মনে হচ্ছে হালকা শাদা পশমে বোনা বিশাল এক চাদর। কেউ একজন যেন পৃথিবীতে বিশাল এক চাদর পাঠিয়েছে। যে চাদর দিয়ে পৃথিবীর সব দুঃখী মানুষকে ঢেকে দেয়া যায়।
মোবারক একটা হাত রাখল বজলুর গায়ে।
বজলু বলল, কিছু বলবি?
মোবারক বলল, দোস্ত তোকে একটা মিথ্যা কথা বলেছি। আমি আসলেই চোর। এই শালটা আমি চুরি করে এনেছি।
বাদ দে।
না দোস্ত বাদ দিব কেন? আমি চোর। বিরাট চোর। আমি অসতী মায়ের জারজ সন্তান।
আহ্ বাদ দে না।
মোবারক কাঁদতে শুরু করল। জহির বলল, দোস্ত কাঁদিস না। কান্না থামা। তোর পায়ে ধরি কান্না থামা।
মোবারক কাঁদছে। মোবারকের কান্না দেখে বজলুরও কান্না পেয়ে গেছে। সেও কাঁদছে। তাদের গায়ে গাঢ় হয়ে কুয়াশা পড়ছে। কান্না থামানোর জন্যে জহির একবার মোবারকের পায়ে ধরছে আরেকবার ধরছে বজলুর পায়ে।
আজ মোবারকের বসার জায়গা হয়েছে
আজ মোবারকের বসার জায়গা হয়েছে অন্য একটা ঘরে। প্রমোশন না ডিমোশন বোঝা যাচ্ছে না। এই ঘরটা আগেরটার চেয়ে বড়। তবে মেঝেতে কার্পেট নেই, দেয়ালে পেইনটিং নেই। সোফা আছে। সোফার কভার ময়লা। প্রথমবারের ঘরে মোবারক একা বসে ছিল। এই ঘরে আরো লোকজন আছে। সবার মধ্যে এক ধরনের ব্যস্ততা। মোবারক কিছুক্ষণ বসতেই বড় ট্রে ভর্তি চা নিয়ে একজন ঢুকল। সে সবাইকে চা দিচ্ছে। গণ-চা হয় খুব কুৎসিত হবে, আর নয়তো খুব ভাল হবে। এই চা-টা ভাল। শুধু চা না, দেখা গেল আরেকজন প্লেট ভর্তি কেক নিয়ে এসেছে। কেকের প্লেট রাখা হয়েছে সামনের টেবিলে। কেউ কেক নিচ্ছে না। মনে হচ্ছে দ্রতা করছে। মোবারক উঠে গিয়ে দুই পিস নিয়ে নিল। একটা আপাতত জমা থাকুক চায়ের কাপের পিরিচে।
কিছুক্ষণ পর পর ম্যানেজার সাহেব ঢুকছেন। একজন দুজন করে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন। ম্যানেজার সাহেব আজ স্যুট পরেছেন। ভদ্রলোককে স্যুটে একেবারেই মানাচ্ছে না। টাই-এ ইস্ত্রী নেই বলে টাই এর মাথা উঁচু হয়ে আছে। মনে হচ্ছে টাইটা মাথা উঁচু করে আশে পাশে কি হচ্ছে দেখার চেস্টা করছে। কোনো কারণে ম্যানেজার সাহেবের মনও মনে হয় খারাপ। তাঁকে মিয়ানো মুড়ির মত লাগছে।
ম্যানেজার সাহেব মোবারকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বোঝাই যাচ্ছে ডাক পড়েছে। এক পিস কেক এখনো রয়ে গেছে, খাওয়া হয় নি। থাক ফিরে এসে খাওয়া যাবে।
মোবারক সাহেব কেমন আছেন?
জ্বি ভাল।
আসুন আমার সঙ্গে।
কোথায় যাব? বড় সাহেবের কাছে?
আপাতত আমার ঘরে।
আপনি নিজে এলেন কেন? কাউকে দিয়ে ডেকে পাঠালেই হত।
ডেকে পাঠানোর লোক নেই। অফিস স্টাফের দুইজন আজ আসেই নি। একজন গেছে ছুটিতে।
স্যার, আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি— আপনার উপর চাপ বেশি পড়েছে। আপনার বিশ্রাম দরকার।
ম্যানেজার সাহেব এই গভীর আন্তরিকতায় অভিভূত হলেন না। বিষাদময় মুখ করে মোবারককে অফিসে নিয়ে গেলেন। মোবারককে তার সামনের চেয়ার বসতে বললেন।
মোবারক বলল, স্যার, ডাক্তারের রিপোর্ট কি এসেছে?
হ্যাঁ এসেছে। রিপোর্ট পজেটিভ।
আপনার এই ঘরে কি সিগারেট খাওয়া যায়?
হ্যাঁ যায়।
মোবারক সিগারেট ধরাল। ম্যানেজার সাহেব বললেন, ঝামেলা যখন ঘাড়ে এসে পড়ে একসঙ্গে আসে। আমার হয়েছ মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা। কোন হেল্পিং হ্যান্ড নাই— অথচ আজকের মধ্যে আপনার পাসপোর্ট করাতে হবে। ভিসার জন্যে কাল পাসপোর্ট জমা দেব। কোথায় যাওয়া হবে সেটা নিয়ে ফ্যাকড়া বেঁধেছে।
কী ফ্যাকড়া?
স্যারের বড় মেয়ের জামাই বলছে অপারেশনটা ইংল্যান্ডে করাতে–কুইনস হসপিটাল। তার নাকি চেনা জানা আছে। এদিকে মেজো মেয়ের জামাই থাকেন সুইজারল্যান্ডে; তিনি সেখানে সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
কোথায় যাওয়া হবে এখনো ঠিক হয় নি?
ঠিক হয়েছে। সুইজারল্যান্ডে যাওয়া হবে। আসগর সাহেব এটা নিয়ে খুবই আপসেট। স্যারের সঙ্গে উনার যাবার কথা। উনি মনে হয় যাবেন না।